নাডি রহস্য
রহস্যময়ী
নারী নই, নহী আমি নাড়ি,
নাডি
আমি - ভাগ্যলিপি পড়ে দিতে পারি।
‘কোলকুত্তা, কোলকুত্তা…’ উল্টোদিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে একজন পূজারীগোছের লোক একটা কাগজ হাতে নাড়াতে নাড়াতে চোখের সার্চলাইট আলতো করে বুলিয়ে গেল সমবেত জনতার উৎসুক মুখের ওপর দিয়ে। সেকেন্ড দুয়েক লাগলো নিজেকে চিহ্নিত করতে - এবড়ো খেবডো চিন্তার পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ মনে হল, বাংলা ‘কলকাতা’ শব্দের ইংরাজী বানানটা দাক্ষিণাত্য ভ্রমণে এসে এধরনের বদলে পারে কি? চেয়ারে বসেই অনিশ্চিতভাবে ডানহাতটা তুলে নাড়িয়ে দিলাম। ভদ্রলোক স্মিত হাসিতে অভ্যর্থনা জানিয়ে ইশারায় ডাকলেন, ঢুকে পড়লেন পর্দা সরিয়ে পাশের ঘরে।
ভাগ্য প্রসন্ন - ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আমার ডাক এসে গেল। শুনেছিলাম দু’তিন দিন তো বটেই, অনেক সময়ে ২-৩ বছরও নাকি লেগে যায় ডাক পড়তে। আমার জার্মানির ভাইয়ের বৌ-এরই তো হয়েছিল! অপেক্ষারত জনমন্ডলীর তির্যক ঈর্ষার জোয়ার সাঁতরে দ্রুতবেগে আমরা ঢুকে গেলাম ঐ ঘরে - আমরা মানে, সর্বাগ্রে ভাগ্নে, অতি উৎসাহী পিনাকী, পেছনে রীতা আর আমি। প্রথম থেকেই দেখছি পিনাকীর কৌতূহল আগাগোড়াই হিমালয়ের চূড়ায়।
গত পরশু সন্ধ্যবেলা। ভাগ্নেবৌ টুসমীর হাতে সঠিক সমন্বয়ে গঠিত ফিশ ফ্রাইএর ওপরের পাতলা মোড়কটাতে সবে কামড় বসিয়েছি - অন্দরমহলের ম্যারিনেট করা ভেটকীর স্বাদটা দাঁতের স্বাভাবিক কারুকার্যের পরে জিভে ঠেকেনি তখনও। ধপাস করে আমার ঠিক পাশেই সোফাতে ব্রীফকেসটা পড়ল, হাতের কাছে সোফার ওপরে রাখা ফ্রাইএর প্লেটটা দু-তিন ইঞ্চি ওপর নীচে দোল খেয়ে কোনমতে টাল সামলে থিতু হল। এবং আমি কোনমতে অন্য হাতে ধরা চায়ের কাপে বিপর্যয় ঘটবার আগেই ব্যালান্স করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছি। তখনই সোফার পেছন দিক থেকে আবির্ভূত হল পিনাকী, অফিস ফেরত - চেন্নাই প্রবাসী ভাগ্নে। বৌএর এই মূহূর্তের অগ্নিদৃষ্টি এবং অবধারিত অগ্নিবাণ বর্ষণকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, উচ্ছ্বসিত গলায় ঘোষণা করল – ফুলমামু-মামী, সব ঠিক করে আসলাম। পরশু, শনিবারই আমরা যাচ্ছি নাডির কাছে। সব ব্যবস্হা পাকা, বুঝলে তো?অথৈ
জল, সাঁতার জানি না। কাছে দূরে কোথাও কোন লাইফ বোটের দেখা নেই।
-নাডি
কে? ওদের কি চিনি আমরা? তাছাড়া পরশু ম্যারিনা বীচএর প্ল্যান আছে, তা সেটা ছেড়ে কেন
যাব রে?
-আরে
মামু, ওসব বীচ টীচ ছাড়ো তো? নাডি জান না? পুরাকালের পুঁথিতে ভৃগুমুনি না কোন ঋষি যেন
আমাদের সবাইকার জীবনী লিখে গেছেন!
-ও,
জ্যোতিষশাস্ত্র? দূর - ওসব ঠগ, মিথ্যুক, মানুষকে বোকা বানাবার কারখানা। আমি জীবনে অনেক
দেখেছি, অনেক জেনেছি, আমার লাইফের পুরো ছক আমার জানা আছে…
ঝাঁপিয়ে
পড়ল পিনাকী, মামা, নাডি একটা সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা, না গেলে বুঝবে না!
হাত পা না ধুয়েই কফি, টেবিলের ওপর থেকে একটা গোটা ফ্রাই তুলে মুখে ঠেসে ঢুকিয়ে নিল। দু’চোখ ফ্রাইএর অপূর্ব স্বাদের নেশায় ঢুলু ঢুলু, কোনমতে ভাঙাচোরা অবোধ্য উচ্চারণে চালিয়ে গেল আমার দিকে না তাকিয়েই…
-চলোই
না মামু! সবাই প্রথমে অবিশ্বাস করে, তারপর কৌতূহল এবং শেষে হয় দৃঢবিশ্বাস, যাকে বলে
টোটাল কনভিকশন। ছোটমামারা তো জার্মানি থেকে এসে গিয়েছিল ওখানে। নিজেদের স্বাস্হ্য তো
বটেই, নাতাশার বিয়ে নিয়েও দুশ্চিন্তা ছিল খুবই। মামা বিশ্বাস করবে না, ভূত ভবিষ্যত
সব অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে এবং এখনও মিলে চলেছে। মামীর ঠিকুজীপত্র কিন্তু প্রথমবার
পায়নি, পরে আবার যখন দেশে এসেছিল, সেবারে খুঁজে পেয়ে সব খুঁটিনাটি এ্যাকিউরেটলি বলে
দিয়েছে! ওরা তো দারুণ ইম্প্রেসড। কথা বলে দেখ এখনই!
বলেই
মোবাইলটা উঁচিয়ে ধরেছে।
-আরে
কী করছিস? জার্মানীতে এখন ভরদুপুর, সবাই কাজে গেছে। ছেড়ে দে। তুই-ই ব্যাপারটা বোঝা
না!
-তাহলে
শোন মামু - অগস্তমুনিই বোধহয় বা ভৃগুমুনিও হতে পারে, কয়েক হাজার বছর আগে পুরনো কোন
লিপিতে তালপাতার ওপর মানুষের অদৃষ্টলেখন হাতে লিখে গেছিলে। কিছু তামিল সম্প্রদায়ের
ব্রাহ্মণেরা বহু বছর পরে এসবের মর্মোদ্ধার করে আমাদের অতীত বর্তমান ভবিষ্যত নিখুঁত
হুবহু বলে দিচ্ছেন এখন। নতুনেরা গুরুর কাছে ৪-৫ বছরের ট্রেনিং নিয়ে কিছুটা শিখে…
ততক্ষণে
পিনাকী দাঁত আর জিভের যুগ্মপ্রচেষ্টায়, মুখের প্রথম শিকারটাকে কব্জা করে ফেলেছ, নিশানায়এখন
দু’নম্বরটি। কিন্তু না, আপাপাতত দেখছি আমাদের রাজী করানোটাকেই প্রাধান্য দিল ও। হাত
তুলে থামিয়ে দিল -
না না মামা, অত সহজে বোকা বানানোর ব্যাপার নয়! তোমাকে
নাম-ধাম গোত্র ঠিকানা পত্র ওসব কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবে না, কেবল তোমার বুডো আঙ্গুলের ছাপটা
নেবে কাগজে, তার পরেই কী সব করে ঐ হাজার পুঁথির টাল থেকে তোমার লিখন বের করবে - যদি
পাওয়া যায় অবশ্য! তারপর তোমাকে আর কিছুই করতে হবে না, কেবল বসে বসে শুনবে আর শুনবে…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন