কবিতার কালিমাটি ১২০ |
বৃক্ষ-নৃত্য
এক গোধূলি বেলায়
একটি বৃক্ষকে
নাচতে দেখেছিলাম
ঘাসের নূপুর
পায়ে অক্লান্ত নেচে যাচ্ছিল বৃক্ষটি,
তার নাকে নাকছাবি
হালকা গোলাপি রঙের পুষ্প-কুঁড়ির,
গোলাপি আভায়
বেগুনি রঙের ছোপ লাগা প্রস্ফুটিত পুষ্পের কর্ণাভরণ কানে,
মাথায় সবুজ
পাতার মুকুট;
বৃক্ষটির কুমারী
শরীর বেয়ে চূর্ণ চূর্ণ ঘাম ঝরে পড়ছিল
শুকনো পাতা
হয়ে, ফুলের পাপড়ি হয়ে,
হালকা হাওয়ায়
তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো দুলছিল নাগরদোলার মতো
বৃক্ষের অপরূপ
নৃত্যপর ভঙ্গিমার আবহে মেঘ হয়ে যেতে চেয়েছিল মন,
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
জলকণায় অভিষিক্ত করতে চেয়েছিল বৃক্ষটিকে,
তখনও গোধূলি
পুরোপুরি অতিক্রান্ত হয়নি,
একটি লালচে
আলোক-রেখা মিলিয়ে যেতে না যেতেই একটি অচেনা
পাখি উড়ে গেল
সেই আলোক-রেখা বরাবর;
সন্ধ্যার আবছায়ায়
নৃত্যপর বৃক্ষটিকে আর দেখা গেল না।
একটি টিকটিকির গল্প
ছাইরঙা মাকড়সার
জালের পাশে বাদামি রঙের টিকটিকিটিই
একমাত্র সঙ্গী
এই নির্জন ঘরে
পায়চারিরত দ্বাররক্ষীর
মতো মনে হয় টিকটিকিটিকে,
ঘরের দেয়াল
জুড়ে অস্থির ঘোরাঘুরি,
অনুসন্ধানী
চোখ যেন কাউকে খোঁজার দায় বহন করে চলেছে
বাইরে প্রচন্ড
শব্দে দরোজা-জানালা কাঁপিয়ে মেট্টো রেল চলে গেল
সে শব্দের রেশ
একটু একটু করে শেষ হয়ে যেতে না যেতেই
নৈশপ্রহরীর
বাঁশি বেজে ওঠে,
দুটি কুকুরের
ঘেউ ঘেউ ডাক শোনা যায়,
জ্যোৎস্নাপ্রপাত
ধুয়ে দিচ্ছে বহুতল ভবনগুলোর সুদৃশ্য প্রাচীর,
পৃথিবীর সাথে
সখ্য গড়ে তোলার জন্য যেন উদগ্রীব হয়ে আছে
আকাশের গায়ে
ঝুলে থাকা নক্ষত্রগুলো
এই বুনো রাত
জ্যোৎস্নাপ্রপাতের নান্দনিকতায় মিলেমিশে একাকার
হয়ে যেতে না
যেতেই টিকটিকিটি ডেকে ওঠে,
নিস্তব্ধতা
ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ঘরময়,
টিকটিকিটি নিস্তব্ধতার
ভাঙা টুকরোগুলোর ওপর
গড়িয়ে গড়িয়ে
হারিয়ে যেতে থাকে
হারিয়ে যেতে
যেতে বাদামি টিকটিকিটির অনুসন্ধানী
ঈষৎ নীলাভ চোখ
কাকে যেন খোঁজে!
শব্দের লুকোচুরি
সাড়া জাগানো
একটি উপন্যাস পাঠে নিমগ্ন ছিলাম
তার আগে দেখে
এসেছি গোধূলির আকাশে রঙের খেলা
সেই সাথে এক
ঝাঁক পায়রার ওড়াউড়ি গোধূলির আকাশকে
করে তুলেছিল
অনিন্দ্যসুন্দর;
পাঠে পুনরায়
মনঃসংযোগ করতেই বইয়ের পাতা থেকে হঠাৎ একটি শব্দ
লাফিয়ে উঠলো,
যেন রাজপুরিতে
সোনার-রুপোর কাঠি বদলে দিতেই ঘুমন্ত রাজকন্যার
ঘুম ভেঙে গেল
ঘরের মেঝেতে
নেমে শব্দটি অস্থির পায়চারি করলো,
একবার আমার
চেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়ালো কিছুক্ষণ
আবার ছুটে গেল
দেয়ালের কাছে মাথা উঁচু করে তাকালো যেখানে
স্থাপিত তিনটি
ছবি রবীন্দ্রনাথ নজরুল আর বঙ্গবন্ধুর,
একবার শোকেসের
ওপরে রাখা টেবিল ঘড়িটির কাছে গেল
হঠাৎ ঘড়ির পেছনে
গিয়ে অদৃশ্য হয়ে থাকলো কিছুক্ষণ
আবার বেরিয়ে
আসলো
দরোজার আড়ালে
গিয়ে লুকালো;
আবার বেরিয়ে
এসে জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকালো,
মনে হলো আমার
সাথে লুকোচুরি খেলছে শব্দটি
দেখছে আমি তাকে
খুঁজে পাই কিনা!
কেননা একটি
অসমাপ্ত কবিতার জন্য শব্দটি আমার প্রয়োজন।
বিরহী দুপুর
একাকী একটি
তালগাছের মতো টানটান শরীর নিয়ে
নিঃসঙ্গ দুপুর
দাঁড়িয়ে আছে সারা শহর জুড়ে,
জনমানবের চিহ্ন
নেই কোথাও
যেন করোনাকালের লকডাউন,
একটি কাক ডেকে
উঠলে
তার কর্কশ কণ্ঠ
ছাপিয়ে বিরহ-কাতরতা ছড়িয়ে পড়লো টিপটিপ বৃষ্টির মতো,
অনাহুত অতিথির
মতো ঘরে বাইরে দুপুরের প্রকট নির্জনতা
দেয়াল ঘড়ির
টিকটিক শব্দও গ্রাস করতে পারে না নীরবতাকে
স্বজনহীন পরিবেশে
মধ্যাহ্ন ভোজনের পর ঝুলো বারান্দায় দাঁড়ালে
রোদের উত্তাপ
ততটা অনুভূত হয় না,
আকাশের নীল
ক্যানভাসে সাদার কারুকাজ মনকে আচ্ছন্ন
করে রাখে কিছুক্ষণ
এভাবে কতক্ষণ
জানা নেই,
বিরহী দুপুর
তেমনই নির্বাক,
হঠাৎ মানবীয়
কণ্ঠস্বরে আড়মোড়া ভাঙে মন
তবে কি জনমানবের
চিহ্ন প্রস্ফুটিত হবে সকালের সদ্য ফোটা ফুলের মতো!
তবে কি ঘুচে
যাবে নিঃসঙ্গ দুপুরের বিরহ-বেদনা!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন