হিটলার করোনা ও ধর্ষণ
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
শুরুতে হিটলার যখন পোল্যান্ড আক্রমণ করেছিলেন, জানা যায় তার চারবছর আগেই হিটলার নাকি তাঁর প্রশাসনের
কর্মকর্তাদের ডেকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে আগামী চারবছর পর তিনি যুদ্ধ করবেন। তাই তাঁরা যেন সেই মর্মে প্রস্তুতি নেন। সেই সঙ্গে তিনি তাঁদের এও বলেছিলেন যে দেশের মানুষের মধ্যে এই মর্মে দেশপ্রেমের
মাহাত্ম প্রচার করতে যাতে তারা মেনে নেয় সেই যুদ্ধটা তাদের এবং দেশের কল্যাণের জন্যই করা হচ্ছে। যুদ্ধ শুরুর চারবছর আগে থেকেই জার্মানির স্কুল
কলেজগুলোতে সিলেবাসের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই দেশপ্রেমের বাণী। এবং বলা বাহুল্য
সত্যিকারের যুদ্ধটা যখন শুরু হয়েছিল, তখন হিটলার তাঁর দেশবাসীর কাছ থেকে পেয়েছিলেন
অকুন্ঠ সমর্থন যা তাঁর যুদ্ধ করাটাকে অনেক বেশি অনায়াস সাধ্য করে দিয়েছিল সন্দেহ
নেই।
দুহাজার উনিশে যখন করোনা অতিমারী গোটা পৃথিবীকে একটু একটু করে গ্রাস করতে শুরু করেছিল এবং উত্তরোত্তর আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা লাফ দিয়ে দিয়ে বাড়ছিল, তখন সেই আপতকালীন পরিস্থিতিতে পৃথিবীর প্রায় সব দেশই যার যার মত করে তাদের দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছিল তাদের স্ট্রাটেজির কথা এবং কড়াভাবে সেগুলো মেনে চলার নির্দেশও জারি করেছিল। বলা বাহুল্য ফলও ভালোই মিলেছিল। না। হিটলারের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা কোভিড নাইনটিনের মত ঘটনা হয়তো এখন ঘটেনি। কিন্তু সারা পৃথিবীতেই বিশেষ করে আমাদের দেশ ভারতে ধর্ষণের ঘটনা যেভাবে ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে, তাতে একেবারে হাত পা ছড়িয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকার দিন কিন্তু ফুরিয়ে আসারই কথা। তবু যে কেন আমাদের কর্মকর্তারা এই বিষয়টাকে নিয়ে গা করছেন না, তা সত্যিই আমার মত এক নিতান্ত ছাপোষা বাঙালি মধ্যবিত্তের বোধগম্য হচ্ছে না। আসুন এবার একটু দেখে নেওয়া যাক ধর্ষণের সরকারি পরিসংখ্যানগুলো ঠিক কী বলছে।
ভারতের ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর দেওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে প্রতি ১৬ মিনিটে এ দেশের কোথাও না কোথাও একটা ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। রাজধানী দিল্লিতে আট মাসের একটি কন্যাশিশুকে ধর্ষণের খবর উঠে এসেছে। এন সি বি সি-র ২০১৬ সালের একটি রিপোর্টে জানা যাচ্ছে সে বছরে ভারতে প্রায় কুড়ি হাজার শিশু বা কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ২০১৭তে ৩২৫৫৯টি ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে যেখানে ২০১৮ সালে সেটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩৩৫৬ এ। ৬০০র বেশি শিশু-ধর্ষণ হয়েছে ২০২১এর মে মাস পর্যন্ত কেরালায়, যেখানে উড়িষ্যায় ২০২১এর প্রথমার্ধে আগের বছরের তুলনায় ২৯% ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। ২০২০ সালে প্রতিদিন ৭৭টি ধর্ষণের ঘটনা ও ৮০টি খুন নথিভুক্ত করা হয়েছে। এন সি বি সি-র সাম্প্রতিক একটা রিপোর্টে জানা যাচ্ছে প্রতি ৩০ ঘন্টায় ভারতে একজন গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে যেখানে প্রতি ২ ঘন্টায় অন্তত একটি মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় আর প্রতি ৬ মিনিটে একটি মেয়েকে যৌনহেনস্থা করা হয়। আমেরিকার ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকের দেওয়া পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী ধর্ষণের ঘটনায় সারা পৃথিবীর মধ্যে আমেরিকা (৯১%) প্রথমে রয়েছে। ন্যাশানাল ভায়োলেন্স এগেনস্ট উইমেনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আমেরিকার প্রতি ৬জন মহিলার মধ্যে ১জন ধর্ষণের শিকার হয়। এই দেশে ১৪ বছর বয়স থেকেই ধর্ষণের প্রবণতা তৈরী হয় শিশু মননে। ধর্ষণের ঘটনায় সারা পৃথিবীর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বিতীয়, সুইডেন তৃতীয়, ভারত চতুর্থ স্থানে রয়েছে। এন সি বি সি-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ভারতের মধ্যে রাজস্থান ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনে শীর্ষে রয়েছে। এর পরেই রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা ও ছত্তিসগড় ক্রমান্বয়ে। সেই তুলনায় পরিসংখ্যানের একেবারে নিচের দিকে রয়েছে ক্রমান্বয়ে নাগাল্যান্ড, তামিলনাড়ু ও বিহার। ভারতের মেট্রোপলিটন শহরগুলোর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটবার ক্ষেত্রে দিল্লি রয়েছে সর্বোচ্চ স্থানে। ২০১৯ সালে সেখানে ১২৫৩টি ধর্ষণ হয়েছে। এবং সর্বোপরি কলকাতাকে সবচেয়ে নিরাপদ শহর হিসেবে মেয়েদের চলাফেরার ক্ষেত্রে চিহ্নিত করা হয়েছে। এন সি বি সি-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী (২০১২) ভারতে ধর্ষণের শিকার হওয়া ১০০ জনের মধ্যে ৯৮ জনই আত্মহত্যা করে। বলা বাহুল্য এগুলোর সবই নথিভুক্ত সরকারি তথ্য। সহৃদয়, সহমর্মী, বুদ্ধিমান পাঠক মাত্রেই জানেন সরকারি তথ্যের চাইতে বেসরকারি ও আসল তথ্য সবসময়ই অনেক বেশি হয়ে থাকে। তবু এই বিপুল পরিমাণ ধর্ষণ সংক্রান্ত তথ্যের অবতারণা কোনভাবেই পাঠককে ভারাক্রান্ত করার জন্য নয়। বরং এই তথ্য দিয়ে আমি পাঠককে এটাই বোঝাবার চেষ্টা করছি ধর্ষণের ভয়াবহতা ভারত এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতে কতখানি।
প্রায়শই আজকাল অনেককে বলতে শুনি ধর্ষণ মহামারীর আকার নিচ্ছে। কিন্তু তারা কেউই এটা বুঝে উঠতে পারেন না যে এর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে কী করে। ধর্ষণের মুখোমুখি যারা হন তাদের অসহায়তা তো অবর্ণনীয়, এমন কি বৃহত্তর জনসাধারণ যারা ধর্ষণের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয়, যারা শুধুমাত্র ধর্ষণের খবরগুলো শুনে আতঙ্কিত হন, তাদের সংখ্যাও বহুগুণ। এই বিপুল পরিমান জনগণের মানসিক স্বস্তি ও শান্তির বিষয়টাকে সত্যি কথা বলতে কি কখনই এড়িয়ে যাওয়া কোন দেশ বা জাতির পক্ষে, সর্বোপরি মানবজাতির পক্ষেও কল্যাণের হতে পারে না।
শুরুতে যে কথা বলছিলাম, যুদ্ধপ্রবণ হিটলার কীভাবে তাঁর নিজের প্রবণতাকে, চাওয়াপাওয়াকে সমগ্র জার্মান জাতির চাওয়াপাওয়া ও প্রবণতায় রূপান্তরিত করেছিলেন যার জন্য পরবর্তীকালে গোটা জার্মান জাতিটাকেই যুদ্ধপ্রবণ জার্মানি বলে উল্লেখ করা হত, সেই সময়ের কোন প্রসঙ্গ বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোন ঘটনার উল্লেখ করতে গিয়ে সেটা আমরা একটু চেষ্টা করলেই জানতে পারব। হিটলার যে কাজটা মানবজাতির পক্ষে নেতিবাচক একটা অধ্যায়ের রচনায় ব্যবহার করেছিলেন, আমরা কিন্তু আমাদের একটু সদিচ্ছা থাকলেই সেই একই পদ্ধতিকে বা সেটাকে একটু অদলবদল করে নিয়ে ধর্ষণের বিলুপ্তিকরণে প্রয়োগ করতে পারি। আমরা শিশু কিশোরদের শিক্ষাদানের পদ্ধতিটা
অনায়াসেই একটু রদবদল করে তাদের মানসিক গড়নটাকে বদলে ফেলতে পারি। এ বিষয়ে আমরা শিশু মনস্তাত্বিক ও অন্যান্য শিক্ষাবিদদের নিয়ে পরামর্শ কমিটি গড়ে
সেই অনুযায়ী একটা শিক্ষাপদ্ধতি তৈরী করে কঠোরভাবে সেটা প্রয়োগ করতে পারি। দেশের নাগরিকদের মধ্যে নানাভাবে প্রচার ও সচেতনতার প্রসার ঘটিয়ে কঠোরভাবে তা প্রয়োগ
করে তাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে পারি। আবার বাবা-মায়েদের শিশুসন্তানকে
শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতিরও একটা ট্রেনিংএর ব্যবস্থা করেও ধর্ষণ সংক্রান্ত পরিস্থিতিকে
একটু একটু করে আয়ত্বে আনতে পারি। কিন্তু সেই পারবার জন্য যে ইচ্ছেটা দরকার, সেই ইচ্ছেকে ততটা গুরুত্ব দেওয়া তো দূরের কথা, এই ধরনের ভাবনা চিন্তাকে ‘আঁতলামি’ বলে লেবেল এঁটে দিয়ে ব্যাঙ্গবিদ্রুপ করে বিষয়টাকে হেসে
উড়িয়ে দিই।
কোভিড নাইনটিন ওরফে করোনার সময় আমরা দেখেছি বিশ্বের নানা দেশ কীভাবে তাদের নাগরিকদের ওপর সতর্কবার্তা প্রয়োগ করে তা সবাইকে কঠোরভাবে মানতে বাধ্য করেছে আর নাগরিকরাও তা মেনে নিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। তাই চাইলে কিছু করা যায় না, এমন সুবিধেবাদী বা নৈরাশ্যবাদী ভাবনা চিন্তায় বিশ্বাস করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ সত্যিই আছে বলে আমি বিশ্বাস করছি না বা অন্যদেরও বিশ্বাস করার কোনও কারণ দেখছি না।
অনুমান করতে পারি, এই পর্যন্ত পড়ে পাঠক ভাবতে শুরু করেছেন ধর্ষণ ও তার বহুধা বিস্তৃত সমস্যাকে আমি বোধহয় তার সঠিক তাৎপর্য না বুঝে অতি সরলীকরণ করার চেষ্টায় নিয়োজিত হয়েছি। কিন্তু না, আমার সেরকম কোন অভিপ্রায় সত্যিই নেই। আমি শুধু এটুকু বলতে চাইছি যে কোন শাস্তি বা মৃত্যুদন্ড দিয়ে ধর্ষণের মত সমস্যার সমাধান করা আদৌ সম্ভব নয়। কেননা এর শেকড় আরও অনেক অনেক গভীরে। তাই সমাধান করতে চাইলে সেই গভীর থেকে উপরে ফেলতে হবে ধর্ষণের শেকড়। তা না হলে সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হতে বাধ্য। ধর্ষণের শেকড় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে জড়িয়ে আছে আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি-মননে। তাই তার সমাধানের জন্য আমাদের ঢুকতে হবে মানুষের মনের সেই অদৃশ্য ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহায়, দেখতে হবে নেড়েচেড়ে ধর্ষণের মত কারণের জটিল উপাদানগুলোকে, নির্মূল করতে হবে আগে একে একে সেই সমস্ত উপাদান গুলোকে, তারপর তার ওপরে নির্মাণ করতে হবে নতুন ভাবনা চিন্তার আলোকস্তম্ভগুলোকে। তা না হলে আমরা যে অন্ধতমসার তীরে দাঁড়িয়ে রয়েছি, সেইখানেই থেকে যাব। কাজের কাজ কিছুই হবে না।
পাঠক হয়ত বলবেন তাহলে আর আমি মিছিমিছি হিটলার আর করোনার প্রসঙ্গ তুললাম কেন? আর যদিও বা তুললামই, তা দিয়ে আদতে আমি কী বোঝাতে চেয়েছি। সেই কথাটাই এবার বলি খুব সংক্ষেপে, যেটা করতে গেলে হাজার হাজার আলোকবর্ষ অন্ধকার পেরোতে হবে। খুব ভালো করে দেখুন পাঠক, হিটলার তার কার্যসিদ্ধির জন্য গোটা দেশের আপামর জনসাধারণের মানসভূমিটাকেই পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন মাত্র চার বছরের মধ্যে, ঠিক যে ঘটনা ঘটেছিল করোনা মোকাবিলার সময়েও। মুখে মাস্ক পরা আর বাড়িতে বন্দি থাকা ছাড়াও নিজের জীবন্মৃত অথবা মৃত প্রিয়জনদেরও মানুষ কিভাবে দূর থেকে দেখেছে, কেঁদেছে, তবু একবারের জন্যও কাছে যাওয়ার মত পাগলামি করেনি। এই দুই ক্ষেত্রেই মানুষের মানসিকতাটাকেই পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যে। ধর্ষণের বিলুপ্তিকরনের বীজও লুকিয়ে আছে আসলে মাইন্ডসেট পরিবর্তনের মধ্যে।
এই পদ্ধতিটা আমাদের সমাজের সর্বোচ্চ শিখরে যে বা যারা বসে আছেন, তাদের পক্ষে প্রয়োগ করা যতটা সহজ, প্রজাসাধারণের পক্ষে প্রয়োগ করা ততটাই অসম্ভব। কিন্তু এই ছকভাঙা, প্রথা বিরোধী সিদ্ধান্ত-নির্মাণ ধর্ষণের মত একটা একটা বিরাট স্থানকালব্যাপী বিষয়ের ওপর প্রয়োগ করতে যে মেধা ও শৌর্যের দরকার, তেমনটা ইতিহাসেও সচরাচর দেখা যায়নি। আর এক্ষুনি আমরাও তেমন কাউকে পেয়ে যাব এমন ভাবনার আতিশয্যে ডুবে যাওয়াও নিরর্থক। তবু আশা রাখা যেতে পারে কোন একদিন তেমনটা হবেই। হয়ত তা আমরা আমাদের জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারব না। কিন্তু আমাদেরই কোন এক অনাগত প্রজন্মের কেউ এসে ভাবী কালের বুকে সে মশাল জ্বালাবেই – এ আমার দৃঢ প্রত্যয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন