রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২২

চিরশ্রী দেবনাথ

 

সমকালীন ছোটগল্প


ভগবান


বারোতলার ফ্ল্যাট থেকে মনে হয় চাঁদ অনেকটাই কাছে, তবে তেমন মায়াবী নয়, নিথর পাথরের মতো বিষণ্ণ। দৃঢ় কাচের দেয়ালের ওপারে রাতের আকাশ, আবছা নক্ষত্রের গালিচা আর স্বাদহীন অঢেল জ্যোৎস্নার শব্দহীন ঢেউ, এই তো জীবন!   অখিলেশ্বর নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে চরাচরের দিকে। সমস্যা হলো অখিলেশ্বরের মায়াবী সৌন্দর্য, পুরুষদেহে এতো সৌন্দর্য থাকতে নেই। নিজের চিকণ শ্যামলা  মসৃণ ত্বকের দিকে তাকালে লজ্জা হয়, ঘন কালো ঝাঁকড়া চুলকে মনে হয় ঘিনঘিনে প্রাচুর্য। এইসব আবাসন কম্পপ্লেক্সে একটি ফ্ল্যাটের সঙ্গে অপর ফ্ল্যাটের দূরত্ব যেন হাজার মাইল, তবুও নামা ওঠার সময় কারো কারো সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়, কোনো কোনো তরুণী মুগ্ধ চোখে অখিলেশ্বরের দিকে তাকায়। তাকিয়েই থাকে। এই মুগ্ধতা অসহ্য। অখিলেশ্বরকে অফিসে সবাই আড়ালে রমণীমোহন ডাকে, কারণ মেয়েরা তাকে পছন্দ করে।

অখিলেশ্বর অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ, নিজেকে লুকিয়ে রাখতে ভালোবাসে, কিন্তু এক রহস্যময় আলোকচ্ছটা অখিলেশ্বরকে আবৃত করে রাখে যেন, সবাই তার সঙ্গ পছন্দ করে। কথা বলতে চায়, বন্ধু হতে চায়।

অলৌকিকতায় ব্যাপারটায় সে একদম বিশ্বাস করে না, অথচ অখিলেশ্বরের মনে হয় সে বর দিতে পারে, মানে কারো ভালো চাইলে ভালো হয়, এটা মন্দ নয়। প্রথম প্রথম বুঝতে পারেনি। ঝাঁ চকচকে আবাসন কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়েই ঠিক  উল্টোদিকে বস্তি, গৃহহীন মানুষদের অস্থায়ী আবাস। রোজদিন নিজের দামি গাড়িটায় করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সেদিকে অখিলেশ্বরের চোখ যাবেই, এমনিই, শুধু দেখে, তবে কিছুদিন আগে যখন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল, তখন সেই ঘন ঘোর বর্ষায় অখিলেশ্বর দেখল ওদের ঘরগুলো বৃষ্টির ধারা বহন করতে পারছে না।  ছেঁড়াখোঁড়া ত্রিপল দিয়ে লোকগুলো চেষ্টা করছে তাদের বিছানা, রান্নার বাসনকোসন ঢেকে রাখার, নিজেরা ভিজে যাচ্ছে, স্টোভ ও চুলা ভিজে গেছে, বাচ্চাগুলোর হাতে পায়ে কালো কালো কাদা। অখিলেশ্বর মনে মনে বলতে লাগল  ওদের ভালো ঘরবাড়ি হোক, এই বৃষ্টিতে যেন আর কষ্ট না হয়। হয়তো ভাবার জন্যই ভাবছিলো, কিন্তু একসপ্তাহ পর খবর পেলো, বিশাল এক শিল্পপতি উনার একটি ফ্ল্যাট কম্পপ্লেক্স এই বস্তির লোকজনকে দান করেছেন। একদম কোর্ট কাছারি করে, আস্তে আস্তে বস্তিটি উঠে গেল, এখানে এখন চওড়া রাস্তা ও  সবুজ পার্ক।

অখিলেশ্বর ভাবলো এটা কাকতালীয়। কিন্তু না, অফিসের কলিগ সুদামার বাবা খুব অসুস্থ দীর্ঘদিন ধরে, প্যারালাইসিস, এক সাইড পুরোই অবশ। বেচারা আর পারছে না, মনে মনে যেন রেহাই চাইছে। অখিলেশ্বর ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ এমনিতেই বলেছিল, চিন্তা করো না, তোমার বাবা একদম ঠিক হয়ে যাবে, আমি বলছি দেখো। আসলে নিছক শান্ত্বনা দেবার জন্যই বলেছিল। কিন্তু তারপরই সেই মিরাকল। সুদামার বাবা এখন হাঁটতে পারেন। কোনো ডাক্তার এখনো এই রহস্য বের করতে পারেনি। এমনি করে, কারো বিয়ে হয়েছে, কোথাও ঝগড়াঝাঁটি বন্ধ হয়েছে, অফিসের বহু কাজ মসৃণভাবে হয়েছে, যেগুলোতে প্রচণ্ড প্রতিকূলতা ছিল। অখিলেশ্বরের বস ড্রাগ এডিক্ট বখাটে ছেলে নিয়ে প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তায় ছিলেন, চিন্তায় চিন্তায় উনার ব্লাডপ্রেসার, সুগার দুটোই মারাত্মক বেড়ে গেলে, তিনি খুবই সজ্জন লোক, সমস্ত স্টাফদের সঙ্গে খুব ভালো  ব্যবহার করেন। অখিলেশ্বর উনাকে খুবই ভালোবাসে। বসকে সাহস দেবার জন্য  বলল, আপনার ছেলে নেশামুক্ত  হবেই, আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে, দেখবেন।  এতো হতাশ হবেন না। সেই ছেলে এখন বাঁশি বাজায়, ছবি আঁকে, গ্র্যাজুয়েশনের পর পড়া ছেড়ে দিয়েছিল, আবার মাস্টার্স করছে, অখিলেশ্বর বুঝতে পেরেছে কিছু একটা হয়, যা লোকজনের জন্য খুব ভালো, কিন্তু পুরোপুরি অখিলেশ্বরের আয়ত্তে নেই, ওর মধ্যে স্বল্পমাত্রায় ইচ্ছাশক্তিজনিত একটি ক্ষমতা রয়েছে,  এটা একমাত্র অবচেতন মন থেকে বললেই হয়, সবসময় হয় না, বিশেষ করে সুবৃহৎ কোনো বর সে দিতে পারে না। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, অনেকবার বলে দেখেছে, এখন পর্যন্ত যুদ্ধ থামেনি, এতো দূর পথ বোধহয় তার ইচ্ছাশক্তি অতিক্রম করতে পারে না।

ভারতের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বহু পরিবর্তন সে মনেপ্রাণে চেয়েছে, কিন্তু সেগুলোর ক্ষেত্রে কোনো ফলাফল পরিলক্ষিত হয়নি। তার মানে হলো নির্দিষ্ট মানুষের ওপরই সেই আশীর্বাদ বর্ষিত হয়, তাও অবচেতন মন দিয়ে, ক্ষমতা যদি পেয়েছেই তাও আবার আধা খ্যাঁচড়া করে কেন? তার ওপর রূপের বহর, নিজের পেলব চেহারাটাকে রাফ এন্ড টাফ করার বহু চেষ্টা করেছে, অথচ হয় না, শরীর থেকে শ্যামল দ্যুতি বেরোয় শুধু।

সব ছেড়েছুড়ে গ্রামের পুরনো বাড়িতে চলে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সেখানেও  বৃদ্ধা জ্যাঠু  জ্যাঠিমা  আর তাদের ছেলেমেয়েরা ছাড়া আর একদম নিজের কেউ নেই, মা বাবা  তো  কবেই  মারা গেছে। তাছাড়া গ্রামের মানুষজন যদি ঘুণাক্ষরেও তার এই আধিভৌতিক ক্ষমতার কথা জানতে পারে, সর্বনাশ হবে, লাইন লেগে যাবে। তার চেয়ে এই ভালো, নিজের মতো করে থাকা, কিন্তু কর্মস্থলে লোকজন অখিলেশ্বরের দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়, কী জানি কী ভাবে? অস্বস্তি হয়। বিরক্ত লাগে।

আজ অখিলেশ্বরের মনে ভয়ঙ্কর অস্থিরতা, রাত যত বাড়ছে, তার মনে হচ্ছে কোথাও ছুটে যায়, কোনো এক পাহাড়ের পাদদেশে বসে পৃথিবীর জন্য কিছু চায়।  পৃথিবী তো একটাই, যেন তার মধ্যে মিশে গেছে, নিজের অস্তিত্বকে সে কিছুতেই আলাদা করতে পারছে না ।

ইয়েস লং ড্রাইভ।

যেসব মানুষদের কেউ থাকে না, তাদের জন্য পথ আছে, পথে বেরুলে আর একা মনে হয় না নিজেকে। একবার নিচের দিকে তাকালো, অখিলেশ্বর, অনেক নিচুতে রাস্তার আলোগুলো আবছামতো দেখা যাচ্ছে, কুয়াশা আছে, হেমন্তকালের আগমনবার্তা চারদিকে। গেটকিপারকে ফোন  করতে হবে, এতো রাতে বেরোতে হলে কারণ দর্শানো চাই।

পরক্ষণেই মনে হলো আরে সে তো ভগবান। নাকি ভূত?

মনে মনে অখিলেশ্বর বলল গেটকিপার যেন বিনা বাক্যব্যয়ে গেট খুলে দেয়।

কিছুক্ষণ পর  গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে  রাতের রাস্তায় নির্বিঘ্নে  বেরিয়ে পড়ল অখিলেশ্বর।

কিন্তু যতটা সহজ মনে হয়েছিল ততটা নয়।

রাস্তার অভিমুখ আজ অখিলেশ্বরের আয়ত্তে নেই। ঘোরের মধ্যে গাড়ি চালাচ্ছে সে। শহরের অলিগলি, যেপথে কোনোদিন  আসেনি সেই পথে যাচ্ছে তার গাড়ি, সরু রাস্তা দিয়ে অনায়াসে পাখির মতো ঢুকে যাচ্ছে। তার গাড়ির কি পাখা গজিয়েছে? বিশাল বিশাল পাখা জটায়ূর মতো? স্তম্ভিত হচ্ছে অখিলেশ্বর। স্ট্রিট  লাইটের আলোয় আবছা আলোকিত, সারি সারি গায়ে গায়ে লাগানো ঘর, মাঝখানে বড়ো উঠোন, এমন একটি বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেমে গেলো। যেন কর্ণের রথ, চাকা ভেঙে ঢুকে গেছে মাটির ভেতর।

গাড়ি থেকে নামতেই লোডশেডিং। এবার চাঁদের আলো, বিপন্ন জ্যোৎস্না সর্বত্র।

এজমালি উঠোনে নাচ হচ্ছে, এই বাঁধনহীন নৃত্যবলয়ের মধ্যে অখিলেশ্বর ঢুকে গেলো, একজন পৃথুলা নারী। অখিলেশ্বরের হাতে কী যেন একটা ধরিয়ে দিলো।  ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো অখিলেশ্বর। বাঁশি, কোথাও কি শ্রীখোল বাজছে,  যেমন বাজনা বহুদিন আগে অখিলেশ্বর গ্রামে শুনতে পেতো। আস্তে আস্তে সম্বিত ফিরছে, এতক্ষণ শুধু মায়াময় পরিবেশের অনুভব ছিল, এখন খটখটে বাস্তব চোখে ভেসে উঠল। বৃহন্নলাদের আস্তানায় এসে পড়েছে অখিলেশ্বর। পুরুষালি গঠনের শরীরে মেয়েদের পোশাক পরলে ঠিক যতটাই অশ্লীল লাগে, ততটাই লাগছে, নকল স্তন, চুলের বেনী, চড়া লিপস্টিক, মোটা কাজল আর গাঢ় পাউডারের আড়াল থেকে রুক্ষ, ক্ষয়িত চেহারা ফুটে উঠেছে। অখিলেশ্বরের পাশে একজন এসে বসেছে, তিনি বোধহয় লিডার, প্রবল সাজগোজ তার, সস্তা পারফিউমের উগ্র গন্ধ।

সরু গলায় অখিলেশ্বরকে বলছে এবার বাজাও বাঁশি...

অখিলেশ্বর কোনোদিন বাঁশি বাজায়নি,  বাঁশি বাজাতে জানে না। আস্তে আস্তে  হাঁটু মুড়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে পড়ল সে। বহুদূর থেকে একটি ইচ্ছা প্রকট হচ্ছে এখন। অখিলেশ্বর দু হাত উঁচু করে চিৎকার করে বলছে, পৃথিবীর সব বৃহন্নলারা নারী হোক... নারী হোক।

 

 

 

 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন