সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

শতাব্দী দাশ

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৮


শূন্যপুর ১৫

থেকে থেকে রঙ বদলায় শহর। ট্রেনের পেট থেকে ফইজুল আর আফতাব খসে পড়েছিল যখন, তখন ভোর। শহরে নরম আলো, শিশুর হাসি যেন। পেপারওয়ালার হাঁকডাক, ঠ্যালাগাড়ির 'হঠ যাও' চিৎকার। 'হঠ যাও' শুনলে  আজকাল বুকটা ছ্যাঁৎ করে। হঠতে হঠতে কোথায় যাবে আফতাব?

টিনের বাস তাদের উগরে দিল পেল্লাই সরকারি বাড়ির সামনে। ছুঁড়ি শহর তখন যৌবনের আড় ভেঙে হলুদ মেখেছে স্নানের আগে। চা আর লেড়ো খেয়েছিল ওরা ঢোকার আগে। বাড়ির সামনে এঁকে বেঁকে লাইন। রাত থেকে লাইন দেয় মানুষ  আজকাল। মানুষ বা মানুষের মতো। নাগরিক বা নাগরিকের মতো।

এরা এ রাজ্যের লোক। সেয়ানা বটে! নোটিস হওয়ার আগেই বাপ-ঠাকুর্দার নাম খুঁজতে এসেছে। আফতাব ফ্যালফ্যাল চায় ফইজুলের দিকে। এ বুদ্ধি আগে এল না! অবশ্য ভিনরাজ্যে আসেনি কখনও। ডিব্রুগড়। গৌহাটি। গৌহাটি। ডিব্রুগড়। দৌড় এটুকু। ট্রাইবুনাল কত দূর? ভেবেই ভয় করে। আর এ তো ভিনরাজ্য। ভিনরাজ্য আসতে পেরেছে যখন, ট্রাইবুনালেও পারবে না যেতে? তিনপুরুষ আগের যে জন। পাশের রাজ্যে ছিল তার বাস। তার নাম খুঁজতে হবে ভোটার লিস্টে। সেই নথি সম্বল করে ট্রাইবুনাল। নইলে ডিটেনশন ক্যাম্প!

সবাই সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখে। নাম বলতে রাজি নয় মুর্শিদাবাদ আর  বীরভূমের দুই ছেলে। হাতে কাগজ, ঠায় দাঁড়িয়ে। কী কাগজ? এককথায় জবাব। দরখাস্ত। ফইজুল যায় কাগজ, পেন কিনতে। আফতাব লাইন রাখে। মহামহিম, সত্তর বছর আগের নথি দেখাবেন অনুগ্রহ করে? সৈয়দ আলম আনসারিকে খুঁজে দেখুন দেখি। শুনেছি সে বুড়োর ঠাটবাট ছিল। চোখে সুর্মা, দাড়িতে মেহেন্দি।  শুনেছি এ শহরে খাতিরও ছিল তার। মহামহিম, সে বিস্মৃত পুরুষকে একবার খাড়া করে দিন সামনে। হিসাব বুঝে লই।

ভিড় বাড়ে। শহরের বুকে মধ্যবয়সী খেঁকুটে রোদ। এ রাজ্যেও দিল্লির নেতা এসে  বলে গেছেন, নাগরিকপঞ্জি হবে। সরকারি বাবু লোক ভাল। কাউকে  কম্পিউটারের সামনে বসিয়ে দিচ্ছে। নিজে খুঁজে নাও। অনপড়দের পেড়ে দিচ্ছে  জাবদা খাতা। খাতার উপর হুমড়ি খাওয়া মাথা। খোঁজ। খোঁজ।

ইয়াল্লা! মিলেছে! হলদেটে খাতায় নিষ্প্রাণ পড়েছিল পূর্বমানুষ। সৈয়দ আলম আনসারি। ঠাটবাট কই? ম্রিয়মান নামখানি। ট্রাইবুনালে যেমন অসহায় জোড়হাত  প্রয়োজন, অনেকটা তেমনই। বাবু বললেন, দরখাস্ত মোতাবেক সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে একমাস পর। একমাস! আগে হয় না? ট্রাইবুনালের ডেটের আগে?

বাবুর ড্রয়ারে পাঁচশর নোট চালান করে আফতাব-ফইজুল বেরিয়ে আসে। মরা আলোর শহর তখন প্রৌঢ়। ঈষৎ ঝুঁকে হেঁটে চলে দুই অকালপ্রৌঢ় মানুষও। বাস ধরে স্টেশন। ঘরে ফেরার ট্রেন। ঘর, কিংবা ঘরের মতো কিছু। ঘর কিনা, তা প্রমাণসাপেক্ষ, সরকারি মতে।

স্টেশনের দিকে পা বাড়াতে চমকে ওঠে আফতাব। ও ফুটে মিটিমিটি হাসে, ও কে? সাদা পোষাক। মেহেন্দি দাড়ি। চোখে সুর্মা। কে ও? ফইজুলকে ডেকে  দেখানোর আগেই লোকটা পিছন ফেরে। যে পথে গেলে নদী পড়ে, সেই পথে হাঁটে। নদী তার তীরের মানুষদের চিনে রাখে, আপামর কাল। মন্দ্র চালে সে মিলিয়ে যায় নদীর পথে।

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন