কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১০ |
ভাকুয়া চালচিত্র
যেমন যেমন রোজগার বেড়েছে, দাড়িতে দু’একটা চুলে পাক ধরতে শুরু হয়েছে, বিছানায় স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ফারাকটায় দুটো প্রাণী এসেছে। আমিও সংসার জীইয়ে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে গেছি। তারপর বহুদিন গত হয়েছে। শহরের কায়াপলট হয়েছে, ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে ছুরি শানানোর শব্দ পেটোর নিঃশব্দ আতংক দীর্ঘশ্বাস আর নেইই বললেই চলে। কিন্তু সেসময়ের কথা আমার স্মৃতিপটে তাজা হয়ে আছে, এক্ষুনি যদি সেটা সিনেমায় বা থিয়েটারমঞ্চে দেখানো যায় তো টিকিটের জন্যে খুন খারাবি হতে পারে, এতই হট। সেই সময়টা হলো মাফিয়া সময়। কালো ধুঁয়োয় আচ্ছন্ন ধানবাদের গয়াব্রীজ। ওপর দিয়ে ভারী মালবাহী গুডস ট্রেন যেত, রটরট কটকট শব্দে দুলতো লাইন। নীচ দিয়ে হেঁটে পেরনো কষ্টের ছিল। এবড়ো খেবড়ো কালোজল জমে থাকা। সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে ব্যস্ত ট্রাফিক। এই সুড়ঙ্গ দিয়েই সাইকেল চালিয়ে আমার অফিস ডিউটি। মাঝেমধ্যেই গয়াপুলের নিচ দিয়ে পার হতে দেখেছি কালো ভেজা মাটিতে রক্তের দাগ। গা সওয়া ছিল। গয়াব্রীজ দিয়ে অফিস ফেরার পথে সাইকেল থেকে নেমে পড়তে হতো। পুল থেকেই রাস্তা ঢিবির মত উঁচু হয়ে স্টেশনের দিকে মোড় নিত। ওই চড়াইতে সাইকেল ঠেলা কষ্টকর। আগে আগে শরীরে শক্তি ছিল, প্রাণপণে চালিয়ে উতরে যেতাম। একদিন আমার ফিরতে খুব দেরি হয়েছিল। ওই সময় কয়লামাফিয়া লোহাচোর লুটেরার গয়াপুলের নিচে অবাধ বিচরণ। রোজ মার্ডার ছিনতাই। আমি স্পীডে সাইকেল চালিয়ে পার হচ্ছিলাম, এমন আধোঅন্ধকার সময়ে ঝকঝকে সাদা এম্বেসেডর আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। আমি বাঁদিক ঘেঁষেই চালাচ্ছিলাম, তাই প্রতিবাদ মুখ থেকে বেরিয়ে এল। গাড়িটা মাঝরাস্তা জুড়ে থেমে গেল। যে বেরলো তার হাতে লোহার রড। মুখ থেকে গালির খই ফুটতে লাগল, ‘কা বে কা? জানত নইখে ই কেকরা কে গাড়ি? তেরি মা কা... তেরি বহিনকে...। শুধু গালি নয় মেরে মুখ ফাটিয়ে দিয়েছিল। পড়েই ছিলাম অনেকক্ষণ।
কোনোমতে উঠে ভাঙ্গা সাইকেল ঠেলে মেসে ফিরলাম। মেসে তখন আড্ডা জমে গেছিল। সবাই শুনল কথাটা। ‘আরে! তোর এস ডি সিংএর গাড়ির সাথে টক্কর? তুই খুব লাকি। আয় বোস। দু’টান মার, দেখবি জ্বালা যন্ত্রণা কমে গেছে’। ঘর তখন গাঁজার ধোঁয়ায় আঁধার। ব্যথায় রাতভর ছটফট করেছি। মুখ ফুলে ঢোল। এতটাই কেটে গেছে যে হাসপাতালে ওরা সকাল সকাল নিয়ে গেছে। সেখানে দেখি স্টাফ ইউনিয়ন সেক্রেটারি ধাঁই সিং হাজির। তিনি অফিসে মাসে দুমাসে যান। অনেক ব্যবসার সাথে কয়লাব্যবসা ছিল। হাজিরা খাতায় বকলমে অন্য কেউ সাইন করত। গত কুড়ি বছর ধরে অপ্রতিরোধ্য স্বনির্বাচিত সেক্রেটারি ছিলেন। বেডে আমার কাছে এসে উনি বিশাল থাবা দিয়ে বুক থাবড়ে দিয়ে বললেন, ‘আরে তেরা ভাগ (ভাগ্য) আচ্ছা হ্যায় রে! অভিসে তেরা জান কো সিকিউরিটি মিল গয়া’। ওনার কথায় সবাই হাততালি আমাকে সাবাশি দিতে লাগল। উনি বললেন, ‘আরে অব সে তেরা কোই বাল ভি বাঁকা নহি করেগা। তেরা পহচান হো গয়া’।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন