সমকালীন ছোটগল্প |
পঁচিশে বৈশাখ
অলিভিয়া দশ মিনিট আগে ফোন করে বলেছে, সে তৈরি, বাড়ি থেকে বেরিয়ে
যাবে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই। অনির্বাণের যদিও এত তাড়া নেই, সে খানিকটা বিরক্তও। পাঁচ
মিনিট অলরেডি কেটে গেছে। এই মাসের টিউশনের যে টাকাটা পেয়েছিল, তার মধ্যে প্রায় একহাজার
আজ খরচ হয়ে যাবে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উপলক্ষে। অনির্বাণ গরিব নয়। শখের বসে ছাত্র
পড়ায়, নিজের রোজগারে কিছু টাকা পয়সা হাতে এলে মনটা ভালো থাকে। একটু ভেসে বেড়ানো যায়।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে রেস্টুরেন্টে গিয়ে কেন খেতে হবে, সেটা অনির্বাণ বুঝতে
পারছে না। ছোটবেলা, বড়োবেলা, সব বেলাতেই সে দেখে আসছে এইদিনে লোকজন প্রভাতফেরি, নাচ,
গান, কবিতা, আলোচনা ইত্যাদি করে। তারপর চা-বিস্কুট, মিষ্টি, নিমকি এইসবই সাধারণত খাওয়া হয়। কিন্তু ইদানীং পঁচিশে
বৈশাখে রেস্টুরেন্টগুলো আবার বিশেষ বিশেয পদ
রান্না করছে খাওয়া দাওয়ার জন্য, বেশ পুজো পুজো ভাব।
তবে অলিভিয়ার মন রাখাটাও দরকার। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ যখন এত
ভালোবাসার গান লিখে গেছেন, সেখানে আজকের দিনে গার্লফ্রেন্ডকে দুঃখ দেওয়া কোনো কাজের
কথা নয়। একবার অনির্বাণের মনে হলো পাঞ্জাবি
পরে, তারপর কী মনে করে জিনস আর টি শার্টই পরল। মোটামুটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দেখল অলিভিয়া রাবীন্দ্রিক
সাজে দাঁড়ানো। খয়েরি টিপ, সাদা শাড়ি, নীল ব্লাউজ, বেলফুলের মালা, যেন আর কিছুক্ষণ পরেই
অলিভিয়ার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হবে।
অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল অলিভিয়া। ঢুকতে হবে না এখানে।
চলো অন্য কোথাও যাবো।
মানে এখানেই তো আসার কথা বলেছিলে?
বলেছিলাম। রেস্টুরেন্ট না বললে তুমি তাড়াতাড়ি আসতে না তাই। ভয়
পেয়ো না লাড্ডু, চলো একটু ঘুরব এদিক, ওদিক।
অলিভিয়া প্লিজ আর যাই হোক তুমি আমাকে লাড্ডু বলো না। পৃথিবীতে
এত এত নাম থাকতে এমন একটি মারোয়ারি ঘেঁষা নামে আমাকে কেন ডাকো বলো তো?
তুমি তো মহা সাম্প্রদায়িক দেখছি! আর লাড্ডুর ভুল ইন্টারপ্রিটেশন
মোটেই দেবে না।
লাড্ডু হলো বাঙালির ট্র্যাডিশন। যুগ যুগ ধরে আসছে মুড়ির লাড্ডু,
চিড়ার লাড্ডু, নাড়কেলের লাড্ডু এইসব।
না তো। ওটাকে নাড়ু বলে, নাড়কেলের নাড়ু, লাড্ডু নয়।
তাহলে তোমার নাড়ু নামটা বিশেষ পছন্দ। ও কে, নাড়ু বলি তাহলে।
অলি প্লিজ, ঠাট্টা আমার ভালো লাগছে না।
এতই যদি বিরক্ত, না এলেই পারতে। চলেও যেতে পারো। আমি এতো সিরিয়াস
ছেলেদের পছন্দ করি না!
সে বিষয়ে পরে চিন্তা করব! তুমি ডেকেছো, আমি এসেছি, তিনঘন্টা থেকে সাড়ে তিনঘন্টা
থাকব।
অলিভিয়া চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, আসলে তোমার কোনো কাজ নেই, এটাকে
বলে নকল ঘ্যাম।
অলিভিয়া খুব সুন্দর গান গায়, অনির্বাণ ওর গানের ভক্ত থেকে ধীরে ধীরে বিশেষ বন্ধুতে কর্নভাট
হচ্ছে, তাই খুব বেশি রূঢ় হতে পারে না, কোথাও অমোঘ কোনো সূত্র রয়েছে, সেটার ফাঁদে পড়ে
গেছে দুজনেই। তাই অনির্বাণের গলা থেকে ঝাঁঝ চলে গেলো।
চলো তাহলে, ঠিক
করে জায়গাটির নাম বলবে!
একটু এদিক ওদিক ঘুরবো
আর কি।
এদিক, ওদিক মানে? অনির্বাণ ঢোঁক গিলল।
শহরের যে কোন জায়গায় আজ দাদা অথবা দাদার বন্ধু বান্ধবীদের সঙ্গে
দেখা হয়ে যেতে পারে। তাহলেই কেল্লা ফতে, ইনভেস্টিগেসন আর খিল্লি হবে। সঙ্গে সঙ্গে পিসতুতো
মাসতুতো ভাইবোনদের মধ্যে ফোনাফুনি। অনির্বাণ মনে করেছিল এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে
তারপর চলে যাবে। হলো না। অলিভিয়ার জেদ খুব দীর্ঘমেয়াদী এবং দৃঢ়। তাই তর্ক-বিতর্কে
না যাওয়াই ভালো।
কোথায় যাবে বলো?
মোট তিনটে বাড়িতে যাবো।
বাড়ি? সর্বনাশ! কার বাড়ি? আমি কারো বাড়িতে টাড়িতে যাবো না, আমাকে
তাহলে ছেড়ে দাও আজ।
ছাড়ার প্রশ্নই নেই। তিনটে বাড়িতেই তোমাকে যেতে হবে। আমি যেদিক
দিয়ে বলব সেই রাস্তা দিয়ে যাবে।
অলিভিয়ার হাতে একটি সুদৃশ্য ঝোলাব্যাগও আছে। ব্যাগে কী আছে অবশ্য
বোঝা যাচ্ছে না, চেইন লাগানো। ভেতরটা ফোলামতো হয়ে আছে।
অলিভিয়া অনির্বাণের বাইকে উঠে বসল। অলিভিয়া বলছে, অনির্বাণ চালাচ্ছে। মেইন রোড থেকে নেমে গলি রাস্তা দিয়ে চলেছে বাইক। যাক, অলিভিয়া ঠাট্টা করছিলো তাহলে। মেইন রোডেই ভয় বেশি।
বেশি দূর যেতে হলো না, শহরের ভেতর এ আর এক শহর, পুরনো ঘরদুয়ার। আদি বাসিন্দাদের বসবাস। প্রায় জরাজীর্ণ একটি বাড়ির সামনে অলিভিয়া বাইক থামাতে
বলল। গেটের সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছ। গেট সহজেই খুলে ফেলল অলিভিয়া, নামেই গেট। বাড়িটির
অবস্থা খারাপ হলেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বারান্দায় এক বৃদ্ধা বসে আছেন। অনির্বাণ দেখলো
চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠলেও ভদ্রমহিলা কিছু বললেন না মুখে। অলিভিয়া অনির্বাণকে ইশারা
করলো, মানে চলে এসো।
ঘরে পাটি পাতা। একপাশে তবলা, হারমোনিয়ম, দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের বাঁধানো ফটো। যা পুরো বাড়িটির
সঙ্গে বেমানান। কারণ ছবিটি পুরনো কিন্তু জরাজীর্ণ নয়। খুব ভালো কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো
রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ছবিগুলোর একটি।
ওরা বসতে না বসতেই ভেতর থেকে আরোও একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন।
দুজন মহিলা কাছাকাছি বয়সের হবেন, একজন সামান্য বেশি। অলিভিয়া
হাসল। ওরাও হাসল।
এত নীরবতা অনির্বাণের অসহ্য লাগছিল। পঁচিশে বৈশাখ এত শব্দহীন হলে
ভালো লাগে না।
পল্লবী, আয় তো এদিকে। অলিভিয়ার চোখ অনুসরণ করে অনির্বাণ দেখলো
ফ্রক পরা একটি মেয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে, হাতে প্লাস্টিকের ডিশে কিছু গন্ধরাজ আর টগর ফুল।
পল্লবী পাটির মাঝখানে প্লেটটি রাখল। একজন ভদ্রমহিলা হারমোনিয়মটিও এনে সেখানে
রাখল।
আর দেরি নয় তাহলে শুরু করি। এরা দুজন ঘাড় নাড়ল।
জিন্সের প্যান্ট পরে খুব কষ্ট করে অনির্বাণ আসন পিঁড়ি হয়ে বসেছে, পরিবেশটা ঝিম ধরে আছে। পল্লবী নামের মেয়েটি আর ঐ দুজন মহিলা পাশাপাশি বসেছে।
অলিভিয়া গাইতে আরম্ভ করলো। অলিভিয়ার কন্ঠ আশ্চর্য সুন্দর। এই
গানই তাদের দুজনের মধ্যে সুরের সেতু তৈরি করেছে, তাই রোদের ঝলকানিতে
কখনো সেই সেতুকে চোখে না দেখলেও কেমন করে যেন আবার নিজের উপস্থিতির জোরালো জানান দেয়।
অলিভিয়া গাইছে, "আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার / পরানসখা বন্ধু
হে আমার॥ / আকাশ
কাঁদে হতাশ-সম, নাই যে ঘুম নয়নে মম--/
তন্ময় হয়ে গাইছে, অনির্বাণের আর বিরক্ত লাগছে না। আজকের সময় তো সে
অলিভিয়ার জন্যই বরাদ্দ রেখেছিলো।
বাকি দুজন ভদ্রমহিলার দু চোখ দিয়ে জল পড়ছে। যেন তারা প্রবলভাবে
গাইছেন, শুধু মুখ দিয়ে আওয়াজ আসছে না। পল্লবীর
চোখে হাসির প্রতিচ্ছবি।
“তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ / ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া /
বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক'/ ওগো দুখজাগানিয়া॥"
এই গানটি গাওয়ার পর অলিভিয়ার হাবভাবে মনে হলো সে এখন উঠবে। তার ঝোলাব্যাগ থেকে এবার একটি বড়ো টিফিনবক্স বেরুলো।
এতে তোমাদের জন্য পায়েস আছে, খেও কিন্তু। আবার আসব খুব তাড়াতাড়ি। আসি এখন।
দরজায় দাঁড়িয়ে বিদায় দিলো ওরা তিনজন। অনির্বাণ বাইকে উঠতে উঠতে
একটা কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিলো।
তার আগেই অলিভিয়া বলল, তিন প্রজন্মকে দেখলে, দুজন খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত
শিল্পী ছিলেন, একজনের কন্ঠ জীবন থেকে পাওয়া শোকে বন্ধ হয়ে গেছে সবসময়ের জন্য, চেষ্টা
করলেও সুর বেরোয় না, অপরজনের কন্ঠনালীতে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছিল, কেটে বাদ দিতে হয়েছে।
পল্লবী জন্ম থেকেই মানসিক প্রতিবন্ধী, বোবা নয়, কিন্তু কথা বলতে চায় না। ওর চিকিৎসা
চলছে, আমরা কয়েকজন চেষ্টা করছি সুরে সুরে যদি ওকে কখনো জাগানো যায়, তাই আমাদের গানের
দলের কেউ না কেউ প্রত্যেকদিন এখানে গান গাই, রোজই পঁচিশে বৈশাখ, বলতে পারো। অনির্বাণের
মনে পড়ল কিছুদিন
আগে অলিভিয়া বলেছিল ওরা একটি গানের দল তৈরি
করেছে, যাদের কাজ দুঃখী আর একা মানুষদের বাড়িতে গিয়ে গান শোনানো। আরো কী কী বলতে চাইছিল, তবে অনির্বাণের এসব খুব আজগুবি
কথাবার্তা মনে হয়েছিল, তাই শুনতে চায়নি। অনির্বাণের
অনাগ্রহ দেখে অলিভিয়া চুপও করে গিয়েছিল।
তবে এবার যেখানে যাবো, সেখানে এত নীরবতা নেই। বলতে পারো খুবই সরব, অলিভিয়া বলল।
এখন অনির্বাণের আর বিরক্ত লাগছে না। কারণ বিরক্ত লেগে লাভ নেই।
এই শোনো, যেখানে যাচ্ছি, ওটা একটা ব্যক্তিগত অনাথ আশ্রম। মৃন্ময়দা
খুলেছে।
গতবছর মৃন্ময়দার মা বাবা দুজনেই করোনায় মারা গেলে ও বীভৎস রকমভাবে একা হয়ে যায়। মৃন্ময়দাকে
তো চেনো তুমি। খুব ভালো গান করে। রবীন্দ্রনাথের গান ওর প্রাণ। সেই মৃন্ময়দা গানটান ছেড়ে দিয়ে প্রায়
পাগলের মতো হয়ে গেলো। স্কুলের চাকরিটাও ছাড়ে ছাড়ে ভাব, সেইসময় আবির্ভূত হলো পটলা। এখন
অবশ্য আর পটলা নাম নেই। নাম হয়েছে ধ্রুব। বাজারে সব্জি বিক্রি করত, এই বয়সেই নেশা করাও
শুরু করেছিল, মা বাবা যে যার তালে কেটে পড়েছে। ওকে ধরে আনল মৃন্ময়দা। শুরু হলো ট্রেনিং।
তারপর গুলাই, রাব্বি এরকম করে করে এখন মৃন্ময়দার পাঁচজনের টিম।
এই তো এসে গেছি।
অনির্বাণ বুঝল সত্যিই এসে গেছে। কারণ বাড়িটির খোলা বারান্দা রাস্তা
থেকে দেখা যাচ্ছে। পতাকা দিয়ে সাজানো। মাইক বাজছে। তবে মাইকে নজরুলগীতি।
বুঝলে না, মৃন্ময়দা রবিদাকে নজরুলগীতি শোনাচ্ছেন। মৃন্ময়দা এসব
করে।
এখানে দেড় ঘন্টা কাটল। একদম ওরিজিনাল রবীন্দ্র জয়ন্তী। কেউ কেউ
মাঝপথে কবিতা ভুলে গেলো, বাকিটা সবাই শুধরে দিল, কেউ ভুল ভাল সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইল।
সব শেষে মৃন্ময়দা আর অলিভিয়া গাইল-
"হে নূতন / দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ / তোমার প্রকাশ হোক
কুহেলিকা করি উদঘাটন /
অলিভিয়ার পায়েস ভর্তি দ্বিতীয় টিফিবাক্স বেরুলো, হইহই করে পায়েস
খাওয়া হলো।
এবার কোথায় যেতে হবে বলো?
তুমি ভূত ভয় পাও?
কোথায় যাওয়া হবে শুনি? না আজ আর ঘাবড়াচ্ছি না।
ধমকাবে না তো?
না তো! ধমকে আর কী করব?
শ্মশানে যাবো।
মানে?
মানে হলো, শ্মশানের পাশে আমার পরিচিত ডোম আর ডোমের বউ থাকে। ওদের
ঘরে যাবো। ভয় পেয়ো না, শুধু দুটো গান শোনাবো ওখানে। আর পায়েস দেবো। ওদের বাড়িতে কেউ
কখনো যায় না। ডোমের বউটি একদিন আমাকে দুঃখ করে বলেছিল।
কিন্তু ওর সঙ্গে পরিচয় হলো কি করে।
পেনডেমিক পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। সে অনেক কথা। তুমি যাবে কি না বলো?
না হলেও অসুবিধে নেই। এখান থেকে তো বেশি দূরে নয়। আমি হেঁটে চলে যাবো। ওর নাম মল্লিকা।
আমি ডাকি মল্লিকামাসী। মল্লিকামাসী আমাকে আসার
সময় এগিয়ে দেবে, তারপর টমটমে তুলে দেবে। সবে তো সন্ধ্যা রাত।
চলো। অনির্বাণ গম্ভীর কন্ঠে বলল। অলিভিয়ার একটু মজা করতে ইচ্ছে করছিল, তবুও করল না,
রেগেমেগে আবার কথা শোনাবে।
রাতের আকাশের আবছা আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। নক্ষত্রের রাত। বাড়িঘর কমে এসেছে, এখন মাঠ আর মহাশূন্যের দিকে যাওয়া এক একা শুনশান রাস্তা ।
নাহ পুরোপুরি শ্মশানে যেতে হলো না। ডোম পরিবার একটু বাইরের দিকেই
থাকে।
উঠোনে বাল্ব জ্বলছে।
অনির্বাণের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। এই বাড়িতে ঢুকতে তার মোটেও ইচ্ছে
করছে না। যেন মৃত্যুগন্ধ ছড়িয়ে আছে।
ও কে। তাহলে তুমি দাঁড়াও বাইরে। আমার কুড়ি পঁচিশ মিনিট লাগবে।
চা খাবো আর তেলেভাজা।
চা টা না খেলেই নয় অলি?
না নয়। কারণ মল্লিকামাসী বলেছে চা খেতে। তেলেভাজা
রেডি করা আছে, চুলায় কড়াই বসানো আছে। আমি গেলেই ভাজবে। গরম গরম খাওয়াবে। মল্লিকামাসীর প্রিয় দুটো গান আমাকে বলেছিল
ওদের ওখানে বসে শোনাতে।
"ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে/
আর
"আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে"
তারপর খাওয়া দাওয়া হবে, ব্যস্। পারবে তো দাঁড়াতে?
অনির্বাণ অবাক হয়ে দেখছে, কী অবলীলায় অলিভিয়া এসব বলছে! ধ্যুস।
তার চাইতে ভেতরে যাওয়াই ভালো। তবে চা খাবে
না। ইচ্ছে হচ্ছে না।
সবকিছু নিঁখুতভাবে শেষ করল অলিভিয়া। মল্লিকামাসী আর ওনার স্বামী, তিনজন ছেলেমেয়ে সবাই মিলে গান শুনল। খালি গলায় অলিভিয়া প্রাণ ঢেলে গাইল। শ্মশানের প্রান্তে এসে ভালোবাসার গান যে এত সুন্দর লাগে, তা এখানে না এলে সত্যিই জানত না অনির্বাণ।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে নটা। অলিভিয়াকে ওর বাড়ির সামনে নামিয়ে
দিলো অনির্বাণ।
নিজে বাড়ি এসে পরিষ্কার হয়ে হয়ে স্নান করলো । নাহ্ অলিভিয়ার এসব
আচরণে সে মোটেও গদগদ হয়ে যায়নি।
উচ্চবিত্ত মেয়েদের রঙিন শখ। কদিনেই উড়ে যাবে। লোক দেখানোর জন্য
সেই রবীন্দ্রনাথকেই বেছেছে। ঢঙ হচ্ছে। মানুষ
যেন আজকাল গান শুনতে পায় না! ইউটিউবেই তো সবাই শোনে। এত সব উদ্ভট খেয়ালি মেয়েকে নিয়ে আর বেশিদূর এগুনো
ঠিক নয়। স্ট্রং ডিসিশন নিতে হবে।
টেবিলের ওপর পার্সটার দিকে চোখ পড়ল হঠাৎ। কড়কড়ে পাঁচশ টাকার দুটো
নোট দাঁত বের করে হাসছে অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে।
ঝকঝকে দাঁত, খুব ধারালো। তাই হাসিটা বড্ড নিষ্ঠুর লাগছে। অনেকটা তার
মতো, সে কী তবে নিষ্ঠুর? ঠিক কী কী চিন্তা করলে একজন মানুষকে নিষ্ঠুর বলা যায়? এবারের
পঁচিশে বৈশাখে সবকিছু যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে অনির্বাণের, মনে হচ্ছে পৃথিবীর ভেতরেও
আরো একটা গভীর পৃথিবী আছে যেখানে কোনোকিছুই অসম্ভব নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন