বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ২১




বিশ্বভ্রমণ আপাতত কিছুদিন বন্ধ রেখে আমরা আবার ফিরব হলিউডের রূপোলি  জগতের মোহময় হাতছানিতে। প্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রীর আলোচনায়। এই লেখা বেশ দীর্ঘ হবে, তাই একে চার টুকরো করে নেব। আজ প্রথমভাগে  এখনকার প্রিয় অভিনেতা। পরের পর্বে প্রিয় অভিনেত্রী। তারপরের দু’পর্বে হলিউডের স্বর্ণালী যুগের কয়েকজন অভিনেতা ও অভিনেত্রী, যারা কেউ আর আজ আমাদের মাঝে নেই।

এখনকার অভিনেতাদের ভেতর জিনি হাকম্যান থেকে শুরু করে টম হ্যাঙ্কস অব্ধি অনেককেই আমার ভাল লাগে। তবে তালিকা বানিয়ে এক-দুই-তিন করে বলতে বললে খানিক ভাবনার পরে মাত্র কয়েকটা নামই উঠে আসবে। সেই তালিকায় আমার প্রথম পছন্দ ডাস্টিন হফম্যান। দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবে রাখতে চাই এমন একজনকে যিনি হিরো থেকে ভিলেন সব চরিত্রেই সাবলীল। ফলে একজনকেই রাখতে পারি রবার্ট ডি-নিরো। তৃতীয় স্থানে যুগ্মভাবে রাখতে চাই ড্যানিয়েল ডে-লুইস আর গ্যারি ওল্ডম্যানকে। আর, যাকে অভিনয় দক্ষতার জন্য ওপরের ক’জনের যে কোন একজনের জায়গায় অনায়াসে রাখতে পারতাম, কিন্তু  তার মুখ-চোখ-ভুরুর ভঙ্গি তত পছন্দ করি না বলে রাখলাম না, তার নাম জ্যাক নিকল্‌সন (এটা কিন্তু আমার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, এর সঙ্গে নিকল্‌সনের অভিনয় দক্ষতার কোন সম্পর্ক নেই)।

ডাস্টিন হফম্যানের ‘দ্য গ্রাজুয়েট’ দেখেছিলাম দুর্গাপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার  সময়। সম্ভবত ১৯৯৫ বা ৯৬। নুন শো হিসেবে দেখতে গেছিলাম। ছবিটা তখন বেশ উত্তেজক মনে হয়েছিল। আজ এসব মনে পড়লে মনে মনে হাসি, সত্যিই খুব অপরিণত ছিলাম সেই বয়সে। হফম্যানের এখন বয়স ৮৪, ক্যান্সার থেকে  মুক্তি পেয়েছেন কিন্তু হাঁটাচলা আর বিশেষ করতে পারেন না। কিন্তু তার অমূল্য মণিমুক্তোগুলো সেলুলয়েড জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে – দ্য গ্রাজুয়েট (১৯৬৭),  মিডনাইট কাউবয় (১৯৬৯), জন অ্যান্ড মেরি (১৯৬৯), লেনি (১৯৭৪), ক্র্যামার ভার্সেস ক্র্যামার (১৯৭৯), টুটসি (১৯৮২), রেইনম্যান (১৯৮৮), আউটব্রেক (১৯৯৫), ওয়্যাগ দ্য ডগ (১৯৯৭) ইত্যাদি ইত্যাদি। পাঠকের নিশ্চই মনে আছে যে এই লেখা আমি শুরু করেছিলাম ২০২০ সালে কোভিড আতঙ্কের আবহে এবং ভাইরাসঘটিত প্রথম যে ছবি আমি রিভিউ করেছিলাম, সেটা ছিল ‘আউটব্রেক’। ওনার সম্বন্ধে বলা হয় ‘an actor with the everyman’s face  who embodied the heartbreakingly human’। মানুষের অভিনেতা, মানবিকতার অভিনেতা। এখানে আলোচনা করব ওনার ‘ক্র্যামার ভার্সেস ক্র্যামার’ আর ‘রেইনম্যান’ নিয়ে।

‘ক্র্যামার ভার্সেস ক্র্যামার’ সিনেমা হিসেবে খুব একটা মার্কস পাবে না, অনেক  খুঁত আছে। কিন্তু ফুল মার্কস পাবে ডাস্টিন হফম্যান আর মেরিল স্ট্রিপের অভিনয়ের জন্য। এটাকে ডিভোর্স ড্রামা বললেই ভাল হয় যদিও ডিভোর্সের আইনি চর্চা খানিকটা প্রশ্নজনক। হফম্যান আর স্ট্রিপ এখানে এক দম্পতির অভিনয় করেছেন যাদের ডিভোর্স হচ্ছে, তার হফম্যান তাদের স্কুলপড়ুয়া বাচ্চা ছেলেকে নিজের কাছে রেখে দিচ্ছে। বাচ্চা মানুষ করার কৌশলগুলো আস্তে আস্তে শিখছে। অবশ্য কিছুদিন পরেই স্ট্রিপ আবার কেস করছে ছেলের হেফাজত নেবার জন্য। সিনেমা যত গড়িয়ে চলে, হফম্যান ততই যেন বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে বদলে যাওয়া চরিত্র হয়ে উঠতে থাকেন, আর সেখানেই এই ছবি সংবেদনশীল হতে থাকে। কোর্টের ভেতরের লড়াই বাইরের মানুষটাকে মেরে ফেলতে দেয় না। ফলে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই দর্শকের সহানুভূতি পান। ডায়লগ এবং স্ক্রীন-প্লে যথেষ্ট ভাল বলেই আজো এই ছবি দর্শকের ফেভারিট।

আমার জ্ঞানের গন্ডী অনুযায়ী, ‘রেইনম্যান’ আজ অব্ধি একমাত্র সিনেমা যা  অস্কার আর গোল্ডেন বিয়ার, দুটো পুরস্কারই পেয়েছে। এই সিনেমা শুরু হচ্ছে  গাড়ি কেনাবেচার দালাল ছেলে (টম ক্রুজ) যখন বাবার মৃত্যুর পর জানতে পারছে যে বাবার সমস্ত সম্পত্তির মালিক সে নয়, তার দাদা (ডাস্টিন হফম্যান)। এই দাদার বিষয়ে সে কিছুই জানে না, তাকে কোনদিন দেখেওনি। সেই দাদার খোঁজে টম ক্রুজ এক মানসিক হাসপাতালে যায় এবং আবিষ্কার করে সেখানে তার দাদা এক মানসিক রুগি। বাবার সম্পত্তি নিজে আত্মসাৎ করবে বলে টম ক্রুজ হফম্যানকে নিয়ে সেই হাসপাতাল থেকে পালায়। এবং তার সঙ্গে থাকতে থাকতে অনেক কিছু জানতে পারে। নিজের ছোটবেলা, হফম্যানের অনেক জিনিষ একসঙ্গে মনে রাখার ক্ষমতা, এমনকি তার শিশু বয়সের আবছা স্বপ্নে দেখা ‘রেনম্যান’ যে হফম্যান, সেটাও। জীবন সম্বন্ধে টম ক্রুজের ধারণা বদলাতে   থাকে। ছবির শেষে হফম্যান আবার সেই মানসিক হাসপাতালে ফিরে যায় কিন্তু টম ক্রুজ তার সঙ্গে নিয়মিত দেখা করবে কথা দেয়। এইরকম জটিল এক চরিত্র হফম্যান যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা সত্যিই উপভোগ করার মত।

রবার্ট ডি-নিরোর ‘রেজিং বুল’ আর স্ট্যালোনের ‘রকি’ পরপর দেখেছিলাম।  রেজিং বুল বেশি ভাল লেগেছিল। তার কিছুদিন পরে ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’। ডি-নিরোর অভিনয় সেখান থেকেই ভাল লাগতে শুরু করে। ওনার বয়স এখন ৭৮, কিন্তু ওনার যে যে ছবি হিরো বা ভিলেন হিসেবে এখনো চোখে ভাসে – গডফাদার পার্ট টু (১৯৭৪), ট্যাক্সি ড্রাইভার (১৯৭৬), নিউ ইয়র্ক, নিউ ইয়র্ক (১৯৭৭), দ্য ডিয়ার হান্টার (১৯৭৮), রেজিং বুল (১৯৮০), গুডফেলাজ (১৯৯০), অ্যাওকেনিংস (১৯৯০), কেপ ফিয়ার (১৯৯১), সিলভার লাইনিং প্লেবুক (২০১২) এবং দ্য আইরিশম্যান (২০১৯)। এখানে ওনার হিরো হিসেবে একটা এবং ভিলেন হিসেবে একটা ছবি বেছে নেব - রেজিং বুল এবং কেপ ফিয়ার। বলে রাখা ভাল, এই দুটো ছবির পরিচালকই মার্টিন স্করসেসি। স্করসেসি রবার্ট ডি-নিরোকে নিয়ে মোট ৯টি সিনেমা করেছিলেন। ‘মিন স্ট্রীট’ থেকে শুরু করে ‘দ্য আইরিশম্যান’ অব্ধি। রেজিং বুল এবং কেপ ফিয়ার এই জুড়ির দুই সেরা ফসল।

‘রেজিং বুল’ এক মিডলওয়েট বক্সিং চাম্পিয়নের গল্প। এক সাধারণ বক্সার থেকে  চাম্পিয়ন হয়ে উঠেও নিজের বদমেজাজ আর সন্দেহবাতিক চরিত্রের জন্য সব হারানোর গল্প। নিজের বউ-বাচ্চা তাকে ছেড়ে চলে যায়। পুলিশ তাকে একসময় গ্রেপ্তার করে এবং জীবনের সায়াহ্নে এসে যে নিজের মনেই বিড়বিড় করে ‘I coulda been a contender’। এখানে ডি-নিরো এক ট্র্যাজিক হিরো। আবার উল্টোদিকে ‘কেপ ফিয়ার’ (১৯৬২ সালের কেপ ফিয়ার ছবির রিমেক) সিনেমায়  ডি-নিরো এক ভিলেন। এক ১৬ বছরের টিনেজ মেয়েকে ধর্ষণের অপরাধে তার  ১৪ বছর জেল হয়। কিন্তু ডি-নিরো মনে করে তার উকিল ইচ্ছাকৃত তাকে এই সাজা দেওয়া করিয়েছে, সে ইচ্ছে করলেই এই সাজা কম হতে পারত। জেল থেকে বেরোনোর পর সে সেই উকিল ও তার পরিবারকে খুঁজে বের করে। এবং প্রতিশোধের জন্য তাকে ভয় দেখাতে শুরু করে। পরিবারের ভেতরের খবর জোগাড় করার জন্য সেই উকিলের টিনেজ মেয়ের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় শুরু করে। এমনকি পারিবারিক ভ্রমণে সে তাদের পিছু করে নদীতে বোটের মধ্যে  গিয়ে উপস্থিত হয়। সেখানে এক ভয়ঙ্কর মারামারির পর ডি-নিরো জলে ডুবে যায়। অবশ্য এই সিনেমায় আসল হিরো বলতে গেলে ডি-নিরোই। কারণ তার অভিনয় এই ছবির একমাত্র উপজীব্য। সিনেমা হলে বসে চুরুট মুখে অট্টহাসি বা উকিলের মেয়ের সঙ্গে সিরিয়াস প্রেমের সংলাপ বা চোয়ালচাপা খুনি চোখে ডায়লগ - ‘every man has to go through hell to reach paradise’ বা ‘I’m going to chop you into 42 pieces’, বা শেষ দৃশ্যে হাসিমুখে গান গাইতে গাইতে ডুবে যাওয়া – এই সিনেমা দেখে খলনায়কদের অনেক কিছু শেখার আছে।

এ পর্যন্ত ড্যানিয়েল ডে-লুইসের (বয়স ৬৫) মাত্র চারটে ছবি দেখেছি - মাই লেফ্‌ট ফুট (১৯৮৯), দেয়ার উইল বি ব্লাড (২০০৭), লিঙ্কন (২০১২) এবং ফ্যান্টম থ্রেড (২০১৭)। এর ভেতর প্রথম তিনটেই সেরা অভিনেতা হিসেবে অস্কার প্রাপ্ত। বেশি ছবি দেখিনি বলে ওনাকে তিন নম্বরে রাখলাম। নইলে ওনাকে এক নম্বরেও রাখা যেত, কারণ এরকম পারফেকশনিস্ট অভিনেতা খুব কম দেখা যায়।

ক্রিস্টি ব্রাউন সেরিব্রাল পালসির রুগি। সে না পারে কথা বলতে, না পারে চলতে। শুধুমাত্র সে তার বাঁ পা নাড়াতে পারে, চালনা করতে পারে, এবং সেই পায়ে সে লিখতে ও আঁকতে পারে। সেই নিয়ে ছবি ‘মাই লেফ্‌ট ফুট’। মুখ্য  চরিত্রে ড্যানিয়েল ডে-লুইস। কোন এক সময় ক্রিস্টি তার বাঁ পায়ে কলম ধরে নিজের জীবনী লিখতে শুরু করে। আমি বলব, এই সিনেমা সবার দেখা উচিৎ। কারণ অভিনয়ের ‘ক্লিনিকাল’ ফিনিশ এখানে প্রধান আকর্ষণ।

গ্যারি ওল্ডম্যানও ডে-লুইসের প্রায় সমসাময়িক। এখন বয়স ৬৪। ওনার ছবি বাছতে হলে আমার তালিকায় এগুলো আসবে- প্রিক আপ ইয়োর ইয়ার্স (১৯৮৭), ড্রাকুলা (১৯৯২), লিও (১৯৯৪), নিল বাই মাউথ (১৯৯৭), টিঙ্কার টেলর সোলজার স্পাই (২০১১), ডার্কেস্ট আওয়ার (২০১৭) ও ম্যাঙ্ক (২০২০)। এবং ওনাকে নিয়ে আমার একটাই বক্তব্য – এত ভাল ভাল অভিনয় থাকা সত্বেও মাত্র একটা অস্কার? অস্কার কমিটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেল। এখানে আমি ওনার শেষ ছবি ‘ম্যাঙ্ক’ নিয়ে দু-চার কথা বলব। এই সিনেমা হলিউডের বিখ্যাত  ছবি ‘সিটিজেন কেন’-এর স্ক্রিনপ্লে কিভাবে তৈরি হয়েছিল, সেই নিয়ে তৈরি।  অরসন ওয়েলেসের সেই ছবির স্ক্রিনলেখক হার্মান জে ম্যাঙ্ক কিভাবে সেই অসাধ্যসাধন করেছিলেন, তার ওপর ২০২০-র এই সিনেমা। নামভূমিকায় ওল্ডম্যান। ম্যাঙ্ক বাছলাম বেশ কয়েকটা কারণে। এক, ১৩১ মিনিটের এই সাদা- কালো ছবি তৈরির কথা পরিচালক প্রথম ভেবেছিলেন ১৯৯০ সালে, কিন্তু সেটা আর বানানো হয়নি। এত বছর পরে সেটা বাস্তবায়িত হল। এবং সেই তখন থেকেই পরিচালক নামভূমিকায় ওল্ডম্যানকেই ভেবে রেখেছিলেন। দুই, এত বছর পরেও যে ওল্ডম্যানের অভিনয়ে একটুও মরচে পড়েনি, তার প্রমাণ এই সিনেমা। ৯২ সালে ড্রাকুলাতেও যে রকম চরিত্রের সাথে মানানসই হিমশীতল সংলাপ বলেছিলেন যখন ওনাকে প্রথম ভাল লেগেছিল, এত বছর পর এখানেও চরিত্রের সঙ্গে মিশে যাওয়া জেদি প্রাণবন্ত সংলাপ, রাস্তায় বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে নেচে ওঠা, সিনেমার সেটে দৃপ্ত চলন। ‘you cannot capture a man’s entire life in two hours, all you can hope is to leave the impression of one’ অথবা ‘I won’t work with half the producers on the lot, and the other half won’t work with me’ – সঠিকভাবে ম্যাঙ্কের পাগলামোগুলো সংলাপে উনি ফুটিয়ে তুলেছেন। তিন, সাদা-কালোয় দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফি। অদ্ভুত ছায়ার কাজ।

এবার হলিউডের পাশাপাশি গোটা পৃথিবীর আরো্ চারজন বর্ষীয়ান অভিনেতাকে বেছে নেব আন্তর্জাতিক সিনেমায় তাদের অবদানের জন্য। এখানে একটা প্রশ্ন আপনারা করতেই পারেন, বর্ষীয়ান কেন? তরুণ কেন নয়? আসলে, যারা অনেক  দশক ধরে ভাল অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখে এসেছেন, আমার বিচারে তাদের আমি ওপরে রাখতে চাই। যেমন ধরুন, এই মুহূর্তে ভারতে মুখ্যভূমিকায় কারো নাম  জিজ্ঞেস করলে কিন্তু অমিতাভ বচ্চনের নাম মুখে আসবে, অন্য কোন তরুণ  নায়কের নয়। তেমনি চরিত্রাভিনেতা বললেও নাসিরুদ্দিন শাহের কথা মাথায় আসবে। অথচ বয়সে দুজনেই আশিতে পৌঁছে গেছেন। সেই হিসেবেই আমি  বেছে নেব ইউরোপ থেকে ম্যাজ মিকেলসেন (ডেনমার্ক), জেভিয়ার বারডেম (স্পেন) এবং এশিয়া থেকে মোহম্মদ আমির নাজি (ইরান) ও মাসাহিরো মোটোকি (জাপান)।

ম্যাজ মিকেলসেন ৫৬ বছরের এমন একজন অভিনেতা যিনি হরেক রকমের ছবিতে অভিনয় করেছেন। পুশার (১৯৯৬)-এ ড্রাগ ডিলার থেকে ব্লিডার (১৯৯৯)-এ মনোরোগে ভোগা পরিচালক, শেক ইট অল অ্যাবাউট (২০০১)-এ সমকামী দম্পতি হওয়ার পাশাপাশি ওপেন হার্টস (২০০২)-এ তরুণ ডাক্তার, জেমস বন্ড সিনেমার ‘ক্যাসিনো রয়েল’ (২০০৬) এর ভিলেন, আবার ২০০৮-এ  ফ্লেম অ্যান্ড সাইট্রন ছবিতে ডেনমার্কের স্বাধীনতা সংগ্রামী, দ্য হান্ট (২০১২) ছবিতে এক স্কুলশিক্ষক, এবং ২০১৮-য় ‘আর্কটিক’ ছবিতে আটকা পড়া এক  অভিযাত্রী। এইরকম ভার্সেটাইল এক অভিনেতার কোন্‌ ছবি ছেড়ে কোন্‌ ছবি নেব?

আমি বেছে নিলাম ওনার শেষ ড্যানিশ ছবি ‘অ্যানাদার রাউন্ড’ (২০২০)।  চারজন স্কুলশিক্ষক রোজ মদ খায়। নিছক আড্ডায় বসে আনন্দ করার জন্য নয়। তারা দেখতে চায় এই দৈনিক সুরাপান কিভাবে তাদের সামাজিক ও পেশাগত জীবনে প্রভাব ফেলছে। ফ্রি স্টাইল অভিনয়। বাকিটা দেখুন, আর বলব না। অস্কার পাওয়া ছবি, ভালই লাগবে।

জেভিয়ার বারডেম স্পেনের ৫৩ বছর বয়সী এক শক্তিশালী অভিনেতা, যার ঝুলিতে জেমন জেমন (১৯৯২), দ্য সি ইনসাইড (২০০৪), নো কান্ট্রি ফর ওল্ড মেন (২০০৭), ভিকি ক্রিস্টিনা বার্সেলোনা (২০০৮), স্কাইফল (২০১২), মাদার  (২০১৭), লাভিং পাবলো (২০১৭) এরকম বেশ কিছু আন্তর্জাতিক বিখ্যাত সিনেমা রয়েছে। অভিনয়ের জন্য প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন। প্রধানত লো টোন চোয়ালচাপা অভিনয় করতে ভালবাসেন। স্ক্রিনে শুনতে ভাললাগে তার হাস্কিং ভয়েস। যে কোন সমালোচককে যদি ওনার সেরা ছবি বাছতে বলা হয়, তাহলে দ্বিধা না করে যে কেউ ওনার হলিউড ছবি ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড মেন’ বেছে  নেবেন। আমিও একমত। কিন্তু এখানে আলোচনা করব ওনার অন্য এক স্প্যানিশ ছবি নিয়ে, যেহেতু ওনাকে স্পেনের অভিনেতা হিসেবে উপস্থাপিত করেছি।

‘দ্য সি ইনসাইড’ এক বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে বানানো অন্যরকম ছবি। বারডেম  এখানে তার যৌবনে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের ফলে অথর্ব হয়ে যাওয়া এক রুগি, যে বিছানা ছেড়ে নড়তে পারে না। প্যারালাইজড। সে চায় আইনসম্মতভাবে তার জীবন শেষ করতে, ডাক্তারি পরিভাষায় যার নাম ইউথানেশিয়া। সেই নিয়ে দীর্ঘ ২৮ বছরের লড়াই। এবং এই লড়াইয়ে একদিকে যেমন তার পাশে রয়েছে এক মহিলা উকিল যিনি মনে করেন বারডেমের দাবি যুক্তিসঙ্গত, অন্যদিকে তার আরেক প্রতিবেশী মহিলা যিনি মনে করেন বারডেমের বেঁচে থাকা উচিৎ। ১২৫ মিনিটের বেশ ভাল জীবনমুখী ড্রামা। আর এসব ছাড়িয়ে বারডেমের বিছানায় শুয়ে শুধু মুখের অভিব্যক্তি দিয়ে চালিয়ে যাওয়া লড়াই, যা দেখে দর্শক তারিফ করতে বাধ্য।

মোহম্মদ আমির নাজি বয়সে অমিতাভ বচ্চনের সমসাময়িক, ৭৯ বছর। এবং এইমুহূর্তে ইরানের চরিত্রাভিনয়ের অন্যতম প্রধান মুখ। রিটায়ার্ড আর্মি  অফিসার। সিনেমায় কেরিয়ার শুরু করেছেন দেরিতে, ১৯৯৭ সালে। কিন্তু মজিদ মজিদির বেশিরভাগ সিনেমায় উনি এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। যেদিন ইরানের সিনেমা নিয়ে লিখেছিলাম, ওনার ‘চিল্ড্রেন অব হেভেন’ আর ‘বারান’ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, তাই আজ আর ওনার অন্য কোন ছবি আলোচনা করব না।

মাসাহিরো মোটোকি জাপানের ৫৬ বছর বয়সি অভিনেতা, যিনি অভিনয়ের জন্য অনেকবার পুরস্কৃত হয়েছেন। সুমো ডু, সুমো ডোন্ট (১৯৯২), গোনিন (১৯৯৫), দ্য বার্ড পিপল ইন চায়না (১৯৯৮), জেমিনি (১৯৯৯), ডিপার্চারস (২০০৮), দ্য এম্পায়ার ইন অগস্ট (২০১৫) এবং দ্য লং এক্সকিউজ (২০১৬) ওনার প্রশংসিত ছবির মধ্যে কয়েকটি। জাপানের সিনেমা প্রসঙ্গে ‘ডিপার্চারস’ নিয়ে  আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি। এই সিনেমা ওনাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিল। ওনার আরেকটা ছবি দেখার জন্য আমি সবাইকে অনুরোধ করব- ‘দ্য বার্ড পিপল ইন চায়না’। মনোযোগ দিয়ে দেখুন। অদ্ভুত এক আনন্দ পাবেন।

(ক্রমশ)

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন