সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

দিগন্তসেনা

 


(৫)

বেশির ভাগ মানুষের পাকাপাকি সুরক্ষার বন্দোবস্ত করে ইরাণিয়াণে উপুর্যপরি বোমা ফেলার আদেশ দেওয়া আর আশেপাশে সকলের যুদ্ধটা আদৌ হচ্ছে কি, বা হলে ঠিক কখন নাগাদ শুরু হবে এইসব প্রশ্ন আর ডামাডোলের মধ্যে শামাঙ্গীর হঠাতই মনে পড়ে গেল সেই দিনগুলোর কথা যখন চাকরীতে যোগদানের কথা জানিয়ে সম্রাটের নামে চিঠি আসতেই বাড়িতে আনন্দের বন্যা শুরু হল। অনঙ্গ সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলল যে চাকরী পাওয়ার চেয়ে চাকরী রক্ষা করাটা আরও বেশি কঠিন।এই কথায় অবশ্য সম্রাট কোন পাত্তাই  দিল না। মানময়ী কিন্তু এ ব্যাপারে সম্রাটের অক্ষমতার নমুনাগুলো মনে মনে আগেই জড়ো করতে লাগল।

গথিক আর্যদের যে দলটা পার্বত্য প্রদেশের পাদদেশে তারাও আস্তে আস্তে বেড়ে গিয়ে অনেকটাই বিস্তৃত হয়েছে শুধু নয়, মহাসঙ্গীত সম্মেলন থেকে সমাজের সব ব্যাপারে তারাও অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছে। সম্রাট চাকরীতে যাবার দরুণ ওখান দিয়ে, প্রায়ই ওদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত হয় শুধু তাইই নয়, ওদের সঙ্গে রীতিমত সখ্যতাও ওর বেশ হয়েছে। ছুটিছাটার দিনে বন্ধুদের নিয়ে ওখানে আড্ডা মারতেও যায়। কিন্তু গথিক আর্যদের দলটা নানা জায়গায় ঠিক কবে থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সেটা ওদের কেউই নজর করে দেখেনি। এটা হয়েছে মুলত বিবাহের সূত্র ধরেই। ওদের মেয়েরা এখানকার ঘরে বিয়ে করে আসা দিয়েই মুলত শুরু হয়। আস্তে আস্তে এখানকার মেয়েরাও বিবাহ সূত্রে ওখানে গিয়ে পড়ে। এর ফলে আস্তে আস্তে একটা সংকর সংস্কৃতির জন্ম হতে থাকে যেটা কারুর কাছেই খুব একটা মঙ্গলজনক বলে মনে হয় না। সম্রাট বুচি বলে  ওখানকার একটা মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। বুচি মুলত চুঁচি প্রধান হওয়ায় সে  সম্রাটকে অনায়াসেই মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারে। সম্রাটের অনুপস্থিতিতে সে সম্রাটের অন্য বন্ধুদের নিয়ে বিছানায় যায়। সকলেই বুচিকে সম্রাটের বৌ হিসেবে নির্বাচন করে বিয়ের প্রস্তাবে মানময়ী ও অনঙ্গর কাছে আর লোক দেখানো  এক  পাত্রী দেখার আয়োজন করে। কিন্তু মানময়ী বা অনঙ্গ কেউই তা রাজি না হওয়ায় সম্রাট বাড়িতে অশান্তি শুরু করে দেয়। সবচেয়ে সহজ পথটাই সারাদিন ধরে গজগজ করার পর সে বেছে নেয়। সে সোজা শ্যামাঙ্গীকে এসে তার দাবী জানায়। শ্যামাঙ্গী রাজি না হওয়ায় ও সোজা ওর শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলে অকে খামচাতে শুরু করে। আর সঙ্গে সঙ্গে অনঙ্গ  সম্রাটকে ধরে প্রাণপণ টানতে থাকে। শ্যামাঙ্গী ওর হাত থেকে বেরিয়ে এসেই ছেঁড়াখোড়া জামার ওপরে একটা গামছা চাপা এসে বলে, ‘দাঁড়া’। সকলেই স্তব্ধ হয়ে যায়। তারপরেই ও বলে ফেলে সেই মোক্ষম কথাটা। ‘তোর পছন্দ করা মেয়েটাকে আমি আগেই দেখেছি। তার পরও যদি আবার যেতে হয় তাহলে আমরা সবাই যাব’। সঙ্গে সঙ্গে মানময়ী আর অনঙ্গ আপত্তি  জানিয়ে বলে, ‘আমরা যাব ঠিকই, তবে মেয়ে দেখতে নয়। পুলিশের কাছে’। সম্রাট ভেঙে পড়ে। কিন্তু শ্যামাঙ্গী এইবার তার জীবনের সবচেয়ে দূরদর্শী আর বিচক্ষণ কাজগুলোর  মধ্যে একটা কাজ করে ফেলে। সে বলে, ‘সবাই তৈরী হও। আমরা মেয়ে দেখতে যাব’। অনঙ্গকে সঙ্গে নিয়ে করে শ্যামাঙ্গী সাজানো পাত্রী দেখার কাজটা প্রথমে  করে ফেলে। তারপর আত্মীয় আর পাড়াপড়শী নিয়ে একটা দিন দেখে বিয়েটাও দিয়ে দেয়। কিন্তু বুচি ঘরে এসেও তার চুঁচি প্রধান জীবনযাপনটা চালিয়েই যায়। আর তখনই শ্যামাঙ্গী, অনঙ্গ আর মানময়ী ওদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে তাড়াতাড়ি। এবারে ওষুধে কাজ হয়। ওরা তিনজন এবার শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে।  বাড়িটাকে আবার আগের মত করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যায়।

সেবারের মহাসঙ্গীত সম্মেলনের সূত্র ধরে ঘটে যায় একটা সাঙ্ঘাতিক ঘটনা যেটা গোটা জনপদের ভবিষ্যতটাই একেবারে বদলে দেয়। মহাসঙ্গীত সম্মেলনের শেষে গণস্বয়ম্বর সভায় গথিক আর্য শ্রেণীর একটি ছেলে শ্যামাঙ্গীকে দেখে পছন্দ করে ও ওকে বিয়ে করতে চায়। শ্যামাঙ্গী এতে রাজি হয় না। এর ফলে ছেলেটি ক্ষেপে যায়। ওদের মোড়ল এসে জানায় যে ওদের প্রথা অনুযায়ী শ্যামাঙ্গী এখন ওই ছেলেটির স্ত্রী। তাই শ্যামাঙ্গী চাক বা না চাক ওরা ওকে শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে সহবাসে সহায়তা করবে, আর তার জন্য ওরা একটা উৎসবেরও আয়োজন করে। তবে  শ্যামাঙ্গী যদি স্বেচ্ছায় এটা মেনে না নেয় তাহলে ওরা ওর ওপর বল প্রয়োগ করতে বাধ্য হবে। সব শুনে অনঙ্গ সহ আশেপাশের সমস্ত অঞ্চলের লোকজন চূড়ান্ত রেগে যায়। পরিস্থিতি বিচার করে শ্যামাঙ্গী পুলিশের সাহায্য চায়। পুলিশ  এসে সব শুনে জানায় কোন ধর্মীয় ব্যাপারে ওরা হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। অনঙ্গদের তরফ থেকে গোটা জনপদের লোক ক্ষোভে ফেটে পড়ে জানায়,  আমাদের ধর্মে বা সমাজে যেহেতু এরকম কোন প্রথা নেই, তাই তারা প্রাণ থাকতে এ ধরনের কোন ঘটনা বরদাস্ত করবে না। তাতে তখনকার মত ব্যাপারটা মিটে যায়। সকলে মিলে ঠিক করে এরপর মহাসঙ্গীত সম্মেলন যেমন হচ্ছে হবে। কিন্তু গণস্বয়ম্বর সভা আর করা হবে না।

গুরুজীর কাছে শিক্ষানবিশীর পঞ্চমবর্ষ পার হবার সঙ্গে সঙ্গেই প্যাপিরাস আর  কলকাকলির বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হল। কলকাকলির সঙ্গে পাপ্পা আর প্যাপিরাসের সঙ্গে বেদ বলে একটি স্থানীয় ছেলের বিয়ে ঠিক হল। পুপু এখনই বিয়ে করতে রাজী না হলেও পপি উদয় বলে স্থানীয় একটি ছেলের সঙ্গে বিয়েতে বসল। একই সঙ্গে তিন তিনটি বিয়ে একেবারে মহা ধুমধাম করে এ বাড়ি থেকে হয়ে গেল। কিন্তু এবার আর মানময়ী অনঙ্গ তাদের তরফের কোন আত্মীয়স্বজনকে আমন্ত্রণ করল না। পাত্রপাত্রীদের নিজস্ব আত্মীয়বন্ধুবান্ধবই শুধুমাত্র আমন্ত্রিত হল। কেননা সুদামের বিয়েতে আত্মীয়দের তিক্ত অভিজ্ঞতা আর শ্যামাঙ্গীকে তিক্ত, কুরুচিপূর্ণ আক্রমণ মানময়ী এবার আর হতে দিতে চায়নি। বিয়ের পর কলকাকলিকে নিয়ে দাদা বৌদি আর পাপ্পা ফিরে গেল। আর বেদ আর উদয়ও নতুন বউকে নিয়ে নিজেদের বাড়ি চলে গেল। তবে পাপ্পা মাঝে মধ্যে প্রয়োজন মত এখানে আসা যাওয়া করবে ঠিক হল।

সুদাম ওর চাকরীর সূত্রে বদলি হয়ে ফিরে আসছে নিহিতপাতালপুরীতে ঠিক না হলেও প্রায় তার কাছাকাছি উন্মাদনাপ্রবালগাথা বলে একটা জায়গায়। অফিস থেকে তাকে দেওয়া হচ্ছে মস্ত একটা বাংলো যার উচ্চতা প্রায় ছোটখাট একটা পাহাড়ের সমতুল্য। বাংলোর চারধারে সবুজ ঘাসের লন আর রয়েছে অজস্র ফুলের সুগন্ধযুক্ত একটি বাগান। প্রাসাদোপম সেই বাংলোর ঘরগুলো একএকটা দোতলা বাড়ির সমান উচু, দিঘির মত বড়, জানলাদরজাগুলো ওই বাড়ির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবেই এতই বিশাল যে তা দিয়ে একটা প্রাগৈতিহাসিক কালের ডায়নোসরের বাচ্চা অনায়াসেই ঢুকতে বেরাতে পারবে। ধবধবে সাদা সেই বাড়িতে অনেকজন কাজের লোক সবসময় হুকুম তামিল করার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। সুদামকে এখানে পাঠানো হয়েছে উন্মাদনাপ্রবালগাথা জায়গাটাই শুধু নয়, তার আশপাশের বিস্তৃত মনুষ্যবসতিহীন ঘন বনজঙ্গলে আবৃত জায়গাগুলোর পরিকল্পিত উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে মানুষের বসবাসযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব দিয়ে। কারণ যত দিন যাচ্ছেসূর্যের আগুন ও তার থেকে নির্গত তাপপ্রবাহের  কারণে আনেক উন্নত দেশও সমুদ্রের তলায় চলে যাচ্ছে। এর ফলে কাতারে  কাতারে মানুষ পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত একটু আশ্রয় আর খাদ্যের জন্য ঘুরে ঘুরে শ্রান্ত হয়ে গিয়েও এতটুকু পা রাখার মাটি পাচ্ছে না। তাই আপাতত সন্দেহ বা দেশপ্রেমের মত ক্লিশে ভাবনাচিন্তাগুলোকে বাদ দিয়ে অবিলম্বে ওদের দিকে মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই প্রকল্প। এই প্রকল্পে মোট আঠেরটি দেশ সম্মিলিত ভাবে রয়েছে। আঠেরটি দেশের এই সঙ্ঘ এখন আপাতত ওইসব মানুষের মাথা গোঁজার জন্য এই ধরনের প্রকল্প গোটা পৃথিবীর নানা জায়গায় চালিয়ে যাচ্ছে। তাই সুদাম আপাতত কর্মসূত্রেই পরিবারের কাছাকাছি থাকবার একটা সুযোগ পেয়েছে। সুদামের স্ত্রী অলঙ্কৃতা এবার শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েই সকলের মন জিতে নিল যে শুধু তাইই নয়, গোটা নিহিতিপাতালপুরী অঞ্চলটাই ওকে খুব ভালোবেসে ফেলল। সুদামের সঙ্গে সঙ্গে  ও-ও বসে বসে ওদের বৌভাতের পর চলে যাওয়া থেকে শুরু করে আজ অব্দি ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা শুনে শুধু অবাকই হল না, শিহরিতও হয়ে উঠল।

সেবারের গ্রীষ্মের ছুটিতে আরও দুজন এল গোটা বাড়িটাকে মাতিয়ে মাথায় করে নিয়ে বেড়াবার জন্য। একজন হল শকুন্তলা আর অন্যজন হল শ্রাবণ – ফুটফুটে দুই শিশু, সুদামের মেয়ে আর ছেলে। অসম্ভব প্রাণপ্রাচূর্যে ভরপুর ওরা দুজন কোন কিছুতেই দমে না। নিজের নিজের মত করে এদিকে ওদিকে অজস্র ঢেউ তুলে নেচে বেড়ায়। সেই নাচের ছন্দে গোটা বাড়ীটাই দুলতে থাকে। এবাড়িতে ওদের সবচেয়ে বেশি ভাব হয়েছে প্রথমে অনঙ্গের সঙ্গে তারপর মানময়ীর সঙ্গে। কাজের জন্য সুদামকে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়। অলঙ্কৃতাও সঙ্গেই থাকে। তাই ওদের কোন একটা আবাসিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। তাই বছরে দুবারই শুধু ওরা বাড়িতে আসার সুযোগ পায়। এই ক’মাসে অলঙ্কৃতা এ  বাড়ির নিয়মকানুন দিব্যি রপ্ত করে ফেলেছে। ও খুব ভালো গান গায়। তবে সেটা পশ্চিমী আর তার সঙ্গে নিজেই পিয়ানো বাজিয়ে যায়। কিন্তু এ বাড়ির সঙ্গীতের পরিমন্ডল ওকে এতই আকৃষ্ট করে যে অন্যদের সঙ্গে ও-ও গুরুজীর কাছে তালিম নিতে বসে। উপমা আর লগ্নলতা ওর কাছে সুদামের সকলের জন্য কিনে আনা পিয়ানো বাজিয়ে গান গাইতে শেখে। দিনের মধ্যে বেশির ভাগ সময় ওরা এখানে কাটায়, রাতে কখনও এখানে থেকে গেলেও বেশির ভাগ দিনই বাংলোয় ফিরে যায়। শ্যামাঙ্গী কিন্তু নিজের কাজেই ডূবে থাকে। কখন খেতে আসে, কখন বা আসে না। তখন অলঙ্কৃতাই ওর খাবারটা নিয়ে ওর ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে খাইয়ে আসে। আর সেই পরিসরে শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে দুচারটে কথাও হয়। শ্যামাঙ্গী ওকে জিজ্ঞাসা করে, ও এইসব সংসারের কাজ করে কী পায়! তার চাইতে ও তো অনায়াসেই মানুষের বৃহত্তম স্বার্থের ও উন্নতির জন্য কোন কাজে এই মূল্যবান সময়টা লাগাতে পারে। অলঙ্কৃতা জানতে চায় কী সেই কাজ যাতে সার্বিক কল্যাণ হতে পারে মানুষের। আর তখনই শ্যামাঙ্গী পেড়ে  ফেলে সেই  মোক্ষম কথাটা যার ফলে ভবিষ্যতে সত্যি সত্যিই একদিন এই নিহিতপাতালপুরী শুধু নয়, গণসংবাদালয়, তীর্থসরোবর, এমনকি ওদের ওই উন্মাদনাপ্রবালগাথা এবং অন্যান্য আরও জায়গাগুলো হয়ে উঠতে পারে স্বপ্নপুরী। কিন্তু শ্যামাঙ্গী পুরো কথাটাই এখন বলে না। ও শুধু সব জায়গার মানুষজন যাতে ভালো থাকে তার দেখাশোনা করতে আর সেই তীর্থসরোবর অঞ্চলে প্রতিবছর  যে মহাসংগীত সম্মেলন হয় তার দায়িত্ব নিতে বলে। অলঙ্কৃতা তাতে রাজি হয় শুধু একটাই শর্তে। শ্যামাঙ্গীকে সবসময় পাশে থাকতে হবে। শ্যামাঙ্গী ওকে নিশ্চিন্ত করে জানায় যে ও সবসময় যে কোন ভালো কাজেই ওর পাশে থাকবে। কথাটা শুনে সুদাম চমৎকৃত হয়। আর অলঙ্কৃতাকে উৎসাহিত করে যায় ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না সত্যি সত্যিই ও ঐ কাজটা করতে বাস্তবের মাটিতে ওর পা ছোঁয়ায়। সুদাম আর অলঙ্কৃতা একদিন একদিন বাড়িতে যাতায়াতের সময় সম্রাটের সঙ্গে দেখা হল, ওরা ওকে  ওদের বাড়িতে যেতে বলল। সুদামের বাংলোয় সত্যি সত্যিই সম্রাট এসে হাজির। তাবে একা নয়, সঙ্গে পাপ্পা আর বুচি। কোন সৌজন্য আর রাখঢাক ছাড়াই কথা শুরু হল। ওদের প্রধান বক্তব্য হল এই যে শ্যামাঙ্গী যে এখনও বিয়ে করছে না সেটা নিয়ে কী করা যায়। সুদাম আর অলঙ্কৃতা খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। সম্রাট তা আঁচ করতে পেরেই বলল যে এইবয়সের একটা মেয়ে বাইরে থাকলে উঠতে বসতে লোকের কথা শুনতে হয়।  বুচি পই পই করে ওদের অনুরোধ করতে লাগল যে ওরা যাতে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শ্যামাঙ্গীকে বিয়েতে রাজি করায়। কেননা ও যদি বিয়ে করে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তাহলে মানময়ী অনঙ্গ সম্রাটের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হবে। আর তাহলে দুপক্ষের সমস্যা মিটে যাবে শুধু নয়, ওরা ওই বাড়িতেই বাস করার জায়গা পাবে। পাপ্পা বলল, অনঙ্গ কেন যে এখনও একটা বয়স্থা মেয়েকে ঘাড়ে করে বয়ে বেড়াচ্ছে সেটাই ও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সুদাম এতক্ষণে মুখ খুলল।  বলল শ্যামাঙ্গী বিয়ে করতে আগ্রহী নয়। কথাটা শোনা মাত্রই তিনজনে বলে উঠল যে এমনিতে যদি রাজি না হয়, দুদশটা কানের গোড়ায় থাপ্পড় কশালেই তো বাপ বাপ বলে বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে। সুদাম স্তম্ভিত হয়ে গেল। অলঙ্কৃতা এবার বলল যে একটা মেয়ের বিয়ে করার যেমন অধিকার আছে তেমনি বিয়ে না করার অধিকারও আছে। এ বিষয়ে আমাদের কিছু বলা সাজে না। ওরা আর কথা না বাড়িয়ে অলঙ্কৃতার দেওয়া মিষ্টিগুলো খেয়ে চলে গেল।

মাত্র কদিনের মধ্যে ভাগ্যের চরম পরিহাসে ওদের বাড়ির দরজায় সম্রাট এসে দাঁড়াল ঠিক তখনই যখন কিনা শ্যামাঙ্গী নিজেরই কোন একটা কাজে বাইরে বেরাবার জন্য সদর দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা খুলে দাঁড়ায়। লুপ্তপ্রায় গলার স্বরে হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে সম্রাট কোনরকমে শ্যামাঙ্গীকে বলে যে ওরা  ওকে ওদের বাড়িতে একটু থাকতে দেবে কিনা। শ্যামাঙ্গী তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ওকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ভেতরে যায়। ওদের দুজনকে ওইভাবে দেখে অন্যরা যখন হাঁ করে তাকিয়ে আছে, ঠিক তখনই শ্যামাঙ্গী ওকে নিয়ে  গিয়ে ওর ঘরে বসিয়ে ব্যাগটা রাখতে না রাখতেই কাতর কন্ঠে সম্রাট ওর কাছে একটু জল খেতে চায়। শ্যামাঙ্গী তাড়াতাড়ি ওকে এক গেলাস জল দেয়। ততক্ষণে মানময়ী, সুদাম, অলঙ্কৃতা ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর মুখ  থেকেই  শোনে, গত দুদিন ধরে ওর বউ আর শ্বশুর কীভাবে ওর ওপর নির্যাতন চালিয়ে কীভাবে ওকে খুনের হুমকি দিয়েছে আর কীভাবে আজ ভোরে ওদের চোখ এড়িয়ে ও পালিয়ে এসেছে। অনঙ্গ এসে সব শুনে হন্তদন্ত হয়ে শ্যামাঙ্গীর ঘরে গেল আর সম্রাটকে তিরস্কার করতে শুরু করে দিল। শ্যামাঙ্গী সুদামকে পাঠাল একটা ডাক্তার দেখে আনতে। কদিনের মধ্যেই ক্রমাগত শুশ্রুসায় সুস্থ  হয়ে উঠে সম্রাট ওই বাড়িতেই দিব্যি থাকতে শুরু করে দিল। আস্তে আস্তে আবার বাইরে বেরিয়ে বন্ধুবান্ধব, অফিস যাওয়া শুরু হল। আর পথেই ফাঁদ পেতে বুচি আর ওর বাবা সোনার দিম পাড়া রাজহাঁসটাকে ধরল আর একটু একটু করে  আবার সম্রাট বুচির ফাঁদে ধরা পড়ল আর ওদের বাড়ি থেকে নিজের আস্তানায় ফিরে গিয়ে তার আগের জীবনে মিশে গেল।

অলঙ্কৃতা একটু একটু করে শামাঙ্গীর পরামর্শে ওই অঞ্চলের মানুষের সামাজিক দায়দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তার সুষ্ঠভাবে সমাধানের যথসম্ভব চেষ্টা করল। তীর্থসরোবর অঞ্চলে মহাসঙ্গীত সম্মেলনটাকে ও সে বছর এমন একটা উচ্চতায়  নিয়ে গেল যে তা এর আগে আর একবার মাত্রই হয়েছিল। সেটা প্রথমবার। শ্যামাঙ্গীর হাতে। কিন্তু এরই মধ্যে একটা ঘটনায় সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। পপি তার স্বামীর সঙ্গে বাড়ি  ফিরছিল। বেশ কিছুক্ষণ ধ্বস্তাধ্বস্তি হবার পর রাস্তার কজন ছেলে ওকে তুলে নিয়ে গেল। ওর স্বামী সবাইকে জানাল। সকলে যখন পুলিশের দ্বারস্থ হল আর পুলিশ যখন তল্লাসি চালানো শুরু করল, তখন তাকে পাওয়া গেল গথিক আর্যগোষ্ঠীর একটি বাড়ির পাশের পুকুর থেকে। এই ঘটনায় সকলে এতই বিমর্ষ আর স্তম্ভিত হয়ে গেল যে শ্যামাঙ্গী আর অলঙ্কৃতা দুজনেই আগামী চলার পথটা দ্রুত নির্ধারণ করে ফেলল, শুধু তাইই নয়, আদাজল খেয়ে  তার পেছনে লেগে পড়ল। দুচারদিন যেতে না যেতেই আবার একজন গৃহবধূর অস্বাভাবিক মৃত্যুতে সকলের মনে সন্দেহ দানা বাধল। পুলিশের তদন্তে জানা  গেল কদিন আগেই তার একটা মেয়ে হয়েছিল আর তারই কারণে বচসার জেরে স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে গলা টিপে হত্যা করেছে। মানময়ী অনঙ্গ  শ্যামাঙ্গী সুদাম আর অলঙ্কৃতা এবং সমাজের আর দশজন সকলে মিলে ঠিক করল যে এবার একটা কিছু না করলেই নয়। শ্যামাঙ্গী একটা শোকসভার  আয়োজন করল আর সেখানে সবাই মৃতদের ছবির সামনে মোমবাতি জ্বালিয়ে শোকজ্ঞাপন করল। সেদিনের পর বাচ্চাবুড়ো নারীপুরুষ সকলকে নিয়েই শ্যামাঙ্গী আর অলঙ্কৃতা একটা জনসভা করল আর তাতে বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে যদি কোন রাজনৈতিক দল এসব ক্ষেত্রে কোন ব্যবস্থাই না নেয়, তাহলে ওরা সকলেই ভোট বয়কট করবে বলে প্রচার করা হল। আর যদি দেখা যায় সকলেই এই ব্যাপারে কিছু কিছু করে কাজ করছে, তাহলে যে বেশি কাজ ও দায়দায়িত্ব নেবে, ওরা সবাই তাদের দলকেই ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করবে।  ফলে রাজনৈতিক দলগুলো সবাই খুব মুশকিলে পড়ে গেল। ওরা ওদের সঙ্গে  আলোচনায় বসতে চাইল আর তারই ফলস্বরূপ  ঠিক হল অলঙ্কৃতা ওই অঞ্চলে উদারপন্থী দলের হয়ে ক্ষমতায় দাঁড়াবে। রক্ষণশীল সমাজ দলের হয়ে দাঁড়াবে  গথিক আর্যগোষ্ঠীর একজন প্রৌঢ। আর মধ্যমেধা চৌকনা দলের হয়ে দাঁড়াবে   গণসংবাদালয়ের একজন। এমনিতেই গথিক আর্যগোষ্ঠির  ছেলে বুড়ো সকলে  রাস্তাঘাটে যে কোন মেয়েকে দেখেই পছন্দ করে ওদের স্ত্রী হিসেবে ভেবে নিয়ে  যথেচ্ছাচার করে। পরিস্থিতি এখন এমনই দাঁড়িয়েছে যে ওদের দৌরাত্মে রাস্তায় মেয়েদের চলাফেরা একেবারে শিকেয় উঠেছে। ফলে স্কুলকলেজ যাওয়া থেকে শুরু করে অন্য সমস্ত ব্যাপারেই ওরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় তো রয়েইছে, সেইসঙ্গে ওদের বাবা-মা আত্মীয়স্বজন সবাই এক চূড়ান্ত মানসিক সঙ্কটের শিকার। যতদিন যাচ্ছে ব্যাপারটা মহামারীর আকার নিতে শুরু করেছে। তার ওপরে যদি গথিক আর্য গোষ্ঠীর হাত ধরে রক্ষণশীল সমাজ দল আঞ্চলিক ক্ষমতা দখল করে নেয়, তাহলে যে আরও কী কী হতে পারে সেটা ভেবে সকলে শিহরিত হয়ে ওঠে। উদারপন্থীদলের তরফ থেকে অলঙ্কৃতা প্রথমেই মানুষের সুরক্ষার চেষ্টা করার প্রতিশ্রুতি দিল আর তুমুল সংখ্যক ব্যবধানে জিতে এসে ক্ষমতায় বসা মাত্রই সেই মাফিক কাজকর্ম করা শুরু করে দিল।

শ্যামাঙ্গী এমনিতেই প্রায় সবসমেই একটা কথা বলে যে ধর্ম যখন অন্ধকার গুহায় থাকতে থাকতে প্রখর আলোয় বেরিয়ে এসে চোখ দিশেহারা হয়ে যায় আর তার হাত ধরে থাকা ক্ষমতা যখন কোন পথ পায় না, তখনই তারা একসঙ্গে জুড়ে গিয়ে রাজনীতির আঙিনায় পা রাখে। এখন গথিক আর্যদের দলটাও সেই রকমই একটা নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে। আর রক্ষণশীল সমাজ দল রীতিমত  বড়সড় চুক্তির মাধ্যমে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে। অনঙ্গ মানময়ী সবসময়ই অলঙ্কৃতাকে শুধু সাহায্য করাই নয়, কেউ না কেউ পালা করে ওর সঙ্গে থাকার চেষ্টা করে। উপমা তার নিগের কাজের ফাঁকে ফাকে শ্যামাঙ্গীর ঘরে উকি মারা দেখে নেয় আগে যে ও ব্যস্ত আছে কিনা। যদি কোন কিছুতে ডুবে থাকে আর ওর উঁকি দেওয়াটা টের না পায় তাহলে চুপচাপ দরজা ভেজিয়ে চলে আসে। কিন্তু  কখন কখন যখন শ্যামাঙ্গী টের পায়, তখন ও নিজেই উপমাকে ডাকে। আজকাল কিছুদিন ধরেই উপমার মনে হতে শুরু করেছে যে যতদিন যাচ্ছে ততই যেন শ্যামাঙ্গী আরও আরও বেশি করে সুন্দরী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ও শ্যামাঙ্গীকে একথা জানিয়ে এর কারণ জানতে চায়। কথাটা শোনা মাত্রই   শ্যামাঙ্গী খুব সহজেই উত্তটা ছুঁড়ে দেয়, আত্মরতি। তারপর আবার জানলার পর্দাটা একটু সরিয়ে দিয়ে ফিরে এসে বলে, এবং সংযম। মা গৃধঃ।

অলঙ্কৃতাকে শ্যামাঙ্গী বলল যে পরিস্থিতি ক্রমশ যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে করে মেয়েদের আর অত ঝুল্পিঝাল্পা পোশাক না পরে যতটা সম্ভব সোজাসাপ্টা পোশাকআশাক পরাই উচিত, যাতে প্রয়োজন হলে তারা দৌড়াতে, আত্মরক্ষা করতে পারে শুধু নয়, মেয়েদের উচিত নিয়মিত খেলাধুলা আর শরীরচর্চা করা। খুব বেশি প্রয়োজন মেয়েদেরও আলাদা করে কিছু জমায়েতের জায়গা হওয়া। গথিক আর্যদের লোকগুলো যেভাবে ওদের মধ্যে ঢুকে পড়ে সমস্যার সৃষ্টি করছে তাতে করে ওই অঞ্চলটা একটা বড় সড় পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দিলেই সবচেয়ে ভালো হয়।

জুন মাসে গথিক আর্যদের দিকটার প্রান্ত বরাবর একতা মোটা আর উঁচু পাঁচিল তুলে দেবার ব্যবস্থা করা হয়। এমনকি নিরাপত্তার জন্য তার ওপরে বৈদ্যুতিক তারের রিং বসানোরও ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তারপরেও সরাসরি যোগাযোগের সমস্ত পথ বন্ধ করে দেবার সমস্ত ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গথিক আর্যরা অন্যান্য অঞ্চল ঘুরে, বহু পথ পাড়ি দিয়েও যখন বিনা কোন দরকারেই এই সব অঞ্চলে ঘোরাফেরা করতে থাকে, তখন সকলেই বুঝে যায় যে এর পেছনে নিশ্চয়ই ওদের কোন মতলব আছে।

(ক্রমশ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন