ধারাবাহিক
উপন্যাস
দিগন্তসেনা
(৮)
শ্যামাঙ্গী
এসে দাঁড়াল ভূমধ্যসাগরের তীরে আর পৌঁছান মাত্রই লক্ষ করল জলে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিরাট
জাহাজ যার রঙ রামধনুর বিচ্ছুরণে এম্নিতেই সকলের নজর কেড়ে নেবে, তার ওপর জাহাজের ডেকের
ওপর চালক নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে এমনভাবে স্থলভাগের
দিকে বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে যেন লোকটা কাউকে খুঁজছে। জাহাজটা ঠিক আর পাঁচটা জাহাজের
মত নয়। কেননা সেটা যে কোন লোক দেখলেই বুঝতে পারবে যে একটা বিশেষ স্থাপত্য রীতি অনুসরণ
করেই যেন বানান হয়েছে। শ্যামাঙ্গী তীরে এসে দাঁড়ান মাত্রই চালকের হাবভাবভঙ্গি কেমন বদলে গেল নিমেষে। সে তার জাহাজের
নাবিককে কি যেন বলল। সেটা শোনা মাত্রই নাবিকটি গোটা জাহাজটা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে টপকে
গিয়ে নেমে এল তীরের ওপর আর ঠিক তারপরই সে তার
সামনে এসে দাঁড়িয়ে মাথাটা ধনুকের মত ঝুঁকিয়ে ওদের নিজস্ব কোন এক ভাষায় ওকে যেন বারবার
কিছু বলতে থাকল। কিন্তু শ্যামাঙ্গী ওর বক্তব্য এক কানাকড়িও কিছু বুঝতে পারল না। আর
একথাটা নাবিকটি বোঝা মাত্রই সে তার হাত দিয়ে এমন একটা ভঙ্গি করল যাতে ও বুঝতে পারল
যে ওকে জাহাজে ঊঠতে বলা হচ্ছে। শ্যামাঙ্গী
জাহাজে ওঠা মাত্রই জাহাজটা ভাসতে শুরু করল। শ্যামাঙ্গী দেখল ভূমধ্যসাগর দিয়ে চলতে চলতে
জাহাজটা জিব্রাল্টার প্রণালী দিয়ে ঢুকে আটলান্টিক মহাসাগরে পড়ল। শ্যামাঙ্গী লক্ষ করে
দেখল জাহাজের স্থাপত্য এত নয়নাভিরাম যে সেটা কোন জাহাজ না হয়ে কোন বিশেষ বাড়িতে হলে আরও ভাল হত। ইতিমধ্যে নাবিকটি আবার ওর সামনে এসে
দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ওকে ইশারা করে তীরভূমির দিকে
দেখাচ্ছে। ও বুঝল ওকে নামতে বলা হচ্ছে। ও নেমে
পড়ল। ওর পা যে মাটিকে স্পর্শ করল, লোককে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল সেটা মেক্সিকো। ও
সামনের দিকে এগিয়ে গেল। জাহাজটা আসলে মেক্সিকো উপসাগরে ঢুকে একেবারে ডান দিকের তীরে
দাঁড়িয়ে ছিল। আর ও-ও হাঁটতে হাঁটতে ডান দিকে যেতে লাগল। ফলে ও প্রথমেই উত্তরাঞ্চলটা
দেখতে শুরু করল। স্থানীয় আজতেক অধিবাসীরা সানন্দে
তাকে বরণ করে নিয়ে জানাল এরনান কোর্তেস কিভাবে ওদের গোটা সভ্যতাকে তছনছ করে দিয়ে মেক্সিকো
দখল করেছিল। চারদিকে এমনিতে খুবই পরিচিত দৃশ্য। বেশির ভাগ মেয়েরাই বাচ্চাকাচ্চা সামলাচ্ছে
আর রান্নাবান্না, ঘরের কাজকর্ম করছে। তফাত শুধু চেহারায় আর পোশাক আশাকে। ও উত্তর আমেরিকায়
ঢুকল না। বরং তার গা ঘেঁষে প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ধরে ধরে আস্তে আস্তে দক্ষিণের দিকে
যেতে থাকল। আর যত যেতে থাকল দক্ষিণের দিকে, ততই তীব্র একটা গোঙানির আওয়াজ ওর কানে আসতে থাকল। ও আশেপাশের অধিবাসীদের
বারবার করে উদবিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল যে কী হয়েছে! কিন্তু ওরা ওকে কিছু বলে যাচ্ছিল
হাত দিয়ে চারদিকটাই দেখাতে দেখাতে যা ও তখন একবর্ণও বুঝতে পারেনি। তবে অনেকদিল পর ওর
তৈরী করা রাষ্ট্রে যখন এখানকার ইন্ডিয়ানরা যাবে একমাত্র তখনই কেবল ও জানতে পারবে এই
ভাষাটা আসলে কিচে ভাষা। শুধু ভবিষ্যতের সেই দিনের পর থেকে ও আস্তে আস্তে এই ভাষায় কথা
বলতেও শিখে যাবে। কিছুদূর এগোতে এক অশীতিপর
বৃদ্ধ যার বয়েস নাকি আটশ নিরানব্বুই বছর, আর এরনান কোর্তেস আসার সময় সে নাকি শিশু ছিল।
তার সামনে ঘটে যাওয়া ধ্বংসলীলার সবটাই সে দেখেছিল। সেই বৃদ্ধ তাকে বলল যে শুধু লুঠতরাজই চালিয়েছিল
কোর্তেস তাইই নয়, সে আর তার সৈন্যবাহিনীর সকলেই প্রকাশ্য দিবালোকে মেয়েদের ধরে ধরে
তাদের প্রাত্যহিক শরীরের খিদেও মিটিয়েছিল। তাদের স্বামীসন্তানরা তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
দেখতে বাধ্যও হয়েছিল এইজন্যে যে কোর্তেসের নির্দেশে তাদের হাতপা বেঁধে পাশেই ফেলে রাখা
হয়েছিল। শ্যামাঙ্গী জিজ্ঞেস করল গোঙানির যে শব্দটা ভেসে আসছে সেটা কার এবং কেন। তখন
সেই বৃদ্ধ তাকে জানায় যে ওটা একটা সভ্যতার কান্নার শব্দ যা কিনা একসময় অত্যন্ত উঁচুমানের
সভ্যতা ছিল, যার নাম ছিল মায়া সভ্যতা আর বিস্তৃতি ছিল দক্ষিণ মেক্সিকো থেকে শুরু করে
গোটা গুয়েতেমালা জুড়ে। বৃদ্ধ অত্যন্ত আবেগের
সঙ্গে বলে যেতে থাকলেন, এই কান্না তো শুরু
সেই ঘটনার – এক সভ্যতাকে আর এক সভ্যতা এসে
টুঁটি চেপে ধরে তার সমস্ত কিছুকে ধ্বংস করে লুঠপাট করে নেয় তার সম্পদ। আর এর জন্যে
কোর্তেস নিজে আসেনি, পাঠিয়েছিল তারই বাহিনীর সবচেয়ে দক্ষ এক সেনানায়ক পেদ্রো ডে আলভারাদোকে, যে ছিল আসলে এক নির্বোধ, গোঁয়ার গোবজ্ঞোয়া,
অজ্ঞান এক নরপিশাচ। সাধারণ মানুষকে সে দাস
হিসেবে নিয়োগ করে পুরুষদের বানায় ক্রীতদাস আর নারীদের বানায় চিরকেলে আদিম সেবাদাসী।
তার সব কাজ শেষ করে চলে যাওয়ার পর পরই পাদ্রীরা এসে বেঁচে থাকা সমস্ত মানুষের মনের
ভেতর থেকে জোর করে সুপ্রাচীন মায়া সভ্যতার যাবতীয় ধর্মীয় বিশ্বাস মুছে ফেলে অপর খৃষ্টধর্ম চাপিয়ে দিয়েছিল। কথাগুলো শুনতে
শুনতে শ্যামাঙ্গীর মনে হল এ যেন কোন মেয়ের
জীবনকাহিনী শুনছে ও। গলা আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল। ও কিছু বলতে চাইল। কিন্তু বলতে পারল না। অশীতিপর
বৃদ্ধ সেই ইন্ডিয়ান আসার আগে শ্যামাঙ্গীকে দিয়েছিল একটা খুব ছোট সাদা বাক্স যেটা সঙ্গে
থাকলে নাকি যে কেউ যে কোন ভাষায় কথা বললেই প্রাপক তার নিজের ইচ্ছে মত ভাষায় পুরো বক্তব্যটা
হুবহু তেমনই শুনতে পারবে। শ্যামাঙ্গী পরে যার নামকরণ করবে তর্জমাযন্ত্র এবং ভবিষ্যতে
সেটাই হয়ে উঠবে ওর রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব ও অনস্বীকার্য প্রয়োজনীয়
বস্তু।
মধ্য
আমেরিকার যত দক্ষিণে যেতেশুরু করল ততই আকাশ বাতাস চেনা ছন্দের বাইরে গিয়ে অচেনা সুরে বাজতে শুরু থাকল। এল সাল্ভাদোর,
নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস। কোস্তারিকা থেকেই শুরু হল তুমুল ঝড়। ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া, ইকুয়াডোরের মাটি ছুঁতে না ছুঁতেই ওর পায়ের তলা যেন
চটচট করতে থাকল আর কানে আসতে লাগল মানুষের কান্না আর হত্যারোল। পেরু আর ব্রাজিলে গিয়ে
দেখল মাটি চটচটে, আঠালো, লাল রঙের আর মাথার ওপরের আকাশও জায়গায় জায়গায় রক্তের মত লাল।
সবুজ গাছপালাতে সেই লালের ছিটে। আশেপেশের অসংখ্য কবরের মধ্যে থেকে মানুষের স্বর কানে
এল। বলিভিয়া, চিলি, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে আর ঊরুগুয়ে গিয়ে শুনতে পেল কবরের ভেতর
থেকে মানুষ একে একে বলে ঊঠছে তাদের অত্যাচার আর অবিচারের কাহিনী। শুধু মৃতরাই নয়, জীবিতরাও
শিশু, বৃদ্ধ, জোয়ানদের কঙ্কালসার হতদরিদ্র চেহারা নিয়ে বলে যেতে থাকল কীভাবে তাদের
সোনারূপো নিয়ে গেছে বাইরে থেকে আসা অভিযাত্রীরা, কীভাবে পেট্রোলিয়াম আর লোহা, তামা
আর মাংস, ফল আর কফি, কাঁচামাল আর খাদ্যদ্রব্য চলে যায় দেশের বাইরে আর তারা না খেতে
পেয়ে ক্রীতদাসের জীবনযাপনে নারী, পুরুষ, শিশু সকলেই অভ্যস্ত হয়ে খনিতে কাজ করার সময়
সিলিকার ক্ষতিকারক ধুলোয় ফুসফুসের কার্যক্ষমতা হারায়, হাত, মুখ, চামড়ায় ক্ষত হতে থাকে,
গন্ধ বা স্বাদ নেবার সমস্ত ক্ষমতা হারিয়ে গোটা শরীরটাই হয়ে যায় একটা পাথরের চাঁই। যারা
মরে যায় তারা বেঁচে যায় আর যারা থেকে যায় তারা
নিজের জমি থেকে চিরদিনের জন্য উদ্বাস্তু হয়ে ক্রমশ আরও সস্তা ঊষর পাহাড়ে বা মরুভূমির
মাঝখানে চলে যেতে বাধ্য হয়। লাতিন আমেরিকার ধর্ষিত ইতিহাস আসলে একজন নারীর ধর্ষণের
ইতিহাস্। তার বাজারও যেন ক্রীতদাস কেনাবেচার ইতিহাস, ঠিক যেমন সভ্যতার বাজারও আসলে ক্রীতদাস নারীর শরীর ও শ্রম কেনাবেচার বাজার।
লাতিন আমেরিকার ভাগ্য আসলে একজন নারীর ভাগ্য যার অনেক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও সে শুধু
সভ্য পৃথিবীর ক্রীতদাস হবার জন্য জন্মায়। সত্যি কথাটা হল এই লাতিন আমেরিকাই শ্যামাঙ্গীর
চোখ খুলে দিল আর সে দেখল ওই ভূখন্ডটার মত নারীও তার নিজস্ব
স্বত্বার সম্পদের মূল্য নিজে না বুঝেই এতকাল ধরে বিলিয়ে দিয়েছে নিজেকে। তারই বিলিয়ে
দেওয়া সম্পদ ও ক্ষমতা আর শ্রমের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সভ্যতা তাকেই অনবরত কেনাবেচা করে
গেছে কাঁচা মাংস যোগানের পরিপূরক দ্বিতীয় কোন পথের কথা আদৌ না ভেবে। অথচ সমকামিতাই
হতে পারত সেই পরিপূরকথার সাহায্যে অনায়াসেই
মানুষের, সভ্যতার, সমাজের আদিম খিদের একটা
ভালো রকম নিষ্পত্তি। ধর্ষণ সভ্যতার অভিধানে
লেখবার দরকারই হত না। পেরুর ইনকা সভ্যতার গায়েও লেগে আছে অন্য সব কিছুর পাশাপাশি ধর্ষিতা
নারীর যোনির রক্ত। সোনা আর রূপা আবিষ্কারের পরেও যেমনটা বোঝানো হয়েছিল মানুষকে, এগুলো
তাদের জন্য নয়, ঈশ্বরের জন্য,যারা বাইরে থেকে আসবে, ঠিক এই রকমই ঈশ্বরের দোহাই পেড়েই নারীকে
ব্যবহার করেই তার ওপর তোলা হয়েছে সভ্যতার অট্টালিকা। অজস্র সেনা বল অস্ত্রসস্ত্র থাকা
স্বত্বেও কোর্তেস আর তার দলবলেরা যেভাবে গুটিকয় সেনা আর অল্প পরিমান অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শুধু মাত্র ঘোড়ার
পিঠে চড়ে ঝড়ের বেগে ধুলো উড়িয়ে সকলকে চমকে দিয়ে, ভয় দেখিয়ে সব কিছু জিতে নিয়েছিল, শ্যামাঙ্গীর
মনে হল যে সেটা আসলে তার জন্য নির্দেশিত এক বার্তা যেটা পাওয়া মাত্রই সে মনে মনে স্থির
করে নিল সে ঘোড়ায় চড়া শিখবে এবং শিখেও ফেলল।
আর ঘোড়ার ওপর চড়েই সে বাকিটুকু যা যা দেখবার তা দেখেও ফেলল। সমস্ত দেখা এবং শেখা অর্জন
করা হলে তার প্রত্যয় দশ গুণের জায়গায় একশ গুণ বেড়ে যায়। শুধু তাইই নয়, সে এও ঠিক করে
ফেলে যে তার নিজস্ব একটা রাষ্ট্র গড়বে যেখনে
থাকবে অবিচার আর সাজা পাওয়া সমস্ত মানুষের দল। সারা পৃথিবী থেকে এই জন্যে সে সাতাশ
জনপুরুষ, সাতাত্তরজন নারী, আর সাতানব্বুই জুটিকে বাছাই করে। তারপর তাদের নিয়ে সে উপস্থিত
হয় নিহিতপাতালপুরী ব্লক ১এ ওদের বাড়ির সামনে।
ওদের আসার সময়ই খবরটা স্রেফ গুজব হিসেবে রটে
যায় যে এক দল বিশাল সেনাবাহিনী এইদিকে ছুটে আসছে আর তারা আসছে প্রত্যেকেই ঘোড়ার পিঠে
চড়ে। কিন্তু তাদের গন্তব্যটা কোথায় সেটা না জানার ফলে লোকজনের ভীড় করে আসার আগেই শ্যামাঙ্গী
বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে বৈঠকখানায় যায় সেখানেই দেখা হয়ে যায় মানময়ীর সঙ্গে। খুব সংক্ষেপে
মাত্র অতি প্রয়োজনীয় দুচারটে কথার আদান প্রদান হয় দুজনের মধ্যে আর মানময়ী শ্যামাঙ্গীকে
জড়িয়ে ধরে। ওর মাথায় কপালে চুমু খায় আর তারপর আবারও জড়িয়ে ধরে। ও ‘আসছি’ বলে মায়ের
আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে গোটা বাহিনী নিয়ে সমস্ত জায়গাটা টহল
দেয়। তারপর উন্মাদনাপ্রবালগাথার পাশেই চাঁদের ঢেঊ বলে যে অঞ্চলটায় তেমন জনবসতি গড়ে
ওঠেন, সেইখানে তাঁবু খাটিয়ে সকলের থাকা এবং খাওয়ার একটা প্রাথমিক ব্যবস্থা সুদামের
সঙ্গে সেরে ফেলে আবার বাড়িতে ফিরে আসে। পুংক্ষানুপুংক্ষ সব তথ্য জানাবার পরেই সে একে
একে সকলের চোখের দিকে চেয়ে বলে, ‘সভ্যতার ইতিহাস হল স্রেফ ক্ষমতার এক ভাগ বাটোয়ারা।
তার একদিকে থাকে এক দল আর অন্য দিকে থাকে আরেক
দল আর তাতে মধ্যবর্তী কোন জায়গা বলে কোথাও কিছু থাকে না। মানুষ চাক বা না চাক, তাকে
যে কোন একটা দিকে যেতেই হবে। তাই ক্ষমতাহীন হয়ে থাকার চেয়ে ক্ষমতার আধার হওয়াটাই বুদ্ধিমানের
কাজ। কেননা তাতে ইচ্ছে মত আনেক ভালো কাজও করা সম্ভব,যদি মানুষ চায়।
বুচির
একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হয়েছে, আর আরও একটা হব হব করছে। সম্রাটের সঙ্গে ওর শ্বশুরের
গলায় গলায় ভাব। তা দেখে বুচির গা পিত্তি জ্বলে যায়। শ্যামাঙ্গী তার দলবল নিয়ে আসতে
না আসতেই গথিক আর্য গোষ্ঠী ওকে উগ্রপন্থী তকমা দেয়। উদারপন্থী, মধ্যমেধা চৌকনা দল ও
রক্ষণশীল সমাজ দল – সকলেরই কপালের ভাঁজ প্রগাঢ
হয় এবং রাতে না ঘুমিয়ে শ্যামাঙ্গীর বাড়ির আশপাশ
আর চাঁদের ঢেউ দু দলে ভাগ হয়ে আড়ি পাতে এবং
কোথাও থেকেই কোনরকম আঁচ না পেয়ে ওরা তিন দলই এক জোট হয়ে একদিন সোজা ওর বাড়ির দরজায়
এসে দাঁড়িয়ে আসলে বেড়ালের গলায় ঘন্টাটাকে বাঁধবে তাই নিয়ে তুমুল আলোচনা জুড়ে দেয়। শেষ
পর্যন্ত মতিস্থিরতা আর মতৈক্যের অভাবে যে যার বাড়ি ফিরে যায়। শ্যামাঙ্গী ও সুদাম কিন্তু
ব্যাপারটা টের পেয়ে যায়, যার ফলস্বরূপ দুজনে গভীর আলোচনায় মগ্ন হয় কদিন ধরে সুদামের
বাংলোয় আর তাতে এই সিদ্ধান্তেই ওরা উপনীত হয় যে প্রস্তাবিত রাষ্ট্রটা মূল ভূখণ্ডের
কোথাও না করে বরং দুঃস্থ ইন্ডিয়ানদের এখানে পাঠালে সুদাম চাঁদের ঢেউ আর তার আশপাশের বেশ কিছু অব্যবহৃত জমিতে ওদের ব্যবস্থা করতে পারে। শ্যামাঙ্গী অচিরেই তার
দলবল সহযোগে মূল ভূখন্ডের আরও উত্তরের দিকে অল্প উঁচু কয়েকটা পাহাড়ের মধ্যবর্তী আপেক্ষাকৃত
উঁচু সমতল ভূমিতেই ওর রাষ্ট্র বানাবার সিদ্ধান্ত নেয়। জায়গাটা ওদের এতই ভালো লেগে যায় যে ওরা যেন একটা মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এইভাবেই কয়েকটা দিন
কেটে যায়। শ্যামাঙ্গী নিজেই জায়গাটার নামকরণ করে ‘দিগন্তসেনা’। নামটা সকলেরই খুব পছন্দ হয়। সেই থেকে জায়গাটার নাম দিগন্তসেনা হয়ে
যায়।
পরিসর
যেহেতু অল্প, তাই স্থান সঙ্কুলানের জন্য শ্যামাঙ্গী ও তার দলবল খুব অল্প পরিমাণ জায়গায়
সবচেয়ে বেশি পরিমাণ লোক যাতে থাকতে পারে তার জন্য প্রত্যেক বাড়িগুলোয় অনেকগুলো করে
তল নির্মাণ করল এমন ভাবে যাতে প্রবল ভূকম্পনেও ওগুলো ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আর এই কাজটা
করতে গিয়ে ওদের বাইরে থেকে প্রচুর পরিমানে
জিনিসপত্র আনতে হল। আর সেগুলোর দাম চোকাবার জন্য সংগৃহীত সোনা রূপার বেশ খানিকটা বেচে
দিতে হল। তারপর ওরা চাষের জমি, শিল্পের জমি,
রাস্তাঘাট এইসব নির্মাণ করল। তাছাড়াও যেগুলোর ভাবনা ওরা মাথায় রাখল সেগুলো ব্যাঙ্ক,
পোস্ট অফিস ও আরও নানা রকমের সরকারী ভবন। কিন্তু শ্যামাঙ্গীর মনে হল এগুলোর চাইতেও যেটা বেশী জরুরী, সেটা হল
সামাজিক জীবন প্রবাহের জন্য কিছু নিয়মকানুন তৈরী করা। ঠিক হল যারা নারী পুরুষ জুটি
হিসেবে থাকতে চায় তারা থাকবে। যারা সমকামী হিসেবে থাকতে চায় তারাও নিজেদের পছন্দ মাফিক
সেই ভাবেই থাকবে। যারা সন্তান জন্ম দিতে ইচ্ছুক তারা সন্তান জন্ম দেবে। কিন্তু পরিবার
পরিকল্পনার ওপরই ও সবচেয়ে বেশি জোর দিতে চায়
যাতে এখানে জনবিস্ফোরণের সমস্যা একেবারেই না
হয়। ও নিয়ম করে দিল ‘সবচেয়ে ভালো নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক বছর তিনজনকে এই পুরস্কারে
পুরস্কৃত করা হবে তার ভিত্তিতেই যাতে সামাজিক সম্মান ও তার মূল্যমান নির্ধারিত হতে
পারে। তাই নিজেরা সন্তানের জন্ম না দিয়ে যারা সন্তান দত্তক নিয়ে মানুষ করবে তারা এখানে
তত বেশী ভালো নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবে। এমনকি
তারা এই রাষ্ট্রের বাইরে থেকেও দত্তক নিতে পারে। পোশাকের জন্য যেসব কারিগর রয়েছে তারা
সকলের যাতে মোটামুটি একই রকমের পোশাক বানায় তারও ব্যবস্থা করা হল। তাছাড়া চিকিৎসা বিদ্যার
ওপর যাতে কিছু সামাজিক দায়দায়িত্ব আরোপ করা যায় তারও ব্যবস্থা করল। তার জন্য প্রত্যেক
বিষয়ের বিশেষজ্ঞকে নিয়ে ওয়ার্কশপ ও সচেতনতামুলক নানা অনুষ্ঠানের ভার দেওয়া হল। ব্যক্তির
সম্পত্তি ও টাকাপয়সা এবং উত্তরাধিকার বিষয়েও একটা বিশেষজ্ঞদের কমিটি তৈরী করা হল। গৃহশ্রমে
যাতে নারীপুরুষ একসঙ্গে অংশ নেয় এবং তার ভিত্তিতেই যাতে তাদের সামাজিক মূল্যমান নির্ধারিত
হতে পারে তার জন্য সচেতনতা প্রয়াস গড়ে তোলার
ব্যবস্থা করল। স্বাধীন চিন্তাভাবনা এবং প্রতিভার ঠিকঠাক বিকাশের জন্যও একটা কমিটি তৈরি করল এবং প্রয়োজনে সেখানে পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থাও করল। গোটা দিগন্তসেনার পরিধিটাকে
ছোট ছোট ভাগে ভাগ করল এবং তার জন্য আঞ্চলিক শাসনব্যবস্থাও রইল। তবে সবগুলোকে নিয়ে একটা
উচ্চতম শাসনব্যবস্থাও থাকবে যার পাশাপাশি থাকবে বিচার ব্যবস্থাও। শস্য উৎপাদনের সঙ্গে
সামঞ্জস্য রেখে স্বাস্থ্য উন্নয়নের এমন একটা মেলবন্ধনের ব্যবস্থা করল যেটা এ
যাবত পৃথিবীর আর কোথাও প্রচলিত নেই। যানবাহন ও সড়ক ব্যবস্থার পাশাপাশি ঘোড়ার ব্যবহারও
রাখা হল যাতে মানুষ পরিবেশ দূষণের হাত থেকে রেহাই পেতে পারে। ঝর্ণার জলকে ব্যবহার করে
নানা আধুনিক জলাধার তৈরীর ব্যবস্থাও হল। প্রচুর পরিমানে সৌরবিদ্যুত প্রকল্পও রাখা হল। ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ ধর্মাচারণ করতে পারলেও
সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে তার কোন রকম প্রতিস্থাপন রাষ্ট্রবিরোধী কাজ হিসেবে যাতে বিবেচিত ও বিচার্য হতে পারে তার ব্যবস্থাও করা হল।
ব্যবস্থা করা হল দূরদর্শন ও বেতারের জন্য আলাদা ভবন।
এতগুলো
দিনের মধ্যে সবচেয়ে যে খবরটা শুনে শ্যামাঙ্গীর
ভালো লাগল সেটা হল পুপু একজন মস্ত বড় সঙ্গীতশিল্পী হয়ে উঠেছে। শুধু তাইই নয় সারা পৃথিবী ব্যাপী ওর সঙ্গীতের এতই
কদর যে ও বিকেলে এক দেশে, সন্ধ্যেয় আর একদেশে এবং ভোরে অন্য দেশে থাকে ওর সঙ্গীতের
অনুষ্ঠানের জন্য। এর পাশাপাশি গোটা পৃথিবীর সবাই ওর সঙ্গীতের এতই অনুরক্ত যে সকলেই
ওর কাছে সঙ্গীত শিক্ষার আবেদন স্বরূপ পৃথিবীর সব জায়গায় ও সঙ্গীতের তালিমও দিয়ে বেড়ায়। আর এরই পাশাপাশি সবচেয়ে ওদের পরিবারের পক্ষে লজ্জাজনক ও বর্বরোচিত
যে ঘটনাটা হল পুপুর এই পরিস্থিতিতে ওর বাবা-মা মেয়ে বিয়ে না করে একা সারা পৃথিবী ঘুরে
বেড়াচ্ছে, ওদের পারিবারিক ও সামাজিক সম্মানের পক্ষে এত অপমানজনক যে একদিন বাবা মা পাড়াপ্রতিবেশী
সবাই মিলে একদিন ওর ওপর অকথ্য অত্যাচার করে ওকে গভীর রাতে ঘর থেকে বার করে দেয়। মানময়ী
আর অনঙ্গ গিয়ে ওকে সেখান থেকে নিয়ে আসে নিজেদের বাড়িতে। পুপু এখন এক বৃটিশ চিত্রকরকে
বিয়ে করেছে। দুজনে সংসার পেতেছে লন্ডনের এক সুন্দর গ্রামে যে গ্রামের আকাশে পাখিরা
অনবরত উড়ে বেড়ায়, মাটিতে অসংখ্য লতাগুল্মের সঙ্গে নানারকম ফুল ও ফলের বাস, রাস্তাঘাট
স্বপ্নের মত আঁকা আর বাড়িঘরগুলো কাঠের। গোটা
গ্রামটাই ওরা কিনে নিয়েছে আর সেখানে তৈরী করেছ বিশাল এক শিক্ষালয় যেখানে সঙ্গীত এবং
চিত্রাঙ্কন - দুটোই শেখাবার ব্যবস্থা আছে।
পুপু অবশ্য পৃথিবী পরিক্রমণের ফাঁকে ফাঁকে ওখানে যায় আর ওরা দুজন কিছুটা সময় একসঙ্গে
থাকে। তারপর আবার যে যার কাজে ফিরে যায়। তবে আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে ওদের মানসিক
সংযোগ ও প্রেমালাপের কোন ব্যাঘাত তো ঘটেই না, বরং সেটা আরও বেশী জোরদার ও পোক্ত হয়ে ওঠে। ছেলেটির নাম রবার্ট জয়েস। তার বাবা
থাকে লন্ডনের এক হাজার সাতাত্তর মাইল দূরে
ক্রাফোর্ডভিলা বলে একটা জায়গায়, যেখানে ওর
ছোট দুই ভাই যারা এখনও কথা বলতে শেখেনি বা জীবনের
অন্যান্য ব্যবস্থায় স্বাবলম্বী হয়ে
উঠতে না শেখায় মা বাবার পরিচর্যা ও স্নেহে বড় হচ্ছে। রবার্টরা আসলে ক’ভাই আর ক’বোন
সেটা তারা নিজেরাও জানে না যেমন, তেমনি ওর মাও জানে না। কেননা মাত্র বার বছর বয়স থেকেই ওর মা ওর বাবার দ্বারা অপরিচিত থাকাকালীনই ধর্ষিত হয়ে প্রথমে দুটি সন্তানের
জন্ম দেয়। তারপর থেকে সাত আট মাস অন্তর অন্তরই দুটি কি তিনটি করে ছেলেমেয়ে বিয়োতে থাকে
আর ওর বাবা হল আসলে এক আদিম ব্যবসার দালাল। তাই ছেলে মেয়েগুলো শৈশব শেষ একটু সাবলম্বী
হলেই যে যার পথ দেখে নিতে শুরু করে। যেহেতু ওদের সকলেরই মাতৃপরিচয় নির্দিষ্ট কিন্তু পিতৃ পরিচয় অজানা, তাই ওদের সকলেরই একটা করে নাম
দেওয়া হয় আর পদবীটা মার থেকে নিয়েই জুড়ে দেওয়া হয়। তার চাইতেও যেটা বড় কথা, ওদের ভাইবোনেরা
শৈশব থেকেই কোন না কোন ব্যাপারে তাদের বিরাট নৈপুণ্যের এমন স্বাক্ষর রাখে যে ওর মা
তাদের সেই সেই বিষয়েই নিজে যততুকু পারে, সেইটুকুই তালিম দেয় আর পরবর্তীকালে ওরা সেই
সেই বিষয়েই জীবিকা নির্বাহ করে। ঠিক সেই কারণেই ওরা কেউ গাইয়ে, কেউ বাজিয়ে, কেই স্থাপত্যবিদ,
কেউ শিকারী, কেউ নৃত্যশিল্পী। দু বছর আগে কোন
সঙ্গীত সম্মেলনে পুপুর সঙ্গে ওর এক দাদার আলাপ
হয়েছিল যে কিনা সেই সম্মেলনে তার সঙ্গীতের
দ্বারা শ্রোতাদের এমন ভাসিয়ে দিয়েছিল যে গোটা দুনিয়ায় রাতারাতি তার সেই বছরের সব কটা দিনের
গান গাইবার চুক্তিপত্র স্বাক্ষর ও পোক্ত হয়ে গিয়েছিল। আর সেই বাবদ সে যা আয় করেছিল তাতে সেই বছরে শিল্পীদের মধ্যে সে
সবচেয়ে ধনী বলে একটি ইংরেজি দৈনিকে তার সাক্ষাতকার বেরিয়েছিল।
উপমা একজন ফরাসী চলচিত্র পরিচালককে শুধু যে বিয়েই করেছে তাইই নয়, তার পরিচালিত ছবিগুলোতে অভিনয়ও করা শুরু করেছে। বাকী সময়টা বাড়িতেই থাকে। মানময়ীর তখন আরও বয়েস হয়েছে, সে একটু পৃথুলাও হয়েছে। সংসার দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছে উপমা। তার একটা ছেলে হয়েছে যে শৈশব থেকেই খুব ভালো গান করতে শিখেছে। উপমা আর তার স্বামী দুজনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওকে ওরা কোন্ স্কুলে না দিয়ে বাড়িতেই পড়াবে যাতে বাইরে থেকে মানব জাতির পক্ষে অপকারী বিষয় ভাবনা চিন্তাগুলো ও বাইরে থেকে শিখতে না পারে। অলঙ্কৃতাও আগের থেকে ভারী হয়েছে আর নাকের ওপর একটা চশমা লাগিয়েছে। শকুন্তলা যৌবনে পা রেখেছে শুধু না, এক ইতালীয় যুবকের সঙ্গে এক সঙ্গে থাকতেও শুরু করেছে। চাঁদের ঢেঊ অঞ্চলে একটা সুন্দর বাড়ি বানিয়ে ছেলেটার নাম রেঁনোয়া বত্তিচেল্লী আর পেশায় সে একজন স্থাপত্যবিদ। সারা পৃথিবীড় নানা উল্লেখযোগ্য ভবনগুলো নির্মাণের জন্য তার ডাক পরে। শকুন্তলা হয়ে উঠেছে এক বিজ্ঞানী। সে শুধু গবেষণা করে চলে পৃথিবীর এবং মানুষের পক্ষে নাগাল না পাওয়া বিভিন্ন হরমনগুলো যেগুলো বয়েসকে ধরে রাখতে সাহায্য করে সেগুলো কিভাবে বাইরে মানব শরীরে যোগানো যায়। শ্রাবণ এখন স্থায়ী সঙ্গী হিসেবে কাউকে বেছে নিতে পারেনি। আপাতত সে একজন সমাজতত্ত্ববিদ হিসেবে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন শিক্ষালয়গুলোতে চুক্তির ভিত্তিতে ক’মাস বা দু’এক বছর করে পড়াবার সূত্রে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। এসব ব্যাপারে অনঙ্গ এর সার কথাটা সবাইকে বলে বেড়ায়, ছোটরা বড় হয় আর বড়রা বুড়ো হয়। এই হচ্ছে কালের নিয়ম। সে তুমি যতই চেষ্টা কর, এ নিয়ম কিছুতেই বদলাতে পারবে না। বুঝলে?’
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন