সমকালীন ছোটগল্প |
চশমা
শীত ঘন হয়ে আসলে যেভাবে কুয়াশা জড়াতো সকাল, তেমনই চশমা জুড়ে এখনও অস্বচ্ছতা। যেন কিছু আগেও তার ঠিক নীচেই ছিল বিস্ময় মেশানো চোখ জোড়া। কাঁচের খুব কাছে চোখ আসলে কাঁচ আপনা থেকেই ঝাপসা। যেমন জীবন।
এখন এই বাড়িতে আর কেউ নেই। কেউ থাকা আর না থাকার তফাৎটুকু বোঝা যায় বাড়ির সিঁড়ি, খাট আর থেমে থাকা ঘড়ি দেখে। এ কথাটা বাবাই বলেছিল, তখন উচ্চামাধ্যমিক আমি। বাবা তখন এক চোখে শুষে নেন ডারউইনের জীবন।
“It is not
the strongest of the species that survives, nor the most intelligent that
survives. It is the one that is the most adaptable to change.” – Charles Darwin
আর সেটা কি সবাই
পারে? পেরে ওঠে খোকন?
চশমার কাঁচটা কেন জানি না আজ ঝাপসা। অথচ বাইরে মেঘ নেই। এই অরণ্যে আর তেমন কোনো শাল্মলী বৃক্ষ নেই, যার বাল্কলে লেখা –
‘প্রান্তরে দিগন্ত নিনির্মেষ-
এ আমারই সাড়ে
তিনহাত ভূমি
যদি নির্বাসন
দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে
মরে যাবো’।
বাবা শব্দটার সাথে আমার পরিচয় এক আদিগন্ত শ্যামলিমায়। বীর্যদান করলেই কি আর কেউ বাবা হয়ে ওঠে? সেদিন আমরা মঙ্গলবাড়ি টি-এস্টেটের বাংলোর হাতায় বসে, কফি খাচ্ছিলাম। আর বাবা বোঝাচ্ছিলেন বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্তগুলো পেরিয়ে একজন কী করে মানুষ হয়ে ওঠেন। আর সে কথা বলতে গিয়েই তিনি হঠাৎ চে’র মোটর সাইকেল ডায়েরী বার করে আনলেন। নিজেই অনুবাদ করে পড়ছিলেন। ফাঁক ফোকরে চে’র জীবন। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে। বাবা বললেন, আয় হাঁটি। পদব্রজে না চললে মানুষ হওয়া দুস্কর। অতীশ দীপঙ্করের কথা বলছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে দুজনে তখন যেখানে আদিগন্ত সবুজ মিশেছে নীল আকাশের গায়ে। সন্ধ্যে নামছে। বাবার চশমার কাঁচে হলুদ আর লাল গুঁড়োর মিশেল, চোখগুলো কেমন স্বপ্নালু... বাবা তখনও বলে চলেছেন বলিভিয়ার জঙ্গলে চে’র কীর্তিকলাপ। আমিই দুম করে জিজ্ঞেস করে বসলাম, বাবা তুমি কম্যুনিস্ট?
স্মিত হেসে বাবা
বললেন, ‘না’। অনেক ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এলো যেন।
জানিস খোকন -
কেউ জেতে, কেউ হারে। আসল প্রতিদ্বন্দ্বী হল অশিক্ষা, কুসংস্কার। আর সেল্ফ ইন্টারেস্টেড
পারশনকে আমি তেমনই এক অশিক্ষিত কুসংস্কারগ্রস্ত মানুষ হিসেবেই মনে করি। চ্যালেঞ্জটা
নিজেকেই ছুঁড়ে দিতে হয়। প্রতিদিন নিজেকে উন্নত করার সাধনা, সেটাই মুক্তির উপায়। কম্যুনিজম
অনেক বড় সাধনা। আমার মনে হয় রাশিয়ায় সে প্রস্তুতির অভাব ছিল। আর, বুদ্ধর একটা সোজাসাপ্টা
কথা মনে রাখিস, ডু গুড, বি গুড। ব্যস আদর্শ সমাজ গঠন এ রাস্তাতেই। আর সে অর্থে মার্ক্সের
২৫০০ বছর আগে প্রকৃত সাম্যবাদী সমাজের কথা বোধহয় বুদ্ধই ভেবেছিলেন।
আমি কেমন ফ্যালফ্যাল
করেই চেয়েছিলাম বাবার দিকে। মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এসেছিলো, তাহলে মা?
-পারিনি খোকন।
সবাই সব পারে? বড় হ’ আর একটু, বুঝবি।
বাবার চশমাটাকে দেখছিলাম মন দিয়ে। বাইরের লম্বা মেহগনি গাছগুলো উল্টনো চশমায় আরও লম্বা। কিছুটা বাঁকাও। ঘরের বাইরে একটা প্রশস্ত ব্যালকনি। লাইব্রেরি ঘর পেরোলে অনেকটা জুড়ে গাছ গাছালির বাগান। তার বাইরে কাঠের দরজা। সেখানেই লাগানো সমুদ্ররঙা পোস্টবক্স। বাবার জ্ঞানের আঁতুড়ঘর সেটাই। এ বাড়িতে আর কেউ নেই। থাকার কথাও নয়। আমি নিজেই এলাম এতগুলো বছর পর। তাও খবরটা পেয়েই। অতদূর থেকে তো আর নিয়মিত আসা সম্ভব না! আর শেষের দিকে বাবাও আর যোগ রাখতেন না তেমন। বা পারতেন না। মংলু দেখাচ্ছিলো যেখানটায় বাবা পড়েছিল। একাই। একাই তো। বাড়ি থেকে কিছুটা এগিয়ে যে টিলা মত জায়গা তার নীচেই। সম্ভবত চিঠি পোস্ট করতে যাচ্ছিলেন। স্মৃতিনাশ হচ্ছিল। ঠাহর করতে পারেননি হয়ত। দু'দিন গোটা পড়েছিলেন ওখানে। কেউ জানেও না। জানার কথাও না। এতদ তল্লাটে আশপাশে কারও তেমন বাড়িও নেই।
মংলুকে জিজ্ঞেস
করি, চিঠিটা আছে?
এগিয়ে দেয়। এত
অস্পষ্ট আর জড়ানো লেখা…
চালশে ধরেছে আমাকেও।
পড়তে পারি না। বাবার চশমাটাই পরে নিই। এবার পড়া যায়।
নীরু,
জীবন এক অত্যাশ্চর্য, আর অজস্র ভুল ঠিকের সমষ্টি। কেউ বলতে পারবে না সে নির্ভুল। আর আমি তো ভুল মানুষই আজীবন। সেই কমুনিস্ট পার্টি করা থেকে আজও। তুমি কুসুমকে নিয়ে চিরটাকাল সন্দেহ করে গেলে। সে আমার পিসতুতো বোন, স্বল্প বয়সেই বিধবা। পিসেমশায় মারা গেছেন। পিসি আরও আগেই। উপায় কি ছিলো! তার একটা শেল্টারও তো লাগে! হ্যাঁ আমরা পিঠোপিঠি বয়স। কত বাল্য-কৈশোর স্মৃতি। হয়ত পরস্পর পরস্পরকে ভালোও বেসেছিলাম। কিন্তু সেই সময়, পারিবারিক শৃঙখলা ভেঙে চুরে আমরা বিবাহ করতে পারিনি। তা বলে আমাদের মধ্যে আর কোনো কিছুই ছিল না। তুমি আমার পার্টি কমরেড। তোমাকে বিয়ে করার পর থেকে আমি নিষ্ঠাবানই থেকেছি। তোমার প্রতি কখনও কোনো অন্যায় করিনি। তা বলে কুসুমকে মাসোহারা পাঠানো এত অন্যায় হয়ে উঠবে? সেটাই জ্বলন্ত প্রেমের দলিল হয়ে উঠবে ভাবিনি কখনও। তোমার কাছে তো নয়ই। কম্যুনিজম তো এত সংকীর্ণতার জন্ম দেয় না! আমার কথা বাদ দাও। এর জন্য কেউ দশ বছরের সন্তানকে ফেলে রেখে গৃহত্যাগ করে? ক্রোধ অতি বিষম বস্তু। আশা রাখি পরিহার করেছ এখন। হ্যাঁ, খোকন তোমার ছেলে। তুমি তাকে দেখতে আসতেই পারো। সে তো এখন নু ইয়র্ক অধিবাসী। ক'দিন পর আসবে। তুমি এসো। এ বাড়ি, ঘর সবই তো তোমার নীরু! এর জন্য জিজ্ঞেসের কী আছে!
ভালো থেকো।
ইতি-
সন্ধ্যে নামছে, বাবার চশমাটা পরে ই আমি হেঁটে এসেছি সেই জায়গাটায়। আজ হলুদ আর লালের সেই গুঁড়োগুলো আলাদা করে দেখতে পাচ্ছি না। কেবল দিকচক্রবালে নিভে যাচ্ছে সুর্য। আঁধার আসছে। কানে কেন জানি বাজছে সেই কথাগুলো, জানিস খোকন, একমাত্র আঁধারই প্রকৃত সাম্যের দেশ। অথবা ঘুম।
রাত নামলো চরাচরে।
চশমা ঝাপসা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন