ধারাবাহিক উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(২৯)
দেবিকা
যে ফোন করবেই, লিপিকা জানত। দিন পনেরো চুপচাপ ছিল, হঠাৎ একদিন দুপুরে তিনটে নাগাদ ফোন।
ওই সময়েই সাধারণত সে ফোন করে। লিপিকার অসুবিধে নেই তবে দুপুরে ঘন্টাখানেক শোওয়া অভ্যেস
হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠে আরেক প্রস্থ ঘরদোর পরিচ্ছন্ন করা, জামাকাপড় শুকনো হলে গোছগাছ
করা, বিকেলের পরে বাড়ির কাছের দোকানে দরকারি কিছু কিনতে যাওয়া—অগোছালো যাপন
বরাবর ভীষণ অপছন্দ। শোভন অনেক সহিষ্ণু, চিরকাল লিপিকা বিরক্তি প্রকাশ করলে থামিয়ে দিয়ে
হেসেছে,
“ছেড়ে
দাও—নিজের প্রেশার
বাড়িয়ে লাভ আছে? তোমার মতে আমি আর বাবুল ছাড়া
কেউ চলবে না”।
দেবিকার
উত্তেজিত হ্যালোর জবাবে নিরুৎসাহী স্বরে হাই তোলে লিপিকা,
“বল!”
“তুই
আমার মেয়েটারে না ফুসলালে পারতি মেজদি!”
লিপিকা
রাগ সামলে চুপ করে থাকে, আঁচ করেছিল তিরটা তার দিকে আসবেই আসবে। দেবিকা অনর্গল বকে
যায় সত্যি-মিথ্যে মিশিয়ে, মরা-মা, দিদি-দাদাদের বিরুদ্ধে অজস্র তার অভিযোগ —
আশৈশব
তার প্রতি অবহেলা এবং মেয়ের নামে রাশিরাশি নালিশ যার মধ্যে বাবুলও অপ্রাসঙ্গিকভাবে
এসে পড়ে। লিপিকার ফোন ও মাথা দুটোই গরম হতে থাকে। মিনিট দশেক নীরবে শোনার পরে ঠাণ্ডাভাবে
বলে,
“আর
বলবি, না শেষ হয়েছে?”
“তুই
অর বিয়েটা ভেঙ্গে দিলি কেন?”
লিপিকা
আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টাও করে না, যে আদ্যোপান্ত অবুঝ তাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। উলটে কড়াভাবে
বলে,
“শোন
এবারে আমি ক-টা কথা বলছি। তোর মেয়ে এখন বিয়ের জন্য মানসিকভাবে রেডি নেই”।
“তরে
বলেছে? তা-লে প্রেম করে নাকি কারুর লগে?”
“না,
আমি বুঝেছি। আর প্রেম করে কিনা জানি না, করলে দোষ কী?”
“হ,
দোষ নাই! মা-র চেয়ে মাসীর দরদ বেশী কিনা! অমন ভালো সম্বন্ধ একটা, ভালো ঘর, ভালো পাত্র মন উঠল না, ফেলে-ঝেলে একা-একা
হায়দ্রাবাদ চলে গেল!”
লিপিকার
অসহ্য লাগে, পাশের ঘরে শোভন ঘুমোচ্ছে। বলবে না ভেবেও ঝাঁঝ মিশিয়ে মোক্ষম বাণ প্রয়োগ
করে,
“তোর
মেয়ে তোদের কাছ থেকে পালাতে চাচ্ছিল। চাকরিটা যদি না পেত হয়ত বিয়েতে আপত্তি করত না। মা হতে গেলে সন্তানকে একটু
বুঝতে হয়। বিয়েতে ওর বিতৃষ্ণা কেন, সে যে তার নিজের জন্মের জন্য লজ্জা পায়, কষ্ট পায়,
জানিস এগুলো? কোনোদিন কাছে ডেকেছিস, বুঝিয়েছিস? ছোটো থেকে আমি তো কোনোদিন দেখলাম না।
মা জানত, মা ওকে বুঝত।”
“কী?
তরে এইসব বলছে?”
“আমাকে
না দেবার্ঘ্যকে কিছু কিছু বলেছে, তার থেকে শুনেছি। শোন, ছেলেটা বুদ্ধিমান। বিয়ে নিয়ে মিছামিছি ওদের পিছে লাগিস
না। যদি কেউ রাজী করাতে পারে ও-ই পারবে”।
দুম
করে কেটে দিয়ে আগুনের মতো গরম ফোন সোফার ওপরে ছুড়ে রাখে লিপিকা। ওদিকে যা তুলকালাম
হবে হোক, দেবিকা-কৌশিকের আকচাআকচি, ছিরিছাঁদহীন বিশ্রী সংসারে কোনো আগ্রহ নেই। উঠে
শোওয়ার ঘরের কাছে পা টিপে-টিপে আসে, শোভনের ঘুম ভাঙেনি। ক-দিন হল শান্ত আছে মানুষটা,
লিপিকা স্বস্তির শ্বাস ফেলে। বাবুলের সঙ্গে ভালো করে কথা বলতে হবে, কতদিন ঠিকমতো খবর
নেওয়া হয় না। বলে খুব চাপ চলছে, খাওয়া-দাওয়া সময়মতো হয় কি না কে জানে!
ক-মাস যেন হয়ে গেল অদিতির সঙ্গে যোগাযোগ নেই, কাজের চাপে ডুবে থাকা সত্বেও ফাঁক দিয়ে পুরনো ছবি পিছলে এসে ঘুরে যায়। ড্রিম হোমস-এ প্রথম দেখা মনে পড়ে। পরে অদিতির উৎসাহে দুজনে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়িয়েছে চাঁদনি চৌক থেকে লোটাস টেম্পল। পুরনো দিল্লীর ঘিঞ্জি জায়গাতে একসাথে পা ফেলেছে, গরমের সন্ধেয় লালকিলা বা দিল্লীহাট, ছোটো ছোটো কত পাব বা ইট-আউট। হর্ষ বেড়াতে ভালোবাসে, কথা বলতেও, অদিতি মনোযোগী শ্রোতা। কিন্তু বহুবার বলেছে,
“তোমার
মম্মি-পাপাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে”।
গাড়ি
ড্রাইভ করে এসেছে অদিতি, না হলে ক্যাব বা অটোরিক্সায় বসেছে ঘেঁষাঘেঁষি, সহজ বন্ধুত্বে
কাঁধে-পিঠে হাত রেখেছে হর্ষ, এর বেশী আর একটুও এগোয়নি। সে অবস্থায় অদিতির মুখের চেহারা
লক্ষ করলে হয়ত খানিক টের পেত অথবা পেত না। দিল্লী তার সত্যিকারের প্রিয়, এখানকার সামগ্রিক
রুক্ষতা, সৌন্দর্যায়নের সবুজ, শহরের মধ্যযুগীয় আর একই সাথে ঔপনিবেশিক সাজসজ্জা, হাড়হিম-করা
ঠাণ্ডা, গ্রীষ্মে উর্ধ্বমুখী অসম্ভব তাপ, বায়ুদূষণ, দ্রুত জনজীবনে সে ভারী অভ্যস্ত
হয়ে উঠেছে। চাপের কারণে চাকরি বদলানোর ভাবনা মাথায় ঘোরে, তা বলে পুনেতে পোস্টিং নেওয়া
অসম্ভব। কখন অদিতির সাথে মনে-মনে এতখানি জড়িয়েছে —
থম
ধরে বসে থাকে হর্ষ, সামনে খোলা ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে। লাঞ্চটাইম—পাশের ইউনিট
থেকে ভৈভও, নিশা, প্রকাশ এসে ডাকে,
“গেট
আপ হর্ষ্, চল্ ক্যান্টিনমেঁ চলতে হ্যাঁয়”।
ক্যান্টিন
ভালো, পাওয়া যায় নানারকম। এসময়ে যথেষ্ট ভীড়ও আছে। কোণের দিকে একটা টেবিল ম্যানেজ করে
ফেলে নিশা। নিশা প্রায় হর্ষর বয়সী, বিবাহিত, বছর তিনের বাচ্চা আছে। মেয়ে বলেই ষষ্ঠেন্দ্রিয়
জোরালো, একটু আড়াল পেয়ে প্রায় কানে কানে বলার মতো বলে,
“মিঃ
হর্ষ, সামথিং গোইং রং?”
“না,
না তো!”
“তোমায়
দেখছি লাস্ট ক-মাস ধরে, ক্যান টেল মী অ্যাজ আ ফ্রেণ্ড। ফ্রি-লি বোল সকতে হো”।
ধরা
পড়ে গিয়ে হর্ষর সরল মুখটায় একধরনের দুঃখী হাসি খেলে যায়, অথচ সে নিজে বুঝতে পারে না। নিজেকে সপ্রতিভ দেখানোর চেষ্টায়
এটা-সেটা বকবক করে যায়। নিশা বোঝে, আর বলে না কিছু।
ছুটি
নিয়েছিল হর্ষ, শরীর ভালো লাগছিল না রাত থেকে। পিঠে একটা ব্যথা হচ্ছে, ব্যথাটা চারিয়ে
যাচ্ছে হাতের দিকে। ভেবেছিল দু-একদিনে কমে যাবে, তা হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার
দেখাতে হবেই। গরম কমে এসেছে, শীতের আমেজ বাতাসে। তাদের কমপ্লেক্সের গাছগুলোয় পাখির
সংখ্যা বেড়েছে। দুপুরের খাওয়ার পর পেইনকিলার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, ঘুম ভেঙে দেখে সন্ধে।
অন্ধকার ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে বাইরের চিকচিকে আলো দেখা যাচ্ছে, নীচে নেমে একচক্কর
হেঁটে এলে সতেজ লাগবে। উঠবে ভাবছে, দ্যাখে
ফোন রিঙ্ হচ্ছে — লিপিকা। ভীষণ
হালকা লাগল হর্ষর, পরম নির্ভরতায় বলল,
“মা,
বলো?”
“অফিস
ছুটি নাকি রে? এই সময়ে তোকে পাই না, তাই ভাবছিলাম করবো কি করবো না”।
“ছুটি
নিয়েছি আজ”।
“তোর
শরীর ভালো নেই তাই না?”
লিপিকার
প্রশ্নে গলা বুজে আসে, কত উদ্বেগ আর আদর জড়িয়ে আছে সামান্য এই প্রশ্নে! হর্ষ চুপ করে
থাকে কয়েক মিনিট, জবাব দেয় না। মনের ভেতরের অশান্তি উদ্বেল হয়ে উঠে বেরোতে চায়, কে
যেন বলে, ‘বলে ফ্যাল বাবুল, মা-র কাছে লুকিয়ে কী হবে? ছোট্টবেলা থেকে পেরেছিস কখনো?’
লিপিকা
জিজ্ঞেস করে,
“হ্যাঁরে বাবুল
কী হল, বলছিস না কিছু? দুপুরে কী খেয়েছিস?”
“আমি
ঠিক আছি মা”।
“ক-মাস
হল বাড়ি আসিস নি, ঘুরে যাবি ক-দিনের জন্য?”
“খুব
প্রেশার যাচ্ছে মা, তোমরা এসে থেকে যাও কিছুদিন, এখন ওয়েদার দারুণ। এরপর শীত পড়তে শুরু হলে পাগল হয়ে যাবো”।
“যাবো
তো ভাবছি। তোর অসুবিধে হবে না তো? তাহলে আরো একটা কাজ সেরে আসার প্ল্যান করছি।”
“কী?”
“মণীষার
আর ওর মেয়ের সঙ্গে দেখা করবো। দু-একবার কথা হয়েছে, হোয়াটস্যাপে মেয়ের ফোটো দেখলাম। তোর আপত্তি নেই তো
বাবুল?”
এটাই
স্বাভাবিক অথচ হর্ষ স্তব্ধ হয়ে থাকে, চেষ্টা করেও মুখ থেকে কোনো উত্তর বের হয় না। কয়েক
মিনিট অপেক্ষা করে লিপিকা ‘আচ্ছা রাখি, তুই রেস্ট নে’
বলে
ফোন কেটে দেয়।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন