শনিবার, ১৪ মে, ২০২২

রুবী মুখোপাধ্যায়

 



আগন্তুক

 

অমাবস্যার রাত। আকাশে অশনি সংকেত। জোর বাতাস। সন্ধ্যে নাগাদ হাঁটছিলাম পার্কে। চারদিকে গাছের শুকনো পাতা উড়ে বেড়াচ্ছে। দ্রুত পায়ে সান্ধ্যভ্রমণ শেষ করতে হবে। এতক্ষণ চোখে পড়েনি, কিন্তু হঠাৎ মনে হল, কেউ আমার আগে আগে হেঁটে চলেছেন, সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে পিছনে মুষ্টিবদ্ধ হাতে। দ্রুত পায়ে ওনার সামনে গিয়ে বলি, ‘কে আপনি? আগে তো এ পাড়ায় আপনাকে দেখিনি? এমন ঝোড়ো হাওয়ায় আস্তে আস্তে হেঁটে চলেছেন?’ ‘আমি? কেউ একটা হ। প্রতি বছর এই সময়টায় আমাকে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে হয়। তোমরা আমাকে ডাকো, তাই। দূর পাগল নাকি! নিজেকে  নিজেই প্রশ্ন করিতারপর ঐ বৃদ্ধ ভদ্রলোককে বলি, ‘কেন? কী এমন দায় যে, লোকে ডাকলেই আপনাকে সেখানে ছুটে যেতে হবে, এই প্রচন্ড গরমে?’ অচেনা ব্যক্তিটি বলেন ‘গরমে আমি ভয় পাই না। গ্রীষ্মপ্রধা দেশ — তা ছাড়া গরমেই তো আমার জন্ম! সে কথা থাক। ভাবছি এবার আমার ডাক এলে, সে ডাকে আমি সাড়া দেব কি না! আমি বলি, ‘দেখুন সামনেই আমাদের গ্রাম বাংলার  ভোট আসছে, আপনি কি কোন রাজনৈতিক নেতা?’ না আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তোমরা যাকে বিশ্বকবি বলে মানো, গুরুদেব বলে ডাকো। আমার মনে হল, চারিদিকে চলমান বাস্তব, বাড়িতে বাড়িতে টি.ভি. চলছে, রাস্তায় গাড়ি, লোকজন থচ আমি কি জেগে স্বপ্ন দেখছি? তা তো নয়, দিব্যি সামনে দাঁড়িয়ে হতাশ চোখে তাকিয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। যদিও দাঁড়ি গোঁফের আড়ালে লম্বা চুলে মুখটা বিশেষ দেখা যাচ্ছে না, তবু যেন মুখে কিছুটা চিন্তার আভাস

মনে হল, একটু যাচাই করে দেখি ওঁর কথার সত্যতা। আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল, বছরের এই সময়টায়, বিশেষ করে বাংলায় আসেন কেন? ‘তোমরা আমার জন্মদিন পালন কর, তাই! তবে জন্মদিনটা দিনের দিন খুব কম জাগাতেই পালিত হয়। এখন হলো রবিবারের রমরমা। তাই তো দেখি, সাপ্তাহিক ছুটির দিনেই আমার জন্মদিন পালিত হচ্ছে। জেনেছি এখন না কি বিবাহ, অন্নপ্রাশ, শ্রাদ্ধ - এ সব সামাজিক  অনুষ্ঠানের দায়ও বর্তেছে ওই রবিবারের ঘাড়েই। আমি  বলি, ‘সে আর কী করা যাবে  বলুন, যা দিনকাল পড়েছে, অধিকাংশ লোকেরই সপ্তাহের পাঁচদিন নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকে না। ঐ শনি-রবিই তাদের ভরসা। ওই তো আমাদের পার্কের এককোণে প্যান্ডেল দেখতে পাচ্ছেন, ওখানেই আমরা একটা শনি অথবা রবিবারে সকলের সুবিধা সুবিধা জেনে নিয়ে তবেই পালন করব আপনার জন্মদিন। নইলে যে ভিড় হবে না! পারফর্মাররা উৎসাহ পাবে কেন ফাঁকা মাঠে নাচ গান করতে? আপনিও আসবেন কিন্তু। দোষ নেবেন না, আজকাল বিদেশে দুর্গাপুজো পর্যন্ত দিনক্ষণ মেনে হচ্ছে না। ওদের সুবিধে মত হয়। আপনার জন্মদিনের ব্যাপারটা তো অনেক দূরের কথা।

গম্ভীর হয়ে গুরুদেব বললেন, ‘না আমি উপস্থিত থাকতে পারব না। গত দু বছর ধরে আমার সার্ধশতবর্ষ নিয়ে তোমরা যে কান্ডকারখানা করলে তাতে আমি যৎপরোনাস্তি বিরক্ত। কিছু জনতার মুখে তো সার্ধশতবর্ষ কথাটা ‘শ্রাদ্ধ’-শতবর্ষে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আর সর্বত্র অনুষ্ঠানে শোনা  গিয়েছে, আমারি লেখা গান, দেখা গিয়েছে আমারই রচিত নৃ্ত্যনাট্য, কবিতা পাঠ। শুনে শুনে আমি বধির হয়ে গিয়েছি।’ এবার আমি একটু রেগে গিয়ে বলি, ‘এ জন্য দায়ী তো আপনিই।   আমৃত্যু আপনার কলম হৃৎস্পন্দনের মত অবিরাম লিখেই চলতো।  জীবনের এমন কোন মানসিক অবস্থা, এমন কোন ভাবাবেগ, অনুভূতির কথা বাদ রেখেছেন, যার ফাঁক গলে কেউ কোনদিন উত্তীর্ণ হতে পারবে? হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখ, প্রেম বিরহ, প্রকৃ্তি, প্রার্থনা, শিক্ষা, রাজনীতি, ধর্মনীতি, কোন সাবজেক্ট  বাদ দিয়েছেন বলুন তো?’ হতাশ কন্ঠে উনি বলেন, ‘ও তা হলে দোষটা আমারই বলছো?’ আমি বলি, ‘সে তো খানিকটা বটেই, নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পরও অত লিখতে গেলেন কেন?’

‘হ্যাঁ, এদিকটা তো ভেবে দেখিনি - পরবর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে আমাকে এমন বাক্যি শুনতে হবে! তবে হ্যাঁ, কতগুলো ব্যাপারে আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই। তুমি আমার হয়ে একটু প্রচার করে দিও যতটা পার। ভাষা তোমার, ভাবনা আমার।’ আমি বলি, ‘অবশ্যই! এই আমাদের পাড়ার প্যান্ডেল থেকেই শুরু করে দেব আমার প্রচার। আপনি এক এক করে বলতে থাকুন।’‘হ্যাঁ, প্রথমটা হলো, তোমাদের এই অঞ্চলটা একটু নিরিবিলি। কলকাতার মতো অত কোলাহল, ভিড়ভাট্টা নেই। কলকাতার যা অবস্থা, আমি যে একটু জোড়াসাঁকোয় যাব, তা যেতে ভয় করে।  বিশেয করে একটা কারণে, বড় রাস্তায় তো চলাই দায়! সিগন্যালে সিগন্যালে আমার গান বাজছে। এটা কি ধরনের অপমান বল তো? কেউ শুনছে আমার গান? এমন কি ওই শ্মশানঘাট, সেখানেও। অবশ্যই জানি শ্মশান অতি পবিত্র স্থান, কিন্তু যতদূর আমার মনে পড়ে, ঐ শোকার্ত পরিবেশে গাইবার মত আমার দু চারটির বেশি গানই নেই। তাও আমার পুজা পর্যায়ের গান হলেও চলত। কিন্তু একেবারে প্রেমের গান!’

‘বিশ্বাস করুন গুরুদেব’, আমি হাঁসফাঁস করে বলে উঠি, ‘এই যত্রতত্র  আপনার  গান বাজানো নিয়ে অনেক কথাই উঠেছিল, কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। ওই যে বলে না, পড়েছি যবনের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে!’

-‘আচ্ছা স্যার, আপনার পরবর্তী অনুযোগটা যদি বলেন!

-‘হ্যাঁ, ওই সিনেমার কথায় আসি। মাণিক বা তপন আমার গল্প নিয়ে যেসব ছবি পরিচালনা করেছে, সেখানে কাহিনির মান-মর্যাদা বজায় রেখেছে। গানগুলোরও অঙ্গসৌষ্ঠব হানি হয়নি। অথচ দেখ এখনকার পরিচালকদের অবস্থা! গানগুলোকে কীভাবে ব্যবহার করছে! খানিক বাংলা, খানিক দু-চারটে ইংরেজি শব্দ!’

-‘দেখুন, দেখুন, অত ব্যস্ত হবেন না। গানের শুরুতে একটু উ-লা-লা, একটু আধটু ইংরেজি শব্দ জুড়ে ফাইন্যালি আপনার গানটাই তো গাইছে, না-কি? কালের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়।’

-‘ও! তাই নাকি? আর ওই ব্যপারটা? আমি ক’মাস আগে গিয়েছিলুম আমার  শান্তিনিকেতনে। প্রিয় ছাতিমতলায় গিয়ে বসেছি, হঠাৎ দেখলাম ক’টা অল্পবয়সি ছেলেমেয়ের দল শিয়ালের মতো হুক্কাহুয়া ডাক ছেড়ে আমার একটা প্রিয় গান গাইতে গাইতে চলে গেল। বর্ষা যে আমার বড়ো প্রিয় ঋতু ছিল – কত বর্ষার গান লিখেছি! সুর দিয়েছি! আর আজ!’

-‘আঃ’, বিরক্ত হয়ে আমি বলি – ‘দেখুন, যদি আমাদের মনে বেঁচে থাকতে চান  তবে এসব ছোটখাটো বিচ্যুতি আপনাকে সইতেই হবে। জানেন না, “যে সয় সেই রয়”? সবে তো একশো একষট্টি বছর বয়স হলো। যদি চান যে শেক্সপিয়ারের মতো চারশো আটান্ন বছর পরও লোকে আপনাকে মনে রাখবে, তবে চুপচাপই থাকুন। যাকগে, বৃষ্টি এসে গেল। একবার পা-টা বাড়ান। আপনাকে একটা প্রণাম ক’রে নিই। আপনার ক্ষোভ-বিক্ষোভ আমি জায়গামতো প্রচার ক’রে দেব’খুনি। নিচু হয়ে প্রণাম করতে গিয়ে দেখি, কিছু নেই, কেউ নেই।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন