সমকালীন ছোটগল্প |
মোমের আলো
(১)
এখন
আবার কে বেল বাজাচ্ছে! এই অসময়ে কে এলো? তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে দরজা খুলতেই দেখেছিলাম
ওকে। সেই প্রথম আলাপ। আজ প্রায় মাস চারেক পর আবার ওকে দেখলাম।
-আরে
মোম যে! এসো এসো, ভেতরে এসো!
-আমি
এখানেই ঠিক আছি। বড্ড জল তেষ্টা পেয়েছে, জলের বোতলটাও খালি হয়ে গেছে, একটু জল দেবে
বৌদি?
-জল
তো নিশ্চয়ই খাবে। আগে ভেতরে এসে বসো তো! বৌদি কি পর হয়ে গেল মোম?
মোম,
ওর ডাকনামেই ওকে চিনি বেশি। যদিও একটা ভালো নাম রয়েছে ওর, কেয়া। প্রসূনের সঙ্গে যেদিন
প্রথম এসেছিল, ওকে দেখেই বড় মায়া হয়েছিল। মাথায় সিঁদুর, কপালে লাল টিপ, কোলে দুধের
শিশুটিকে নিয়ে ভয়ে জড়েসড়ো। লাল সাদা ছাপাশাড়ি, হাত খোঁপা, গলায় জুঁইয়ের মালাটি না
থাকলে আর সিঁথির সিঁদুরের আধিক্যটি না থাকলে
বোঝার উপায় ছিল না ওরা সদ্য বিবাহিত!
-বৌদি,
বড় বিপদে পড়ে তোমার কাছে এসেছি। আজ রাতটা থাকতে দেবে? কাল সকালেই চলে যাব।
সেদিন
ওদের ফিরিয়ে দিতে পারিনি। আমার স্বামী, ছেলে তারাও ওদের আশ্রয় দেওয়ায় আপত্তি করেনি
সেদিন। আসলে প্রসূনকে তো আমরা সবাই বড় ভালোবাসতাম। প্রায় সাতবছর ধরে আমাদের হোটেলে
সে কাজ করার সুবাদে ও তো ঘরের ছেলের মতোই হয়ে গিয়েছিল।
-এই
নাও, খাও দেখি!
-একি,
এতসব কেন? আমি তো একটু জল…
-চুপ,
বড় বৌদির মুখের ওপর এত কথা বলে না।
আমার
দিকে ও তাকাতেই, মনে হলো ওর চোখদুটো অল্প ছলছল করছে!
আসলে
ভালোবাসার ছোঁয়া, আন্তরিকতার এই কপট শাসনে মানুষের মন ভিজে যায়, আর বিশেষ করে সেইসব
মানুষদের, যারা সারাজীবনে শুধু আঘাত পেয়েছে।
-তারপর,
গুবলু কেমন আছে? কথা বলতে শিখল?
-হ্যাঁ,
অল্প অল্প।
আমার
চোখ আটকে গেল মোমের খালি সিঁথিতে। তাহলে কি মেয়েটা সব জেনে গেছে? ওকে জিজ্ঞেস করাটা
কি ঠিক হবে?
মোমকে
দেখলেই আমার নিজেকে বড় অপরাধী বলে মনে হয়! যদিও আমার কিছু করার ছিল না, তবুও ওকে তো
সত্যিটা বলার সাহসও হয়নি কখনও। এই যে একটা মানুষের কাছে সত্য গোপন করেছিলাম, সে তো
অপরাধই ছিল! কিন্তু আমি তো পারিনি, ওকে বলতে পারিনি যে প্রসূন আর ফিরবে না!
(২)
মোমকে
আমি যখন চোখে দেখিনি, যখন ও করাতিপাড়ায় থাকত, যখন ও রতন রাজমিস্ত্রীর বউ ছিল, তখন
থেকেই ওর গল্প শুনতাম। মেয়েটাকে না চিনেও ওর প্রতি বড় মায়া হতো। আহা রে, কতই বা বয়স,
মা মরা মেয়েটা বাপের কাছে এতটুকুও আদর পায়নি নাকি, বিয়ের পরও শান্তি জোটেনি ওর পোড়া
কপালে।
-মেয়েটার
কী দোষ বলো বৌদি? রোজ রোজ এত অত্যাচার সহ্য করেও তো ঘর করত মেয়েটা!
-বরটা
ছেড়ে চলে গেল? কী বলছিস রে!
-হ্যাঁ
গো। সে আবার বিয়ে করেছে, জানো।
-মেয়েটা
প্রেগনেন্ট ছিল না?
-হুম।
সাত মাসের পোয়াতি! কী ছিল আর কী হয়ে গেছে! আজকাল ওর দিকে তাকানো যায় না গো!
-হ্যাঁ
রে প্রসূন, তুই কি মেয়েটাকে… কী রে, প্রেমে পড়েছিস নাকি?
-ধুর,
কী যে বলো বৌদি!
-সারাদিন
তো ওই মেয়েরই গল্প বলিস, কি জানি বাবা, দেখিস কোনো ঝামেলায় জড়াস না যেন!
প্রসূন
তবু জড়িয়েই পড়ল। আমার তো অন্তত তাই মনে হতো। ছেলেটা মোমকে ভালোই বাসতো, কবে থেকে
যে ও মোমকে মনে মনে চাইত, তা যদিও জানা হয়নি। আসলে দুজন একই পাড়ায় তো বেড়ে উঠেছিল,
প্রসূন ছোট থেকেই মোমকে চিনত, জানত, হয়ত মনে মনে চাইত। তারপর যা হয়, মোমের বাবা মেয়ের
বিয়ে দিয়ে দিল রতন রাজমিস্ত্রীর সঙ্গে। আমার আজও মনে আছে, মোমের বিয়ে হওয়ার পর প্রসূনকে
বড় অস্থির লাগত।
-মোমের
বাপটা একটা পিশাচ। জানো বৌদি, ওই রতন মিস্ত্রী একটা পাঁড় মাতাল, একটা লম্পট। সবটা
জেনেও ওর হাতে মেয়েকে ছাড়ল? নিশ্চয়ই টাকা নিয়েছে বুড়ো।
-মোমের
বিয়ে হয়ে গেল বুঝি?
-হুম।
-তোর
মন খারাপ নাকি? কিরে? তুই কি ওকে বিয়ে টিয়ে করার মতলবে ছিলি?
-আরে
না না। তবে মেয়েটার আরও ভালো বিয়ে হতে পারত জানো। বড় ভালো মেয়ে! যেমন দেখতে, তেমন
স্বভাব। পাড়ার কত ছেলেরই তো ওর দিকে নজর ছিল। ও কিন্তু কারুর সঙ্গে মিশতো না।
-তোর
সঙ্গেও না?
-তুমি
যে কী বলো না বৌদি! আমি কি কখনও কথা বলতে গেছি নাকি?
-সেকি
রে?
এমন
কত গল্পই প্রসূনের কাছে শুনতাম। মোমের কথা বলার সময় ছেলেটার চোখ মুখ বদলে যেত। আমার
তো কতবারই মনে হতো, ও মোমকে মনে মনে হয়ত… অবশ্য সেকথা ও কখনও স্বীকার করত না। তারপর
একদিন দুধের শিশুকে নিয়ে মোম আর প্রসূন আমাদের বাড়ির দরজায়!
-কী
রে, তোরা কি বিয়ে করেছিস নাকি?
-উপায়
ছিল না বৌদি। বিশ্বাস করো, মোমকে আমি সত্যি খুব ভালোবাসি। ওকে এভাবে রোজ রোজ…
-তোর
বাড়িতে জানে?
-জানি
না। হয়তো এতক্ষণে…
-কোথায়
বিয়ে করলি?
-মন্দিরে।
কেউ ছিল না, আমিই জোর করে ওকে নিয়ে গিয়ে সিঁদুর পরিয়েছি।
-কী
করেছিস এসব? প্রসূন, একে কেউ বিয়ে বলে মানবে?
সমাজের
চোখে এটা যে কোনও বিয়েই ছিল না তা জেনেও ওরা ঘর বেঁধেছিল। সবার আড়ালে, পালিয়ে, মোম
আর প্রসূন, ওই ছোট্ট গুবলুকে নিয়ে কটা মাস বেশ ছিল।
(৩)
আমাদের
বাড়ির কাছাকাছি ওরা একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করে। বাড়ি বলতে একটা ঘর। পাশাপাশি
আরও বেশ কিছু ঘরে অন্য সব ভাড়াটে, সকলের কৌতুহলের দৃষ্টি ছিল ওদের ওপর, বলা ভালো,
বাঁকা নজর, যেন একটা বিচারসভায় কাঠগড়ায় দাঁড়ানো দুই আসামী। বিশেষ করে বাচ্চার আসল
বাবা কে, এই নিয়ে রোজ রীতিমত প্রতিবেশীদের বেশ একটা গোল টেবিল বৈঠক বসত নাকি। সেসব
কথার কিছু আমার কানে পৌঁছোত রমেনের মায়ের কাছ থেকে। রমেনের মা, আমাদের বাড়ির পুরোনো
কাজের লোক। প্রসূনকে আগে থেকেই সে চিনত। রমেনের মা যদিও ওদের ওখানে থাকার ব্যবস্থাটি
করে দেয়, তবে সেও ওদেরনিয়ে যে বেশ অসন্তুষ্ট তা আবেভাবে বুঝিয়ে ছাড়ত। কারণটা সহজ,
রমেনের মা সবটাই জানত। মোমের কোলের শিশুটির জন্মদাতা পিতা যে প্রসূন নয়, এ খবর তাই
চাপা থাকার কথাও ছিল না।
-যাই
বলো বৌদি, ছেলেটা এটা কি ঠিক করল? বলি, আর মেয়ে পেলি না? কার না কার ছেলে নিয়ে আদিখ্যেতা!
-এমন
কেন বলছ? বাচ্চাটার কী দোষ! তাছাড়া প্রসূনকে কেউ জোর করেনি।
-জানি
জানি। জোর কেন করবে? রূপ দেখিয়ে ফাঁসিয়েছে!
-এসব
কী বাজে কথা বলছ? থামো তো। না জেনে শুনে…
-তুমি
তো আর থাকো না ওখানে। আমরা থাকি। দুজনের যা কান্ড দেখি…
ন্যাকামো
দেখলে গা জ্বলে যায়! কী পিরিত, বাব্বা!
আমি
বুঝতাম, এমন বিয়ে সহজে কেউই হজম করতে পারে না। তাই সদ্য বিয়ে হওয়া দুজন মানুষের স্বাভাবিক
খুনসুটি, আহ্লাদ, টান লোকের চোখে বড্ড লাগে! তবে বিয়ের পর প্রথম প্রথম প্রসূন বড় খুশি
থাকত। কাজে মন কম, ছটফট করত কখন ছুটি হবে! নতুন বিয়ে, মোম ঘরে ওর অপেক্ষায়, ওর এই ছটফটানি
দেখে আমার বেশ মজাই লাগত। যাক, ওরা ভালো আছে, ভালোই থাকুক নিজেদের মতো। যদিও প্রসূনের
বাড়ি থেকে মাঝে মাঝেই ফোন এলে ও একটু চুপচাপ হয়ে যেত। আমি বেশি কিছু জিজ্ঞাসাও করতাম
না। বাড়িতে যে অশান্তি হবেই, তা তো সবারই জানা ছিল। মোমকে সহজে ওরা মানবে না, সে কথা
মোমও জানত মনে মনে। তবে শেষে যে এমন একটা পরিণতি হবে, মেয়েটা কি এতটুকু টের পেয়েছিল?
সত্যি বলতে কি, আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি, কেন, কেন এমন হলো? মানুষ চেনা সত্যিই বড়
কঠিন। আচ্ছা, প্রসূনও কি জানত এমন ঘটবে ওদেরজীবনে?
-বৌদি,
অনেকটা দেরি করিয়ে দিলাম তো! এবার উঠি।
-আবার
এসো, এদিকে এলে।
-হ্যাঁ
আসব।
দরজার
কাছে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মোম বলে বসল,
-তোমাকে
একটা কথা বলার ছিল।
-কী
কথা? বলো।
-তুমি
যা যা দিয়েছিলে, সেসব ফেরত দিয়ে যাব বৌদি। যাকে দিয়েছিলে সে তো আর নেই!
-কেন
মোম? তুমি তো আছো। আমি কি সেসব শুধু প্রসূনকেই দিয়েছিলাম? তোমাকে দিইনি?
মোমের
চোখ থেকে শুধু জল পড়েছিল। ও আর কিছু বলেনি আমায়। যাওয়ার আগে হঠাৎ আমার পা ছুঁতেই আমারও
কেন জানিনা চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।
(৪)
ফিরতে
হবে। অনেকটা পথ। একা একা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ওর মনে হলো সবাই তাকিয়ে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে
সবাই হাসছে।কিন্তু এদের কাউকেই তো ও চেনে না। তবে ওরা হাসছে কেন? বাসে উঠেও মোমের মনে
হলো কন্ডাক্টরটা কী বিশ্রীভাবে ওর দিকে তাকিয়ে। বাসের ভেতরে সকলেই কি ওর দিকে তাকিয়ে?
সেই সব মুখগুলোয় ওই বিদ্রুপের হাসি! আচ্ছা, বাড়ি ফিরে এবারে ও কীকরবে? কোথায় যাবে?
সেদিনও
এমনটাই মনে হয়েছিল, যেদিন মোম তার নিজের বাড়ি ফিরতেই বাবা বলেছিল,
-এখানে
কী চাই?
-আমি
কোথায় যাব?
-কেন?
বরের কাছে। বিয়ের পর মেয়েরা যেখানে থাকে।
-ও
বাড়িতে আমার জায়গা নেই।
-ওটা
তো ভাড়া বাড়ি। সেখানের কথা তো বলছি না। ভাড়া না দিতে পারলে বাড়িওয়ালা তোকে কি পুষবে?
বলছি তোর শ্বশুরের ভিটের কথা। এখানে ঘ্যানঘ্যান না করে ওদের পায়ে ধর। পোয়াতি যখন দেখবি
তাড়িয়ে দেবে না।
-ওখানে
সে নতুন বউ নিয়ে উঠেছে।
-তো?
তুইও থাকবি।
-বাবা!
এটা আমারও তো বাড়ি…
-না,
এটা আমার বাড়ি। এখানে তোর জায়গা হবে না বললাম তো। এবার যা।
সেদিনও
সবাই ওর দিকে তাকিয়েছিল। হয়ত হাসছিল, সেলসগার্লের কাজটা জুটিয়ে যখন ও একা বাঁচার চেষ্টা
করছিল, আড়ালে, সামনে, পেছনে ও এমন কতই ফিসফাস, হাসাহাসি শুনেছে। কত নজরের নোংরা ইঙ্গিত,
ইশারা! শুধু একজন এমন ছিল যার চোখে মোম অন্য কিছু দেখতে পেত। ঠিক কী তা ও নিজেই কি
বুঝত? তবু, সেই চোখের ভাষা আর পাঁচজনের থেকে আলাদা ছিল। প্রসূন, মোড়ের মাথায়, মুদির
দোকানে, রাস্তায় কতবার ওর সঙ্গে মোমের দেখা হতো। ছোট থেকেই ওরা এক পাড়ায় বড় হলেও
ওদের মধ্যে তবুও সেভাবে কথা হয়নি আগে। তারপর একদিন,
-ব্যাগটা
আমায় দাও।
-মানে?
-মানে,
ব্যাগটা ভারি, তোমার এই শরীরে অত ওজন বওয়া ঠিক নয়। দাও।
(৫)
একে
একে হাজার স্মৃতি ভিড় করে আসছে, যেন ঘিরে ধরছে মোমকে। একটা নাম, একটা মুখ, একটা শরীর,
একটা চেনা গন্ধ, একটা নেশা, একটা স্পর্শ, একটা নির্ভরতা, যা আজ হারিয়ে গেল মোমের জীবন
থেকে।
প্রসূন!
মোড়ের মাথায় হলুদ রঙের একতলা বাড়ি, সামনে গ্রিলের বারান্দা। প্রসূনরা দুই ভাই। প্রকাশদার
বছর দুই আগে বিয়ে হলো, বেশ ঘটা করেই। মোমেরও তো যাওয়ার কথা ছিল, চোখের নীচের কালশিরার
দাগটার জন্যই যাওয়া হয়নি যদিও। নাহ, লুকোনোর কিছু ছিল না, রতন মিস্ত্রীর গুণের কথা
পাড়ার সবারই জানা। তবুও, মার খাওয়ার চিহ্ন যে মুখময়, সেই পোড়া মুখ নিয়ে বিয়ে বাড়ি
যেতে ওর মন চায়নি।
প্রসূন
সেদিন যখন ওর ব্যাগ হাতে তুলে নিল, পাড়ার অনেকেরই চোখে লেগেছিল। মোম প্রসূনকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা যে করেনি তা নয়, কিন্তু
প্রসূন এমনভাবে কথা বলত, মোম ওর মুখের ওপর না বলতে পারত না। কিছু তো একটা ছিল, ওকে
না বলার শক্তি সে জোটাতে পারত না, বলা ভালো ও সামনে এলে, মোমের সারা শরীর কেমন অবশ
হয়ে যেত। এমন কি ডেলিভারির দিন আরতি মাসির সঙ্গে সেও যখন জোর করে গেল হসপিটালে, সেদিনও
তাকে বারণ করার সাধ্য মোমের হয়নি। লেবাররুমে ঢোকার মুখে প্রসূনের মুখটাই কেবল চোখের
সামনে ভাসছিল! মোমের কেন জানি না খুব ইচ্ছে করছিল, ওর হাতটা একবার কপালে ছোঁয়াতে!
যেদিন
প্রথম প্রসূন ওকে ছুঁয়েছিল, নিজেকে আটকে রাখার কোনও ক্ষমতাই মোমের ছিল না। বুকের মধ্যে
মুখ গুঁজে শুধু কেঁদেছিল। দুজনের কেউ সেদিন কোনও কথা বলতে পারেনি। তারপর, হঠাৎ প্রসূন
যে অমন একটা কান্ড করে বসবে মোম তো স্বপ্নেও ভাবেনি। ওকে নিয়ে সোজা মন্দির! কেউ নেই…
প্রসূন
ওর সিঁথি রাঙিয়েছিল। মোম কোনও বাধা দেয়নি। প্রসূনকে সে বাধা দিতেই পারে না, ওই যে,
অবশ হয় সারা শরীর!
-এটা
কী করলে?
-কেন?
তুমি আমার সঙ্গে থাকতে চাও না?
-বাড়িতে
কেউ মানবে না।
-জানি।
আমরা আলাদা থাকব।
-তুমি
বুঝতে পারছ এরপর কী কী সহ্য করতে হবে?
-দেখা
যাবে। এখন চলো।
সেদিন
রাতে মোমের খালি সিঁথি আবার রেঙেছিল। আজ বাড়ি ফিরে সেই রঙ মুছে দিতে হবে।
রতন
মিস্ত্রীর ছেড়ে যাওয়ায় মোমের মনে হয়েছিল, মুক্তি! আজ মনে হচ্ছে, সে নিঃস্ব! প্রসূন,
এই নামের থেকে কি ওর মুক্তি হবে?
(৬)
রাত
বাড়ছে। বিছানায় নতুন বউকে আদর করতে করতে ওই মুখটা ভেসে উঠছে বারবার। আধো অন্ধকারে
সেই নরম শরীর ওকে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে। কানের কাছে, গলায়, ঘাড়ে…
তারপর
সারা শরীর জুড়ে শুধু তারই ছোঁয়া। যাকে পাবার আকাঙ্ক্ষায় কত রাত, কত দিন, কত বছর কাটিয়েছিল,
যাকে নিজের করে পাওয়া হলো, যাকে ছেড়ে সে চলে এল, যার সবটুকু প্রসূনেরই ছিল, যে আর
প্রসূনের রইল না।
একটা
যুদ্ধ লড়তে লড়তে একসময় বড় ক্লান্ত লাগছিল যে। সে কী করত? কতদিন?
-ওই
মেয়েকে এবার ছাড়। বাবার মান সম্মান সব গেছে, আর কত নীচে নামাবি আমাদের?
-পাড়ায়
মুখ দেখাতে পারছি না। শেষে কি গলায় দড়ি দেব?
-ভাই,
কারুর কথা না ভাবিস, নিজের কথা তো ভাব, বাবা কিন্তু তোকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবে,
ওই রতন মিস্ত্রীর নোংরারক্ত, বড় হলে ওই ছেলে তোকে মানবে?
-কেমন
লাগছে আমার বউটাকে ভোগ করতে? মাঝে মাঝে আমিও আসব কিন্তু। যতই হোক ও আমার বিয়ে করা প্রথম
বউ…
-বউ
কি রে? তোদের বিয়ে কবে হলো? মোমের ডিভোর্স হয়েছিল? অন্যের বউ নিয়ে ঘর করলেই সে বউ হয়
না।
নিত্য
অপমানগুলো গিলতে গিলতে কখন যে সবকিছু তেতো, বিষ হয়ে গেল, নাহ, ও পারল না। আসলে ও তো
এই সমাজেরই, আর পাঁচটা সাধারণের মতই, দুর্বল, ভীতু, লোভী। লোভ, ভালো থাকার লোভটা ওকে
মোমের থেকে দূরে নিয়ে গেল।
-কবে
ফিরবে?
-দু
চারদিন লাগবে। ফোন কোরো না যেন। বুঝতেই পারছ, ওখানে সবাই থাকবে।
-না
না। আমি তো জানি। সব মিটলে সাবধানে ফিরে এসো।
সেদিন
মোমকে সত্যিটা বলে আসেনি সে, শেষবার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে প্রসূন মনে মনে ক্ষমা চেয়েছিল।
প্রসূনের
না ফেরায় কটা দিন মোম পাগলের মত সবার কাছে ওর খোঁজ করেছিল। কী হলো, কোনও বিপদ, মানুষটা
বেঁচে আছে তো? কেউ তাকে সত্যিটা বলতে পারেনি। শেষে প্রায় দেড় মাস পর প্রসূনের ফোন
এল।
-তুমি
কোথায়?
-কাল
দেখা করো, আমি আসব। আর প্রশ্ন কোরো না, কাল দেখা হলে সব বলব। একা এসো।
মোম
সেদিন কিছুই বলেনি প্রসূনকে। রাগ, অভিমান, কান্নাকাটি কিছুই করেনি। প্রসূনকে মুক্তি দিয়ে চুপচাপ ফিরে গিয়েছিল মোম। শুধু ওর চোখদুটোয়
কী একটা ছিল, নাহ, অভিযোগ নয়, তার থেকেও বেশি কিছু। প্রসূন জানে, তার মুক্তি নেই। রোজ
রাতে তার ঘরে ওই মোমের আলো সে দেখতে পাবে। কেউ জানবে না, শুধু সে জানবে, একটু একটু
করে ওই মোমের আলো তাকেও পুড়িয়ে ছাড়খার করবে। কেউ জানবে না।
ভ্যাপসা
ঘরটায় এই গভীর রাতে বিছানায় নতুন বউকে নিয়ে প্রসূন আবার চোখ বন্ধ করে নিল, অমনি ঘরটা
সেই চেনা গন্ধে ভরে গেল, ওর মনে হলো, মোম ওকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন