কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৮ |
নিতুদা
আমাদের পাড়ার অ্যাথেলেটিকস ক্লাব আজ এই শহরের একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ক্লাব। যখন শুরু হয়েছিল তখন অ্যাথেলেটিকস চর্চাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু কিছুদিন পরে একে একে সংযোজিত হতে থাকল বিভিন্ন রকমের খেলাধুলো। উদ্যোগটা ছিল পাড়ার সর্বজনীন দাদা নিতুদার। আমরা যখন নেহাতই বাচ্চা ছিলাম, নিতুদা সম্বোধন করতাম। আবার আমাদের বাবা, কাকা, জ্যেঠারাও নিতুদা বলেই ডাকত। নিতুদা এক আজব মানুষ ছিলেন। সারাটা জীবন তিনি এই অ্যাথেলেটিকস ক্লাব নিয়েই কাটিয়ে দিলেন। বিয়ে-থা করলেন না, সংসার করলেন না, মাথার ওপর নিজস্ব একটা ছাদ মানে কোনো বাড়ি বা ফ্ল্যাটের ঝঞ্ঝাটে গেলেন না। কোম্পানির কোয়ার্টারে কাজ থেকে অবসর নেওয়া পর্যন্ত থেকে গেলেন, তারপর এক সহকর্মীর ছেলের কোয়ার্টারে বাকি জীবন। শুনেছি তিনি কোম্পানিতে চাকরিটা পেয়েছিলেন অ্যাথেলেটিকসের কোটায়। তাঁর সময়ে ম্যারাথন রেসে তিনি ছিলেন চ্যাম্পিয়ন। এছাড়াও হকি, ফুটবল, ভলিবলের মাঠেও সমান বিচরণ। এক কথায় নিতুদা সারাটা জীবন ছিলেন মাঠের হিরো।
কিন্তু আজ পরিণত বয়সে পৌঁছে খুব দুঃখ হয় নিতুদার জন্য। জীবনটা তো ক্লাবের জন্য উৎসর্গ করলেন, কিন্তু বিনিময়ে কী বা পেলেন! শুরুতে তিনি ছিলেন ক্লাবের সর্বেসর্বা। তারপর ক্লাবের বিস্তার ঘটল, সদস্য সংখ্যা বাড়ল, কোম্পানি থেকে একটা কোয়ার্টার অ্যালোট করল ক্লাব হাউস হিসেবে, একটা খোলা মাঠকে সংস্কার করে ক্লাবকে লিজ দিল ক্লাবের নিজস্ব মাঠ হিসেবে। সব কিছুই ক্লাবের ইনফ্রাস্ট্রাকচার গড়তে সাহায্য করেছিল। নিতুদা প্রথম থেকেই ছিলেন ক্লাবের জেনারেল সেক্রেটারি। কিছুটা বয়স গড়িয়ে যাবার পর তাঁকে ক্লাবের প্রেসিডেন্ট পদে বসানো হলো। আর তারপর থেকেই একটু একটু করে তাঁর হাত থেকে ক্লাবের যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ প্রায় কেড়ে নেওয়া হলো। নিতুদার আর সেই ক্ষমতা বা দাপট থাকল না ক্লাবের বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে।
কোম্পানি থেকে অবসর নেওয়ার বছর কয়েক আগে ক্লাবের যে সাধারণ নির্বাচন হলো, তাতে স্পষ্ট বোঝা গেল, ক্লাবের নিয়ন্ত্রণ নেবার জন্য ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ গড়ে উঠেছে এবং তারা একে অপরের বিরোধী ও প্রতিপক্ষ। ক্লাবের স্বার্থকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তারা হীন ষড়যন্ত্রে সামিল। আর এই নির্বাচনেই এক কথায় সরিয়ে দেওয়া হলো নিতুদাকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে। তাঁকে নাকি আরও সম্মান দিতেই বসিয়ে দেওয়া হলো ক্লাবের উপদেষ্টার পদে।
এরপর নিতুদা মনে মনে খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। ক্লাবে তাঁর নিজেকে বহিরাগত অবাঞ্ছিত বলে মনে হতো। কেউ তাঁকে আর কোনো গুরুত্ব দেয় না, কোনো পরামর্শ ও উপদেশ শুনতে চায় না। তবু তিনি প্রতিদিন ক্লাবে যেতেন, একা একা কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরে আসতেন।
এই রকমই একটা দিনে আচমকাই দেখা হয়ে গেল মৃণালিনীর সঙ্গে। সেই মৃণালিনী, নিতুদাকে অনেকদিন আগে আড়ালে ডেকে বলেছিলেন, বাবা চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন, আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি। তোমার সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে জানি না। তবে তুমি যদি আমার জন্য অপেক্ষা কর, আবার একদিন দেখা হবেই।
Khub bhalo laglo .
উত্তরমুছুনবাহ ! ঠিক সময়েই তো দেখা হলো । এই ইতিবাচকতা মানুষকে সাহস দেয় ।
উত্তরমুছুন