ধারাবাহিক উপন্যাস
রূটম্যান
(৯)
ল্যাংড়া খলিলের কাঁধে বাক্স–মনের কোণে হাজার মকশো
সে
একটা দিন ছিল বটে! হাতের কাজ যেন শেষই হতে চাইত না! একেবারে নগদা নগদি কারবার ছিল।
তবে হ্যাঁ, তার কথায় কেউ ঠকেছে বা অসুবিধায় পড়েছে এমনটা কখনই হয়নি। নদীয়া সীমান্তে
তার একটা নাম-ডাক ছিল। অচেনা লোকে শুধু রুটম্যান ‘খ’
বললেই
কচিকাঁচারা পর্যন্ত বলে দিতে পারত খলিলের ডেরা। তবে দুঃখ যে একেবারেই ছিল না তা নয়।
লোকে যখন তাকে ল্যাংড়া খলিল বলত তখনও যতটা না কষ্ট হত, তার থেকে বেশি কষ্ট হত যখন সাবিনা
ওকে ল্যাংড়াভাই বলত। আর তখনই তার নজর চলে যেত নিজের ডান পায়ের দিকে। ফৎ করে একটা গরম
নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসত বুক মোথিত করে। অথচ সাবিনা তা টের পেত না।
এসব
পুরনো কথা খলিল মনে রাখতে বা মনে করতে চায় না। দিন কখনও কারোর অপেক্ষায় বসে থাকে না।
এটা সবাই জানে যে সূর্য উঠলে তা ঠিক সময় মতো ডুববেই। এর কোন ব্যত্যয় হয়নি। আর খলিল
যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন হবেও না। তবে হ্যাঁ, তখন খলিলের মনে যতটা চনমনে ভাব ছিল আজ
ঠিক ততটা নেই। কারণ তখন প্রায় রোজ না হলেও মাঝে মাঝেই সাবিনাকে নিয়ে সে একটা নৌকায়
করে বাগদার বিল, গড়ার বিল, প্রতাপতলার বিল আবার কোনদিন জলঙ্গিতলার বিলে দিব্বি বিহার
করে বেড়াতো। আদিগন্ত বিস্তৃত বিলের একদিকে পাট গাছের পাহারাদারেরা সব কিছুকেই আড়াল
করে রাখত। তখন ছিল মনের মাঝে সাবিনার উষ্ণতা! আর পকেটে ছিল আর এক অন্য উষ্ণতার অনুভব।
দু’জনেই ছিল একে
অপরের পরিপুরক। কাউকেই ছাড়া যাবে না।
আজ
খলিল না চাইলেও ওকে পুরনো কথার নির্মম স্মৃতিগুলো লুতাতন্তুর মতো যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে
ফেলেছে। এ সব স্মৃতিতে খলিলের শ্বাসরোধ হলেও তার থেকে কোন নিস্কৃতি নেই! এর মধ্যে এত
সব বিলের জল বহুবার বেড়েছে আবার গ্রীষ্মের সময় কিছুটা কমেছেও। অথচ সাবিনার সান্নিধ্যের
সুগন্ধ আজো মাঝে মাঝেই খলিলকে উদ্বেল করে তোলে। জানে আজ সবিনা মতিনের সন্তানের মা।
আর এটাও জানে যে মতিনের নিজের কোন জমি নেই। সে অন্যের জমিতেই গতর খাটায়। অথচ তার নিজের
সেদিনের থেকে আজ অনেক বেশি বৈভব। সব সময় ডান পকেটে লক্ষ্মীর বাস। শুধু ডান পাটায় একটু
ইয়ে থাকায় লোকে তাকে ল্যাংড়া খলিল বলে ডেকে থাকে। সে তো হাজার লোক আছে যারা প্রতিবন্ধী।
কৈ তারা তো লোকের উপহাসের পাত্র নয়। সাবিনা কিনা শেষে তার পায়ের দিকটাই দেখলো। তার
মনটার বিচার করলো না একবারও! শুধু ডান পাটা ছাড়া তার শরীরে তো আর কোন অসুবিধা নেই।
বরং অনেক পুরুষের থেকেও সে অনেক কর্মক্ষম। শেষে সাবিনার নজর গেল আমার পায়ে কিন্তু দিলটাকে
সে চিনলো না। আর তাই সে সব কিছু ছেড়ে, নিজের গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছে ভিন্ন গ্রামে। জমি
কিনে বাড়ি করেছে এখানে। লোকেরা এখানে তাকে হ্যাটা করে না। তবে কেউ কেউ মাঝে মাঝে ল্যাংড়া
খলিল বলে ডেকে ফেলে। আর তখনই পুরনো স্মৃতিগুলো ওর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মনটাকে কয়েক মুহূর্তের
জন্য বড় বিবশ করে দেয়।
মানুষের
মনে যদি দুর্জয় সাহস থাকে তাহলে একজন পঙ্গুও পর্বত ডিঙিয়ে যেতে পারে। আবার দুই পা নেই
এমনও তো দিব্বি সমুদ্রের প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে সাঁতরে পার হচ্ছে। কাজেই সবটাই নির্ভর
করে মনের জোরের উপর। যেমন যে ধরনের কাজের জন্য আজ খলিলের মতো আরো বিভিন্ন লোক প্রতিদিন
কাজ করে তাদের পকেট ভরাচ্ছে, তাদেরও যে প্রাণের ভয় নেই তা নয়। প্রতি মুহূর্তেই সামান্য
ভুলের জন্য প্রাণ সংশয় হতেই পারে। তাহলে কি এটাই সাবিনার কাছে প্রতিবন্ধকতা তৈ্রি করেছিল!
স্মৃতির দু’একটা পাতা উল্টোতেই খলিলের মনে পড়ল একদিন
বিলে ভাসতে ভাসতে সাবিনা বলেছিল-তুমহার এই কামখানা হামার এক্কেবারেই পসন্দ না।
সেদিন
হাসতে হাসতে খলিলের জবাব ছিল, তুমি কি যে কহ না সাবিনা। হামিতো আর চুরি করি না। মাথার
ঘাম পায়ে ফেইলা যা করার করি। সব কামকেই সমান চোক্ষে দেইখতে হয়।
সাবিনা
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিলের জলে হাত ডুবিয়ে বলে, হামি উ কামের কথা কহছি না।
-হাঁ-হাঁ,হামি
জানি তুমি বুট পালিশের কথা ভাইবাই তোমার না পসন্দের কথাখান কহিলা। তবে হামার একখান
কথা শুন। বুট পালিশ হইল গিয়া বড় পুণ্যের কাম। শুননাই হিন্দুদের রামায়ণে আছিল যে ভরত
রামের খড়ম মাথায় কইরা আইনা সিংহাসনে রাখছিল। আবার হামাগো দেশেরই কুন একটা রাজ্যে হিন্দুদের
একখান মন্দির আছে। মন্দিরখান নাকি পুরাটাই সোনার! একদিন হামাগো ইস্কুলের স্যার কহেছিল
যে সেখানে জুতা পিনহা ঢুকায় নিষেধ আছে। তাই মন্দিরে ঢুইকবার আগেই সক্কলের পায়ের জুতা
জোড়া একজন নিজের হাতে নিয়া যত্ন কইরা রাখে। আর এই কামখান হইল গিয়া পুণ্যের কাম। কাজেই
হামার বুট পালিশের কামে আবার পাপ কিসের? খলিল এবার হাসতে থাকে।
-হামি
কিন্তু সে কামের কথা কহি নাই। সাবিনা বিলের জল নিয়ে খেলতে খেলতে বলে ।
-তাহলে
তুমি কুন কামের কথা কহিছ শুনি? খলিল বিস্মিত হয়ে জানতে চায় ।
-আর
একখান কামের কথা ।
-সেটা
আবার কী? খলিলের বিস্ময়ের ঘোর কাটে না ।
-গেরামের
লোকেরাই কহেছিল যে তুমি নাকি পাচারের কাম কর। তোমার নামে সব্বাই তাই কহে ।
-পাচারের
কাম! সেটা আবার হামি কখুন কইরেছি? ওসব কাম তো দৌড়ঝাঁপের কাম। চ্যাংড়াদের কাম। ও কামে
জানের ডর আছে। কত্ত লোকের বডি যে বিলের জলে ভাইসে গেল সেকি আর হামি জানি না। হামি ওসব
পাচারের কাম কইরতে যাব কেনে? হামার কি পাইসার অভাব আছে নাকি? এবারও আগের মতোই খলিল
হাসে।
ঠোঁটে
হাসি ঝুলিয়ে রাখলেও খলিলের বুকের ভেতরটা একবার কেঁপে ওঠে! ও বুঝতে পারে অনেক কাজই লোকের
চোখকে ফাঁকি দিলেও একদিন না একদিন তা সকলেই জানতে পারে। লোকে সন্দেহ করতে শুরু করে।
পরে সেই সন্দেহ ক্রমশই পরিষ্কার হয়ে যায়। তাহলে কি তার এই কাজের জন্য সাবিনাকে মৃত্যু
ভয় তাড়া করছিল। আর তাই সে ধীরে ধীরে খলিলের সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। এটাই
কি তাহলে সাবিনাকে নিজের করে না পাওয়ার মূল কারণ? হয়তো এমনটা হতেও পারে। কিন্তু এর
পরেই একদিন হঠাৎ করেই সাবিনার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তাকে আর সে কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। তবে
আজও যদি মতিন সাবিনাকে তালাক দিয়ে দেয় তাহলেও সে তাকে নিকা করতে রাজি আছে। কারণ সাবিনাই
তার জীবনে প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা। এরপর অনেক মেয়েকে চোখের সামনে দেখলেও আর মনে ধরেনি।
ইদানীং
খলিল জানে এপারের ব্যস্ততার থেকে ওপারের চঞ্চলতা অনেক বেশি। কখনও বা পদ্মার জলের উপর
দিয়ে ভাসতে ভাসতে এপারে পৌছে যায়। গঙ্গার তটভূমিতে দাঁড়িয়ে কান পাতলেই কিছু কিছু ছেঁড়া
কথার অর্থহীন দলা পাকানো শব্দ শোনা যায়। কিছুটা হুল্লোরের মতো। তবে কাজ শুরু হয় ওপার
থেকে ফোন এলে। তার আগে এপারে তেমন কোন ব্যস্ততা নেই বললেই চলে।
বেশ
কয়েক মাস ধরে জলের উপর জওয়ানদের বেশি নজর। তাই ওপথের কারবারে ভাঁটা পড়েছে! তবে জলপথে ভাঁটা পড়লেও ডাঙা পথে নতুন উপায়ে ব্যবসা
রমরমিয়ে চলছে। আর সেই নতুন উপায়ের জন্যই বেশ কিছু লোকের প্রয়োজন আর তাই তাদের কথার
তেজও বেশি।
এ
পথে জল নেই। আছে কাঁটাতারের বেড়া। আর এই কাঁটাতারের দু’দিকেই রয়েছে
বিস্তৃত পাটের ক্ষেত। এখন বেশ লম্বা হয়ে গেছে। এ পথটাই এখনও সুগম রয়েছে। তবে মাঝে মাঝে
যে জওয়ানদের গাড়ি আসে না তা নয়। কিন্তু কবে এবং কখন ওরা এই রাস্তায় টহল দিতে আসবে তার
খবর আগেই পাচারকারির কাছে চলে আসে। ওরাও সেই মতোই গা ঢাকা দেয়।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন