ধারাবাহিক উপন্যাস
একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী
(১৮)
রীতিমতো উৎসব শুরু হয়ে গেল। সবাই মিলে হৈচৈ করে পরীক্ষা দিতে গেল। হৃদয় বিশেষভাবে উৎসাহ দিচ্ছিল অনির্বেদকে। বলছিল, তোকে ভালো পরীক্ষা দিতেই হবে। বাকি যার যাই হোক, চাকরিটা তোকে পেতেই হবে। পরীক্ষা চলার সময়ও হৃদয় উশখুশ করছিল। নিজের লেখার দিকে মন ছিল না। ঘাড় ঘুরিয়ে কে কী করছে, তা নিয়েই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যেন চাকরিটা ওর বন্ধুদের একান্তই দরকার। ও এসেছে নিছকই যোগাযোগ করিয়ে দিতে। তদারকি করতে। সৌজন্য দেখাতে। বিশেষ করে অনির্বেদের দিকে ও তীক্ষণ নজর রাখছিল। নানাভাবে ইশারা করে উৎসাহ দিতে চাইছিল ওকে। ফেরার সময়ও ওরা সবাই নিজেদের মধ্যে মজা করছিল। চাকরিটা শেষ পর্যন্ত ওদের কারোরই হয়নি। ওটা অবশ্য আগেই গৌন হয়ে গেছিল। হৃদয়ের কাছে বন্ধুদের জন্য কিছু করত পারাটাই বড়ো হয়ে উঠেছিল। নিজে একা সুযোগ না নিয়ে ও বন্ধুদের সবাইকেই সমান সুযোগ দিতে চাইছিল। আর এই আনন্দটাই ছিল ওর কাছে শেষ কথা...
বিশ্রুত পরে দিশারীকে বলেছিল, এটাই সমস্যা হৃদয়ের। নিজের ভালোমন্দ
ও কোনোদিনই বোঝেনি। একটা সুযোগ এসেছে, সবাই মিলে কাজে লাগাই। ভালো হলে সবারই হোক। একার
ভালো ওর পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। শুধু নিজের ভালো ভাবতে গেলেই নিজেকে ওর স্বার্থপর মনে
হত। যা কিছু ভালো, যা কিছু সুযোগ, যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মহৎ ও বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ
করে নিতে চাইত। বন্ধুত্ব বলতে ও এই অংশীদারিত্বই বুঝত। সেখানে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবার
মতো সঙ্কীর্ণতাকে ও ঘৃণা করত। কয়েকদিন পর এক বিকেলে হৃদয়ের বাড়িতে অনির্বেদ এলো ক্লান্ত,
বিধ্বস্ত অবস্থায়। খুব অবাক হয়ে হৃদয় জানতে চাইল, কী হয়েছে? কোত্থেকে আসছিস?
প্রাইভেট সেক্রেটারির বাড়ি গেছিলাম।
হৃদয় যেন আকাশ থেকে পড়ল। প্রাইভেট সেক্রেটারি? কেন?
অনির্বেদ খুলে বলল, অতলান্তের সঙ্গে গেছিলাম। ও তো প্রায়ই যায়।
তাই নাকি? হৃদয় চমকে উঠল। বলল, কবে থেকে? আমাকে কিছু বলে নি
তো...
অনির্বেদ বলল, তোকে সবাই সব কিছু বলে নাকি? কিন্তু সে চুপ করেই
রইল। হৃদয়ের একটা ভুল ধারণা আছে। সে নিজে বন্ধুদের কাছে নিজের হৃদয়কে একটা খোলা বইয়ের
মতোই ব্যবহার করে। তার ধারণা তার বন্ধুরাও তার সঙ্গে ঠিক একই ব্যবহার করবে। বন্ধুদের
সব কিছু জানার অধিকার তার আছে। আর বন্ধুদের তার কাছে গোপন করার প্রয়োজন নেই। বন্ধুত্বে
কোনো লুকোচুরি চলে না। বন্ধুত্ব মানে একে অপরের কাছে খোলা বই হয়ে থাকা।
অতলান্ত তাকে কিছুই জানায় নি। সম্পূর্ণ গোপনে প্রাইভেট সেক্রেটারির
সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। সেখানে নিয়মিত যাচ্ছে। আজ অনির্বেদকে পর্যন্ত নিয়ে গেছে। আর সে
কিছুই জানে না? তার মনে পড়ল একা যাওয়ার সুযোগ তারও ছিল। সে যায় নি। বন্ধুদের অন্ধকারে
রেখে কোনও বিশেষ সুবিধা নিতে চায় নি। আর তার বন্ধুরা কী করছে! বন্ধুদের ব্যবহার তাকে
ক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
অনির্বেদ বলছিল, ওই ফুল কম্পানির হয়ে অতলান্ত এখন জোকস লিখছে।
ওটাই সে ভালো পারে। একমাত্র আমাকেই কথাটা জানিয়েছে।
হৃদয়ের জানতে ইচ্ছা করল, কথাটা ওকে জানায়নি কেন? সে তো অতলান্তকে
না জানিয়ে কিছুই করে না! কিন্তু সে চুপ করেই রইল। ওর বন্ধুরা কেউ অবুঝ শিশু নয়। যা
করেছে জেনেবুঝেই করেছে। সে অনির্বেদের দিকে তাকাল। বিধ্বস্ত গলায় সে তখনও বলে চলেছে,
আমাকেও অতলান্ত জোকস লেখার কথা বলেছিল। আমারও অর্থের প্রয়োজন। আজ গেছিলাম ওর সঙ্গে।
অনেক আশা করেই গেছিলাম।
তারপর?
প্রথমে অতলান্ত ওর জোকসগুলো দেখাল। প্রাইভেট সেক্রেটারি তো ভূরি
ভূরি প্রশংসা করল। তারপর আমি আমার চিঠিগুলো দেখালাম। হঠাত লোকটির মুখের ভাব কেমন পালটে
গেল। মেজাজটা। সে যেন খুব বিরক্ত হচ্ছিল। তারপর ভুরুটুরু কুঁচকে বলল, আমার এখনও হাত
পাকে নি। তৈরি হতে অনেক সময় লাগবে। তারপর থেকেও আমার কেমন যেন বিধ্বস্ত লাগছে। সত্যিই
কি আমার চিঠিগুলো এতটাই দুর্বল? তোরা তো কখনও আমাকে অমন করে বলিস নি। এই ফুলের বাগানের
জন্য কত সময়ে তো কত চিঠি লিখেছি। তোরা আমার প্রশংসাই করেছিস। তাহলে এই লোকটি এভাবে
বলল কেন বল তো? আমার তো কিছুই মাথায়
হৃদয় মৃদু হেসে বলল, প্রাইভেট সেক্রেটারিকে দেখে তুই তাহলে কিছুই
বুঝিস নি। লোকটি জোকসের সমঝদার, চিঠির নয়।
ব্যাপারটা কিন্তু এখানেই থামল না। কয়েকদিন পর হঠাত হৃদয়ের চোখে
পড়ল ফুলের কম্পানির বিজ্ঞাপনে অনির্বেদের লেখা একটা জোকস। কয়েকদিন ধরেই জোকসের দিকে
খুব ঝুঁকেছে অনির্বেদ। হৃদয় জানতে চেয়েছিল, চিঠি ছেড়ে জোকস ধরলি কেন?
অনির্বেদ চুপ করে থেকেছে। শুধু ওর মুখের ভাব আরও বিষণ্ণ হয়েছে।
এই জোকসটা কয়েকদিন আগে ওকে শুনিয়েছিল অনির্বেদ। দেখেই চিনতে
পারল হৃদয়। কিন্তু অনির্বেদ তো ওকে কিছু জানায় নি। সে কী তাহলে পরেও অতলান্তের সঙ্গে
প্রাইভেট সেক্রেটারির বাড়িতে গিয়েছিল? নিজের জোকসগুলো তাকে গিয়ে দিয়ে এসেছে?
অনির্বেদকে সরাসরি কথাটা জিজ্ঞেস করল হৃদয়। সে বলল, হ্যাঁ। কিন্তু
খুলে কিছুই বলল না। হৃদয়ও আর কিছু জানতে চাইল না।
পরে সে বিশ্রুতকে বলেছিল, আমার বন্ধুরা গোপনে অনেক কিছুই করত,
আমি কিছুই টের পেতাম না। অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম ওদের। আর ওরা নিজেদের বেশ গুছিয়ে
নিচ্ছিল...
বিশ্রুত ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল, তুই কেন চোখ-কান বন্ধ রেখেছিলি? ওগুলো
তো খুলে রাখারই জিনিস। যে কোনও মানুষেরই চারপাশে কী ঘটছে না ঘটছে সে ব্যাপারে সজাগ
ও সতর্ক থাকা উচিত...
কয়েকদিন পরে একটা অনুষ্ঠানে হৃদয়ের স্পঙ্গে দেখা হয়ে গেল প্রাইভেট
সেক্রেটারির। সে বলল, তোমাদের ওই অতলান্ত ছেলেটিকে আমরা নিয়ে এলাম। ও তো আমাদের এখানে
প্রচুর কাজ করেছে...
খবরটা আগেই পেয়েছিল হৃদয়। তাই কিছু বলল না। অতলান্ত ওকে খুলে
কিছুই বলেনি। হৃদয় আঁচ পাচ্ছিল শুধু। অতলান্তের কাছে দু-একবার জানতেও চেয়েছে। খুবই
ভাসা-ভাসা উত্তর পেয়েছে তখন। তাছাড়া কিছুদিন ধরে অতলান্তও যেন একটু দূরে দূরেই থাকছে।
কিছুটা যেন এড়িয়ে যাওয়া ভাব। আগের মতো আসে না বা ফোন ধরে না। দেখা হলে বা ফোন করলে
মনে হয় কিছু যেন লুকোচ্ছে। ঠিক যেন হদিশ পায় না হৃদয়।
প্রাইভেট সেক্রেটারির কথা তখনও শেষ হয়নি। সে বলল, অবশ্য ওই অনির্বেদ
ছেলেটিকে নিতে পারলাম না। ওকে এখনও তৈরি হতে হবে। খুব এসেছিল কয়েকদিন। যখন আসত হাতে
থাকত মিষ্টির ভাঁড়। ওর জন্যও কিছু করতে পারলে ভালো লাগত।
ওকে না জানিয়ে যা কিছু ঘটেছে, হৃদয় সবকিছুই যেন চোখের সামনে
দেখতে পেল। জানতে ইচ্ছা করল, অনির্বেদের ওই একটি জোকস তাহলে ওরা ব্যবহার করল কেন? কিন্তু
চুপ করেই রইল সে। বুঝতে পারল, স্রেফ করুণা করেই ওরা অনির্বেদের একটা লেখা নিয়েছে। এখানেও
অনির্বেদ করুণার হাত থেকে রেহাই পায়নি। অতলান্তের চাকরি জুটেছে, আর ওর জুটেছে নিছক
করুণা।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন