ধারাবাহিক উপন্যাস
হে নেপথ্যচারিণী
(৩)
অভিনিবেশ
সকালে শহরের বুকের ভিতর এই গাছে মোড়া ব্যুলেভার্ড উপর থেকে দেখলে মনে হয় মনের ভিতরের ফুসফুস যেন আরও কিছুটা বাড়তি হাওয়া পেল। আশুদা আজকাল তার ওই রঙের গোলক নিয়ে অনেক রাত অবধি কাজ করে চলে। কী তার এই পরীক্ষানিরীক্ষার লক্ষ্য আমি জানি না। বুঝিও না তেমন। কিন্তু মনে মনে নিশ্চিন্ত হই। আশুদা এই পরীক্ষার ভিতর থেকে যেন এতোদিন বাদে শান্ত হয়ে এসেছে অনেক। তার কপালে বিষাদের 'ওমেগা' চিহ্ন মুছে গেছে। সকালে হাসপাতালে যাবার সময় সোফায় অঘোরে ঘুমাতে থাকা মানুষটিকে আর জাগিয়ে তুললাম না তাই। হাসপাতালে যেতে যেতে অত্রি আর সুচন্দ্রার কথাই মনে হচ্ছিল বারবার। মনে মনে ভাববার চেষ্টা করছিলাম সেই দৃশ্যটুকু। এক অষ্টম বর্ষীয়া মেয়ের চোখের সামনে কেউ তার মাকে বিবস্ত্রা করছে। সৃষ্টির গোপনতম ও কুৎসিৎতম সত্যটি তার সামনে ডানা মেলে ধরছে। কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তার মনের ভিতর? ভাবতে চেষ্টা করেও বারবার বিফল হলাম। সেই বিফলতার ভিতরেই কখন কর্মক্ষেত্রে পৌঁছে গেলাম আমি।
আজ কলেজে অত্রি এসেছে। বাইরে থেকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই কাজ করছিল সে। মাঝে একবার আমার কাছে এসে তার স্ত্রী সুচন্দ্রাকে ঘিরে তার ঘোর দুশ্চিন্তার কথা জানিয়ে গেল। সে দুশ্চিন্তার কারণ সুচন্দ্রার দুর্বলতা। ঘন ঘন মাথা ঘুরে যাবার প্রবণতা। খিদে না হওয়ার কারণে দুশ্চিন্তা। মনে মনে ভাবলাম হয়তো এই ছোট্ট আখ্যানের এক সুখময় পরিণতি ঘটবে অচিরেই। হয়তো কোনও আগামী সম্ভাবনার বীজ জাগ্রত সুচন্দ্রার জঠরে। সেই কারণেই এই স্নায়ুদুর্বলতা। সদ্য বপন করা ধানজমিতে অকালবর্ষণের পর আকাশের মেঘ কেটে গেলে কৃষকের ললাটে যে নিশ্চিন্তভাব ফুটে ওঠে, আমারও ঠিক তেমনটাই ঘটছিল। বাধ সাধল আমার নিজস্ব অন্যমনস্কতা। ঘটনাটি আর কিছু নয়, এই ঘরে সাময়িক বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পাবার পর থেকে যৌতুক হিসেবে পেয়েছি সাবেকি আমলের আবলুশ কাঠের একটি বড় টেবিল। টেবিলটির ড্রয়ারটিও বেশ কারুকাজে ভরা বড়সড়। দায়িত্বপ্রাপ্তির পর সেই ড্রয়ারে কলেজসংক্রান্ত যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ নথি তালাচাবি দিয়ে রাখার অভ্যাস করেছিলাম। এই ছোট পিতলের চাবিটি সচরাচর আমি নিজের কাছছাড়া করি না। আজ কাজের ফাঁকে বিরতির সময় অত্রির সঙ্গে কথা বলতে বলতেই কক্ষে রঘুপতি এসে হাজির। প্রিন্সিপল ম্যাডাম একটা জরুরি কাগজ চেয়ে পাঠিয়েছেন। সে কাগজ ওই বাহারে ড্রয়ারে। চাবি ঘোরাতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম আমার পকেটে চাবিটি নেই। নেই তো নেইই। আমার ঘরে আসবাব বলতে একটা বই আলমারি, ঘরের কোণায় একটি কাঁচের আলমারি বন্দি নরকঙ্কাল, দেয়ালে একটি কাকপক্ষী আঁকা ক্যালেণ্ডার, অজন্তাঘড়ি আর ছোট্ট একটি কম্পিউটার টেবিলে প্রিন্টার ডেস্কটপ। অত্রি চলে যেতেই রীতিমতো তন্নতন্ন করে ঘরটা খুঁজলাম। কিন্তু চাবি মিলল না। বাধ্য হয়েই রঘুপতিকে আগামীকাল আরেকবার আসতে অনুরোধ করলাম। এরপর তিনটে নাগাদ ক্লাস আছে। ধীরে ধীরে যত অফলাইন হয়ে উঠছে ক্লাস, পড়ার ঘরগুলো সব জীবন্ত হয়ে উঠছে। টক্সিকোলজি পড়াতে পড়াতে মন বেঁধে রইল চাবির দিকেই। তবে কী ঘরে ফেলে এলাম চাবিগুচ্ছ? আমার যে ঘরের চাবি ভেঙে পালাবার উপায় নেই। ভাবতে ভাবতেই ছুটির ঘন্টা পড়ল। বেশ বুঝতে পারছিলাম অত্রির ঘটনাটা আমার মনের ভিতর এক থিয়েটারের যবনিকা টেনে দিয়েছে। সে যবনিকা মায়াযবনিকা। তার ভিতর কূল পাওয়া কঠিন। মনোসংযোগের ব্যাঘাত হতে বাধ্য।
প্রতিদিন অপরাহ্ন হবার ঠিক আগে হিমঘরে আসা দেহগুলির ময়নাতদন্ত সেরে ফেলতে হয়। এখানে অনেক মানুষের এই আধুনিক যুগে দাঁড়িয়েও ধারণা যে সন্ধ্যা নেমে গেলে আর মৃতদেহ ছুঁতে নেই। এই প্রেতাত্মা কী আসলে মানুষের অবচেতননিবাসী নিষিদ্ধ ইচ্ছাগুলির লৌকিক রূপ? কে জানে! প্রতিদিন মর্গ থেকে বের হবার সময় মনে হয় এক উন্মাদিনী তার অনন্ত অন্ধকার কেশরাশি নিয়ে আমার ওপর ঝুঁকে পড়ছে। সেই সুন্দরী নৈশচুম্বন যেন আশুদার রঙের গোলকে ব্যবহৃত ডিমারগুলির মতোই অত্যন্ত স্মিত। আজ জনা চারেক মানুষ শুয়েছিলেন আমার তদন্তর অপেক্ষায়। তাদের স্থির চোখের মণির দিকে বহুবার তাকিয়ে দেখেছি। সে এক গভীর সমুদ্রে ডুব দেবার মতো। একটি অনতিদীর্ঘ মানবজীবনে সঞ্চিত অভিমান, বঞ্চনা, অপমান যেন সেই সমুদ্রেপৃষ্ঠে সাজিয়ে রাখা প্রবালসারির মতো। আজ তেমনই এক নিশিথিনী ছিলেন আমার চতুর্থ দেহ। বছর চব্বিশ বয়স। অপরূপ সুন্দরী। গলায় গাঢ় নীল ফাঁস দেবার দাগ। মৃত্যুর কারণ গলায় ফাঁস দেওয়া। এখানে ময়নাতদন্তকারীর কাজ সমাপ্ত। অথচ কেন সে এইভাবে ফাঁস দিল? কে বাধ্য করল? এসব তলিয়ে দেখলাম না আমি। এইসব ভাবতে ভাবতে আবার ফিরে আসছিলাম নিজের ঘরে। এই মর্গে আসার আগেই ছাত্রছাত্রীদের ছুটি দিয়ে দিয়েছি। অত্রিকেও বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। তাই এইসময় হাসপাতালের এই চত্বরটা বেশ শুনশান হয়ে ওঠে। তবে নিজের ঘরে গিয়ে এমন এক অভিজ্ঞতা হলো আমার যার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। এইবার বলি সেই কথা।
ঘরের ভিতর ঢুকে দেখলাম আমার টেবিলের বিপরীতে কালো পাগড়ি আর জোব্বা পরিহিত এক রহস্যময় লোক বসে আছেন। উচ্চতায় ফুট ছয়েক হবে। গায়ের রঙ ধবধবে সাদা। টিকোলো নাক। চোখগুলো দেখলে কোন হিংস্র পেঁচার নিশিপোহারিনী নয়নযুগলের কথা মনে পড়ে যাবে। বিনা অনুমতিতে এই কক্ষে তিনি কীভাবে প্রবেশ করছেন ভাবছি এমন সময় তিনি নিজেই আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে হাতজোর করে হাসিমুখে বললেন, "আদাব ডাক্তারবাবু। আমার নাম মনসুর গাজি।"
'মনসুর গাজি' নামটা এর আগেও শুনেছি। এঁর কাছেই অত্রিকে নিয়ে গিয়েছিল রঘুপতি আর সরফরাজ। এর প্রতি ওদের অগাধ ভক্তি। তাই আমার ঘরে প্রবেশের রহস্য আপাতত সমাধান করা গেল। অত্রির স্ত্রী একে নিয়েই ভয় পাচ্ছিল। কিন্তু মনের ভিতরে প্রশ্ন জাগলো আমার। এভাবে আজ আমার কাছে মনসুর গাজির আসার কী কারণ থাকতে পারে?
-আপনাকে
না জানিয়ে এইভাবে চলে এলাম। মাফি চেয়ে নিলাম।
-বলুন কী করতে পারি।
মনসুর আমার ঘরে বাক্সবন্দি নরকঙ্কালটা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে দেখতে দেখতে বলল। "এ বান্দাকে আমি চিনতাম। সুলেমান। রেলে হকারি করত। প্রেম করত এক বড়লোকওয়ালিকে। তারপর হঠাৎ বিষ খেয়ে মরে গেল।"
আমি সামান্য বিস্মিত হলাম। যদিও মনসুরের এই বিশ্লেষণের উপর আমার বিশদ আস্থা একেবারেই জন্মাল না। এই ছলের পদ্ধতি আমি জানি। মনোবিদ ফ্রান্স মেসমার এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তাঁর রোগিদের সম্মোহিত করতেন। পদ্ধতি আর কিছুই না। অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে একটা মিথ্যেকে সত্যি করে তোলা। সেই প্রথাই যে আজ কিছু সংবাদমাধ্যমও বিলক্ষণ গ্রহণ করেছে একথাও বলাই বাহুল্য। তাই বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়েই বললাম,
-কী করে এতো নিশ্চিত হচ্ছেন মনসুরজি?
আমার প্রশ্নের উত্তরে এক আশ্চর্য রহস্যজনক চাহনিতে মনসুর গাজি আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হিসহিস করে বলল, "সুলেমানের যখন দশ বছর বয়স, তখন ও একবার প্যাণ্ডেল বাঁধতে গিয়ে বেশ খানিকটা উঁচু থেকে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। বাঁদিকের মাথায় গভীর ক্ষত হয়। আপনাদের হাসপাতালেই ভর্তি ছিল টানা কুড়িদিন। জ্ঞান ছিল না। আল্লা মেহেরবান। তারপর ও চোখ খুলে তাকালো। ভালো করে দেখেন ডাক্তারবাবু। আপনার ওই কঙ্কালের খুলির বাঁদিকে এখনও সেই ক্ষতর দাগ রয়ে গেছে।"
আমার শিড়দাঁড়া বেয়ে সত্যিই যেন হাজার ভোল্টের কারেন্ট বয়ে গেল। সত্যিই কঙ্কালের বাঁদিকের প্যারাইটাল বোনে একটা ছোট্ট ডিপ্রেসড ফ্র্যাকচার রয়েছে। এতদিন খেয়াল করিনি। নিজের বাহাদুরিতে গদগদ মনসুর এইবার বেশ বিজ্ঞর মতো বলল,
-স্যার। আপনারা মাটির উপরের মানুষকে দেখেন। আর আমি দেখি মাটির নীচের মানুষজনকে। গোর দেবার পর তাদের উপরে তুলি। যাক গে। যে কাজে আসা।
কথা বলতে বলতে মনসুর গাজি তার কালো জোব্বার ভিতর থেকে একটা সাদা তুলোর পুতুল বের করল। সেই পুতুলের গায়ে অজস্র ছুঁচ ফোটানো। পুতুলটি টেবিলের ওপর রেখে মনসুর বলে চলল,
-আপনার এখানে একটা ছেলেকে জিনে ধরেছে। সেই জিন আমি এই পুতুলে ভরে রেখেছি। কিন্তু পুরোপুরি বের করতে পারিনি ওর দেহ থেকে। আপনি একটু ওকে ডেকে পাঠালে সে কাজ সম্পন্ন করি।
আমার মনের ভিতর বিজ্ঞান ও অলৌকিকতার কোনও দ্বন্দ্ব নেই। আমি এইসব বুজরুকিই মনে করি। মনসুরের এইসব হরকতে বুঝতে পারলাম কেন অত্রির স্ত্রী সুচন্দ্রা আমাকে তার উদ্বেগের কথা বলছিল। চোয়াল শক্ত করে বললাম,
-মনসুরজি। আপনাকে আদাব জানিয়েই বলছি। এটা একটা হাসপাতাল। একটা মেডিকেল কলেজ। আপনি কোনও উপায়ে এখানে ঢুকে পড়েছেন বটে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে এখানে আপনি আপনার ইচ্ছে মতো যা খুশি তাই করে যাবেন। আপনার অনুরোধ আমি রাখতে পারব না।
মনসুর আমার কথায় রেগে গেল না। তার কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফের আড়ালে একসারি কুৎসিত ছ্যাতলাপরা দাঁত তার মুখকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলল।
-আপনি
এইসব মানেন না। তাই তো ডাক্তারবাবু?
-হ্যাঁ।
মানি না।
-বহুত
খুব। কিন্তু এ পুতুল যে সে পুতুল নয়। তার প্রমাণ দিচ্ছি।
-আমি বাড়ি যাব মনসুর। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কাজ আছে অনেক।
-একটু ঠেহরে যান না স্যার। চলুন। এই পুতুলটাকে একবার ভালো করে দেখুন তো। আমি নিজে বানিয়েছি ওকে। তারপর বলুন তো, আজ আপনি কী হারিয়ে ফেলেছেন?
আমি চমকে উঠি। আমার ড্রয়ারের চাবি হারাবার কথা মনসুরের জানার কথা নয়। এমনকি যে সময় আমি হন্যে হয় ঘর তোলপাড় করছিলাম চাবির খোঁজে, সেইসময় ঘরে কেউ ছিল না। তাই সেই কথা কারোর জানার কথা নয়।
-চাবি
ঢুন্ডছেন তো? পেলেন কি?
আমি
চুপ করে আমার চেয়ারে বসে পড়ি।
-এবার
দেখুন...
মনসুর
বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়বার ঢঙে পুতুলটাকে টেবিলে শুইয়ে কীসব করতে থাকে। তারপর বলে,
-ওর
নাম রেখেছি রেশমি। রেশমি আপনার ছাত্রর ভিতর জিন হয়ে ঢুকে আছে। এবার দেখুন রেশমি কোন
দিক দেখাচ্ছে ওর হাত দিয়ে।
লক্ষ্য
করলাম পুতুলটির হাত আমার বইয়ের আলমারির দিকে নির্দেশ করছে।
-যান ওখানে ডাক্তারবাবু। যে ছিল আমার স্বপনচারিনী। মনে পড়ে?
আমি সম্মোহিতের মতো বইয়ের আলমারির দিকে এগিয়ে গেলাম। এই আলমারিতে একটিই মাত্র গানের বই আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অখণ্ড 'গীতবিতান'। মনসুর বলল,
-নিন। ও বই নামিয়ে আনুন।
আমি বইটি নামিয়ে আনতেই দেখলাম যেখানে ওই গানটি রয়েছে, সেই পাতায় কখন নিজেরই অজান্তে ড্রয়ারের চাবিটা পেজমার্কার হিসেবে ব্যবহার করে রেখেছি। হাত থরথর করে কাঁপছিল আমার। মনসুর গাজির ভুডুপুতুল জানল কীকরে এখানেই আমি চাবিটা রেখেছি!
-কী
স্যার। আমার রেশমীকে এবার বিশ্বাস হলো। চলুন। আপনার দের হচ্ছে। আমি উঠি।
মনসুর
গাজি আবার পুতুলটা জোব্বায় পুরে দরজার দিকে বেরিয়ে যেতে গিয়ে আবার ফিরে এসে বলে।
-ওই ছেলেটার খুব বিপদ স্যার। আমাকে সাহায্য করতে দিন। না হলে ওকে আপনি আর রাখতে পারবেন না।
মনসুর চলে গেলেও আমি গুম হয়ে চেয়ারে বসে রইলাম বেশ খানিকক্ষণ। আমার সামনে গীতবিতানের খোলা পাতার উপর ড্রয়ারের চাবি। আশুদা বলে যা কিছু আজগুবি অলৌকিক, তাই আসলে মনোবিজ্ঞান। মনের ব্যবচ্ছেদ করলে একমাত্র তাকে দেখা যাবে। তাহলে আজ যেটা ঘটল তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করব? আশুদা ছাড়া এ প্রশ্নের উত্তর মেলা অসম্ভব।
একটা সম্মোহিত চালনায় ফিরে এলাম নিজস্ব ঘরে। কিছুতেই ভেবে উঠতে পারছিলাম না মনসুর গাজি আর তার ভুডুপুতুল রেশমী কীকরে আমার অজান্তেই আমার মনের ভিতর এভাবে তল্লাশি করতে পারল। বসার ঘরে ঢুকে দেখলাম আশুদা তার পরীক্ষা নিয়ে মশগুল। একটা গোল চাকতি আনা হয়েছে। তার মধ্যিখানে ছিদ্র করে তার সঙ্গে একটা ছোট্ট মোটর জুড়ে দিয়েছে আশুদা। চাকতির রঙ লাল। পাশে আরও একটি চাকতি রয়েছে। তার রঙ নীল। আমাকে দেখে আশুদা বলল,
-কী
অর্ক! মন উদাস কেন?
-এটা কী আশুদা?
-এটাকে বলে ম্যাক্সওয়েলের চাকতি। এটা দিয়ে রঙের ভারসাম্য মাপা হয়। সে আমি তোকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। আগে তুই বল এত কী নিয়ে ভাবছিস?
এটা প্রথম থেকেই হয়। আশুদা খুব সহজেই বুঝে যায় আমার মনের ভিতরকার কথা। আমি আশুদা মনসুর গাজির পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম। আশুদা চোখ বন্ধ করে পুরোটা শুনল। কাহিনীর শেষ প্রান্তে এসে আশুদার ঠোঁটের কোণায় আলতো হাসির আভা ফুটে উঠল। তারপর চোখ খুলে বলল,
-বুঝলাম। এইবার তোকে আমি আমার এক্সপেরিমেন্টটা বোঝাই। এই যে লাল, একে বলা হয় ভেনেশিয়ান রেড। আর এই যে নীলচে বেগনে, ওর নাম কোবাল্ট। এইবার দুই চাকতি একই মোটরে ঘুরিয়ে দিলে দেখবি তোর মনের অবস্থা ফুটে উঠছে।
কেন সবাই এমন করছে আমার সঙ্গে কে জানে? বিকেলে মনসুর গাজির পর এই রাতের বেলায় আশুদা। তবু ঠিক করলাম শান্ত হয়ে এই পরীক্ষাটা শেষ অবধি কী হয় দেখব। ম্যাক্সওয়েলের চাকতিদুটো মোটরে লাগিয়ে ঘুরিয়ে দিল আশুদা। খানিক পর দেখলাম সেই ঘূর্ণায়মান চাকতি দুটির নিজস্ব রঙ আর চেনা যাচ্ছে না। বরং সেখানে অন্য একটি রঙের সৃষ্টি ঘটেছে। ধূসর। আশুদা নিজের পরীক্ষায় সফল হয়ে আনন্দে গদগদ হয়ে বলল,
-এই যে ধূসর রঙ দেখছিস, ও হল তোর সচেতন মস্তিষ্কের রঙ। যখন তুই কর্মব্যস্ত চলমান থাকিস, আলাদা করে ওর ভিতরের অবচেতনের রঙগুলো আর চেনা যায় না। আজ মনসুর গাজি যে ভেলকি তোকে দেখিয়েছে তা দেখাতে কোনও অতিমানবিক অলৌকিক শক্তির প্রয়োজন হয় না। যেটা দরকার তা হলো তীব্র পর্যবেক্ষণ।
আশুদার এই কথায় বেশ কৌতূহল জন্মালো আমার। কী এমন তীব্র পর্যবেক্ষণ থাকতে পারে মনসুর গাজির চোখে যা আমার অবচেতনে ঢুকে পড়ল আর আমি জানতে পারলাম না। আশুদা বলে চলল,
-আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে এমন অনেক ঘটনাই দেখে থাকি যার আপাতভাবে কোনও স্মৃতি আমাদের মনের ভিতর থাকে না। হতে পারে তা শৈশবের কোনও অভিজ্ঞতা। হতে পারে বড় বয়সে ঘটে যাওয়া খুঁটিনাটি কোনও ঘটনা। মনে রাখতে না পারার কারণ দুটো হতে পারে। প্রথমটি হয়তো ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও তার বিশ্লেষণের জন্য পর্যাপ্ত জ্ঞান আমাদের নেই। অথবা দ্বিতীয় ঘটনাটি সচেতনভাবে গুরুত্বপূর্ণ না মনে হওয়ায় তার স্থায়িত্ব ঘটেনি। এখন মজার কথা হল এমন অনেক ঘটনাই নানান কারণে সচেতন মন মনে করে অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু অবচেতনে তার অঙ্কুর থেকে যায়। তারাই নিজের অজান্তে এমন কিছু ক্লু রেখে দেয় যা কেবলমাত্র অত্যন্ত সচেতন পর্যবেক্ষকের পক্ষেই ধরে ফেলা সম্ভব। বুঝলি অর্ক, এই যে সবাই প্লাজিয়ারিজম বলে নাচানাচি করে, জগতের সব মৌলিক ভাবনার আড়ালে প্রারব্ধ কোনও ধারণা অবচেতনে রয়ে গেছে। এটাই সত্যি। একেই মনোবিদ ইয়ুঙ বলতেন ক্রিকট্যামনেশিয়া।
আমি আশুদার কথা মেসমারের রোগিনীদের মতোই অবাক হয়ে শুনছিলাম। ভাবতে ভাবতে এই অদ্ভুত সুন্দর মানুষটির তল খুঁজে পাবার ভ্রান্ত চেষ্টা করছিলাম। সেই তল খুঁজতে হলে সূত্রধরের সন্ধান পাওয়া আবশ্যক। আমি তাই বললাম,
-কিন্তু
আমার ক্ষেত্রে মনসুর বুঝল কী করে চাবিটা কোথায় আছে?
-তোর
ক্ষিদে পেয়েছে। চল। খেতে বের হই। সারাদিন এভাবেই তো ঘরবন্দি হয়ে বসে আছি।
-কী করে বুঝলে?
-যে ভাবে মনসুর তোর চাবি খুঁজে দিল। চোখের মণি একটি সুতীক্ষ্ণ অস্ত্র অর্ক। ও দিয়ে রমণীর হৃদয়হরণ আর পাতকের জীবনহরণ, দুটোই সহজে সম্ভব। আমাদের কথোপকথনে তোর চোখের মণি তোরই অজান্তে তিনবার ফ্রিজের দিকে তাকিয়েছে। অথচ তুই সেটা জানিস না। ঠিক তেমনই আমার বিশ্বাস মনসুরের সামনে তোর চোখের মণি তোর গাড়ির চাবি আর আলমারির দিকে নড়েছিল। সচেতনভাবে মনে না থাকলেও তোর অবচেতন জানত চাবিটা কোথায় আছে। আর সেটাই মনসুর ধরে ফেলেছিল।
সারাদিনের ম্যাক্সওয়েলের চাকতি আর সারা সন্ধ্যা ক্রিকট্যামনেশিয়ার ধাক্কা সামলাতে আশুদাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাতের রবীন্দ্রসরোবরে। এইসময়ে কলকাতার ফুটপাতে ভিড় করে থাকা স্ট্রিটফুডের দোকানগুলো হাতড়ে রুটি আর ঘুগনি মটর জুটে গেল। সেটুকু খাবার পর আশুদা বলল, "চল। একটু হাঁটি।"
শরৎ বসু রোড দিয়ে রাতের রাস্তা ধরে দুজনে হাঁটছিলাম। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁই ছুঁই। রাস্তায় পথচারীর সংখ্যা কমে এসেছে অনেকটাই। খানিকটা এগোতেই হঠাৎ আশুদা আমার হাতটা খামচে ধরল। তার দুটি চোখ বিস্ফারিত হয়ে উল্টোদিকের ফুটপাতের দিকে তাকিয়ে আছে। আশুদার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও চমকে গেলাম রীতিমতো। উল্টো ফুটে ঠিক আমাদের দিকে মুখ করে তাকিয়ে রয়েছে অত্রি। একলা। এতো রাতে! চালতাবাগান থেকে দেশপ্রিয় পার্ক। দূরত্ব কম নয়!! এতো রাতে ও এখানে কী করছে? হাত নাড়লাম। লাভ হলো না। ও যেমন পাথরের মতো আমাদের দিকে চেয়েছিল তেমনই চেয়ে রইল। আশুদা ফিসফিস করে বলল, "লাভ হবে না। চল। ওদিকে চল। অত্রিকে আজ রাতে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাই। নাহলে এ অবস্থায় ও আর ফিরতে পারবে না।"
আশুদা আর আমি নিথর অত্রির কাছে পৌঁছোতে শহরের নিঃসঙ্গ রাস্তা পার হয়ে অপরদিকে হাঁটা লাগালাম।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন