সমকালীন ছোটগল্প |
সেকেলে
খোলা জানলার পাশে দাঁড়িয়ে আছে বিশাখা। দৃশ্যটি খুব সুন্দর। বিশাখার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটি আরোও আর্টিস্টিক। তার চুল খোলা। সে বেশ লম্বা। মুখখানা ডিম্বাকৃতি। গায়ের রঙ উজ্জ্বল। গালের একপাশে দু’একগাছা চুল হাওয়ায় অল্প অল্প উড়ছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে বিশাখা ঘরের জানলাটি দিয়ে রাস্তা দেখছে। আসলে সে তা দেখছে না। বিশাখার দৃষ্টি সূদূরে, হয়তো বা আকাশে যেখানে সাদা মেঘ কাল্পনিক প্রাসাদের আকার নিয়েছে, সেদিকে। শুধুমাত্র এই ভঙ্গিমাটি ধার করে একজন দক্ষ শিল্পী সুন্দর একটি ছবি এঁকে ফেলতে পারে। কিন্তু আসলে এই দৃশ্যটি মনখারাপের দৃশ্য। বিশাখা সদ্য টুয়েলভ পরীক্ষা দিয়েছে। পড়াশোনায় খুবই ভালো। সেখানেই যত বিপত্তি। বন্ধুদের সঙ্গে তুলনা করলে নিজেকে মাঝে মাঝে বড়ো বেমানান মনে হয়। তার জন্ম নেওয়া উচিত ছিল কয়েক শতাব্দী পেছনে, যখন রাজ্যে রাজ্যে রাজারা রাজত্ব করতেন। তার ড্যাডি হতেন রাজ দরবারের একজন সুপণ্ডিত। ড্যাডি নয়, তিনি হতেন পিতা। গভীর, শান্ত সন্ধ্যায় সে তার পিতার কাছে বসে সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন করতো, তাদের গৃহপ্রাঙ্গন তখন সান্ধ্য ফুলের সুগন্ধিতে ভরে উঠত। নিস্তব্ধ দুপুরে কোনো এক পদ্ম প্রস্ফুটিত সরোবরের পাশে বসে বিশাখা তুলাপটে লিখত কাব্যগাঁথা।
বিশাখা! বিশাখা!
চিন্তাজাল ছিন্ন হলো। বিশাখা ফিরে এলো ২০২২এ।
ড্যাডি দাঁড়িয়ে আছেন। ড্যাডি খুব কমই বিশাখার ঘরে আসেন। তিনি বড়ো সরকারি অফিসার। সময়ই পান না। তবে বিশাখার জন্য কোনো ত্রুটি রাখেননি। ওর জন্য শহরের সেরা স্কুল, সেরা টিচার সবকিছুর ব্যবস্থা করেছেন। বিশাখাও আজ পর্যন্ত একদিনের জন্যও অবাধ্য হয়নি। কিন্তু এখন তিনি খুব বিভ্রান্ত। এই বিভ্রান্তি শুরু হয়েছে দিনকতক আগে থেকে।
বিশাখাই প্রথম তার মাম্মাকে বলেছে, সে হায়ার সেকেন্ডারির পর আর্টস পড়তে চায়। এতোটুকু শোনার পর বিশাখার মাম্মার চোখ গোল গোল হয়ে গিয়েছিল, তারপর যখন বিশাখা বলল, সে সংস্কৃত সাহিত্য নিয়ে পড়তে চায়, তখন তিনি একঘন্টার জন্য বোবা হয়ে গিয়েছিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় এবং ভয়াবহতায় ওদের বাড়িতে এখনও পর্যন্ত ঝড়ের রেশ বর্তমান। সেই ঝড় বিশাখাকে টলাতে পারেনি। রেজাল্ট আউটের আর দুদিন বাকি। প্রথমে সবাই ভেবেছিল এটা একটা আজব শখ মাত্র। বোঝালে ঠিক হয়ে যাবে। না, ঠিক হয়নি। বিশাখা অটল রয়েছে। তার চোখ মুখে সামান্য বিষণ্ণতা থাকলেও বেশ বোঝা যাচ্ছে বিশাখা এই ডেড ল্যাঙ্গুয়েজের ভার তার নিটোল কাঁধে অবলীলায় নিতে চাইছে। বিশাখার বাবা, মুখ শক্ত করে বললেন, আমি যা বলব তাই হবে। তুমি ইঞ্জিনীয়ারিং পড়বে। এটাই লাস্ট ডিসিশন। তোমার জন্য আমি ভালো কলেজ হস্টেল সব ঠিক করে রেখেছি। মার্কশিটটা জাস্ট কালেক্ট করবে, গিয়ে ভর্তি করিয়ে আসব।
বিশাখা আরোও শান্ত গলায় বলল, বাবা কোথাও যেতে হবে না, বাড়ির কাছের কলেজেই আমি সংস্কৃত নিয়ে পড়ব।
-মানে? তুমি কী করবে ভবিষ্যতে? টোল খুলবে? কে সেই টোলে অং বং চং শিখতে আসবে? এসব কেউ পড়ে না। তুমি কি মূর্খ? না হলে অন্য কিছু পড়ো। আর্টস পড়তে চাও, মানছি। আর সাবজেক্ট নেই?
-না নেই। মানে আমি এটাই পড়তে চাই।
-মুখে মুখে তর্ক করো না। সামান্য পড়ার খরচ ছাড়া তুমি তাহলে জীবনে আর কিছু পাবে না আমার কাছ থেকে। তুমি চাকরিও পাবে না। ভবিষ্যতে ছাত্র পড়িয়েও খেতে পারবে না। কারণ এরকম অচল ভাষা শিখতে তোমার কাছে কেউ আসবে না। তুমি কি মরতে চাও?
বিশাখা বড়ো বড়ো চোখ করে বলল, না ড্যাডি আমি প্রবল ভাবে বাঁচতে
চাই। আমি মরার কথা ভাবছি না তো একবারও!
-তোমার সব বন্ধুরা তোমাকে নিয়ে হাসবে, তুমি হবে এক অন্ধ পৃথিবীর
বাসিন্দা।
-না ড্যাডি, এই ভাষাটি নিয়ে আমি কিছু করতে চাই। মানে ভাষাটিকে আধুনিক করে তার পুনরুজ্জীবন ঘটানো কি যায় না?
-শোনো এসব নিয়ে ভাবার জন্য ভারত সরকারের বড়ো বড়ো দপ্তর রয়েছে, রয়েছে পক্ককেশ পণ্ডিতগণ, প্লিজ তোমাকে এই দায় নিতে হবে না।
বিশাখা যেন ওর ড্যাডির কথাগুলো শুনতেই পায়নি, অন্যমনস্কভাবে বলতে লাগল, কী করে জানি ভাষা হারিয়ে যায়, তাই না, কেউ যদি একটি ভাষা না পড়ে, না বুঝতে যায়, সেই ভাষায় না লেখে তাহলে ভাষাটিই মুছে যায় ধীরে ধীরে।
-দেখো, সংস্কৃত হারাবে না, এই ভাষায় বহু কিছু লেখা হয়ে আছে যুগ যুগ ধরে, তোমাকে এসব ভাবতে হবে না । তোমার লাইন সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনীয়ারিং, স্মুদ অ্যান্ড বিউটিফুল। ওসব জায়গায় তোমাকে মানাবে, বুঝলে মাই চাইল্ড! প্লিজ পাগলামো ছাড়ো। আমি কোথাও মুখ দেখাতে পারব না আর। তুমি শান্ত হয়ে ভাবো। আমি এখন আসছি।
বিশাখা ভাবছে, তার মনে হচ্ছে যুগের সঙ্গে তাল না মেলালে কী হয়? কী হয় সবকিছু থেকে সরে গেলে?তার স্কুল পাঠ্যক্রমে খুব কমদিনই সে সংস্কৃত পড়েছে, তবুও আকর্ষিত হয়েছে প্রবলভাবে। যে ভাষাপথ একদিন ছিল অভিজাত, অহংকারী, আজ তার গায়ে শতাব্দীর ধুলো জমে গেছে, কেউ আর নিতে পারছে না। সময়কে হারাতে পারেনি ভাষাটি। হঠাৎ বিশাখার মনে হলো, তার শরীরটিই যেন ভাষা দিয়ে তৈরি! অজ্ঞাত, প্রাচীন কোনো মুছে যাওয়া ভাষা! বহূদূর থেকে ভেসে আসছে সেই ভাষায় ক্ষীণ আর্তনাদ! শুধু ভয় আর শংকা মেশানো অক্ষরের কাতরতা...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন