পাহাড়ের ধাপে একটি সমাধিসৌধ ও
হাঙ্গেরির বোধিসত্ত্বের বাঙ্ময় ব্যাকরণ
প্রাক্কথন
ছেলেটি এক বিকেলে হেঁটে যাচ্ছিল পাহাড়িয়া শহরের আধা-ব্যস্ত পথ
দিয়ে। উদ্দেশ্যহীন। বেশ ভারি ডিএসএলআর ক্যামেরাটি তার কাঁধে ঝুলছে। ক্যামেরার
স্ট্র্যাপ তার জ্যাকেটে ঘষা লেগে আওয়াজ তৈরি করে চলেছে। সুরহীন কিন্তু একেবারেই
যান্ত্রিক নয়, সেই আওয়াজে মিশে আছে পথ চলার প্রত্যয়। ট্যুরিস্ট সিজন এখনও শুরু হয়নি।
রাস্তায় তেমন ভিড় নেই, বাতাসে ডিজেলের গন্ধ খুব একটা পাওয়া যাচ্ছে না, গাড়ির
হর্নের উগ্রতাও যেন খানিক কম। হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা আনমনেই বাঁ দিকে তাকাতেই তাকে
থমকে দাঁড়াতে হল। পাহাড়ের ব্যাকগ্রাউন্ডের সামনে প্রায় অনন্ত বিস্তৃত তারের উপর
বসে আছে এক হলুদ পাখি। ফিঞ্চ! শহরেরর বুকে ফিঞ্চ এর আগে সে দেখেনি। পরে সে ভালো
করে নেট ঘেঁটে জানবে যে এটি হল ইয়েলো ব্রেস্টেড গ্রিন ফিঞ্চ। হিমালয়ের পাদদেশে
তাদের দেখা পাওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। পাখিটি প্রথম দেখার সময় সে অবশ্য এতকিছু
জানে না। স্বাভাবিক প্রতিবর্ত ক্রিয়াতেই তার ক্যামেরা নেমে এসেছে কাঁধ থেকে;
ক্যামেরা তাক করেছে পাখিটির দিকে। পর পর দুটি ছবি তোলা হয়ে যায় কিন্তু সে বোঝে
ফোকাস ঠিক হয়নি। পাখিটি উড়ে আসে আরো কাছে। এবার তার বিশ্রামস্থান গাছের ডাল। কাছে
এলেও পাখিটি বসেছে তেরছাভাবে। ক্যামেরা তার মুখের দিক স্পষ্ট ধরতে পারে না। সে
একটু এগোতেই ত্রস্ত পাখিটি উড়ে যায় রাস্তা পেরিয়ে। এবার ও বসেছে একটি সৌধের উপর।
ছেলেটি তাকিয়ে দেখে রাস্তার ওপারে শহরের প্রাচীন কবরস্থান, ব্রিটিশ রাজের এক
বিস্মৃত সিগনিফায়ার — দার্জিলিং ওল্ড সেমেট্রি।
ছেলেটি এর আগে কখনও এই পুরনো কবরস্থানে ঢোকেনি। অথচ ফিঞ্চ পাখিটি
সেই কবরস্থানে দিব্যি ঢুকে পড়েছে। বসে আছে একেবারে সামনের একটি সুনির্মিত সৌধে।
ভালো ছবি পাওয়ার নেশা ততক্ষণে চড়ে উঠেছে। রাস্তা পেরিয়ে তাই ওপারে যাওয়া, অতি সন্তর্পণে টার্ন্সটাইল ঘুরিয়ে সেমেট্রির
ভিতর প্রবেশ। কিন্তু তার এত সাবধানতা কোনো কাজেই লাগল না। সে ঢোকার সাথে সাথেই সেই
হলুদ পাখি ফুড়ুৎ। উড়ে গেল একেবারে দৃষ্টিসীমার বাইরে। অগত্যা হতাশ হয়ে দাঁড়াতে হয়
সৌধের সামনে, কিছুটা আনমনেই পড়া হয় রোমান, দেবনাগরী আর বাংলা হরফে লেখা কবর-লিপি।
সামান্য ভুল বানানে বাংলায় লেখা —
সিকন্দর কোরোশি চোমা
১৭৮৪-১৮৪২
ভারত-হাঙ্গেরি মৈত্রীর অগ্রদূত
হাঙ্গেরীয় বিজ্ঞান আকাদেমী
সে বোঝে কবরটির নীচে শায়িত মানুষটি সান্দর কোরোসি চোমা (Alexander Csoma de Kőrös)
বেশ অসাধারণ এক মানুষ ছিলেন। কবরস্থানের যে সামান্য কয়েকটি কবর যত্নের সঙ্গে
রক্ষিত আছে তার মধ্যে চোমার কবরটি অবশ্যই অন্যতম। সেটাই
স্বাভাবিক কারণ আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব্ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে রয়েছে এই কবরটি।
সে মনে করার চেষ্টা করে আলেকজান্দার চোমার নামটি আগে কখনও শুনেছে কি না? কিছুই মনে
আসে না। একেবারে ব্ল্যাংক। কে ছিলেন এই আলেকজান্দার চোমা? হাঙ্গেরি থেকে এসে তিনি
ঠিক কী করেছিলেন? ভারত-হাঙ্গেরির মধ্যে মৈত্রী কীভাবে তিনি স্থাপন করেছিলেন? এই
দার্জিলিংয়েই বা তিনি কীভাবে এসে পৌঁছোলেন? ছেলেটির মাথা থেকেও সেই হলুদ পাখি
ফুড়ুৎ হয়ে গেছে ততক্ষণে। সে শুধু ভাবছে কবরের নীচে শায়িত সেই মানুষটিকে নিয়ে।
কিছুটা যেন অস্থির সে। তাকে জানতেই হবে আলেকজান্দার চোমার কথা। জানার পর সে বুঝতে
পারবে চোমাও ছিলেন পাখির মতন; পরিযায়ী পাখি হয়ে তিনি দেশ-মহাদেশের সীমা পেরিয়ে চলে
আসবেন শিকড়ের খোঁজে, জ্ঞানের সন্ধানে। ছেলেটার সাথে আমরাও বরং চোমাকে খুঁজতে থাকি,
ফিরে দেখি তাঁর প্রায়-অজানা, বিস্মৃত ইতিহাস।
আলেকজান্দার চোমার কথা
চোমার জন্মসাল নিয়েই এক বিতর্ক আছে। অধিকাংশ জীবনীকারের মতে,
যাদের মধ্যে চোমার সবচেয়ে প্রথম ও
প্রামাণ্য জীবনীকার থিওডর ডুকাও আছেন, তাঁর জন্ম হয় ১৭৮৪ সালের এপ্রিলের ৪ তারিখ
তৎকালীন হাঙ্গেরির (অধুনা রোমানিয়ার) কোরোস শহরে। কোরোসের চার্চের রেজিস্টার থেকে
পাওয়া এই তথ্যটা দীর্ঘদিন ধরেই সত্য হিসেবে মান্যতা পেয়ে আসছিল। বিতর্ক বাধল একবিংশ শতকের গোড়ার দিকে যখন প্রশ্ন উঠল যে
১৭৮৪-র জাতক ওই শিশুটি কি আদৌ সান্দর চোমা ছিলেন, নাকি ছিল তার অকালমৃত দাদা?
ঐতিহাসিক বার্নাড লা কালোচের মতে সান্দরের
জন্ম হয় আরো কয়েক বছর পরে, ১৭৮৭/৮৮ নাগাদ। যদিও নিশ্চিত প্রমাণের অভাবে ১৭৮৪-কেই
চোমার জন্মসাল হিসেবে এখনও মান্যতা দেওয়া হয়। হাঙ্গেরিয়ান সিকেলি (Székely) বা মাগ্যা (Magyar) জনজাতির এক সাধারণ পরিবারে
তাঁর জন্ম। চোমার প্রাথমিক পড়াশোনা কোরোস গ্রামের পাঠশালায়; সেখান থেকে নাগিনেইডের
অবৈতনিক উচ্চবিদ্যালয়ে। জ্ঞানান্বেষণে চির-আগ্রহী চোমার কাছে নাগিনেইড এক জ্ঞানচর্চার
নতুন এক ক্ষেত্র উন্মুক্ত করে দেয়। সেই সময়ে হাঙ্গেরিয়ান সিকেলি গোষ্ঠীর
অনেকেই বিশ্বাস করত যে তারা প্রকৃতপক্ষে আটিলার হুন জাতির বংশধর এবং তাদের জনজাতির
একটি শাখা মধ্য এশিয়াতে বসতি স্থাপন করেছে। বিশেষ করে উইঘুর জনজাতির সঙ্গে যে
তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে এই ধারণাটাও বেশ জাঁকিয়ে বসেছিল তখন। চোমা আর তাঁর
দুই বন্ধু ঠিক করে যে তারা মধ্য-এশিয়া যাত্রা করে এই আত্মীয়তার শিকড় খুঁজে বের করবেই। বলাই বাহুল্য,
একমাত্র চোমাই এশিয়া যাবেন তবে সিকেলিদের শিকড় খুঁজতে গিতে তিনি জড়িয়ে পড়বেন এক
ভিন্ন ধরনের জ্ঞানচর্চায়। পাশ্চাত্যের তিব্বত-চর্চায়
অগ্রদূত হয়ে উঠবেন; অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিন
হিসেবে যাত্রা শুরু হবে (পশ্চিমী) তিব্বতবিদ্যা চর্চার বা Tibetology-র।
১৮১৫। একটি বৃত্তি পেয়ে নাগিনেইড থেকে চোমা এলেন
জার্মানির গটিংয়েন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে প্রাচ্যবিদ্যাবিদ (Orientalist) অধ্যাপক
জোহান গটফ্রিড এইক্হর্নের থেকে আরবি আর তুর্কিশ ভাষা শিখলেন যা তাঁর এশিয়া
ভ্রমণের প্রস্তুতিরই অংশ। অন্যদিকে আরেক প্রাচ্যবিদ্যাবিদ অধ্যাপক জুলিয়াস হেইনরিখ
ক্ল্যাপরথ জোরের সঙ্গে তাঁকে জানালেন যে উগ্রিক জাতির হাঙ্গেরিয়ানদের সাথে মধ্য
এশিয়ার উইঘুরদের মধ্যে নিশ্চিত আত্মীয়তা আছে। চোমার সংকল্প আরো দৃঢ় হল। ১৮১৮ নাগাদ
নাগিনেইড ফিরে এসে চোমা তাঁর এশিয়া যাত্রার
পরিকল্পনার কথা পরিচিতদের জানালেন। দু-একজন বন্ধু ছাড়া প্রায় কেউ-ই তাঁকে সমর্থন
করলেন না। একেবারেই নিরুৎসাহী না হয়ে তিনি জাগ্রেবে কিছুদিন স্লাভিক ভাষা শিখলেন
আর তারপর ১৮১৯-এর শেষ দিকে ২০০ ফ্লোরিন পকেটে নিয়ে তাঁর বহু পরিকল্পিত যাত্রা শুরু
করলেন। সেনাবাহিনীর বাধ্যতামূলক দায়িত্ব পালন না করায় তাঁর বৈধ পাসপোর্টও জোটেনি; বণিকদের
সাময়িক ছাড়পত্র নিয়েই তিনি পূর্বদিকে রওনা হলেন। দেশে আর কোনোদিন তাঁর ফিরে আসা হয়নি।
পরবর্তী আড়াই বছর কেটে যায় যাত্রাপথে। গ্রিস
থেকে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া, সেখান থেকে সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান
হয়ে ভারত উপমহাদেশে। মার্চ ১৮২২-এ তিনি লাহোরে; অমৃতসর আর জম্মু হয়ে কাশ্মীরে পৌঁছোন
এপ্রিলে, আর মে মাসে চলে আসেন লেহ্-তে। সেখান থেকে য়ারকান্ত হয়ে উইঘুরদের কাছে যাবার
পরিকল্পনা করেন। কিন্তু একদিকে তাঁর সংগৃহীত অর্থ শেষের পথে, অপরদিকে রাস্তাও রীতিমতো বিপদসংকুল। সবদিক
বিবেচনা করে পঁচিশদিন যাত্রার পর চোমা ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৬ জুলাই,
কাশ্মীরে ফেরার পথে চোমার সাথে দেখা হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসার ও ব্রিটিশ
অভিযাত্রী উইলিয়াম মুরক্রফ্টের সঙ্গে। এ এক বিস্ময়কর ভবিতব্য। মুরক্রফ্ট চোমাকে
জ্ঞানচর্চার সম্পূর্ণ নতুন এক দিকের সন্ধান দিলেন — তিব্বতবিদ্যা। চোমার জীবন পথ
অন্যদিকে বাঁক নিল।
তিব্বত নিয়ে ব্রিটিশ ভারতে তখন সদ্য উৎসাহ দেখা
দিতে শুরু করেছে। লাদাখে ব্রিটিশরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোও শুরু করে দিয়েছে
ততদিনে। লাদাখের গা ঘেঁষেই পশ্চিম তিব্বতের সীমানা। তিব্বতি সংস্কৃতি আর বৌদ্ধ
ধর্মের প্রভাব লাদাখে যথেষ্ট। এ রকম সময় এমন কারো খোঁজ চলছিল যিনি তিব্বতি ভাষা ও
সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করে সেই জ্ঞান ব্রিটিশদের সামনে নিয়ে আসবেন। চোমার মধ্যে
মুরক্রফ্ট সেই গবেষক-কে খুঁজে পেলেন। তিনি চোমাকে প্রস্তাব দিলেন যে তিনি যদি
লাদাখে গিয়ে তিব্বতি ভাষা শিখে একটা তিব্বতি-ইংরেজি অভিধান লিখতে পারেন তাহলে ভারত
সরকার তাঁকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করবে। চোমা ততদিনে আন্দাজ করতে পেরে গেছেন যে তাঁর
মধ্য-এশিয়া যাত্রা আপাতত সম্ভব নয়। মুরক্রফ্টের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলে তাঁর
অভিযান ভবিষ্যতে ব্রিটিশ সহায়তায় হতে পারে। তিনি রাজি হলেন। আরেকটা কারণও বোধহয়
ছিল। চোমার আশা ছিল প্রাচীন তিব্বতি সাহিত্যের মধ্যে তিনি হাঙ্গেরীয়দের সঙ্গে
মধ্য-এশিয়ার উইঘুরদের আত্মীয়তার বিষয়ে কিছু খোঁজ
পেতে পারেন। মুরক্রফ্টের দেওয়া একটি তিব্বতি প্রাইমার দিয়ে চোমা তাঁর
তিব্বতি ভাষা শিক্ষা শুরু করলেন। তবে ভালো করে তিব্বতি শিক্ষার জন্য তাঁর এক গুরুর
প্রয়োজন। মুরক্রফ্ট সেটা বুঝে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিলেন। শিক্ষগুরুর ব্যবস্থা হল। ২০ জুন
১৮২৩ চোমা পৌঁছোলেন লাদাখের জান্সকার প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ইয়াংলাতে। ইয়াংলার লামা
সাং গিয়াস ফুন ছোগের তত্ত্বাবধানে প্রকৃত অর্থে শুরু হল তাঁর তিব্বতি চর্চা।
ইয়াংলা মনাস্টারির একটি অতি ছোটো কুঠুরিতে লামার
কাছে চলতে থাকে তিব্বতি-শিক্ষা। থিওডোর ডুকার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কুঠুরিটির মাপ
ছিল নাকি নয় বর্গ ফুট! ভাবা যায়? ২০ জুন ১৮২৩ থেকে ২২ অক্টোবর ১৮২৪ — এই ষোল মাসের অধিকাংশ সময়টাই
চোমা বিদ্যাশিক্ষার কাজে অতিবাহিত করেন। লাদাখ-পশ্চিম তিব্বতের আটমাস ব্যাপী দীর্ঘ
শীতও তাঁকে কাবু করতে পারেনি। প্রথমে ফারসি তারপর সংস্কৃতের মাধ্যমে তিব্বতি শিখতে
শুরু করলেন। বৌদ্ধ সাহিত্যের বেশ কিছু ভারতীয় সংকলনের তিব্বতী অনুবাদের সাথেও তাঁর
সম্যক পরিচিতি হয়। এই সময়ে চোমা প্রায় ৩০,০০০-এর
মতো তিব্বতি শব্দ শেখেন যা তাঁর অভিধান লেখার কাজের প্রথম ধাপ হিসেবে দেখা যায়।
তিনি একদিকে যেমন বেশ কিছু তিব্বতি গ্রন্থ সংগ্রহ করেন অন্যদিকে লামাদের অনুরোধ
করে কিছু নতুন গ্রন্থ রচনাও করিয়ে নেন।
চোমার বিখ্যাত পাণ্ডুলিপি ‘আলেকজান্ডার বুক্স’ মূলত এখানেই রচিত হয়। তবে জান্সকার
থেকে হঠাৎ যখন চোমাকে ফিরে আসতে হয় তাঁর অভিধান রচনার কাজ তখনও অনেকটাই বাকি।
তাঁকে আরো দু’বার ফিরে যেতে হবে তিব্বত সীমান্তে। ১৮২৬ সালে বুসাহিরে (বর্তমানে হিমাচল-তিব্বত
সীমানায় অবস্থিত) যাওয়া একেবারেই সফল হয়
না। ততদিনে চোমা ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ৫০ টাকা মাসোহারা পেতে শুরু করেছেন।
একটি বছর বৃথা নষ্ট হওয়ায় তিনি রীতিমতো হতাশ। ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতা থেকে অবশ্য তিনি
বঞ্চিত হননি। ১৮২৭-এর আগস্ট মাসে তিনি এলেন কানম মনাস্ট্রিতে। শিক্ষাগুরু সাং
গিয়াস ফুন ছোগ-ও ইয়াংলা থেকে চলে এলেন সেখানে। পরবর্তী তিনবছর ধরে চলল কঠোর
বিদ্যাচর্চা। চোমা বুঝতে পারছেন যে তিনি প্রায় তৈরি। অভিধান আর তিব্বতি ব্যাকরণের
কাজও প্রায় শেষের দিকে। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে খবর গেল। তাঁরা চোমাকে কলকাতায়
আহ্বান করলেন তাঁর কাজগুলো প্রকাশের জন্য। চোমা রাজি হলেন। এবার তাঁর গন্তব্য
কলকাতা।
তবে চোমার কলকাতা অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করার আগে
ব্রিটিশদের সাথে তাঁর এক তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু কথা বলে নেওয়া উচিত। ১৮২৪-এর
অক্টোবরে জান্সকার থেকে চোমা চলে আসেন সাবাথুতে। সেখানে এসেই তিনি সেখানকার
মিলিটারি কমান্ডার ক্যাপ্টেন কেনেডির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। তাঁর ধারণা ছিল যে
মুরক্রফ্ট নিশ্চয় তাঁর কাজের বিষয়ে কেনেডিকে জানিয়েছেন। কিন্তু দেখা গেল তা তো হয়-ইনি,
বরং হিমালয়ের পাদদেশে এই হাঙ্গেরীয়ের হঠাৎ আবির্ভাব কেনেডি মোটেই ভালো ভাবে নেননি।
তিনি তো চোমাকে গুপ্তচর হিসেবেও সন্দেহ করতে লাগলেন। সেই সময়ে রাশিয়ার সাথে
ব্রিটিশ-ভারতের কূটনৈতিক শীতলতার সূচনা হয়ে গেছে। কেনেডি তাই অতি সাবধানী।
কেনেডিকে নিজের পরিচয় আর কাজের বিবরণী দিতে চোমাকে লিখতে হল একের পর এক চিঠি। এই
চিঠিগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য তাঁর জীবনীকারদের কাছে অত্যন্ত বেশি। চোমার ইওরোপ থেকে
এশিয়া ভ্রমণের বিস্তৃত বিবরণ এগুলিতে পাওয়া যায়। তবে ব্রিটিশদের এই অহেতুক সন্দেহ
চোমাকে পীড়িত করেছিল। সারা জীবন তিনি এই অপমান মনে রেখেছিলেন। তবে একটা মজার
ব্যাপার এই যে কয়েক মাস পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে কেনেডি শুধু লজ্জিতই হননি, চোমার
এক গুণমুগ্ধ বন্ধু হয়ে তিনি আজীবন থেকে গিয়েছিলেন।
১৮৩১ সালে সান্দর কোরোসি চোমা কলকাতায় এসে
এশিয়াটিক সোসাইটিতে যোগ দিলেন। অভিধান ও ব্যাকরণ বইয়ের প্রকাশনার কাজও জোরকদমে
চলছে তখন। ১৮৩৪ সালে অবশেষে প্রকাশিত হল তাঁর দীর্ঘ গবেষণার ফল — ‘এসে টুয়ার্ডস আ ডিকশনরি, টিবেটান অ্যান্ড ইংলিশ’ আর
‘আ গ্র্যামার অব্ দ্য টিবেটান ল্যাঙ্গুইজ ইন ইংলিশ’। ডিকশনরির প্রথমেই তিনি তাঁর
শিক্ষাগুরুর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে নিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে তাঁকে ছাড়া এই অভিধান লেখা
সম্ভব হত না। ভূমিকাতে তিনি এও জানিয়েছেন যে তিব্বতি ভাষা নিয়ে চর্চার কোনো
উদ্দেশ্যই তাঁর প্রাথমিকভাবে ছিল না। তবে মুরক্রফ্টের উপদেশে এই বিদ্যাচর্চা করতে
গিয়ে তিনি বুঝেছেন যে তিব্বতের বৌদ্ধধর্ম নিয়ে লেখা সাহিত্যগুলো সবই প্রকৃতপক্ষে
ভারতীয় সাহিত্য —
The result of … investigation has been that the literature of Tibet is
entirely of Indian origin. The immense volumes, on different branches of
science, &c. being exact or faithful translations from Sanscrit works,
taken from Bengal, Magadha, Gangetic or Central India, Cashmir, and Nepal,
commencing in the seventh century after Christ.
এটি একেবারেই প্রাথমিক একটি মত। ভবিষ্যতের
তিব্বতিবিদ্যার পণ্ডিতেরা এই ভারত-ঘেঁষা মতকে বাতিল করে দেবেন। তবে চোমা তাঁর মতটি
দিয়েছিলেন তাঁর কাছে উপলব্ধ টেক্স্টের নিবিড় পাঠ করেই। অধিকাংশ বৌদ্ধ তিব্বতি
লেখাই যে তাঁর পড়া হয়নি সেটাও আমাদের মনে রাখতে হবে।
কলকাতায় চোমা প্রায় এক দশক সময় কাটিয়ে ফেলেন।
১৮৩৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি তাঁকে সাম্মানিক সদস্যের সম্মাননা দেয়। ১৮৩৭ থেকে ১৮৪১
— এই চারবছর তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থগারিক হিসেবেও কাজ করেন দক্ষতার সাথে।
মাঝে অবশ্যই চলছিল তিব্বতিবিদ্যা চর্চা। সংস্কৃত-তিব্বতি শব্দকোষ
‘মহাব্যুৎপত্তি’-কে ইংরেজিতে অনুবাদের কাজও তিনি সমাপ্ত করেন। মাঝে অবশ্য
তিতালিয়াতে (অধুনা তেঁতুলিয়া, বাংলাদেশ) গিয়ে কিছুদিন সংস্কৃত আর বাংলা ভাষা
শিক্ষাও মন দিয়ে করেছেন। এত ব্যস্ততার মধ্যেও একটা বিষয় তিনি তখনও ভোলেননি। মধ্য
এশিয়ার উইঘুরদের কাছে পৌঁছে সিকেলি হাঙ্গেরীয়দের সঙ্গে তাঁদের কোনো আত্মীয়তার যোগ
আছে কি না সেটা অনুসন্ধান করে দেখা। কলকাতায় আর বসে থাকা যায় না। তাঁকে আবার
বেরোতে হবে।
১৮৪২। চোমা আবার পরিব্রাজক হলেন। উদ্দেশ্য লাসা
হয়ে উত্তর চিনের উইঘুরদের কাছে পৌঁছোনো। বাংলার তরাই অঞ্চল দিয়ে উত্তরে যেতে যেতে
চলে এলেন দার্জিলিং। ৫৮ বছরের চোমা (যদি ১৭৮৪ সালেই তাঁর জন্মসাল ধরা হয়) কলকাতা থেকে অধিকাংশ পথ হেঁটেই এসেছেন এখানে।
দার্জিলিংয়ে আসার কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য তিনি জ্বরে পড়লেন। ম্যালেরিয়া। তরাই
অঞ্চল থেকে আসার সময়ই সম্ভবত রোগটা দেহে বাসা বেঁধেছে। দার্জিলিংয়ের ব্রিটিশ সুপারিটেন্ডেন্ট ডাঃ আর্চিবাল্ড ক্যাম্পবেলের
আপ্রাণ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চোমাকে বাঁচানো গেল না। ১১ এপ্রিল, ১৮৪২-এর ভোরবেলায় এই
পরিব্রাজকের পার্থিব যাত্রার সমাপ্তি হল। ডাঃ ক্যাম্পবেলের তত্ত্বাবধানে পরের দিন
১২ তারিখ তাঁর পার্থিব দেহ কবরস্থ করা হল দার্জিলিং সেমেট্রিতে। চোমার ঘরে
ক্যাম্পবেল পেলেন চারটি বাক্স- ভরা বই, কিছু টাকা, কিছু সরকারি কাগজ, একটা নীল
সুট, কয়েকটি চাদর, রান্নার হাড়ি আর তাঁর প্রিয় চা পাতা। এই ছিল চোমার পার্থিব
সম্পত্তি। এই সম্পত্তির কোনো উত্তরাধিকারি না থাকলেও চোমার যে জ্ঞানচর্চার
উত্তরাধিকার রেখে গেলেন তার দাবিদার আমরা সবাই। দাবি জানানোর যোগ্যতাটা শুধু একটু
পরিশ্রম করে অর্জন করতে হবে।
উত্তর কথন
এক তীব্র শীতের সকালে আবার সে এসেছে পুরনো
কবরস্থানে। আজকেও কাঁধে ক্যামেরা। জ্যাকেটের সাথে স্ট্র্যাপের ঘষা লেগে সৃষ্টি সেই
অদ্ভুত বেসুরো আওয়াজ। আজ শুধু সে সান্দর কোরোসি চোমার কাছেই এসেছে। সেমেট্রিতে
ঢোকার জন্য রাস্তা পেরোতে গিয়ে সে থমকে দাঁড়াল সামনে। আরে, বাইরের দেওয়ালে বড়ো বড়ো
করে লেখা দেওয়াল লিখন জানাচ্ছে যে এই রাস্তাটার নাম ‘আলেকজান্দার চোমা দি কোরোস
অ্যাভিনিউ’। এত বড়ো করে লেখা হলেও এতদিন চোখে পড়েনি; সেই পাখি দেখার দিনটাতেও নয়। সেমেট্রিতে
ঢুকে পড়ে সে। ভরা ট্যুরিস্ট সিজনেও একজনও লোক নেই এখানে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে চোমার
সমাধিসৌধের সামনে। এই দু’মাসে চোমাকে নিয়ে বেশ কিছু পড়াশোনা করেছে সে। জানতে পেরেছে
তাঁর যাত্রার কথা, তাঁর জ্ঞানচর্চার কথা। সে জেনেছে উইঘুরদের সঙ্গে সিকেলি/মাগ্যা
হাঙ্গেরীয়দের যে আত্মীয়তার শিকড় খুঁজতে চোমার যাত্রা শুরু হয়েছিল, পরবর্তীকালে সেই
ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। উইঘুর জনজাতিদের যে তুর্কিদের সাথেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক,
তা চোমা জেনে যেতে পারেরনি। কিন্তু ঘটনাচক্রে তিব্বতি ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষায়
জড়িয়ে পড়ে তিনি অজান্তেই এই নতুন অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিন সূচনা করে ফেলেন। হারিয়ে
যাওয়া কিছু বৌদ্ধ সাহিত্যকেও পুনরুদ্ধার করে তিনি এই সাহিত্যের
গুরুত্ব আবার পশ্চিমী অ্যাকাডেমিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৩৩ সালে জাপান সরকার
চোমাকে ‘বোধিসত্ত্ব’ উপাধিতে সম্মানিত করেন এই কারণেই। কিছুদিন পর ভিয়েতনামও
চোমাকে একই উপাধি দিয়ে সম্মাননা জানায়। হাঙ্গেরির সরকার চোমার গুরুত্বের কথা
বারংবার স্মরণ করে চলেছেন। ভারত-হাঙ্গেরির সংস্কৃতির মধ্যে সেতু বন্ধনের কাজটি
চোমাই সূচনা করেছিলেন। ১৯১০ সালে চোমার সমাধিসৌধের পিছনের দেওয়ালে হাঙ্গেরিয়ান
সরকার একটি ফলক বসিয়ে দেন, সেখানে যা লেখা আছে তার ইংরেজি তরজমা করলে দাঁড়ায় — “A
poor lonely Hungarian, without applause or money but inspired with enthusiasm
sought the Hungarian native country but in the end broke down under the burden”।
সেই ফলকের দিকে চেয়ে আছে সে আজ। ইংরেজি তরজমাটি আগে
থেকে জানা থাকায় সুবিধা হয়েছে বটে। ফলকের লেখাটি কি কিছুটা জাতীয় হতাশার প্রকাশ? হাঙ্গেরির বোধিসত্ত্বের সঠিক মূল্যায়ন কি “broke down under the burden” শব্দবন্ধটি দিয়ে করা যায়? তাঁর চোখে
পড়ে এশিয়াটিক সোসাইটির ফলকটি যেখানে চোমার
পরিচয়ে লেখা আছে “A native of Hungary who to follow out philological research
resorted to the east and after years passed under privations such has have been
seldom endured no patient labour in the cause of science complied a dictionary
and grammar of Tibetan Langauge, his best and real monument”। সত্যিই তো, তাঁর
কাজেই তাঁর পরিচিতি, তাঁর লেখাই তাঁর সৌধ। ছেলেটি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর
আস্তে আস্তে উঠতে থাকে সেমেট্রির উপরের
ধাপে। সেখানেও রয়েছে অনেকের কবর। একটিতেই মাত্র যত্ন করে সৌধ বানানো আছে। সে জানে ওটা
লেফটেন্যান্ট জেনারেল লয়েডের কবর, ব্রিটিশ-দার্জিলিংয়ের
প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যাঁকে এখনও মান্য করা হয়। না, সে লয়েড-কে নিয়ে আগ্রহী নয়।
অযত্নে রাখা, ভেঙে যাওয়া কবরগুলো সে দেখতে থাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কী খুঁজছে সে
নিজেও কি জানে?
তথ্যঋণ
De Koros, Alexander Csoma. Essay Towards a Dictionary,
Tibetan and English. Calcutta:
Baptist Mission Press, 1834. - - - . A Grammar of the
Tibetan Language in English. Calcutta, 1834.
Duka, Theodore. Life and Works
of Alexander Csoma de Koros. London: Trubner & CO., Ludgate Hill, 1985.
Hetenyi, Ernest (Dr.). “Alexander Csoma De Koros: The Hungarian
Bodhisattva.” Bulletin of Tibetology 9(1): 34-41.
“The Life of Alexander Csoma de Körös.”
<http://csoma.mtak.hu/en/csoma-elete.htm>. Date of Access: 3 Nov. 2022.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন