ধারাবাহিক উপন্যাস
(২২)
সেদিন কেউ কিছু বলল না। নীরবতাকেই সম্মতির লক্ষণ বলে ধরে নিল হৃদয়। কিন্তু ব্যাপারটা যে তা নয় সেটা কয়েকদিন পরেই বোঝা গেল। সেদিন ওদের জঙ্গলের ভেতর কিছু দুর্লভ ফুল খুঁজতে যাওয়ার কথা। নির্মাল্য বাদে সবাই হাজির। আর নেই অনির্বেদ। হৃদয়ের সঙ্গে নির্মাল্যকে নিয়ে ওর তখন মন কষাকষি চলছে। কিন্তু এরকম তো হয় না। একটু অবাকই হল হৃদয়। ফোন করল। নির্মাল্য জানাল, ক্যারাটের বিশেষ ট্রেনিং ক্লাস আছে। সেখানেই আটকে পড়েছে। আসতে পারবে না।
পরে কিন্তু আসল খবর পেল হৃদয়। মেহুলীইই জানাল, নির্মাল্যর
এক বন্ধুর বাবা মারা গেছেন। তারই শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান ছিল আজ। সেখানেই নির্মাল্য সারাদিন
ছিল।
হৃদয় বিশেষভাবে জানতে চাইল, ও কী সেখানে খেয়েছে?
মেহুলী হেসে বলল, আর কোথায় খাবে? অন্যদের চেয়ে একটু বেশীই
খেয়েছে। আর তাও আমার বাবার পাশে বসে...
হৃদয় খুব আঘাত পেল এই কথায়। কয়েকদিন আগে ওর দাদু মারা
গেছেন। সেই অনুষ্ঠানে ও গেছিল ঠিকই কিন্তু খাদ্য বা পানীয় কিছুই ছোঁয় নি। অথচ সেসবের
এলাহী আয়োজন ছিল সেখানে। ও বাইরে গিয়ে রাস্তার ধারে একটি ধাবায় খেয়ে নিয়েছিল। খুবই
নিম্নস্তরের ছিল সেই খাবার। কিন্তু আশেপাশে আর কোনও খাবারের দোকান ছিল না। খেতে বসে
বারবার ওর মনে পড়ছিল সুখাদ্যগুলির কথা। কিন্তু নিজের মনকে কড়া শাসনে রেখেছিল সে। ওর
তখন মনে পড়ছিল বন্ধুদের কথা। তাদের শ্রাদ্ধে খেতে নিষেধ করে ও নিজে সে কাজ করে কী করে?
এরকম দ্বিচারিতা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষ করে ওর মনে পড়ছিল, বিশ্রুত আর নির্মাল্যর
মুখ। কী নিষ্ঠা আর বিশ্বস্ততার সঙ্গে ওরা কাজ করে চলেছে। নির্মাল্য তো কখনও শ্রাদ্ধানুষ্ঠান
নিয়ে ও যা বলেছে, সে ব্যাপারে কোনও আপত্তি জানায় নি। তাহলে ও এরকম করল কেন? এটা কি
দ্বিচারিতা নয়?
পরে হৃদয় শ্রমণকে বলেছিল, অনির্বেদের ব্যাপারটা নিয়ে ও
আমাকে গোপন করতে শুরু করেছিল। সেই অভ্যাসটাই বজায় রেখেছে দেখছি।
সাঁঝ পরে বলেছিল, নির্মাল্যই ওপরে এতদিন মায়ের প্রভাবই
বেশী ছিল। কিন্তু এবারে তাকে ছাপিয়ে যেতে শুরু করল বাবার প্রভাব। অনির্বেদকে নিয়ে হৃদয়ের
সঙ্গে মানসিক টানাপোড়েন আর মেহুলীর ঔদাসীন্য এই দুটো থেকেই ও পালাতে চাইছিল। ফলে হঠাৎ
করেই কেরিয়ারটাই ওর কাছে হয়ে উঠল ধ্যানজ্ঞান। আর সবই হয়ে দাঁড়াল গৌণ। নিজের সমস্ত নিষ্ঠা,
অধ্যাবসায়, শ্রম আর প্রাণশক্তি দিয়ে ও ঝাঁপিয়ে পড়ল নিজের ভবিষ্যৎ গোছাতে। অন্য সব ব্যাপারে
উদাসীন হয়ে গেল। ফুলের বাগান নিয়েও ওর আর কোনও উৎসাহ রইল না।
হৃদয় পরে শ্রমণকে বলেছিল, এই ঘটনাই বিশ্রুতকে আমার আরো
কাছে এনে দিয়েছিল। আমি দুজনের ওপরেই ভরসা করতাম। নির্মাল্য যা করেছিল, ওই বয়সে সেটাই
ছিল স্বাভাবিক। আমাদের গোটা প্রজন্মটাই নিজেদের পকেট ছাড়া অন্য কিছু ভাবে না। আদর্শ-ফাদর্শ
কিছু নেই তাদের। সব সম্পর্কই লেনদেনের। গভীরভাবে কিছু জানার ইচ্ছেই নেই। কোনও অনুভূতি
বা উপলব্ধিরই জায়গা নেই। স্রেফ পকেট গোছাও, আরাম করো, আর ছুটে চল। সব একেকজন রেসের
ঘোড়া। সবার চেয়ে আগে যেতে হবে, সবার চেয়ে ভালো থাকতে হবে, সবার ওপর প্রভূত্ব করতে হবে,
সবাইকে তাক লাগিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে নিজের সাফল্য আর শ্রেষ্ঠত্ব, তবেই না জীবন! এখানে
তুমি ভাবো-টাবো মানেই বাতিল হয়ে গেলে। ব্যাকডেটেড। আউটডেটেড। গোটা বিশ্বের অলিগল;ইতে
সব ছুটে চলেছে। কিন্তু মনগুলো সব অন্ধ কুঠূরি। কোনও বিস্তৃতি নেই। দুনিয়া উচ্ছন্নে
যায় যাক। কিছুই আসে যায় না। স্রেফ নিজের পকেট ভরলেই হল। আরাম-বিলাসের ব্যবস্থা হলেই
হল। আর কী চাই! আমার লড়াইটা ছিল ঠিক এরই বিরুদ্ধে। বিশ্রুত সেটা বুঝেছিল। নির্মাল্য
বোঝেনি। ওর ছিল কয়েকদিনের হুজুগ। বিশ্রুত কিন্তু পালিয়ে যায়নি। বরং নিজেকে উজাড় করে
দিল। তাতে ওর কেরিয়ারে কোনও ক্ষতি হয় নি। কয়েকদিনের মধ্যেই নাচে গোটা দেশের প্রতিনিধি
হয়ে ও বিদেশে গেছিল। নির্মাল্য এসেছিল বলেই আমি বিশ্রুতকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারলাম।
নির্মাল্য ছিল গতানুগতিক। বিশ্রুত ব্যতিক্রম। গতানুগতিককে না চিনলে ব্যতিক্রমকে আমি
হয়ত ঠিক তখনই শনাক্ত করতে পারতাম না।
শ্রমণ মৃদু হেসে বলেছিল, নির্মাল্যর প্রতি তুই একটু বেশীই
নিষ্ঠুর হচ্ছিস। ওর অন্য কারণও ছিল...
একদম ঠিক, হৃদয় বলেছিল। অনির্বেদ বিশেষ করে মেহুলীকে হারিয়ে
ও জোর ধাক্কা খেয়েছিল। কিন্তু ওর মধ্যে একটা সুবিধাবাদী মানসিকতা ছিলই। সেটা বোঝা যায়
আমাকে মিথ্যে বলে ঐ শ্রাদ্ধে খাওয়ার ঘটনায়। তার মানে ও মুখে যা বলত মন থেকে তা বিশ্বাস
করত না। সময় বুঝেই ওর বাবা ওর উপর ভর করেছিল। ও বদলে গেল। এতদিন যাকে গ্রাহ্য করছিল
না তাকেই সবচেয়ে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছিল।
ফুলের বাগানের কাজে যারা এসেছিল তারা সবাই বিশ্রুতকে অন্য
চোখে দেখতে শুরু করেছিল। তাদের কাছ থেকে সে পেতে শুরু করছিল শ্রদ্ধা সমীহ আর সম্ভ্রম।
বিশ্রুতর বাড়িতে কিন্তু অশান্তি বেড়েই চলছিল। ডান্স কলেজে চান্স পেয়েই আগে সে হস্টেলে
থাকার ব্যবস্থা করল। এখন আর কোনও চিন্তা রইল না। নিজের বাড়িতে থাকার সময়ে বিশ্রুতকে
অনেক মিথ্যার আশ্রয় নিতে হত। বহু সময়ে সে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে আসত। এখন আর সে ভয়
রইল না। অনেক সময়ে সে নিজে ডান্স কলেজে বন্ধুদের ডেকে নিত। ক্যান্টিনে খাওয়াত। রাতে
ওর হস্টেলেই অনেক সময়ে থেকে যেত বন্ধুরা। আরও একটা কাজ করছিল বিশ্রুত, যার মধ্যেই ফুলের
প্রতি ভালোবাসার পরিচয় পেত, তাকেই ফুলের বাগানের কাজে যুক্ত করতে চাইত। এভাবেই দিশারী
আর সাঁঝলে নিয়ে এসেছিল। বিহানকে যুক্ত করেছিল। আরও কাউকে কাউকে এনেছিল। সাময়িকভাবে।
তারা থাকেনি। এতে আর্থিক সমস্যারও অনেকটা সুরাহা হয়েছিল। এরা সবাই মাসে মাসে চাঁদা
দিত। বিশ্রুত এদের প্রাথমিক উৎসাহটা দিত। পরে হৃদয় বাকি কাজটা করত। এই ফুলের বাগান
যে নিছক শখে করা হয়নি, এর পেছনে যে একটা মহৎ লক্ষ্য রয়েছে সে ব্যাপারে তারাও নিঃসন্দেহ
হত। হৃদয় ও এদের মধ্যে যোগাযোগটা রাখত বিশ্রুতই। সব সময়ে তো আর এরা আসতে পারত না। অনেক
সময়ে হৃদয়ও ওদের সঙ্গে দেখা করতে ডান্স কলেজে যেত। বিশ্রুতই তখন সব ব্যবস্থা করে রাখত।
দিশারী পরে সাঁঝকে বলেছিল, ফুলের বাগানটা দাঁড় করানোর
জন্য বিশ্রুতর ভূমিকা ছিল অসামান্য। ও যত ছেলেমেয়েকে নিয়ে এসেছে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত
করেছে আর কেউ তা করেনি। ও পুরো কাজটাই করত নিঃস্বার্থভাবে। বাকিদের মধ্যে কমবেশী উচ্চাকাঙ্ক্ষা
ছিল। ফুলের বাগানটাকে তারা একটা সিঁড়ি হিসাবেই ব্যবহার করতে চাইত। এই কাজের সূত্রে
যে বিচিত্র যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল, নিজেদের প্রয়োজনে সেগুলোকে ব্যহার করতে চাইত। এরা শুধু
নিজেদের নিয়েই ভেবেছে। তাই অন্য কাউকে এ কাজের সঙ্গে যুক্ত করার কথা ভাবেনি। বিশ্রুত
নিজের কথা না ভেবে শুধু কাজটার উন্নতির কথাই ভেবেছে। ও সত্যিই চেয়েছে গোটা দেশের মধ্যে
শ্রেষ্ঠ ফুলের বাগানটা গড়ে তুলতে। আর তাই চেয়েছে যত বেশী সম্ভব ছেলেমেয়েকে এ কাজের
সঙ্গে যুক্ত করতে...
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন