বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

রেজাউল করিম

 

সমকালীন ছোটগল্প


উৎকণ্ঠিত রাত্রি


আমি একটা ভাঙ্গা ঘরের এক কোণে অন্ধকারে বসে। চারদিকে গুলির শব্দ। ভীষণ শব্দ। কান ফেটে যাচ্ছিলো। শরীর মনও সাংঘাতিক ক্লান্ত। দু’দিন ভাত মুখে যায়নি। পথে কোথাও বাংলার শান্ত নিরীহ মানুষের স্বাভাবিক যাতায়াত নজরে পড়েনি। সবাই আতঙ্কে যে যেদিকে পাচ্ছে পালাচ্ছে। নদী পার হয়ে, বিরাম ভূমির উপর দিয়ে চলতে পাচ্ছে না, তবু শরীরটাকে টেনে হেঁচড়ে জীবন রক্ষায়  চলছে। ঘরের উপর দিয়ে মটারের সেলের দ্রুত গতি ও আওয়াজে আমি বারবার  ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছিলাম। চুপচাপ বসে। ঘুম নেই সারারাত ক্লান্তির পরেও। হঠাৎ টের পেলাম এ ঘরে আমি ছাড়া আরো একজনের উপস্থিতি। লোকটার দুর্বল কণ্ঠ, কাশতে কষ্ট হচ্ছিলো। আমি অন্ধকারের মধ্যেই তার পাশে গেলাম। আস্তে আস্তে বললাম ‘আপনি কে, কোথায় চলছেন?’ লোকটি আমার দিকে তাকিয়েছে কিনা জানি না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘প্রাণে বাঁচতে ভারতে।  লোকটির নাম নিতাই বসাক। ঢাকার শাঁখারিপট্টির বাসিন্দা। পাকসেনার গুলিতে, আগুনে শাখারিপট্টি ধ্বংস্তুপ। দু’একজন মানুষ ছাড়া নারীপুরুষ শিশু কেউ ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই পায়নি। নিতাই বেঁচে গেছে, ঐ সন্ধ্যায় বারিধারায় বোনের বাসায় গিয়েছিলো। ফিরতে পারেনি। সমস্ত শহরে শুধু গুলি আর গুলি।  সারারাত নিতাইয়ের চোখে ঘুম নেই, ছটফট করে কেটেছে। সকালে বাড্ডার দক্ষিণ দিকটায়েও আগুন লাগিয়ে দিয়ে যায়। নিতাই বোনদের পালাতে বলে চলে আসে। অনেক ঘুরে ফিরে এ-গলি সে-গলি হয়ে বিকেলের দিকে শাঁখারিপট্টি আসে। সমস্ত গলি একটা প্রেতপুরী। মৃতদেহ আর আগুনের চিহ্ন। নিতাই ওর  বাড়িটির কাছে যায়, বুক ফেটে যায়। রক্তাক্ত ছয় বছরের জবাকে মায়ের বুকে বিকৃত দেহে পড়ে থাকতে দেখে। নিতাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলে, ‘জানেন আমি  এক মুহূর্ত ওখানে দাঁড়াতে পারিনি। পাগলের মতো ছুটে এসেছি ওখান থেকে। আসতে আসতে দেখলাম জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রোকেয়া হলের সামনে অনেক মৃতদেহ। শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আমার বুক ফেটে যাচ্ছিলো।  আমি কোথাও দাঁড়াতে পারিনি। তারপর কোন পথে এখানে পৌঁছেছি, বলতে পারবো না।

আমার কাছে কিছু চিড়ে ছিলো দু’জনে খেয়ে নিলাম অন্ধকারে। আমি নিতাইকে  বললাম, ‘নিতাইবাবু একটু ঘুমিয়ে নেন। সকালে তো আবার হাঁটতে হবে।  নিতাই আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দাদা আপনার নামটা?’ আমার নাম, পেশার কথা বললাম। ‘আমিও আপনার সহযাত্রী বন্ধু। ওরা আমাকে পেলে হত্যা করতো। ওরা আমাদের সংবাদ অপিস পুড়িয়ে দিয়েছে। ওই রাতে যারা ডিউটিতে ছিলো তাদের কোনো খবর জানি না’। নিতাই বললো, ‘মতিন ভাই, আপনার  আর সবাই?’ নিতাইয়ের প্রশ্নে আমার বুকটা হাহাকার করে ওঠে ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। বাসায় ছোটভাই থাকতো। এম, এ দিতো এবারে। সংগঠনের কাজে দু’দিন বাসায় ফেরেনি। বিকেলে  সংবাদ অফিসে সেলিমের সঙ্গে এসেছিলো। বেশ কিছুক্ষণ আমার রুমে ছিলো। যাবার সময় বলে যায় ‘আজ রাতেও বাসায় ফিরবো না। ইকবাল হলে মিটিং আছে’। জানি না ও বেঁচে আছে কি মারা গেছে!  মা দেশের বাড়িতে থাকতেন ছোটবোনসহ। জানি না ওদের কি হয়েছে। রংপুর দিনাজপুরেও যুদ্ধ চলছে ছাব্বিশ তারিখের পর। মা, কচি নিশ্চয় দিনাজপুরে নেই।  বেঁচে থাকলে হয় তারা কোনো শরণার্থী শিবিরে আছে, নতুবা পাক সৈন্যের শিকার হয়েছে। ছোটবেলায় আমি নাকি ভীষণ কাঁদতাম, মা বলতেন। এখন আর কান্না আসে না চোখে। কিন্তু ব্যথায় অস্থির হচ্ছে মন। দুঃখ বেদনায় চঞ্চল হই। তবু কেন জানি না কচির হাসি ভরা মুখ, ওর মনোবল, সাহস, কাজে উৎসাহ আমার চোখে ভাসছে। ও খুব উদ্দীপনাময়ী মেয়ে। ছাব্বিশের আগে ও লিখেছিল,  ‘জানো ভাইয়া আমরা কলেজের ছেলে মেয়ে সবাই ট্রেনিং নিচ্ছি। স্বাধীনতার জন্য আমরা জীবন দেব’। দিনাজপুরে তো নেতৃত্বে অনেকেই। অধ্যাপক ইউসুফ  আলী, হাজী দানেশ, আব্দুর রহিম, গুরুদাস তালুকদার, সাত্তার। মনতোষের কথাও মনে পড়ছে। ঠাকুরগা কলেজের অধ্যাপক। কিছুদিন আগে ওর একটা সন্তান হয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বন্ধুদের সঙ্গে মিলে কত রাত আমাদের কেটেছে গল্প করে আড্ডা দিয়ে। ঊনসত্তরের মিছিল মিটিং। চোখের সামনে ভাসে সব। আমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় বের হলাম। আমি বাচ্চু, রাজ্জাক, মনোতষ, সাজু, আসাদ একসঙ্গে ছিলাম। অধ্যাপক ড. জোহা কোথা থেকে এলেন যাতে ছাত্রদের ওপর গুলি না হয়। কিন্তু গুলি হলো। ড. জোহা নিহত হলেন। আরো অনেক ছবি চোখে ভাসে। রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার  জেলে। পল্টনে মতিয়া চৌধুরীর সে কী বক্তৃতা! আর মনে পড়ে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’র কথা। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কথাও মনে পড়ে।  এত মানুষ, লক্ষ লক্ষ জনতা। ভাবা যায় না! বঙ্গবন্ধুর সেকি উদাত্ত আহ্বান!

একদিকে রক্তপিপাসু জালেম। আর একদিকে শান্তিকামী স্বাধীনতাকামী মানুষ। ভাবতে ভাবতে ক্লান্তিতে ক্লান্তিতে চোখ জড়িয়ে আসে, ঘুম পায়। কিন্তু ঘুম আসে না পুরোপুরি। নি:সঙ্গ লাগে, খুব উৎকন্ঠা। আমি ঘুরে বসি। পা দুটো লম্বা করে দিই। ব্যথায় টনটন করছে। মাথার নিচে হাত দিয়ে ভাঙ্গাবেড়ার সঙ্গে মাথা ঠেস দিয়ে বসে থাকি। নিতাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ভাঙ্গাবেড়ার ফাঁক দিয়ে একটু আলো এসে পড়ছে ঘরের মাঝে। নিতাইয়ের মুখটা অস্পষ্ট দেখাচ্ছিলো। ও তো বড় ক্লান্ত, উদ্বিগ্ন। ওর মুখটা অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখচ্ছিলাম। আমি উৎকণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন মনে মা, জাফর, কচির মুখের পাশে নিতাইয়ের ছয় বছরের মেয়ে জবা আর ওর বৌয়ের মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম।

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন