বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

মৌ চক্রবর্তী

 

ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি : ওই আলোকেই বলি, ধন্যবাদ হে




 

প্রতি,

সম্পাদক কাজল সেন-এর তত্ত্বাবধানে সমৃদ্ধ আন্তর্জালিক মাধ্যমে লেখার সুযোগ। তাঁর প্রেরণায় নতুন করে পুরনো সে দিন ফিরে দেখা। মানে ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার। এবং তারই জন্যে খোলা চিঠি পাঠকের সন্ধানে। রথের সময় বলে রথের দিনের একটা বিজ্ঞাপন নিয়েই নাটকের কথা। নাটকের অন্দরমহলের অনেক কথাই লিখেছেন তাত্ত্বিক অরুণিতা রায়চৌধুরী। তাঁর একটি তথ্য পাই এরকম যে, ১৯৯৭ সাল ৫ জুলাই একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকায় ছাপা খবর, আগামী রবিবার রথের দিন খুলছে 'রঙমহল থিয়েটার'। মানে সময়টা বোঝা গেল  তো! এর কিছু আগে থেকেই একের পর এক সব থিয়েটার হল বন্ধ হয়ে  যাচ্ছিল। ১৯৯১ সালে 'স্টার থিয়েটার' ভস্মীভূত। আবছা কথা ঝাপসা স্মৃতি থেকে। যে নাটক দিয়ে সেবারের শোয়ের সূচনা হয়, তা হল 'জয় জগ্ননাথ'। এটা জানানোর নয়। জানানোর হল, এই লেখার কিস্তির সময়টাও উল্টোরথের লগ্নে। পাঁপড়ের গন্ধে তেলে ভেজা ঠোঁটে একটা মেলায় ঘুরছি। চারপাশে যাত্রাপালার ঢঙে গান চলছে। রোশনাই মাটির রঙ বদলে দিতে চাইছে। এরই মধ্যে মনে পড়ল, 'জয় জগ্ননাথ' নাটকের কলাকুশলীদের নামগুলো লেখা যাক। জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, কল্যাণী মণ্ডল, রত্না ঘোষাল, নিমু ভৌমিক, বোধিসত্ত্ব মজুমদার, দেবাশিস রায়চৌধুরী প্রমুখ। এই যে তথ্যগুলো লিখলাম, এসবই অরুণিতা রায়চৌধুরী তাঁর 'রঙমহলের কথা' প্রবন্ধে লিখেছেন। ভাগ্যিস তিনি লিখেছিলেন। নইলে আজ স্মৃতি নাড়া পড়ত না। এই নাটকের নির্দেশনা দিয়েছিলেন রত্না ঘোষাল। সেখানে তিনি যা লেখেননি সেটুক লিখি। এই নাটকের মঞ্চসজ্জার একটি বিশেষ দিক লিখেছেন তিনি, মঞ্চে দেখা যাবে সমুদ্র, ঝড় উঠবে, দেবতাদের আগমন ইত্যাদি ব্যাপার। এইখান থেকেই লেখার আমার কথাটি।

যেদিন থিয়েটার দেখতে যাওয়া থাকত, তার আগের দিন রাতে আর ঘুম হত না। এইজন্যে নয় যে কী পরে যাব, কী সাজব! তখন দুধের দাঁত পড়েছে হবে, তাই  সাজগোজের ব্যাপারটায় ঝোঁক আসেনি। মধ্যে যে আলোড়ন চলত তার একটা কারণ আলো আর আলো।  চাদরে মুখ চাপা দিয়ে শুনতাম গল্প। কোন নাটকের টিকিট কেন কাটা হল, তার একটা যুক্তি থাকত বাবার কাছে। বাবা বলত, বাকিরা নাবালক বনে শুনত। আমার ভাল লাগত মঞ্চে যে কতকিছু দেখাত, সেটা দেখে। একটা  নাটকে তো এরোপ্লেন চলে যেত মাথার উপর দিয়ে। তখন কিন্তু বুঝিনি, ওটা সত্যি নয়, পরে বুঝেছি, নকল এরোপ্লেন দিয়ে চমক ছিল। আমার উত্তেজনা খুব। মঞ্চে যাবতীয় কারসাজি দেখতাম। আর ভাবতাম, আলোগুলো একদিক যদি নাড়িয়ে দিতে পারতাম, অভিনয় বা নাটকের গল্প এসব তো বুঝতাম না ওই বয়েসে, কিন্তু একটা আকর্ষণ যেন কথা ছাপিয়ে আলোর ভেতরে টেনে নিয়ে যেত। কী সহজ ছিল আলোর নাড়াচাড়া করার।  একদিন সত্যি সুযোগ এলো, আলোগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর। আর সেটা ছিল পরীক্ষার দিন। এটুক থেকে ফিরে যাই 'জয় জগন্নাথ' নাটকের কথায়। এই নাটকটা দেখিনি। সেটা তো আগেই লিখলাম। কিন্তু এখানে যাঁদের অভিনয় তাঁদের অনেককেই দেখা। অনেকবার। তাঁদের নিয়েই কথা। যেমন, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়। তাঁকে নিয়ে লিখতে পারি। যেমন, রত্না ঘোষাল, নিমু ভৌমিক, দেবাশিস রায়চৌধুরী, তাঁদের নিয়ে পরে পরে লিখব। অভিনেতাদের যে দেখার অভিজ্ঞতা সেটা পরিণত বয়েসের। যা পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে পোক্ত হওয়ার। সে বড় শক্ত।

থিয়েটার দেখার একটা মজা ছিল। সেই মজা বইয়ের পড়ায় মেলে না। যখন পাশ-ফেলের ব্যাপারটাই মুখ্য, মুক্যু লাগে নিজেকে। মনে হয় পিঁপড়ে বনে যাই। তাহলে মঞ্চের এই পরীক্ষা থেকে মুক্তি। সিলেবাসের পড়ায় আলো একটি অপরিহার্য পাশ-ফেলের বিষয়। অনেকক্ষণ আলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে  চাইছিলাম, কীভাবে রপ্ত করব? জিজ্ঞাসা ঘুরতে ঘুরতে আমাকে নিয়ে এক লাফে  ফেলে দেয় বিছানা থেকে। যাহোক, ওই হালে পরীক্ষা। মঞ্চের আলো। আলো পড়তেই দেখলাম যিনি বসে তিনি… আর কেউই নন, নাট্য ব্যক্তিত্ব জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়। ওরে বাবা রে, পালাবার উপায় নেই! শুরুতেই তিনি প্রশ্ন করলেন,  নাটক শুরুর আগে ওই আলোটা কেন দেওয়া হয়?  আমি দাঁড়িয়ে কোথায়, বুঝিয়ে বলি। আমি ওঁর সামনে। উনি বসে রয়েছে আমাদের বিদ্যায়তনের মঞ্চের দর্শকের সিটে। সামনে পরীক্ষার টেবিল, সেখানে খাতা, প্রশ্ন আর একটা হলদে আলোর টেবিল ল্যাম্পও। পাশ দিয়ে কত আলো বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি সচেতনভাবে ওই আলোটার দিকে তাকিয়ে। উত্তর নেওয়ার তাড়া ওঁর ছিল না। এক চুমুক চায়ের শব্দ। তারপর আমার উত্তর? নাহ। এই নাটকের স্ক্রিপ্ট আমার, তাই সংলাপ নড়বড়ে। চরিত্র নড়ে? আর কাহিনি মানে সংলাপ? এর কোন রিহার্সাল তো দেওয়া নেই। প্র্যাক্টিক্যাল যা শেখা, তারই ভিত্তিতে পরীক্ষা। আনাড়ি নাট্যকার সংলাপের অভাবে একমাত্র চরিত্রকে ধরা যাক দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আর সেই চরিত্রটি আমি। বেবাক বনে আরেকটা আলোর জন্যেই হবে অপেক্ষা করছিলাম। নাকি যদি কোন ক্যারেক্টার ঢুকে এসে গোল বাধিয়ে বলে, এই যে পরীক্ষা দিচ্ছ, দেওয়া চলবে না। আমার সংলাপ তোমার বলা চলবে না।  নাহ, কেউই এল না। বুঝলাম, সবাই চরিত্রটি উত্তমরূপে রিহার্সাল করেছেন। শুধু ফাঁকি দিয়েছি আমি।

পরীক্ষক নাট্যব্যাক্তিত্ব জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় আমাকে দেখছেন। আমি হাসলাম।  উনি চায়ের শেষে কাপ নামানোর নিখুঁত শব্দ করলেন। এবারে, বলতেই হয় কিছু। উনি চুপ থেকেই চোখে চোখে প্রশ্নটা ছুঁড়লেন। আমি লুফলাম। হ্যাঁ, ঝুঁকলাম। এত বড় গুগলি যে! আচ্ছা, পরিবেশের বর্ণনায় আরও যাঁদের নাম  বলতেই হবে, লিখি। ফ্ল্যাশব্যাকে থেকে উঠে আসছেন একে একে। এই নাটকের মতন এত ভারি দর্শক আর কখনও আমার কোন নাটকে হয়নি। হবেও না। তাঁদের নাম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি- নির্দেশক নাট্যকার অভিনেতা মনোজ মিত্র। আলোর প্রবাদপ্রতীম কণিষ্ক সেন। বিভাগের আরও সবাই, আমাদের স্যারেরা, দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়, পীযূষ চক্রবর্তী, সোমনাথ সিনহা, ধ্রুব মিত্র এবং আরও অনেকেই। তো, এবারে উত্তরের পালা। অনেক ভেবেছি। তারপর বললাম যে, এই আলোটা পর্দায় ফেলা হয় মনঃসংযোগ করার জন্যে, দর্শকের অবশ্যই। এবং, তারপরই শুরু হবে নাটক।

কারণ, দর্শক। আগের পর্বে লিখেছিলাম তো, তাই না! দর্শকই নাটকের সব।  তিনি বা তাঁরা তো ছুটে-ছুটে আসেন। বাস, ট্রাম, গাড়ি। তারপর হুড়োহুড়ি করে ঘড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। থিতু হতেই এই কায়দাটি। এই আলো মঞ্চে থাকলে দেখা যাবে না কিন্তু। আগেই লিখেছি যে, মঞ্চের নাটক সময়েই শুরু হয়। হব্বেই। তাই…।  আলোর প্রসঙ্গে ছিলাম। রেজাল্ট জানতে কিছুক্ষণ আরও। মঞ্চে জ্বলছে হলদে আলো। এদিকে হাউজ কাট করা। কারণ, পরীক্ষা চলছে যে আলোর। পরীক্ষার্থী আর আলোর মধ্যে খুবই মিল পেলাম সেদিন। স্থির থাকার  চেষ্টায় যাঁদের অন্তর অল্প অল্প কাঁপছে, তারা হয় আলো না হয় পরীক্ষা দিচ্ছে। মনে হল, কাছে গিয়ে বলি, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়কে, দেখুন থিয়েটার ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারিনি। একটা ধারণা ছিল আবছা মনে থাকার সুবাদে, যে পারব। কিন্তু… মঞ্চে বাঁয়ে একটা আলো পড়েছিল। মনে করার চেষ্টা করছি কী নাম তার। নাম মনে পড়ছে না, সেদিনও পড়েনি নাকি, নাকি পড়েছিল! এতটাই ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলে আলোগুলো হাতছাড়া হয়ে যাবে। এবারে তাই লিখে ফেললাম। এখান থেকে নাটকের আলোর গতি, তার ইতিহাস কতটা জায়গা নিয়ে থাকে আমার মনে। আর মাস্টারমশাইরাও। কী যত্নে গড়ে তুলেছেন  আমাদের। যে চাইলেও ভুলতে পারার নয়। সবশেষে, আলোর কথা বলি, ওই আলো সেদিন পাশ করিয়ে দিয়েছিল। আর আমি কোনদিনও সেটা ভুলিনি, ভুলব না। আজও দর্শকের আসনে বসার তাড়া থাকে তাই, নাটক শুরুর আগেই পৌঁছে যাই। না হলেই তো মিস।  ওই আলোর দিকে দেখি। বলি, ধন্যবাদ হে। আজ তোমাকে কিন্তু দারুণ লাগছে!   

_ ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী

(ক্রমশ)

   


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন