সমকালীন ছোটগল্প |
ঘড়ি
কতদূর আর যাবো? এই বলে থেমে যাচ্ছে পথ। বারবার থেমে যাচ্ছে। কোথাও এগোনো যাচ্ছে না। ফ্ল্যাশলাইটের মতো মাঝে মাঝেই চারিদিক ধাঁধিয়ে উঠছে। পরক্ষণেই অন্ধকার। যেটুকু সময় চোখ ধাঁধাচ্ছে তাতে দেখে কিছু মনে রাখা যাচ্ছে না। এরকম ফ্ল্যাশলাইট কয়েকবারই পাসপোর্ট ছবি তুলতে গিয়ে দেখেছে, কতকটা সেইরকম। ক্যামেরাম্যান যে মুহূর্তে সামনে বসিয়ে ক্যামেরা বাগিয়ে কিছুটা সময় নিয়েই ক্যামেরার শার্টার ট্রিগার চাপেন তখন এমন হয়। একটা ছোট্ট ঘর এসে পড়ে হঠাৎ। ভিতরটা সাজানা গোছানো। দেওয়াল ভর্তি নানান ফুটফুটে বাচ্চা ও সুন্দরী মেয়েদের ছবি ফ্রেম করা। একদিকের দেওয়াল জুড়ে একটা আকাশি রঙের কাপড়। দুটো বড়ো বড়ো সাদা ছাতা। মাঝ বরাবর টেরিকাটা, ক্লিন শেভ করা একটা শান্ত যুবক। হাতের ক্যামেরাটা উঁচিয়েই ইশারায় থুতনিটা সামান্য তুলতে বলে ক্যামেরার শার্টার ট্রিগার চাপলো। আবার অন্ধকার, হাঁটা শুরু। হাঁটা ক্রমশ ধীর গতির দৌড়ানোয় পরিবর্তিত হয়, সে গতি ক্রমশ বাড়তে থাকে, বাড়ে বাড়ে, বেড়েই চলে। তবুও কোথাও বিন্দুমাত্র এগোনো যায় না। সেই একই অন্ধকার। হঠাৎ ঘুম ভাঙে অম্লানের। শুয়ে শুয়েই ঘাড় কাত করে দেখে উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে।
দরজা খুলে ঘরের বাইরে
পূবমুখি দাওয়ায় বেরিয়ে এসে দেখে সামনে খোলা উঠোন। ঘামে ভেজা শরীরে বাইরের খোলা হাওয়া লাগে। অম্লানের মনে পড়ে স্বপ্নের
কথা। এরকম
স্বপ্ন আগে কখনো দেখেনি। এভাবে দৌড়ে কোথাও একটুও এগোনো যায় না? অম্লানের ট্রেডমিলের
কথা মনে পড়ে। কলেজে
পড়াকালীন শরীর বাগানোর ব্যর্থ প্রয়াস একবার সে করেছিল। সে যে অসফল তাকে দেখেই
যে কেউ বলে দেবে। অম্লান
মনে মনেই হাসে। স্বপ্নে
দৌড়ানোর সাথে ট্রেডমিলে দৌড়ানোর তুলনা হাস্যকরই বটে।
সামনের গোঁড়া নিমগাছটার ফাঁক দিয়ে ক্ষীণ রোদ প্রথম প্রেমে পড়া কিশোরীর ঠোঁটের মতো এসে ছুঁয়েছে তার শরীর। এ উষ্ণতা তীব্র নয়, তীব্র হয় না কখনো। এ উষ্ণতা, এ তীব্রতা গভীরে উপলব্ধির। অম্লান তা জানে। অম্লান জানে ভেসে যাওয়ার শতাধিক কারণ এসে জোটে সে-সময়। কেউ কেউ নিজেকে অবরুদ্ধ করে, কেউ কেউ খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। অম্লান ঠিক ওই খড়কুটোর মতো। একটা কোকিল পাশের কোনো এক গাছ থেকে ডেকে ওঠে। অম্লান তাকে দেখার চেষ্টা করে। প্রথমটায় খুঁজে পায় না। দাওয়া থেকে নিচে নামে। চোখ যেন মরিয়া হয়ে ওঠে কোকিলটাকে দেখার জন্য। শব্দে অস্তিত্ব স্থাপন করো, শব্দে গাঁথলে তোমাকে মানুষ ঠিক খুঁজে নেবে। কথাগুলো কানে বেজে ওঠে অম্লানের। তাহলে কি ঊর্মিদি এরকমই কোনো এক কোকিলের কথা বলতে চেয়েছিল? অবশেষে চোখ খুঁজে পেলো কোকিলটাকে। উঠোনে দেওয়ালের ওপাড়ে একটা প্রকাণ্ড তেঁতুল গাছের ডালে। সেখানে এখনো সকালের রোদ পড়েনি। হয়তো কখনো পড়ে না। তাই তার লুকিয়ে থাকা সুবিধে।
ঘরে ফিরে আসে সে। তার ঊর্মিদি তখনো ঘুমিয়ে আছে। অম্লান নিঃস্পৃহ চোখে তাকিয়ে থাকে ঘুমন্ত ঊর্মিদির দিকে। ঘুমন্ত নারীর সৌন্দর্যের মায়াবী উপমা সে কবিতায় পড়েছে। আগে কখনো এভাবে ভাবার সুযোগ হয়নি তার। আজ সে কবিতার মতো করেই যেন ভাবছে। সময়টাই সেরকম। এই সময়ের জন্যই তো এতকিছু। এত দৌড়ঝাঁপ, এত মারামারি, এত অশান্তি, হিংসা, হানাহানি। পাওয়ার লোভ, আরও পাওয়ার সাথে জুড়ে যায় আরও আরও পাওয়ার উদগ্র ইচ্ছে।
ইতিমধ্যে কখন যে ঊর্মি চোখ খুলেছে
সে টের পায়নি। যখন
টের পেলো তখন কী করবে ভেবে না পেয়ে ইতঃস্ততবোধে নিজের খাটিয়াটার উপর
রাখা একটা বই হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। খাটিয়াটা গতকাল এখানে
পৌঁছানোর পর এ ঘরে আনা হয়েছে। ঊর্মি বেশ কয়েকবার জানতে চেয়েছে
এ গ্রামে হঠাৎ তাকে ঘুরতে নিয়ে আসার কারণ।
কারণ আছে। নিরিবিলি জায়গা। তুমি এমনই চেয়েছিলে। বলেছিল অম্লান।
শুধু নিরিবিলি বলেই? আর কি কিছু কারণ থাকতে
পারে?
মনে মনে
ভেবেছিল ঊর্মি।
অম্লানের প্রতি ঊর্মির অগাধ আস্থা। তাই তো সে অম্লানের ইচ্ছেয়
এক কথায় হ্যাঁ বলেছিল। যখন এখানে এসে পৌঁছলো জানতে পারলো এই একটা ঘরেই তাদের
দুজনকে থাকতে হবে। অম্লান
যদিও বাইরে কোথাও থেকে যাবে বলেছিল, কিন্তু ঊর্মি
তা মানতে চায়নি। অম্লানই ধানুকাকাকে বলে একটা খাটিয়ার ব্যবস্থা করিয়েছিল। ঘরে একটা মাত্র বড়ো তক্তা। অম্লান নিজেকে যতই খড়কুটো
ভাবুক। ভেসে
যাওয়া বড়ো কঠিন।
একটা গলা খাকড়ানির শব্দে অম্লান বই হাতে ঘর থেকে বাইরে এসে দেখলো ধানুকাকা উঠোনে দাঁড়িয়ে। সেই একইরকম শীর্ণকায়, পরনে লুঙ্গি আর একটা বহুছিদ্রযুক্ত গেঞ্জি। গতকাল সন্ধের অন্ধকারে ভালো করে দেখা হয়নি। সেই একইরকম আছে যেমনটা বছরদুয়েক আগে অম্লান দেখেছিল। হাতে একটা কেটলি আর দুটো কাপ। সকাল সকাল চায়ের ব্যবস্থার জন্যই আসা।
কী হলো হাতের জিনিস দাওয়ায় নামিয়েই
কোমর থেকে গামছা খুলে মুখ মুছতে লাগল! তাকানোর দিক অনুসরণ করে অম্লান দেখলো ঊর্মিদি বেরিয়েছে
ঘর থেকে।
তুমি আবার এত সকাল সকাল এসব করতে
গেলে কেন?
আমি চা
খাই না। বলল
অম্লান।
এ-কথা ধানুকাকা জানতো না। আগেরবার চা নিয়ে কোনো
বাক্যালাপ তার অম্লানের সাথে হয়নি। এবারে সাথে একজনকে নিয়ে ঘুরতে
এসেছে দেখে একটু যত্নআত্তি করা।
ধানুকাকার ফ্যাকাসে মুখটা দেখে
ঊর্মি বলল,
আজ খাবে। উনি এনেছেন আমাদের জন্য।
ঊর্মি নিজেই কেটলি থেকে নতুন
কাপে দুজনের চা ঢেলে একটা কাপ অম্লানের দিকে বাড়িয়ে দিলো। কেটলিতে তখনো কিছুটা
চা আছে দেখে ধানুকাকার উদ্দেশ্যে আরও একটা কাপ নিয়ে আসার কথা জানালো।
একটু ঘুরে আসবো আরকি। সেই
কবে এসেছিলাম। এতটা সময় পরেও কতটা বদল হয়েছে দেখতে হবে তো।
চায়ে চুমুক দিয়ে বলল অম্লান। কোনো
প্রত্যুত্তর নেই দেখে ধানুকাকার দিকে তাকাতেই টের পেলো তার মুখ থমথমে। এক অদ্ভুত
নীরবতা। কারণটা অম্লান বুঝতে পেরেছে। অম্লানও চুপ করে গেলো। নীরবে চা শেষ করলো।
ধানুকাকা চায়ের কেটলি আর কাপ হাতে নিয়ে, ‘সময় সব পচিয়ে দেয়’ এই কথাটুকু বলে
চলে গেলো।
হঠাৎ করেই ফোনটা ডেড হয়ে গেছে। রাত্রি থেকে কারেন্ট নেই। কী করে আর জানব এমন হবে। জানলে নিজের পাওয়ার ব্যাংকটা সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম। কী যে করি! ঘর থেকে বেরিয়ে, উঠোন ছাড়িয়ে সদর দরজা দিয়ে বেরতেই দেখলাম লুঙ্গি ও ফুটিফাটা গেঞ্জি পরা একটা লোক দাঁড়িয়ে। কাছে এগিয়ে যেতেই লোকটা রীতিমত আমায় অদেখা করে গম্ভীর মুখে পাশ দিয়ে হেঁটে ওই বাড়িতেই ঢুকে গেলেন। আমিও পিছন পিছন। কারেন্ট কখন আসবে জানতে চাওয়ায় উত্তর পেলাম, তা জানা নেই। যেন তার কিছু এসে যায় না কারেন্ট কখন এলো না এলো এসবে। কিন্তু আমায় তো জানতে হবে। আমার ফোনটা অফ থাকলে কিছুই করতে পারছি না। একটা রাত কাটিয়েই আর থাকবো না সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। ফিরবো। ফেরার ট্রেনের ব্যাপারে আগেই জেনে নিয়েছিলাম। দুপুর দুটো কুড়ি নাগাদ। কিন্তু স্টেশন অনেকদূর। হাতে অনেকটা সময় নিয়ে বেরতে হবে। তারপর ট্রেন আবার সেই রাত্রে। এখন কটা বাজলো? কে জানে? লোকটাকে জিজ্ঞেস করায় কোনো উত্তর পেলাম না। একেবারে নিশ্চুপ। বাইরে বেরলাম আবার। কয়েকটা ছেলেকে দেখে এগিয়ে গেলাম। ভাবলাম তারা বলতে পারবে। ওরাও কোনো পাত্তাই দিলো না। তেঁতুল গাছে একজন একটা ঢিল ছুঁড়ে দিলো। বাকিরা এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে তেঁতুল কুড়োতে লাগল। হাত দশেক দূরেই একজন একটা পুকুরপাড়ের কয়েৎবেল গাছের তলায় হেলান দিয়ে কী যেন উদাস হয়ে ভাবছিল। তার কাছে গিয়েও জিজ্ঞেস করলাম। এরকম যাকেই দেখি পাগলের মতো ছুটে যাই আর সময়ের কথা জিজ্ঞেস করি। কটা বাজল অন্তত বলে দিন! আমার ট্রেন মিস হয়ে যাবে। কেউ কিচ্ছুটি বলল না। সবাই কত শান্ত, ধীর স্থির। আমার কাছে যেন তারা নিষ্প্রাণ, নিশ্চল। কিন্তু তারা নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে অবিরাম। আমার থেকে অনেক অনেক বেশি শান্তি তাদের মনে। আমার তাড়াহুড়ো আছে। আমার কথা দেওয়া আছে। সেই দেওয়া কথা সময় মতো পূরণ করার তাগিদ আছে।
অম্লান থামল। কথাগুলো বলতে বলতে অনেকখানি
পথ অম্লান আর তার ঊর্মিদি হেঁটে ফেলেছে। তারপরেই অম্লান আবার বলল, জানো এই গাঁয়ে একটাও
ঘড়ি নেই। কেউ
ঘড়ি দেখে না। একবার
ভাবো তো,
আজ হঠাৎ যদি আমাদের জীবন
থেকে এই ঘড়ি জিনিসটা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে
যায়! এই যে তুমি, সকাল সকাল কাজের লোকের কলিং বেলের আওয়াজে বাকিদের
ঘুম নষ্ট যাতে না হয় ভেবে আগে থেকে উঠে তৎপর থাকো। সেও ঠিক সাতটা বাজার
অপেক্ষা করে। তাকে
সময় দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অফিসে পৌঁছানোর তাড়া, সময় মতো না যেতে পারলে বসের বকবকানি। কোথাও যাবে, বাস-ট্রেন-ফ্লাইট-এর নির্ধারিত সময়। মানুষে মানুষে বাক্যালাপের
সময় নেই। সবাই
ব্যস্ত। চারিদিকে
সময় সময় আর সময়। নির্ধারিত
সময়ে কাজ সারার তাগিদ। ভাবো এরা সবাই যদি ঘড়ি হারিয়ে ফেলে? সকলেরই সময় জানা আছে
অথচ ঘড়ি নেই। কী
দুর্বিষহ,
কী ভয়ানক
উন্মাদ পরিস্থিতি তৈরী হবে? কিন্তু যখন এই ঘড়ি ছিল না তখন মানুষের কী সময় জ্ঞান ছিল
না?
তারা কাজ
করত না?
তারা খেতে
পেত না?
কী হতো? আমরা নিজেদের উন্নত বলতে
পারতাম না। উন্নত
হতে গিয়ে আমরা যে অশান্তিময় জীবন কাটিয়ে চলেছি প্রতি নিয়ত তার পিছনে একমাত্র দায়ী তো
এই ঘড়ি।
অম্লান চুপ হয়ে যায়। ঊর্মি তাকে শুধু দেখে। একটিও প্রত্যুত্তর করে
না। অম্লান
ভাবে নির্ঘাত সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে তার ঊর্মিদি নিশ্চয়ই
তাকে সেরকমই কিছু একটা ভাবছে।
কিন্তু সময়ই তো সব। সময়েরই দাম। এ-কথা কীভাবে অস্বীকার
করবে?
সময়জ্ঞান
তো থাকাই উচিত। নইলে
নিজেকে তৈরি করবে কীভাবে? আর এটা তো স্বীকৃত যে, টাইম ইজ মানি। বলে ঊর্মি।
শেষের কথাটায় যেন বেশ জোর দিয়েই
ঊর্মি বলে।
এন্ড দ্যাট সেন্স অফ টাইম ইজ
দ্য বিগিনিং অফ অল ডেস্ট্রাকশনস। এই যে লুকিয়ে রাখা সত্যটা? এটাকে অস্বীকার করে থাকবে
মানুষ?
এবার কিছুটা ক্রোধ ফুটে ওঠে অম্লানের
স্বরে। ঊর্মি
জানে এও সময়েরই খেলা। ঠিক সময় আসলে অম্লান ঠিক নিজেই বুঝে যাবে একদিন। এভাবেই বাঁচতে হয়।
সকালের রোদ তীব্র হতে শুরু করেছে। অম্লান আর ঊর্মি একটা পুকুরকে বেষ্টন করে থাকা আমবাগানে দাঁড়িয়ে ছিল। পাশ দিয়েই কাঁচারাস্তা শেষ হয়ে খেতজমি শুরু হচ্ছে। কয়েকজন মহিলা পিনকসু ভঙ্গিমায় কাপড় পড়ে একহাতে বস্তা, কাস্তে আর অন্য হাতে একটা ছড়ি নিয়ে ছাগল-ভেড়া-গরু নিয়ে চলে যাচ্ছে মাঠের দিকে। ঊর্মি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো তাদের। অম্লান আর যাই বলুক এখানে যে খুব শান্তি আছে তা একদমই ঠিক। আজ বিকেলেই সে কলকাতা ফিরবে। সেখান থেকে কদিনেই ঊর্মিকে চলে যেতে হবে নিজের আস্তানায়। সেই একই জীবন যাপন।
চলো ফিরি। এরপর রোদ আরও কড়া হবে। তোমার অসুবিধে হবে। বলল অম্লান।
ঊর্মি একবার অম্লানের দিকে চেয়ে, কী যেন ভাবল। তারপর হাঁটতে শুরু করলো। বাগানটা পেরিয়ে রাস্তায়
উঠতেই একটা সাইকেলভ্যান দেখে তাকে দাঁড় করাল অম্লান। একটা বাইশ-পঁচিশ বছরের ছেলে। বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার
কথা বলায় ছেলেটি হাসি মুখে সম্মতি জানালো। ভ্যানের পিছনের দিকটা পা ঝুলিয়ে
বসল ঊর্মি। অম্লান
তারই পাশে উঠে বসতে গেলে ছেলেটি জানালো দুজনেই পিছনে বসলে ভ্যান চালাতে অসুবিধে হবে
তার। অগত্যা
অম্লান গিয়ে বসল সামনের দিকে, একেবারে উলটো দিকে মুখ করে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে ভ্যান। কাঁচা রাস্তার ধারে ধারে
গাছ। কখনো
কিছুদূরে পুকুর। রাস্তায়
মাঝেমাঝেই ছোটো বড়ো ছায়ারা ঘুমিয়ে আছে শিশুর মতো। ঠিক দু’বছর আগেও এমনই দেখেছে
অম্লান এ গ্রামকে। এ
গ্রাম এমনই থাকুক। এ
গ্রাম পোষাকী উন্নতির ধার যেন না ধারে। তারই মতো যেন কাউকে সময় জিজ্ঞেস
করলেও তাকে বলা না হয়। বোঝানো হয় সময়ের চিন্তার ভারে আজ সে কত অসুখী। কত বিপন্ন, অসহায়।
বাড়ির সামনে একটা পাতাহীন কংকালসার গাছ দেখে ঊর্মি জিজ্ঞেস করে, এটা কী গাছ?
হবে কোনো পর্ণমোচী গাছ। উত্তর দিলো অম্লান।
অম্লান গাছ চেনে না। ভ্যানের ছেলেটা হেসে
হেসে বলে,
ওটা বাতাবি
লেবু গাছ। মরে
গেছে। বাইরে
থেকে বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু ভিতর থেকে পচা।
অম্লানের মনে পড়ে ধানুকাকার কথা। সময় সব পচিয়ে দেয়। সত্যিই তাই। মানুষও এই বাতাবি লেবু
গাছটার মতো হয়ে যাচ্ছে। ভিতর থেকে পচা, অন্তঃসারশূন্য।
ঊর্মি আর অম্লান বাড়িতে ঢোকে। সেইদিন অম্লান প্রথমবারের
জন্য ঊর্মিকে ছুঁয়েছিল। সেই নিঃস্পৃহ ছোঁয়া আর কারো কাছে পায়নি ঊর্মি। অম্লানকে স্পর্শ করে
মনে হয়েছিল সে কোনো জন্মের পর না কাঁদা শিশুর
মতো মূক ও বধির। সে কাঁদছে ঠিক কথাই কিন্তু তার সাথে চিৎকারও করতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। কিছুতেই পারছে না। সেদিনের সেই কথা আজও
ঊর্মির মনে আছে। সেই
চরম চাওয়াকে সেদিনও ঊর্মি পূর্ণ করতে পারেনি আজও পারে না, পারবেও না।
ঊর্মিদিদি চলো না আমি আর তুমি
একটা সংখ্যাহীন বড়ো ঘড়ি বানাই আমাদের চারপাশে। সেখানে দুটো কাঁটা থাকবে। তুমি হবে ঘণ্টার কাঁটাটা
আর আমি ওই মিনিটের। আমার
প্রতি পূর্ণ আবর্তনে তোমার স্থান পরিবর্তন হবে ঠিকই কিন্তু প্রতি ঘণ্টায় আমি তোমাকে
একবার ছোঁয়ার জন্য দৌড়াব তোমার দিকে।
কিন্তু তা যে হয় না অম্লান!
যে একবার এই সময়ের স্বাদ পেয়ে গেছে সে কী করে সময়কে অস্বীকার করবে? আমার জীবনে যে সংসার নামক একটা সময় জড়িয়ে গেছে। তাকে ছিন্ন করি কীভাবে? স্বামী-সন্তান-সংসার। সময় যে আরও ক্ষুদ্র খণ্ডে
বিভক্ত অম্লান। সেখানে
শুধু মিনিটকাঁটা-ঘণ্টাকাঁটার
সহাবস্থান নেই। আছে
আর একটা সেকেন্ডকাঁটাও যে!
ভ্যান পাড়ায় ঢোকার মুখেই অম্লান সেই পুরনো ঘরটা দেখলো। এরও কোনো পরিবর্তন নেই। একটা খড়ের ছাউনি দেওয়া পাকা দেওয়ালের ঘর। ওটা এ গ্রামের একমাত্র পোস্টঅফিস। কেউ কোনোদিন চিঠি পাঠায় না। কোনো চিঠি আসেও না। শুধু পোস্টমাস্টার আছে নামেই। নিশ্চয়ই ঘরে শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। অম্লানের কিছুই মনে পড়ে না আর। নির্বাক চোখে শুধু তাকিয়ে থাকে। ঊর্মি ঠিক ভ্যানের সামনে ওইপাশে বসে অম্লানের হাত ধরে। সে চায় বারবার, অম্লানের সব মনে পড়ুক। যে সময় হঠাৎ করেই অম্লানকে তার কাছে নিয়ে এসেছিল একদিন। সেই সময়ই তাকে ফিরিয়ে দিক তার কাছে। পরক্ষণেই আবার মনে হয় অম্লান ফিরলেও সে তো ফিরতে পারবে না। পারবে না অম্লানের চাহিদাকে পূরণ করতে। তাও সে অম্লানের থেকে দূরে যেতে পারেনি। মাঝেমাঝেই ওই গ্রামে ঊর্মি ফিরে আসে। মনে করানোর ব্যর্থ চেষ্টায় একটা দিন সময় কাটায়। আবার ফিরে যায়। ঘড়ি তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, ফিরিয়ে নিয়ে আসে ওই বদ্ধ উন্মাদের গ্রামে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন