সমকালীন ছোটগল্প |
এক ধরনের ভালোবাসা
বাড়ির সামনেই একটি নিমগাছ। বয়স আনুমানিক পঁচিশ হবে। শরীর স্বাস্থ্যে বেশ বড়সড়। ডালপালা প্রচুর। নিমরঙের পাতাও প্রচুর এবং ঠাসা। বেশ বড় একটা ঝুড়ি, ঝুড়িটা পাড়ার আকাশটাকে সহজেই ধরতে পারে এমন। এমন ঝুড়ির কথা বলতে গেলে জামবাটির কথা মনে পড়ে। অবশ্য জামবাটির ছবিটাকে মন থেকে বার করে একটু বড় করে নিতে হবে মাত্র। তেমন একটা বাটি। ঝুড়ি বা বাটি যাই হোক, ঠেসে ভরা নিমরঙ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে গাছটার মাথায়। এই নিমগাছটা যার বাড়ির সামনে তার নাম অতীশ। না, দীপঙ্কর নয়, মাল। অতীশ মাল। অতীশ মালের ঠাকুমা, ধরা যাক তাঁর নাম ছিল নিসিন্দা সুন্দরী মাল। নিসিন্দারা সুন্দরী হয় কিনা তা নিয়ে নিশ্চয়ই তর্ক জুড়বেন না আপনারা। তো সেই নিসিন্দা সুন্দরী মাল, অতীশ মালের ঠাকুমা, বড় কাঁসার বাটিতে ভাত চাপ দিয়ে দিয়ে ঢুকিয়ে, একটা বড় বগি থালার উপর উল্টো করে বসিয়ে দিতেন। তখন তো মোবাইল ছিল না, থাকলে, অতীশের ঠাকুরদা নিশ্চয়ই সেই বাড়া ভাতের একটা ছবি তুলে রাখতেন। স্মৃতিচারণের পাতায় অলংকরণের জন্য খুব কাজে লাগত।
-বাড়ির
সামনে এতবড় একটা নিমগাছ রেখেছেন মশাই! এ তো গাঁ-ঘর নয় যে মানিয়ে যাবে। দেখতে ভালো লাগে
না।
এসব
বলে অতীশের পাড়ার কোনো কোনো লোক।
-যখন ছোটো ছিল তখনই কেটে ফেলতে হতো। উপড়ে ফেলতে হতো। এখন এতবড় গাছটা তো কাটতেও পারবেন না। পারমিশন পাবেন না।
তখনই বলতো হয়তো অন্য একজন কেউ। অতীশ গাছটার গায়ে হাত বুলায়। কথা প্রসঙ্গে অতীশের ঠাকুমা, ঠাকুরদার কথা এসে পড়লেও তাঁরা কেউ এ গাছ দেখেননি। তাঁরা তো এখানে থাকতেন না। থাকতেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানে শুধু নিমগাছ কেন, কত গাছ ছিল। আম, জাম, তেঁতুল, গাব, শ্যাওড়া, বাবলা। পরপর পঞ্চাশ একশো গাছের নাম বলতে বসলে আপনারাই আপত্তি করবেন। অতীশ মালের দাদু ঠাকুমার গ্রামের বাড়িতে কী কী গাছ ছিল, তার ফিরিস্তি শুনতে চাইবেন না আপনারা। সে সব গাছের সকলের নাম আপনারা না জানলেও আমাদের গুগল জানে।
গাছটায় প্রতিদিন অনেক অনেক পাখি আসে। বসে। গান গায়। ঠিক গান কিনা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। তবে লেখক সাহিত্যিকরা বলেন সেসব নাকি পাখিদের গান। হবেও বা হয়তো। শালিক, ছাতারে, টুনটুনি, বুলবুলি, কাক, কোকিল প্রতিদিনের অতিথি। মাঝেমাঝে নতুন কিছু পাখিও আসে। একা একা বা স্ত্রী-পুরুষে বা দলবেঁধে। সেরকম কেউ এলেই, নিমগাছটাই অতীশকে ডাকে - এসো, দেখে যাও, একে আগে কখনও দেখনি।
অতীশের ছেলে, ধরা যাক তার নাম ইয়শ। হ্যাঁ, ওই বাংলায় যাকে যশ বলে আরকি। তার একটা এসএলআর ক্যামেরা আছে। ধীরে সুস্থে, যত্ন করে, সে পাখির একটা ছবি তুলে ফেলে। তারপর পাখিটার নাম, গোত্র, ঠিকুজি সব বলে শোনায় অতীশকে। নিমগাছটাও শোনে। সেও অবাক হয়। অতীশকে কানে কানে বলে - তোমার ছেলে এতো জানে! এরা সব তো আমার বন্ধু। চিনি সবাইকে। কিন্তু ওদের জাত গোত্র সম্পর্কে এতকিছু জানি না।
অতীশ গাছটার কানে কানে বলে - কী দরকার ওসব জানার? তোমার তো প্রেম আছে। ওটা থাকলেই হলো। অন্য কিছু দরকার হয় না।
এসব কথা জোরে জোরে বলতে পারে না অতীশ। ইয়শের কানে এসব কথা গেলে ভীষণ রাগ করবে। এই উদাসীনতা সে মোটেই পছন্দ করে না।
অতীশ মাল এ শহরে এসেছিল চাকরি সূত্রে। তারপর শহরের প্রায় পশ্চিমপ্রান্তে একটুকরো জায়গা কিনে বাড়ি তৈরি করেছিল। জায়গাটার চতুর্দিক তখন ফাঁকা পড়েছিল। প্রতিবেশি বলতে কেউ ছিল না। নিমগাছটা আগে থাকতেই ছিল। বেড়ে উঠেছিল নিজের মনে। অতীশের চেয়ে সে ছিল অনেক বড়। কারো কোনো অসুবিধা করেনি কখনও। কেউ তো ছিলই না তার ধারেকাছে। আর নিমগাছেরা এমন মানুষ, তারা কখনও নিজের মুখে বলে না কার কার কী কী উপকার করে। ধীরে ধীরে চতুর্দিক নতুন নতুন বাড়িতে ভরে উঠল। অতীশের বাড়ির সামনে দিয়েই পাড়ার রাস্তা। সে রাস্তা ছোটো হলেও কাঁচা নয়। পিচ বাঁধানো। ইলেক্ট্রিকের আলোর খুঁটিগুলো সে রাস্তার কৌলীন্য আরও বাড়িয়েছে কিছুটা। এখন সেই রাস্তার উপর পাকা নিমপাতা, নিমফল পড়ে থাকলে কারো কারো অসুবিধা হয় বইকি। তার উপর গাছের ডাল থেকে ঘুঘু বা পায়রা বা অন্য কেউ যদি কারো মাথার উপর, তাদের শরীরের অসার অংশটুকু ফেলে দেয় কখনো সখনো, কার না রাগ হয়! অতীশ নিজেই পরিষ্কার করতে হাত লাগায়।
রাস্তার উল্টোদিকে, রাস্তারই পাশে, একটা দু কাঠা পরিমাণ জায়গা পড়ে আছে। সেখানেও একদিন একটা বাড়ি তৈরি হবে। সে বাড়িতে অন্য কয়েকজনের সঙ্গে একজন যুবতী থাকবে। বিয়ে করব করব করতে করতেও তার বিয়ে করা হয়ে উঠবে না। একদিন সেই যুবতী, যেদিন সে প্রথম এই গাছটার সঙ্গে আলাপ করবে, কী বলবে প্রথম? হয়তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে, চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে, গাছটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করবে - আপনি বুঝি এ পাড়ায় অনেকদিন আছেন?
নিমগাছটা উত্তর দেবার জন্য শব্দ খুঁজে পাবে না। ত ত করতে করতে উত্তর দেবে- হ্যাঁ, বো-বো-বহুদিন হলো।
অতীশ মাল সেদিন বেঁচে না থাকলেও, ওদের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকবে। ওদের কথা শুনবে। শুধু শুনবে না, ওদের আলাপপর্বকে দীর্ঘ করার জন্য, মুখের সংলাপও যুগিয়ে যাবে অবিরাম। বললে কি আপনারা বিশ্বাস করবেন, সেই যুবতী শেষপর্যন্ত সেই বৃদ্ধ নিমগাছটিকে ভালোবাসবে? বিশ্বাস করুন, ঠকবেন না। অতীশের অবর্তমানে নির্বান্ধব হয়ে পড়বে না এই গাছ, সে কি কম কথা? তখন যা যা কিছু ঘটবে সেসব নিয়ে একটা উপন্যাস হয়তো লিখে ফেলবে এ শহরের কোনো উঠতি লেখক।
এখন আমার একটা একান্ত অনুরোধ - একথা যদিও আপনারা শোনেন, বনদপ্তরের অনুমতি নিয়ে একদিন অতীশ মাল নিজেই গাছটাকে কেটে ফেলেছে; কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হলেও, বিশ্বাস করবেন না প্লিজ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন