বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

অমলেন্দু চক্রবর্তী

 

সমকালীন ছোটগল্প


ও মধু - ও মধু


তারপর কি বলবে আই লভ ইউ আই লভ ইউ। ইয়েস লভ‌ ইউ টু... কেন জানেন? আইশোলেসন, আইশোলেসন করে কবিতার সিরিজ সেরে ফেলল মৃন্ময় ছোঁড়াটা, যেন বা লিগ চলছে এগারো ইধার এগারো উধার। তারপর উত্তেজনা উচ্ছ্বাস উন্মুক্ত ময়দান উন্মাদ নব্ব‌ই মিনিট দেওয়ালে যায়গায় কুলাচ্ছে না। হৈ হৈ কান্ড রৈ রৈ ব্যাপার। এদিকে আমার হয়েছে যত জ্বালা, পায়ের তলায়  সর্ষে হলে যা হয়। ঘুরে ফিরে আসি (কদিন আগে তখনো চাকরি করছি, পনেরো দিনের জন্য গৃহবন্দী) ঘরে ঢুকিয়ে দেয়, পনেরো দিনের কোরেনটাইন, তাপ্পর ডাক্তারবাবুর সমক্ষে। মানে দেড় মিটার দূরত্ব রেখে। পিস্তলের মতো একটি  মেসিন দূর থেকে টেম্প্রেচার দেখে লিচ্চেন।  ইঙ্গিত করলেন, সেখানে দাঁড়িয়ে  এক রোবটবৎ আগাপাশতলা প্লাস্টিকমোড়া মানুষ। তাঁর কিঞ্চিত দূরে একটি চেয়ার বুঝলাম ঐখানটিতে বসতে হবে। বসলুম যথারিতি তিনিও এগিয়ে এলেন।  এসময় আমি মনুষ্য ন‌ই, যেন বা একটি জিতা-জাগতা প্রচন্ড বিস্ফোরক বম্ব, কখনো ফেটে যাবো, কৌ নেই বলতে পারতা। এঁগ্যে 'পোখরানে' লিয়ে গিয়ে পরিচ্ছন্ করলে হয় না? এত‌ই যদি ডেনজারাস মরুভূমিও টুকচাঁই ঘুরাফিরা হথো। মারিভয়া ইত ডরভয়, উ এমনই পোশাকে মুড়া। মুঢ়টাও, সব ঠিক আছে ঐ যে ফেসগার্ড না কি বলে। বড় ডেঞ্জার! উটো আমি প‌ইরে দেখেছি পরলেই সব ধুঁদলা ধুঁদলা একদম ঝাপসা পারা। পটাপট্ নাকের বদুলে চোখট্ই খ্যাঁচারে দিয়ার বড্ড ডরভয় হয় বাছা, শালো টুং করে যদি টুনায় দেয় হয়ে গেল জীবন ভর কানা, জীবনভর গনঞ্জন। ইহার নাম কোভিড্ টেষ্টো বাঁচলে ভালো নাইলে কিষ্টো। যায় হোক হে কোরোনা সিন্ধুক, চালায়ো না বন্ধুক্। মুঢ়টি চিয়ারের পিছুদিকে ঝুলিয়ে, আকাশ বরাবর নাকের দুই ফুটা, আমি গোঁফ রাখি না। ফুটায় লোম কাটা হয়েছে ডর! বঢ়বালাই বঠে বাবু। তবুও চোক্ষু গোলান মুজি দিলম। নাকে একখানা দেড় বিত্তার নল ঢুকিয়ে সুড়সুড়ি হাঁচি, নেটাপোঁটা নিই পরীক্ষা  নিরীক্ষা। কোরোনা মহারাজ আমাকে এমন টেষ্ট কয়েকবার। আঁইজ্ঞা চুপুচুপু বলি  ফুটাটা বড় হৈঁ গেছে। ব্যেথাটোও যেতে খুঁজেনি জলদি।

গল্প এইটে নয়। গল্প হল, কোরেনটাইন থাকাকালীন যারা আমাকে তাড়িত করছিল অতীতের সেই দিনগুলির দিকে, ঐ ও মধু ও মধু। পড়াশোনায় যে ধার ছিল তাতে থার্ড বেঞ্চেই আমার জায়গা। যদিও আমি লাস্ট বেঞ্চেরই উপযুক্ত‌ ছিলুম। কিছু বন্ধুদের বদন্যতা এবং অকৃত্রিম ভালবাসাই আমাকে থার্ডবেঞ্চে টেনে নিয়ে ছিল। তবে আমি একটি কারণে ক্লাসের সবার প্রিয়, ফাস্ট টু লাস্ট বেঞ্চের সকলের মধ্যেমণি 'খেলা' ক্রিকেট ফুটবল হান্ড্রেট্ মিটার স্প্রিন্ট, রিলেরেস  জ্যাভলিং, হকি আউটডোর গেম‌্ই কেবল। ইভন মেয়েরাও তারা যে ইন্টারেস্ট্ রাখতো সবায়‌ই, তা নয়। কেউ কেউ এতেই বাজিমাত্ গ্রেভানস্ তো রাখাই যায়, তাই না! পালোয়ানির দুর'মুশ ভাঁজার আরেক দোস্ত ধীরেন ওহ্ যেন লোহার ভীম! যেমন বল‌-এ হেড করতো। তেমনি হেডে হেড্ করতো। যার সঙ্গে হেড  অন কোয়ালিশন হত কয়েকটি স্টিচ্ তো পড়তোই, আমি ফার্লাং দূরত্ব থেকে ক্যেরিকেচার, পকেটে রেখে; খেলতুম্ ষাঁড়কে ভয় পায় না এমন কেউ আছে বল!

এ গেল লোহার ভীম। এবার অলরাউন্ডার রতন। রোমান্টিক পঢ়া, প্রেম ভালোবাসা সবেতেই বাজিমাৎ। মেয়েদের বেঞ্চ থেকেও খুনসুটি করত। নেগলেজিবুল্ বলা যাবেনি। রতন আসতো সুদামডি্ থেকে ব্যেগেই এক্সট্রা জামা প্যান্ট রাখতো। টিউশানি পড়তো এদিকেই, ইচ্ছে হলে ফিরতো, না হয় বাড়িতে বলে আসতো। তখন ল্যান্ডফোনের জামানা আমী'রদের ঘরে থাকতো আমরা সরকারি স্কুলের পড়ুয়া। বেশির ভাগ মধ্যবর্তী পরিবার থেকে বিলং করি। তাই রতন বলে কয়েই আসতো। টিউশন পড়তে, আমরা ছাড়াও হিরন্ময়ী শোভা চামেলী মিঠু স্বপ্না মল্লিকা সুস্মিতা কেকা চন্দনা বন্দনা শিপ্রা। রতনের আকর্ষণ এইখানেই। যেহেতু মধ্যমণি তাই আমার কাছে কোন গুপ্ত নেই, এবং অদ্ভুত ব্যাপার আমকে মোটামুটি সবাই অকপট, মিঠু একদিন-

--মল্লিকা চন্দনা রতনের দিকে পাল্টি খাচ্ছে জানিস?

--জানি সব‌ই চোখে পড়ছে।

--জানাজানি হয়ে গেলে-

--হয়ে গেলে হবে।

--পরিণাম খারাপ হবে না?

--ওসব ওদের ভাবতে দে।

--তোরা তো আর একবছর!

-- তো?

লাস্ট বেঞ্চের শঙ্কর প্রায়ই আমাকে ফিসফিস করে বলে-

--তরে দেখাইতে চাই! তুই এইহানে বসবি, তবে না! তক্কে তক্কে থাকতি হ‌ইব তবে না! কোন গুরুতর রহস্য যে শঙ্কর আমাকে দেখাতে চায় কে জানে! আমরা হলুম অনেক ভাইবোন। শঙ্করদের মিষ্টির দোকান।

--যাহ্ আর বলবনি অন্ধকারটা আমারই থাক। তবে ইমানদরি বলছি আমি সৎ  আর পরিশ্রমী তনমন সবসময় দিতে পারি। ধনসম্পত্তি নাই, পারব নাই।

--কিছু কিছু আমিও জানি শঙ্কর।

--হাঁ তোর সাথে সবার দোস্তি।

--কিন্তু আমি যে দেখাবো কমসে কম তুই দেখিস নাই।

মনে সন্দেহ জাগলো কোন অসভ্যতা নয়তো! বলছে না তো দেখাবে।

--হিরন্ময়ী ইলায়চি চিবায় জানস?

--জেনেই আমার কি লাভ বল? আমাকে থোড়াই না দিবে, বল, এদিকে চুইংগাম জুটে না, এলাচ? একটা কথা আছে না, মা খায় ভাচা বুনে, ছেলা খাই এলাচ কিনে।

অনুপায় হয়ে‌ একদিন হিরন্ময়ী এলাচ রহস্য শঙ্করের তাহকিকাত্, একদম সাবধান, যেন তুই কুছু জানিস না। যা দেখলুম সেই নাসিকা গব্হর হ‌ইতে টানিয়া আনিয়া পাকাইয়া এলাচ। এদিক সেদিক চাহিয়া দন্ত দ্বারা... থাক হিরন্ময়ী থাক!

তোমার শরীর খুব ভালো, খেলাধুলা কর বুঝি? এক স্বাস্থসচেতন দাদা। ডন মারছেন সরস্বতী নদীর পাশের মাঠে। সঙ্গীটির কাছ থেকে বিড়ি নিয়ে ফুঁক‌ও  মারছেন। শীতকাল আড়‌ইটে নাগাদ।

হঠাৎ মনে হল, আদিসপ্তগ্রাম পায়দলঞ্চু ঘুরে এলে বেশ  হয়। যেমন ভাবা  তেমনই কাজ। এই উড়ুক্ক মনোভাব আমাদের বংশের ধারা, উঠলো বাই তো কটক যায়। হাঁটাও হয়। শরৎস্মৃতি মন্দির দাঁয়ে রেখে হাঁটা জুড়লাম। ঘুড়ি ওড়ানো লাট্টু ঘোরানো খুব খুব নেশা ছিল। সুর্যের তেজ চোখে পড়তো রাত্রে পড়ার সময়।  প্রায় দেখতেই পেতুম না। ঘরে ভয়ে কাউকেই বলতে পারতাম না। ‘ষষ্টি’ বান্ধবী বলেছিল, তুই রাতকানা হয়েচিস, ডাক্তার দেখা।

সেদিন বুঝতে পারলাম যেদিন আদিসপ্তগ্রাম থেকে ফিরতে রাত হয়ে গেল। তখনো বোধহয় বৈদ্যুতিক আলো আসেনি গাঁ'গঞ্জে। হাতড়েই একরকম আর দুএকজন সঙ্গী লন্ঠনধারি পেয়ে ছিলুম সেদিন। কোন রকমে বাড়ি ফেরা। লালু বাজারে থলে হাতে আমাকে দেখে এগিয়ে এল, বল!

--কি বলব? যথাপূর্বং তথা পরং।

--আরে পালোয়ান ভ্যাক্সিন নিলি?

-- নেব। তুই নিয়েছিস তো?

--আমার হয়ে গেছে। হ্যাঁরে ঐ মোজনুটার কি খবর? রতন রে রতন, খবর জানিস কিছু? কতকাল কারো সঙ্গে দেখা হয় না। কয়েকজন ছাড়া তাদের মধ্যে তুইও। তুলসী  নিমা মাঝে মাঝে আসে। কেমন সব উবে গেল বল?

--ঠিকই বলেছিস পুরনো স্মৃতি, বন্ধুদের ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে। কে কোথায় কে জানে! আজকাল যোগাযোগের এতো ভালো মোবাইল মিডিয়া, তবুও!

--সবাই ব্যস্ত সংসার ধর্মে।

লালুর বাজার সারা থলে ভর্তি। হাই পাওয়ার চশমা। শরীর ভারি হয়েছে। ক্লাসের  ফার্স্ট বয়। প্রতিষ্ঠা তেমন পায়নি। আমার দিকেই চেয়েছিল।

--চলি রে, খবরটবর পেলে জানাস, দেখতে ইচ্ছে করে।

লালু ধীর পায়ে এগিয়ে গেল।

আমাদের তখন অন্য স্কুলে যাওয়ার পালা চলছে। আমাদের পরিবারের বিধ্বস্ত অবস্থা, তাই সেরকম কোন উচ্চবাচ্চ নেই। বাঙালি বেকার ছেলেরা যা করে আমিও তাই করতে লাগলাম। টিউশনি আর নাট্যচর্চা। আর একটু আধটু কবিতা টবিতা। আমার কাছে অনেকগুলি ছেলে মেয়ে আসতো। ব্যাচ করে। সক্কালে একটি বিকালে একটি। বাকি বাড়ি বাড়ি গিয়ে। আমার বাড়ির ব্যাচের মধ্যে দুটি  জুড়ি বেঁধে গেছে মধুশ্রী আর সৌমেন পড়তেই খুনসুটি বাইরে বেরিয়েই গান ধরে ‘ও মধু – ও মধু আই লব্বিউ আই লব্বিউ’।

আমার মনে পড়ে যায়, রতন সুভাষ মল্লিকা সুস্মিতা কেকা। আর স্কুল চত্বরে ভাঙ্গা মালগাড়ির ওয়াগান, ঝুরি নামা বট গাছটা, তার তলায় বসে চুরন পাচক বিক্রেতা ছেদিলাল, বরফের গোলা আইসক্রিম বিক্রেতা লছমন সাহূ, গুপচুপ বিক্রেতা ভগ‌ওয়ান দাশ কুড়মি মাহাতোদের ধান ক্ষেত যেখানে ‘অনিল টকিজ'।  লালুদের বিশাল কত কত মেহগিনি গাছ বাগান। আর সেই স্কুল মাঠে প্রার্থনার সুর ‘অন্তর মম বিকশিত কর অন্তর হে…

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন