বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

দিগন্তসেনা




 

(৬)

 

ইতালির ভাল দি ফাসা সামুদ্রিক গ্রামে অভিমন্যুর সঙ্গে মধুচন্দ্রিমা যাপন অবসরে শ্যামাঙ্গীর মনে পড়ে যায় সুদূর অতীতের কথা। উন্মাদনাপ্রবালগাথা অঞ্চলটা সাফসুতরো করে মানুষের বসবাসের উপযোগী করা হয়েছে, আর দলে দলে মানুষ এসে ওখানে বসবাসের জন্য মাথা গোঁজার মত একটা ঠাই তৈরী করতে একেবারে প্রাণান্তকর পরিশ্রম করছে। ওদের সাহায্য করার জন্য সুদামের  দলে যে সব ইঞ্জিনিয়ার আছে তারাও হাত লাগাচ্ছে। প্রথমে এল একদল সিরিয়া ও মিশর থেকে। তাদের মধ্যে দুটি ফরাসী পরিবার ও একটি ঈজিপ্সীয় পরিবারও ছিল। যা শুধুমাত্র তাদের নাম থেকেই সুদাম জানতে পেরেছে। কেননা বেশভূষা বা খাওয়াদাওয়া অর্থাৎ সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে খুব ভাল করে নজর করার পরই সেটা বোঝা গেছে। ওরা সকলেই অভিন্ন। ওরা কিছুদিন এসে বসেছে কি বসেনি তারই মধ্যে এল একদল আরব যাদের সঙ্গে আছে এমন একটি পরিবার যাদের পূর্বপুরুষরা এক সময় গ্রীসের বিখ্যাত সব দার্শনিকের জ্ঞান অর্জন করেও সে লোকে সর্বসাধারণের মধ্যে বিস্তৃত করাই জীবিকা নির্বাহ করত। ওই দলেই আর একটি পরিবার আছে যারা একসময়ে রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান পতনের সঙ্গে নাকি খুব ওতপ্রোত ও গুরুত্বপূর্ণ ভাবে জড়িয়ে ছিল, আর দলের বেশিরভাগ পুর্বপুরুষরাই মধ্যযুগের অন্ধকার ভেদ করার কাজেই নিজেদের ব্যাপৃত রেখে গিয়েছিল স্রেফ জ্ঞান চর্চার মধ্যে দিয়ে। রোমানদের পরিবার দুটির পূর্বপুরুষরা  একসময় এপিকুরীয় ও স্টোয়িকবাদী ছিল। হয়ত সেই কারণেই ওরা ভীষণভাবে ধীরস্থির ও শান্তিপ্রিয়। নিজেদের বাসস্থান হয়ে যাবার পরে পরেই ওরা যে যার নিজেদের মধ্যেই নিজেরা মিলে মিশে পারিবারিক ঐকতানে অংশগ্রহণ করতেই বেশি পছন্দ করত। আর একটি মাত্র আরব পরিবারই শুধু ছিল যাদের পূর্বপুরুষরা স্কলাস্টিক দর্শনের বিস্তারে রীতিমত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা গ্রহণ  করেছিল। সুদামকে জানান হয়েছিল গৃহহীন মানুষজনই খালি বাসস্থানের জন্য  আসছে। কিন্তু এদের  সঙ্গে পরিচয় হবার সুত্রে ও যখন ওদের পূর্বপুরুষদের কথা জেনেছিল তখন একটু দ্বন্দ্বে পড়ে গিয়েছিল আর পরে অবশ্য নিজের বুদ্ধির  জোরেই তা থেকে উদ্ধার পেয়েছিল। সেটা কেবল এই ছিল যে পূর্বপুরুষরা  ওইরকম ছিল তাদের উত্তরপুরুষদের এ হেন দশা কেন। উন্মাদনাপ্রবালগাথা অঞ্চলে নানারকম পাখি আর প্রজাপতি দেখা যেতে লাগল যেটা এর আগে আর কোথাও দেখ যায়নি। সবচেয়ে মজা আর আনন্দের ব্যাপার হল ওখানে মানুষের  মনোরঞ্জনের জন্যই তৈরী হতে থাকল নানারকম শিল্পেরই একটা করে কেন্দ্র আর সেখানেই এবার সবাই দেখতে পাবে কত নানা রকমের গান ও গায়কী, কত রকমের  বাদ্যযন্ত্র আর আরো কত রকমের মানুষের হাতের আঁকা চিত্র। এ ছাড়াও হচ্ছে একটা থিয়েটার আর চলমান ছবির প্রদর্শনীর বিশাল প্রেক্ষাগৃহ। এই সব তৈরী করার জন্য যেমন বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, ব্যয়ও হচ্ছে তেমনই। অসংখ্য শ্রমিক কাজও করছে ওই সব ইঞ্জিনীয়ারদের অধীনে। তারা আসছে আশেপাশেরই নানা জায়গা থেকে। ডিসেম্বরের শেষাশেষি একটা  সার্কাসের দল আসতেই গোটা অঞ্চলটা জুড়ে সার্কাসের খেলা দেখবার জন্য টিকিটের কাউন্টারে লম্বা লাইন পড়ে গেল। আর তারই আশেপাশে তৈরী হল নানারকম মুখরোচক টকঝালমিষ্টি খাবারের অস্থায়ী তাবু। গোটা নিহিতপাতালপুরীর তিনটে ব্লক, তীর্থসরোবর অঞ্চল, গণসংবাদালয়ের থেকে আসা মানুষের ঢেউ দেখে সার্কাস কর্তৃপক্ষ বেজায় খুশি হলেও শান্তিপ্রিয় বিদেশী আগন্তুকেরা বেজায় ভয় পেয়ে গেল। তারা বারবার খোঁজ নিতে লাগল কী হয়েছে। সুদাম তাদের উৎকণ্ঠিত হতে বারণ করে যখন আসল কারণটা জানাল তখন তারা যেন খানিকটা ধাতস্থ হল। লোকজনের সমাগমের তুলনায় দেখা গেল তাঁবুটা অনেকটাই ছোট। তখন কর্তৃপক্ষ মাইকে ঘোষণা করতে থাকল যে যারা  এখন দেখার সুযোগ পায়নি তাদের জন্য এটা শেষ হওয়ার পরপরেই আরও একবার সার্কাস দেখাবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে এবং তারা যেন শান্ত হয়ে বাইরে অপেক্ষা করে। এতে সকলেই শান্ত হল আর সেইদিন থেকেই সার্কাস কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন দুটো করে শো করতে থাকল। সুদাম তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে আর উপমা লগ্নলতাকে নিয়ে একদিন সার্কাসে যাওয়ার তোড়জোড় করছে শুনতে পেয়ে অনঙ্গ শিশুর মত আবদার জুড়ে দিল যে সেও যাবে সার্কাস দেখতে। তখন মানময়ী বলল যে সেই ছোটবেলার পর এতদিন সেও সার্কাস দেখার আর সুযোগ পায়নি। তাই সেও যেতে চায়। তখন অলঙ্কৃতা দায়িত্ব নিল ওদের সার্কাসে নিয়ে যাওয়ার। সেখানে গিয়েই দেখা হল বুচি আর সম্রাটের সঙ্গে। কিন্তু অন্যরা সৌজন্যমুলক অল্পস্বল্প কিছ কথা বললেও  মানময়ী আর অনঙ্গ একেবারে কঠিন  ভাবে নিজেদের মুখ ফিরিয়ে রাখল ওদের উল্টোদিকে। হঠাৎ বুচি এসে অনঙ্গকে নানা ভাবে অনুরোধ উপরোধ করতে লাগল ওরা যাতে শ্যামাঙ্গীর বিয়েটা দিয়ে দেয়। তাহলে ওরা আবার একসঙ্গে থাকতে পারবে। আর বুচি নিজেই শ্বশুর শাশুড়ির খেয়াল রাখতে পারবে। যখন এমনি বলে হল, ‘না’, তখন হাত ধরে নাড়া দিতে থাকল। যখন তাতেও হল না তখন পায়ে ধরতে শুরু করে দিল। আর তারপরেই মানময়ীকেও একইভাবে ধরল। রাগে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মানময়ী ওকে জিজ্ঞেস করল, ওটা ওর বাপ চোদ্দপুরুষের সম্পত্তি নয় যে ওর আবদার মেনে শ্যামাঙ্গী, যে কিনা ওদের একমাত্র মেয়ে, তাকে ওর কথা শুনে তাকেই বাইরে বের করে দিতে হবে আর তার জায়গায় ওকে ঘরে তুলতে হবে?  তার উত্তরে বুচি নাকি সুরে এমন কুৎসিত গালিগালাজ করতে শুরু করল যে সকলেই কানে আঙুল দিল। তারপর সকলেই ওরা সার্কাস দেখতে তাঁবুতে ঢূকে পড়ল।

বাড়ি ফিরে অনঙ্গ আর মানময়ী রাগে গজ গজ করতে লাগল আর সেটা এমন এক পর্যায়ে পৌছে গেল যে একসময় শ্যামাঙ্গী ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হল। তারপর সব কথা শুনে সে বুচির বিষয়ে কোন কথাই বলল না। ফরাসী ব্যালের কোন অনুষ্ঠান হলে ও যেতে চায় আর তাছাড়া ওই অঞ্চলের  নতুন অধিবাসীদের সঙ্গে ও আলাপ করতে চায় বলে সম্রাটকে বলল। আর জানা মাত্রই  সুদাম আর অলঙ্কৃতা শ্যামাঙ্গীকে ওখানে নিয়ে গেল এবং সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। নতুন বাসিন্দারা শ্যামাঙ্গীকে দেখে ও ওর সঙ্গে কথা বলে এতই অভিভুত হল যে তারা প্রায় ওকে ছাড়তেই চায় না। সুদানের বাংলোতে তখনও অব্দি একবারও যাওয়া হয়নি বলে অলঙ্কৃতা, সুদাম ওকে ওখান থেকে শ্যামাঙ্গীকে নিয়ে গেল ওদের বাংলোয় আর তারপর সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পর ওরা শ্যামাঙ্গীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল। পার্বত্য অঞ্চলে গথিক আর্যদের  পাড়ার  প্রান্তে এক জায়গায় ‘খাদ্যসম্ভার নাম দিয়ে রমণপ্রিয় মানুষদের জন্য দেহ ব্যবসার একটা প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে, আর ওটার মালিক গথিক আর্য গোষ্ঠীরই  একটা লোক। অলঙ্কৃতা যখন এটা জানতে পেরে একটু বিমর্ষ হয়ে পড়েছে, তখনই একদিন নিজেদের বাংলো থেকে দেখতে পেল মধ্যমেধাচৌকনা দলের কিছু লোক উন্মাদনাপ্রবালগাথার নতুন বাসিন্দাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কীসব  বলছে। এমনিতেই শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে আলাপ সূত্রে সুদামের প্রতি ওরা যথেষ্ট  সম্ভ্রমশীল, তবু অলঙ্কৃতা কথাটা সুদাম আর ও বাড়ির সবাইকে জানিয়ে রাখল। শ্যামাঙ্গীর নামে বেশ কয়েকটা করে চিঠি আসতে লাগল। চিঠিগুলো শ্যামাঙ্গী উপমাকে দিয়ে বলল, ‘দেখ তো, কী লিখেছে আর কারা লিখেছে? উপমা সব  দেখে বলল, ওগুলো সব প্রেমপত্র আর লিখেছে উন্মাদনাপ্রবালগাথার কয়েকজন তরুণ। তখন ও ওগুলোকে ফেলে দিতে বলল আর ঠিক তখনই শ্যামাঙ্গীর মাথায়  খেলে গেল একটা বুদ্ধি। বুদ্ধিটা উপমাকে কেন্দ্র করে। উপমাকে ও আগে জিজ্ঞেস করল যে বিয়ের জন্য ওর কোন পাত্র আগে থেকেই ঠিক করা আছে কিনা। উত্তরে উপমা জানালো, না। তখন ও ওকে বলল, ‘তোর যোগ্যপাত্র তুই পেতে পারিস ওই জায়াগাটা থেকে’। উপমা এতে খুব খুশী হল। ও আর সময় নষ্ট না করে খুব তাড়াতাড়ি ওখানকার তরুণদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে শুরু করে দিল।জীবন কি জাদুময় ও রহস্যের আধার তা না জেনেই শ্যামাঙ্গী এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে এই কথা ভেবে, ও জানে উপমা যে আফসোস করবে ভবিষ্যতের এক দিন, তার প্রথম সলতে পাকানোর পর্বটিও শুরু হয়ে যায় এই রকমই কোন একদিন। আর বয়ঃসন্ধি কালসন্ধি শুরু করে অনেকটা বড় বয়েস অব্দি সম্রাট আর অনঙ্গের অকথ্য অত্যাচারে মাথার চুল থেকে পায়ের ডগা অব্দি অসংখ্য, অগণন সাক্ষ্য বহন করতে করতে শ্যামাঙ্গী যে কবে কখন কীভাবে তার চিরন্তন  নারী সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে নিছকই একটা জীব হিসেবে নিজেকে পালটে ফেলেছে, যে এই পৃথিবীর জীবন প্রবাহের একটা অংশ হয়েও একেবারে একা চলতে আর একা থাকতে চরম স্বস্তি বোধ করে, আর শরীরের জান্তব ক্ষুধা মেটাবার একমাত্র উপায় হিসেবে আত্মরতিকেই বেছে নিয়ে সমাজসংসারের এখন পর্যন্ত নানা সমস্যার সমাধানের জন্য নির্বিকল্প সমাধিতে আত্মস্থ হয়ে আছে, তার কোন হিসেব ছাড়াই একা একা পথ হেঁটে যায়। শুধু মানময়ী এজন্য একমাত্র মনে মনে যন্ত্রণায় পুড়ে একেবারে খাক হয়ে গিয়েও তবু সংসারের সকলের মঙ্গলের জন্য সকাল সন্ধে  আরাধনায় বসে। অথচ চিরযৌবনবতী হয়েও আজও অসংখ্য পুরুষ ও নারী শ্যামাঙ্গীকে নিজের করে পাবার জন্যে নিজেদের মানসিক শান্তি আর জীবনের সবচেয়ে বড় শুশ্রুষা ঘুমকে বিসর্জন দিয়েছে তার কোন হিসেব কোথাও লেখা থাকে না। পার্বত্য প্রদেশে গথিক  আর্যদেরই কোন এক ঘরে একটা মেয়েকে অকথ্য অত্যাচারের পরে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘটনাটা  ঘটেছে সম্ভবত কাল রাতে এবং জানা গেছে আজ সকালে এবং জানা যে গেছে তাও ঘটেছে তারই এক বন্ধুর খোঁজ খবর আর চেঁচামিচির কারণে। তা না হলে সকালবেলাই তার লাশটা নামিয়ে  গায়েব করে দেবার যাবতীয় ব্যবস্থা যে পাকা হয়ে গিয়েছিল, তাও হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে পুলিশের কাছে। মেয়েটি আর তার বন্ধু দুজনে নিহিতপাতালপুরী তিন নম্বর ব্লকের বাসিন্দা ছিল বিয়ের আগে আর প্রেম ও বিয়ের সূত্রেই সকলের নিষেধ ও সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ওরা গথিক আর্য গোষ্ঠীরই একই পরিবারের  মামাতো আর পিসতুতো দুই ভাইকে বিয়ে করে ওখানে ওঠে। এইসব ডামাডোলের মধ্যে সবাই যখন রীতিমত হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন একদিন খবর এল সম্রাটকে বুচি চাকরি ছাড়িয়ে দূরে কথায় নিয়ে গেছে আর ওর চাকরি সূত্রে প্রাপ্য  যাবতীয় টাকা ওর বৌ আর শ্বশুর আত্মসাৎ করা চেষ্টা করছে। খবরটা নিয়ে আসে ওর এক বন্ধু যাকে কিনা সম্রাট নিজেই খবর দিয়ে পাঠিয়েছে। খবরটা শোনা মাত্র সারা বাড়িতে তুমুল হৈ-হট্টগোল পড়ে যায় আর পরিবারের প্রতিটি সদস্যই শ্যামাঙ্গীর ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা রাখে, ও যেন কোন ভাবেই আর এ ব্যাপারে কিছু না করে। কিন্তু শ্যামাঙ্গী তার সমস্ত বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে আবারও সম্রাটকে শুধু নয় তার চাকরিটাও রক্ষার ব্যবস্থা করে ফেলে আর সে সূত্রে গোটা পরিবার আরও একবার শ্যামাঙ্গীকে নতুন করে আবিষ্কার করার সুযোগ পেয়ে যায়।  

তীর্থসরোবর মহাসঙ্গীত সম্মেলনে এবার ঊন্মাদনাপ্রবালগাথা অঞ্চলের নতুন অধিবাসীদের বিশেষ ভাবে স্বাগত জানানো হয় শুধু এইজন্যেই যে তারা যেন আমাদ্র শিল্প সংস্কৃতিও কতটা প্রাচীন ও গভীর তা জানার সুযোগ পায়। গুরুজী গুরুমার সঙ্গেও তাদের আলাপ করিয়ে দেওয়া হয় আর তারই সূত্রে ওরা সঙ্গীত শিক্ষাইয় আগ্রহ প্রকাশ করলে সুদামের বাংলোয় সে শিক্ষার আয়োজন করা হয়। ওরা মুলত বাদ্যযন্ত্রের তালিমটাই নেয়। তাই তাদের জন্য সেতার, সরোদ, বাঁশি, আরও নানারকম বাদ্য যন্ত্রের ব্যাবস্থা করা হয়। যে লোকটা এই দায়িত্ব পেয়েছিল সে সবে মাত্র কয়েকটা যন্ত্র তৈরী করে পৌছে দেওয়া মাত্রই আর আর ফরমাস আসতে শুরু করে স্রেফ এইজন্যে যে ওদের দেখাদেখি অন্যান্য অঞ্চলের নারীপুরুষরাও সকলেই এই শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে ওঠে।  এর ফলে  ওই লোকটার পক্ষে একা একা এই দায়িত্ব পালন করা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না।সে তার অধীনে  আরও লোক নিয়োগ করে। তার ফলে সে প্রা কয়েক রাতের মধ্যেই  এত বড়লোক হয়ে যায় যে নিজেদের জন্য যথেষ্ট পরিমান রেখেও আনেক উদ্বৃত্ত থকে যায়।  তখন সে টাকা সে গ্রীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেবার বন্দোবস্ত করে। সকলেই সুরের জাদুতে ভেসে যায়। হিসেব মত পুলিশের এতে কাজ অনেকতা কমে যাবার কথা। কিন্তু তা  হয় না। কারণ্টার জন্য সকলেই ভাবতে বসে। তারপর একদিন্মাঝরাতে শ্যামাঙ্গী উঠে ঘোষণা করে, ‘ পৃথিবীর সবচেয়ে বিচক্ষণ ব্যাক্তিটিও কিন্তু ঐতিহ্যের দাস কথাটা শুনে বোদ্ধারা হিসি মুখে মাথা নাড়ে। বাকীরা যে যার মত চলে যায়।

গথিক আর্য গোষ্ঠীর জনসংখ্যা গত ক’বছরে পাঁচ গুন হয়েছে আর তাদের  অপ্রাধের দৌড়াত্যও সাড়েসাতাশ গুণ বেড়ে গেছে। এর সমাধান হিসেবে সমাজ কল্যাণ দপ্তরের উপপ্রধান আজুবা ব্যাবিলনিয়া প্রস্তাব করেন একমাত্র সঙ্গীত চিকিৎসাই সেই উপায় যা দিয়ে ওদের সংশোধন করে জীবনের মুল স্রোতে ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধবার আসল দায়িত্বটা কে নেবে এই নিয়ে পারস্পরিক চাপান উতোরের মধ্যেই বুধবার সকালে উথেই লোকজন খবর পায় গণসংবাদালয়ে এক বছর তিনেকের শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে। পুলিশি তৎপরতায় জানা যায় মেয়েটির কাকাই এই কাজ করেছে। তাকে ধরা হয় ও তার শাস্তির বিধানও জারি হয়। আর দুদিনও যেতে না যেতে চাঁদের ঢেউ অঞ্চলে একজন মহিলাকে জনা দশেক  ধর্ষণ করে খুন করেছে। পুলিশ ছ’জনকে ধরেছে। বাকীদের তল্লাশি চলছে। বিচারে তাদের মৃত্যুদন্ড দেওয়া ও কার্যকর করাও হয়ে গেছে। আর এইসব চলাকালীনই দেশের অন্য প্রান্তে সজবি ব্যাবিলনিয়া নামে এক মহিলাকে গণধর্ষণের পর খুন করা হয়েছে। এই ঘটনাতে কিন্তু জল অনেক দূর গড়াল। কেননা এই মহিলা আর কেউ নয়, আজুবা ব্যাবিলনিয়ার নিজের একমাত্র ছোটবোন। দেশের বাইরে অনেকেই বলাবলি করতে শুরু করল যে এ দেশে নাকি ধর্ষণের ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি এটা একেবারেই ঠিক নয়। সরকারের তরফে জানান হয় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই প্রত্যেকটি দোষীকে ধরে আদালতে তোলা হয়, তাদের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় ও তা যথাযথ ভাবে কার্যকর করা হয়। তাই সরকারের কোন গলতি নেই এ ব্যাপারে। এইসব তর্কবিতর্কের মধ্যেই ঘটে যায় আরও একটা সাধারণ নির্বাচন স্রেফ শুধু এই জন্যে যে,  জনদরদী তকমা লাগিয়ে গদিতে কোন রাজনৈতিক দল বসবে – উদারপন্থী দল,  রক্ষণশীল সমাজ দল না কি মধ্যমেধা চৌকনা দল। উদারপন্থী দলই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় এল। এরই মধ্যে খুন হয়ে গেলেন কঁতিয়ের ব্রাসো। যদিও তার নিজের কোন বিশেষ পরিচয় নেই, তবু এককালে তার মায়ের ব্যালে নাচ দেখার জন্যে পৃথিবীর সমস্ত অডিটোরিয়ামগুলোই উপচে পড়ত। তার একমাত্র ছেলে হিসেবে কদিনের জন্য শহরে এসেছিলেন কয়েকটি তথ্য সংগ্রহের জন্য জাতীয় গ্রন্থাগারে। সঙ্গে তার শিশুকন্যা আনালোভা ব্রাসোকে নিয়ে যে গত তিনদিন হল হারিয়ে গেছে হোটেলের টেরাসে খেলতে খেলতে। আর তাই কঁতিয়ের গত বাহাত্তর ঘণ্টা কেবল মেয়ের জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন পুলিশের দরজায় দরজায়। আর তাই এই খুন, পুলিশের বক্তব্য। সাতাত্তর দিন বাদে পুলিশ ছবি মিলিয়ে খুঁজে বের করল শিশু আনালোভাকে মৃত অবস্থায় দেশের পশ্চিম দিকের একটা নদীর পার থেকে মধ্যরাতে। ময়নাতদন্ত বলছে মারা যাবার সাতদিন  আগে থেকে তাকে নিয়মিত ধর্ষণ করা হত। পুলিশ বলছে ধর্ষকের বয়স বড় জোর চোদ্দ, তার বেশি কিছুতেই নয়। খোঁজ চলছে, আশা করা যায় অবিলম্বে ধরা পড়বে।

পরিস্থিতি এতদ্দূর গিয়ে ঠেকেছে যে শ্যামাঙ্গীর পক্ষেও আর চোখ কান বন্ধ করে ঘরে বসে নিজেই কাজে আত্মমগ্ন হয়ে থাকাটাও অসম্ভব হয়ে উঠেছে। বিষয়টার গভীরে যাবার জন্য সে পড়াশোনার পাশাপাশি জনসংযোগটাও বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। আর এর ফলে অচিরেই ও এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে গলদটা রয়েছে গোড়ায়। অথচ সে ব্যাপারে সামান্য দু চার কথা বলতে গেলেই গোটা সমাজ, তাবৎ সভ্যতা যেন কেঁপে ঊঠে ওকে আক্রমণ করতে  অসংখ্য থাবা নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসে। অথচ সেটার আর দ্বিতীয় কোন সমাধানও নেই। গোটা সমাজের প্রাজ্ঞজনেরাও ওর মত ওই একটাই সমাধানের  কথা বারবার বলে যাচ্ছেন। কিন্তু কথাটা কানে তুললে তবে তো? আরও একটা মজার জিনিস ও লক্ষ করল। বেতার বা অন্যান্য জনসংযোগ মাধ্যমেও নানা কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সেগুলো প্রয়োগ করার ব্যাপারে প্রশাসন উদাসীন। আর একটা ব্যাপারও লক্ষ করল যে এখানে ধর্যণ মহামারীর আকার নিলেও অন্য দেশে যে এসবের কোন অস্তিত্ব নেই বা ছিল না কোন কালে তা নয়। বরং ও এটা আবিস্কার করল যে এসবের মূল যে শিকড়টা সেটা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ভাল তবিয়তে বিদ্যমান। এইসব বিষয় নিয়ে সভা সমিতি থেকেও ডাক আসতে থাকল। এবং শ্যামাঙ্গী সেখানেও যেতে লাগল আর মনে মনে ভাবতে থাকল যে ঐতিহ্যের গোলামী করাটা এদের একেবারে মজ্জার মধ্যে মিশে গেছে এমনভাবে যে মাথার গ্রে ম্যাটারগুলো আর মোটে কাজই করতে চায় না।

 

(ক্রমশ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন