বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

অবলা, সবলা, যাযাবরজীবনপর্ব ও ধর্ষণ




বেশ কয়েক বছর আগে কোন একটা ধর্ষণের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ মাধ্যমে দুজনের দুটো মন্তব্যের কথা মনে পড়ছে। প্রথমটি ছিল এইরকম – ধর্ষণের কোন প্রতিকার নেই, সমাধানও নেই। তাই ধর্ষণের শিকার হলে সেটাকে এনজয় করতে শিখুন। একমাত্র এটাই পথ ধর্ষণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার। আর দ্বিতীয়টি ছিল – মেয়েদের যেহেতু শারীরিক সক্ষমতা কম, যেহেতু মেয়েরা শক্তির নিরিখে ছেলেদের থেকে পিছিয়ে, তাই ধর্ষণ আছে, থাকবে। নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব এই যুক্তি। যখন একটি মেয়েকে তার বিনা অনুমতিতে সঙ্গম করা  হয়, তখন মেয়েটার পক্ষে কোনভাবেই সেটা এনজয় করা সম্ভব নয়। বরং সেটা তার পক্ষে চূড়ান্ত শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন।আর গণধর্ষণের ক্ষেত্রে তো সেটা সাঙ্ঘাতিক একটা পরিস্থিতি। উপরোক্ত মন্তব্যদাতাদের সহমর্মীতার তারিফ  না করে পারছি না কিন্তু শুধু তারিফ করেই হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারছি না কেননা ভারতের ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর ২০১৮ সালের রিপোর্ট বলছে, এ দেশে প্রতিদিন ৯১টা করে ধর্ষণ হয় যার মানে দাঁড়াচ্ছে প্রতি পনের মিনিটে ভারতের কোথাও না কোথাও একজন মহিলা ধর্ষণের শিকার হন আবার অন্য একটি রিপোর্ট থেকে এই তথ্য পাচ্ছি ২০২০ সালে প্রতিদিন ৭৭ জন মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন যাই হোক, এই সব তথ্যের অবতারণা করে সময়টাকে আর অপচয় করতে চাই না এগুলো আপনারা একটু চেষ্টা করলেই হাতের মুঠোফোনের মাধ্যমে আন্তর্জাল থেকে দেখে নিতে পারবেন তাই বরং আসল কথায় আসা যাক উপরোক্ত মন্তব্যকারী দুই ভারতীয় বাঙালি পুরুষের( যতদূর মনে পড়ছে, তারা বাঙালিই ছিলেন) কথা প্রসঙ্গে আসিনারী  অবলা নারী কি সত্যিই অবলা না সবলা? কোনটা সত্যি? নারী মাত্রেই অবলা, এরকম একটা ধারণা সমাজের নিরানব্বুই দশমিক নিরানব্বুই শতাংশেরই আছে কিন্তু নারী এরকম অবলা হল কী করে বা কবে থেকে, যখন কিনা প্রকৃতির প্রায় সব জীব ও উদ্ভিদেরই আত্মরক্ষার জন্য নিজস্ব কোন না কোন ডিফেন্স মেকানিজম ও স্ট্রাটেজি আছে! নারী তো প্রকৃতিরই একটা জীব তাহলে  নারীর সেই  ডিফেন্স মেকানিজম ও স্ট্রাটেজি কোথায় গেল? কোথায় যে গেল সেটার অন্বেষণ আমরা একটু পরে করব তার আগে একটু দেখে নেব, এই  নারীদের মধ্যে থেকেই কিছু কিছু নারী আমাদের সমাজে তাঁদের শক্তির পরিচয় দিয়ে সমাজনন্দিত হয়েছেন আমরা দেখেছি পি.টি.উষা এবং মেরি কমের মত নারীরা কতখানি শক্তির পরিচয় দিয়ে বিশ্বনন্দিত হয়েছেন এরকম আরও অনেক নারীরাই আছেন দেশে বিদেশে তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? চেষ্টা করলে নারীরাও শক্তি অর্জন করতে পারেন তাই তো? তাহলে এটা বোঝা গেল আশা করি, অবলা থেকে সবলা নারীতে উত্তরণ শুধু একটু চেষ্টার ব্যাপার তার চাইতে আর বেশি কিছু নয় তবুও এ প্রসঙ্গে আরও আনেক কথাই বলার আছে কিন্তু আপাতত এই পর্বের আলোচনাটা আমি এখানেই মুলতবি রাখছি বরং এবার আসি সাধারণ ভাবে নারী যে অবলা, সেই প্রসঙ্গে আজকের নারী যে সাধারণ ভাবে অবলা, সেটা সভ্যতার দান অনুমান করতে পারি, আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ এটা পড়ে একটু অবাক হয়েছেন হয়তো কারো কারো খুব কৌতুহল  হচ্ছেএটা আমি কেন বলছি? কোন যুক্তিতে? মাননীয় আগ্রহী পাঠক, আপনার কৌতূহল নিরসনের দায় এবং দায়িত্ব আমার এর জন্য আমাদের একটু মানবসভ্যতার ঊষা লগ্নে ফিরে  যেতে হবে সভ্যতার একেবারে উন্মেষ লগ্নের প্রাক পর্বে যখন মানুষ যাযাবর জীবনযাপন করত, তখন তারা নিজেদের প্রয়োজনেই দলবদ্ধ্বভাবে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াত খাবার সংগ্রহের জন্যে বলা বাহুল্য  মানুষ জাতিটা সেই সময় খুব দুর্বল আর অসহায় ছিল অন্যান্য ভয়ঙ্কর দানবীয় প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তুদের সর্বত্র অনায়াস বিচরণের কারণে তাদের সবসময় ভয়ে ভয়ে যূথচারী জীবনযাপন করতে হত প্রকৃতির মধ্যে থেকে খাবার সংগ্রহের জন্য মানুষ সেসময় গাছের ফলমূল যেমন খেত, তেমনই ছোটখাটো জীবজন্তু শিকার করেও তাদের কাঁচা মাংস অথবা হয়ত আগুনে (আগুন আবিষ্কারের পরে) ঝলসে নিয়ে খেত, একথা আধুনিক  জ্ঞানবিজ্ঞানের বিস্তারের ফলে আজকের দিনে একটা শিশুও জানে। তখন পৃথিবীর পরিবেশ কতটা ভয়ঙ্কর ছিল তা শুধু পাঠককে একটু কল্পনা করতে অনুরোধ করব।

সেইরকম একটা সময় মানুষ যেমন খাবারের জন্য পশু শিকার করত, ঠিক সেইরকমই পশুরাও তাদের খাবারের জন্য মানুষ শিকার করত আর একটা কথা এখানে উল্লেখ করে রাখি, মানুষ যে দলবদ্ধ্বভাবে এখানে ওখানে যাতায়াত করত, তাদের সেই দলে নারী পুরুষ দুইই থাকত সেই সময় মানুষ শিকার করতে গিয়ে যখন অন্য পশুদের দ্বারা আক্রান্ত হতো, তখন তার ফলে দলের মধ্যে থেকে একজন পুরুষ বা নারী যে কাউকেই জন্তুরা টেনে নিয়ে যেত পাঠকদের এখানে একটা জিনিস মনে রাখতে অনুরোধ করব যে তখনকার যাযাবর জীবনে কিন্তু লিঙ্গ বৈষম্য ছিল না সবাই সব কাজই করত অর্থাৎ করতে পারত এখানে প্রমাণ হয়, সেই প্রাগৈতিহাসিক কালের জমানায় নারীও পুরুষের সমান শক্তি ধারণ করত অর্থাৎ প্রকৃতি কিন্তু নারীকে সবলা করেই গড়েছে আশা করি এই মোক্ষম গুণটার কথা পরবর্তী আলোচনায় বিস্মৃত হবেন না তখনকার পৃথিবীতে এখনকার মত এত অসংখ্য মানুষও তো বিচরণ করত না অতি অল্প কিছু মানুষ দল বেঁধে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াত খাবারের সন্ধানে

তখনকার সেই দিনগুলোতে জন্তুজানোয়ারদের আক্রমণে  যেমন মেয়েদের প্রাণ দিতে হত, ঠিক তেমনই ছেলেদেরও প্রাণ দিতে হত কারণ গোটা ব্যাপারটাই  ছিল খুব অনিশ্চি সেই সময় তখনকার মানুষরা হিসেব করে দেখল যে যেসব  ক্ষেত্রে পশুরা এক বা একাধিক ছেলেদের টেনে নিয়ে যেত, তাতে তাদের দলের যত না ক্ষতি হত, তার চাইতে অনেক বেশি ক্ষতি হত, যখন পশুরা এক বা একাধিক মেয়েদের টেনে নিয়ে যেত পাঠকরা কি অনুমান করতে পারছেন কী সেই কারণ? হ্যাঁ পনারা ঠিকই ধরেছেন, নারীর জন্ম দেবার অর্থাৎ প্রজনন ক্ষমতার কারণেই এমন ঘটনা ঘটত তখন নারী পুরুষের যৌনজীবন এখনকার মত এমন সুশৃঙ্খল একগামী ছিল না, বলা বাহুল্য তাই দলের মধ্যে ছেলেদের  তুলনায় মেয়েদেরকে  বাঁচিয়ে রাখার গুরুত্ব সেই আদিম মানুষরা অনুধাবন করতে পেরেছিল অর্থাৎ নারীর সংখ্যা সে সময় দলের মধ্যে কম হওয়া মানেই নতুন মানুষ জন্মাবার সম্ভাবনা কম হয়ে যাওয়া শুধু নয়, দলটির ক্রম অবলুপ্তির সম্ভাবনা বেড়ে যেত কিন্তু উল্টো ক্ষেত্রে অন্য কোনরকম ক্ষতির সম্ভাবনা ততটা থাকত না এইরকম একটা পরিস্থিতিতে সে সময়ের আদিম মানুষরা চাইল নারীকে যতটা সম্ভব নিরাপত্তা দিয়ে সুরক্ষিত করে রাখতে দলের বা প্রজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে অর্থাৎ এখান থেকে একটা কথা স্পষ্ট যে নারীকে সন্তান জন্ম দেবার যন্ত্র হিসেবে মানবসভ্যতা এতদিন ধরে ব্যবহার করে এসেছে যাই হোক আবার ফিরে যাই আমার আলোচ্য প্রসঙ্গে প্রজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে নারীকে আর বাইরে নিয়ে যাওয়া হত না তার বদলে তাদের  তখনকার মানুষদের অস্থায়ী থাকার যে জায়গা থাকত, সেখানেই রেখে যাওয়া হত আর সেই সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার প্রয়োজনীয় নানা কাজকর্ম করার দায়িত্ব থাকত নারীদের ওপরে এইভাবেই শুরু হয়ে যায় একধরনের আদিম শ্রমবিভাজন যার ফলে ঘরের কাজ করত নারীরা আর বাইরের কাজ করত পুরুষরা

এ থেকে এটা প্রমাণ হলএক, নারী অবলা নয়, বরং সবলা ছিল সভ্যতার প্রত্যূষে দুই, সভ্যতার কারণেই নারী আজ অবলা হয়েছে নারীর ঘরের কাজ আজ তাকে দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী করেছে তিন, প্রজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যে নারীকে এক সময় ঘরবন্দী করা হয়েছিল, আজ সভ্যতার বিকাশের এমন পরম লগ্নে যখন কিনা মানুষ চাঁদে বসবাসের স্বপ্ন দেখছে কিম্বা পরমাণু অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ক্রমাগত এক দেশকে রীতিমত শাসাচ্ছে, সেইরকম একটা পর্যায়ে এসে যার জন্য এই সভ্যতা তৈরী হতে পারল, সেই নারী জাতিকেই একটা অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি করে দেওয়া হয়েছে এবং যারা সেদিন নারীদের ঘরবন্দী করেছিল, সেই তারাই, প্রায় গোটা পুরুষ জাতিই আজকে নিজেদের প্রতিহিংসা চরিতার্থতার জন্য, কিম্বা কখনও কখনও নিজেদের লোভ লালসা মেটাবার জন্য যখন তখন, যেখানে সেখানে ধর্ষণ, গণধর্ষণ করছে  এবং তারপরে তাকে খুন করে তার দেহটা লোপাট করে দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করছে

এবার এখন যদি কেউ এসে বলেন সবলা নারী তো এখন অবলা হয়েছে অর্থাৎ যা হবার তা তো হয়েই গেছে, আর তো কিছু ফিরে আসবে না; অতএব এখন সময়ের সঙ্গে নারীকে মানিয়ে এবং মেনে চলতে হবে, তাদের মনে রাখা দরকার, সব কিছুর ওপরে এখনও প্রকৃতি রয়েছে রয়েছে প্রকৃতির নিজস্ব মেকানিজম বা নিয়মকানুন সেগুলো যাঁরা মানবেন তাঁরাই টিকে থাকবেন আর যারা মানবেন না, তারা অবলুপ্ত হবেন হ্যাঁ, আমি তাদের কথাই বলছি যাঁরা ধর্ষক বা কোনভাবে ধর্ষণকে সমর্থন করেন কেননা প্রকৃতিরও নিজস্ব কিছু মেকানিজম আছে যার ফলে সবলা নারীশরীর পরিবর্তিত হতে হতে আজকের অবলা নারীশরীরে এসে পৌঁছেছে, ঠিক সেই একই রকম মেকানিজম অবলম্বন করেই আজকের অবলা নারী আবার আগেকার সবলা নারীতে উন্নীত হতে পারেন

পৃথিবীটা কিন্তু ঘুরছে পৃথিবীটা কিন্তু ঘুরবেই সে আমি আপনি, আমরা যতই একে অপরকে নিজের পকেটে গুঁজে রাখতে চাই না কেন, পৃথিবীটা ঘুরেই চলবে এবং মানবসভ্যতাও এ পৃথিবীতে ততক্ষণ অব্দি বিরাজমান থাকবে, যতক্ষণ না একটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এসে তাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করছে

 

(ক্রমশ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন