সিনেমার পৃথিবী – ১৯
চিনদেশের যে কোন কিছু নিয়েই লিখতে বেশ
ভয় লাগে। তা সে অর্থনীতি হোক বা কোভিড ভাইরাস। এমনি বেশ চাপা দেশ, মিলিটারির আধিপত্য,
বেশি কিছু বললেই কোর্ট মার্শাল। কিন্তু চিনের প্রাচীন শিল্প ও সংস্কৃতির এক দীর্ঘ ইতিহাস
আছে। তেমনি ইতিহাস রয়েছে চিনের সিনেমার। ১৮৯৫
সালে প্যারিস আর বার্লিনে প্রথম চলচিত্র বানানোর মোটামুটি দশ বছরের ভেতরেই চিনদেশে
প্রথম সিনেমা বানানো হয়েছিল। ১৯১৪ সালে যখন ভারতে প্রথম চলচিত্র ‘রাজা হরিশচন্দ্র’
বানানো হয়, তদ্দিনে চিনে প্রচুর ব্যবসায়িক সফল ছবি বানানো হয়ে গেছে। সিনেমার ইতিহাসে এই দেশকে অস্বীকার করা সম্ভব
নয়। ইরানের পরে আমাদের আজকের গন্তব্য তাই চিন। হ্যাঁ, একটা কথা শুরুতেই বলে রাখা ভাল।
চিন থেকে প্রচুর ছবি অস্কারের জন্য পাঠানো হলেও নমিনেটেড হয়েছে খুবই কম সংখ্যক ছবি
এবং আজ অব্ধি চিনের কোন ছবি অস্কার পায়নি। কিন্তু তাই বলে চিনের ছবি দুর্বল নয়, বরং
মূলত ইতিহাস আশ্রয়ী। এবং সেই কারণেই চিনের
ছায়াছবির সিনেমাটোগ্রাফি কিন্তু বেশ শক্তিশালী। আমরা আজ প্রথমেই চিনের এমন কিছু ছবি
বেছে নেব যেগুলো থেকে চিনের বেশ খানিকটা ইতিহাস পাওয়া যাবে। এবং তার পাশাপাশি অন্য
বেশ কিছু আর্ট ফিল্মও বেছে নেব।
তো, আমাদের বাছাই ১৫টা চিনা সিনেমা হল
- দ্য গডেস (১৯৩৪), স্প্রিং ইন এ স্মল টাউন (১৯৪৮), ইয়েলো আর্থ (১৯৮৪), রেড সোরঘাম
(১৯৮৭), এ সিটি অব স্যাডনেস (১৯৮৯), জু দো (১৯৯০), রেইজ দ্য রেড ল্যান্টার্ন (১৯৯১),
এ ব্রাইট সামার ডে (১৯৯১), ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন (১৯৯৩), দ্য ব্লু কাইট (১৯৯৩), টু
লিভ (১৯৯৪), চাংকিং এক্সপ্রেস (১৯৯৪), ইন দ্য মুড ফর লাভ (২০০০), 24 সিটি (২০০৮) ও
আফটারশক্ (২০১০)।
আমি জানি, আপনারা যারা চিনের ছবি দেখেন,
এই লিস্ট দেখে একটু মুচকি হেসে বলবেন, গং লি-র এত ছবি? তাহলে বলি, চিনের এই নায়িকা
আমার প্রিয় একটাই কারণে – ওনার সাবলাইম অভিনয় ক্ষমতা। ঠিক যে কারণে ওনার ছবি দেখলে
মীনাকুমারী বা নার্গিসের কথা মনে পড়ে যায়। চড়া টোনে নয়, বরং অন্তঃসলিলা এবং কম কথায় শুধু মুখের অভিব্যক্তি দিয়ে
অনেক কিছু বুঝিয়ে দেওয়া – এজন্যই গং লি আমার প্রিয় নায়িকাদের লিস্টে। তবে এখানে ওনার
যে পাঁচটা ছবি রেখেছি - রেড সোরঘাম (১৯৮৭), জু দো (১৯৯০), রেইজ দ্য রেড ল্যান্টার্ন
(১৯৯১), ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন (১৯৯৩) এবং টু লিভ (১৯৯৪) – এর ভেতর মাত্র একটাই আলোচনা
করব।
প্রথমে এই ছবিগুলোর ভেতর কী কী ইতিহাস
দেখানো হয়েছে, সেগুলোর একঝলক দেখা যাক।
কুড়ি-তিরিশ-চল্লিশের দশকে চিনে ভারতের
মতই ধনিক শ্রেণী, জমিদারি প্রথা ও একাধিক মিস্ট্রেস
রাখার প্রচলন ছিল। যখন কমবয়সী মেয়েদের এইরকম বয়স্ক ধনী ব্যক্তির কাছে বেচে দেওয়া হত।
সেইরকম কিছু থিম নিয়ে ‘রেড সোরঘাম’, ‘জু দো’, ‘রেইজ দ্য রেড ল্যান্টার্ন'। ভিন্ন পটভূমিকায়।
একটু অন্যরকম আর্ট ফিল্মের ছোঁয়া রয়েছে ‘ফেয়ারওয়েল
মাই কনকুবাইন’ ছবিতে। আবার তিরিশের দশকের সাংহাইতে কীরকম সামাজিক অন্যায় চলত, যে কারণে
এক অসহায় মা-কে যৌনকর্মীতে পরি্ণত হতে হয়, তার দলিল ‘দ্য গডে’। তিরিশের দশকের এক কমুনিস্ট
সৈনিকের অভিজ্ঞতা নিয়ে বানানো হয়েছে ‘ইয়েলো
আর্থ’। চল্লিশের দশকের চিন-জাপান যুদ্ধের পর এক পরিবারের ধ্বংস নিয়ে তৈরি ছবি ‘স্প্রিং ইন এ স্মল টাউন’। চল্লিশের
দশকের তাইওয়ানে চিনের অনুপ্রবেশকারীদের কীভাবে
কুপিয়ে মারা হয়েছিল, সেই নিয়ে ‘এ সিটি অব স্যাডনেস’। পঞ্চাশের দশকের মাও-সে-তুং এর
সময়ের চালচিত্র ফুটে উঠেছে ‘দ্য ব্লু কাইট’-এ।
ষাটের দশকের নেপথ্যে এক রোমান্টিক ড্রামা ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’। ১৯৭৬-এর তাংশান ভূমিকম্প
নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘আফটারশক’। একমাত্র ‘24 সিটি’ এইসময়ের চিনের কথা তুলে ধরেছে।
সুতরাং দেখতেই পাচ্ছেন, চিনের বেশিরভাগ
ছবি ইতিহাসে মোড়া। এবং খুব বেশি ইতিহাস আমরা ঘাঁটব না (এটা আমি এই সিরিজের প্রথম থেকেই
বলে আসছি)। বরং বেছে নেব একটু অন্যরকম সিনেমা। ফলে আমরা আজ আলোচনার জন্য নিয়ে নেব
- ইয়েলো আর্থ (১৯৮৪), ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন (১৯৯৩), চাংকিং এক্সপ্রেস (১৯৯৪), ইন
দ্য মুড ফর লাভ (২০০০) এবং 24 সিটি (২০০৮)। তাহলে সাবেক চিন থেকে আধুনিক চিন, পুরোটাই
আমরা খানিক দেখে নিতে পারব।
সময়টা ১৯৩৯এর বসন্তের শুরু। চিনা সেনাবাহিনীর
এক সৈনিক গু উত্তর দিকের এক গ্রামে আসে যেখানকার মাটি হলুদ। উদ্দেশ্য, সেই গ্রামের
লোকেদের থেকে লোকসঙ্গীত রেকর্ড করে নিয়ে গিয়ে কমুনিস্ট সেনাদের জন্য সেইসব গানে নিজেদের
ইচ্ছেমত কমুনিস্ট কথা চাপিয়ে বাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করা। এই নিয়েই পরিচালক চেন কাইগে-র
প্রথম ছবি ‘ইয়েলো আর্থ’। প্রায় দেড় ঘন্টার ছবি।
গু এসে সেই গ্রামে এক গরীব চাষির বাড়িতে
ওঠে। চাষির বউ মারা গেছে, সঙ্গে রয়েছে শুধু ১৪ বছরের এক মেয়ে আর ১০ বছরের এক ছেলে।
গু সকালে নিজের কাজ করে চলে আর রাত্রে সেই পরিবারের সঙ্গে গল্পচ্ছলে দক্ষিণের কমুনিস্ট রাজ্যে মেয়েরা কত স্বাধীন সেই গল্প শোনায়।
গল্প শুনে ১৪ বছরের মেয়ের মনেও স্বপ্ন জাগে, তার মনে হয় তার জীবনও এইরকম হওয়া উচিৎ।
কিন্তু রক্ষণশীল বাবা এইসব গল্প অপছন্দ করে। কারণ কয়েক মাসের মধ্যেই সে তার মেয়ের বিয়ে দিতে চায় এক বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে,
নিজের ধারদেনা মেটানোর জন্য। গু কাজ শেষ করে চলে যাবার সময় সেই মেয়েটি এসে তাকে সঙ্গে
নিয়ে যাবার অনুরোধ করে, কিন্তু কমুনিস্ট সেনাবাহিনীতে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। তাই গু
তাকে বলে অপেক্ষা করতে, বাহিনীর কমান্ডারকে বলে সে পরেরবার ওকে নিয়ে যাবে। মেয়েটি সরল
বিশ্বাসে বাড়ি ফিরে যায়। পরের বছর গরমে গু আবার সেই গ্রামে ফিরে আসে। কিন্তু তখন চাষির
বাড়ি কেউ নেই। পরিত্যক্ত। গ্রামে ভয়ঙ্কর খরা চলছে, সমস্ত চাষিরা একজোট হয়ে নেচে চলেছে
বৃষ্টির আশায়।
গ্রাম্য গল্প। কিন্তু ক্যামেরায় চোখ
রেখে প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে গল্প বলা আর সংলাপের মধ্যে দিয়ে গল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে
তফাৎ আছে। এই সিনেমা প্রথম শ্রেণীভুক্ত। ভিসুয়াল গল্প। বিশ্বাস, বিশ্বাসভঙ্গ এবং তার
মাঝে বয়ে চলা জীবন, হলুদ মাটি, হলুদ নদী। এই
সিনেমা প্রথমবার দেখে আমার ইয়েট্সের when you are old কবিতার কয়েক লাইন মনে পড়ে গেছিল
– ‘one man loved the pilgrim soul in you/ and loved the sorrows of your
changing face’। ছবির বিশেষত্ব এর লং শট এবং সেটাও স্ট্যাটিক। প্যানোরামিক ক্যামেরা
থাকার জন্য একেক লং শটে প্রকৃতির অনেকটা করে দৃশ্য ফুটে উঠেছে। এবং এর ফলে এটাও দেখানো
সম্ভব হয়েছে যে এই বিশাল প্রকৃতির মাঝে মানুষ শুধু ছোট্ট এক অংশ। এছাড়াও এখানে মধ্যযুগীয়
কিছু রীতিনীতি বা তিরিশের দশকের রাজনৈতিক প্রতিফলন রয়েছে। আর সেই সময়ের চিনের লোকসঙ্গীত
তো মাঝে মাঝেই। এই সিনেমা আক্ষরিক অর্থেই চিনা সংস্কৃতির বাহক।
পরের ছবি আবার চেন কাইগে-র। ‘ফেয়ারওয়েল
মাই কনকুবাইন’। তিরিশ- চল্লিশের টালমাটাল দশকে এক অভিনেতার ব্যক্তিগত জীবন ও অভিনয়
জীবনের আইডেনটিটি ক্রাইসিস নিয়ে তৈরি এই ছবি। বিশাল বড় সিনেমা, প্রায় ১৭০ মিনিটের।
কান ফিল্ম ফেস্টিভালে এই ছবি গোল্ডেন পাম পেয়েছিল। চিনের প্রথম ছবি হিসেবে।
ছোটবেলার দু’বন্ধু, দাইয়েই আর জিয়াওলু,
মঞ্চাভিনেতা ও সমকামী। তাদের নিয়েই ছবি। এই
সিনেমা সেই সময়ের যখন চিনে বিংশ শতকের রিপাবলিকান ধারণা শুরু হচ্ছে। সেখান থেকে সিনেমা
চলতে চলতে ৫০ বছর পেরিয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলন
অব্ধি টানা। যখন রক্ষণশীল ধারণা ছাড়িয়ে চিনে নিজের মত কিছু করার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে।
তার অংশ হিসেবেই সমকামিতা দেখানো হয়েছে। এবং এই দুই আবাল্য বন্ধুর সমকামিতার মাঝে জিয়াওলু-র
সঙ্গিনী হিসেবে গং লি-র অনবদ্য চুপচাপ অভিনয়।
সবকিছু জেনেও, দেখেশুনেও যে নৈঃশব্দে এবং অবশেষে যে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। এই সিনেমায়
চিনের ইতিহাস এবং বিশ্বখ্যাত পেকিং অপেরা-কে (পরবর্তীকালে নাম বদলে বেজিং অপেরা) মূলত
সামনে রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে বয়ে চলেছে দুজন শিল্পীর কাজ, পেকিং অপেরার প্রতি তাদের
আনুগত্য এবং পাশাপাশি তাদের ভেতর সমকামিতা। ছবিটা দেখুন। এর বেশি প্লট বলব না। এই ছবি
রিলিজ হবার কয়েক সপ্তার ভেতরেই ব্যান করে দেওয়া হয়েছিল। প্রায় ন’মাস পর সেই নিষেধ তোলা
হয়েছিল।
এই ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখার আরেক কারণ
এর রংয়ের ব্যবহার। অনবদ্য বলতেই হয়। সেটা কস্টিউম
থেকে শুরু করে শুটিং-এর জায়গা, সব আনুসঙ্গিকে। সিনেমার গল্পে সাহসিকতার ছোঁয়া, সাথে
সাথে ব্যক্তিগত ক্ষোভ, দুঃখ, বিশ্বাস, অবিশ্বাস – অনেকটা সেক্সপিয়ারের নাটকের মত। এবং
ইতিহাসের পটভূমিকায় এই সিনেমাকে ফুল মার্কস দিতেই হবে কারণ একটা ছবিতে ইতিহাসের ৫০ বছর একটানা দেখানো হচ্ছে, তাও নিখুঁত
– এরকম সিনেমা সচরাচর পাওয়া যায় না। এককথায় শক্তিশালী ছবি।
পরের সিনেমা ওয়াং কার-ওয়াইয়ের ‘চাংকিং
এক্সপ্রেস’ এক এক্সপেরিমেন্টাল নন-লিনিয়ার
ন্যারেশন। ৯৮ মিনিটের ছবি। দুটো ভালবাসার গল্প পরপর জুড়ে এই সিনেমা। আরো ভালভাবে বললে
দুই পুলিশ প্রেমিকের ভাঙা হৃদয়ের দু’টুকরো কাহিনী। দুই কাহিনীই হংকং-এর পটভূমিকায়।
প্রথম গল্প পুলিশ নং ২২৩ এর, যার প্রেমিকা
তাকে ছেড়ে চলে গেছে। যার এখন নজর রয়েছে এক ঝাঁকড়া চুল মহিলার দিকে, কিন্তু এই মহিলা
আদপে একজন ড্রাগ চোরাচালানকারী। দ্বিতীয় গল্প পুলিশ নং ৬৬৩-র, যার এয়ার হোস্টেস প্রেমিকার
সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়েছে। একদিন সেই প্রেমিকা এক কফি শপে এসে তার জন্য একটা চিঠি ছেড়ে
যায়, যেখানে সেই পুলিশ অফিসারের ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি রয়েছে। কফি শপের পাগলাটে
ও কৌতুহলী ওয়েট্রেস ফে ওয়াং সেই চাবি নিয়ে চুপিসাড়ে অফিসারের ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। তারপর
তাদের ভাললাগা শুরু হয়। গোটা সিনেমায় যা দেখে দর্শকের মন ভরে যাবে, তা হল ছিপছিপে যুবতী
ফে ওয়াং-এর পাগলাটে অভিনয়।
এই ছবিতে লুকিয়ে আছে গতি, জীবন, জীবন
উপভোগ করার ইচ্ছে, মানুষের সঙ্গে মানুষের সাধারণ সম্পর্ক এবং অদম্য প্রাণশক্তি। আর
চিনের পঞ্চম প্রজন্মের পরিচালক কার-ওয়াই এই
শৈলির ছবি করতেই ভালবাসেন। ফ্রি স্টাইল। প্রশ্ন একটাই, এই ছবির নাম হঠাৎ ‘চাংকিং এক্সপ্রেস’
হল কী করে? আপনারা খুঁজে বের করবেন, নাকি বলে
দেব? বলেই দিই। হংকং-এর ‘চাংকিং ম্যানসন’ বলে এক বাড়িতে পরিচালক কার-ওয়াই বেড়ে উঠেছিলেন।
এবং ‘মিডনাইট এক্সপ্রেস’ মধ্য হংকং-এর পথচলতি
এক রাত্রিকালীন স্ন্যাক্স শপ। এই দুয়ে মিলেই
চাংকিং এক্সপ্রেস।
পরের ছবিও আবার সেই কার-ওয়াইয়ের। ‘ইন
দ্য মুড ফর লাভ’। এটাও ৯৮ মিনিটের ছবি। সম্ভবত
কার-ওয়াইয়ের শ্রেষ্ঠ কাজ। মনে করে দেখুন যে আমি ১১ নং পর্বে যখন আমার বাছাই গোটা পৃথিবীর
প্রথম ২০ ‘টাইমলেস ক্লাসিক’ লিস্ট বানিয়েছিলাম, তখন এই ছবিকে সেই লিস্টে ২২ নম্বর হিসেবে
রেখেছিলাম এবং বলেছিলাম যেদিন চিনের সিনেমা নিয়ে লিখব, একে নিয়ে আলোচনা করব।
এই ছবি এক সাংবাদিক চাউ ও এক কোম্পানি
সেক্রেটারি সু-এর নীরব ভালবাসার ছবি। ষাটের দশকের সাংহাইতে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকার
সময় তারা বুঝতে পারে চাউ-এর স্ত্রী ও সু-এর স্বামী একে অপরের সঙ্গে অ্যাফেয়ারে জড়িয়ে
পড়েছে। এটা বুঝেও তারা বাড়িতে অশান্তি করে না। বরং চাউ ও সু মানসিকভাবে একে অপরের কাছে
চলে আসে। সু চাউকে লেখালেখি নিয়ে সাহায্য করতে শুরু করে। দিনের অনেকটা অংশ একসঙ্গে
কাটায়। দুজনেই দুজনকে মনে মনে ভালবাসে, কিন্তু কেউই সেই ভালবাসা সাহসী হয়ে মুখ ফুটে
বলতে পারে না। সু কাজ শেষ করে মাথা নামিয়ে চলে যায়, চাউ কখনোই তার হাত ধরতে সাহস পায়
না। চাউ সাংহাইতে কাজ শেষ করে একা সিঙ্গাপুর চলে যায়, যাবার সময় সু-কে তার সাথে যেতে
বলে। কিন্তু সু গিয়ে পৌঁছয় অনেক পরে। এক বছর পর, সু চাউ-এর ফ্ল্যাটে গিয়ে তাকে ফোন
করে, কিন্তু ফোন তুলে কথা বলতে সাহস পায় না। চাউ রাত্রে তার ফ্ল্যাটে এসে বুঝতে পারে
সু এসেছিল, আবার চলে গেছে। কয়েক বছর পর, সু আবার সাংহাইতে ছেলেকে নিয়ে তাদের পুরনো
ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতে শুরু করে। তদ্দিনে তাদের সেই বাড়ির মালিক চলে গেছে, নতুন এক মালিক
এসেছে। চাউ একদিন সেই নতুন মালিক-কে সাংহাই এসে জিজ্ঞেস করে, সেই ফ্ল্যাটে কে ভাড়া
থাকে। ফ্ল্যাটের নতুন মালিক জবাব দেয়, এক মহিলা ও তার ছেলে। বুঝতে না পেরে চাউ শহর
ছেড়ে চলে যায়। প্রেম অসমাপ্ত রয়ে যায়।
এই সিনেমা নিয়ে গোটা পৃথিবীর অনেক সমালোচক
বলেছেন যে ‘never before has a film spoken so fluently in the universal language
of loss and desire’। কেন? এত দরাজ প্রশংসা কেন? কারণ এই সিনেমা যে কোন এক পরিচালকের
হাতে হয়ে উঠতে পারত চাপা যৌন ইচ্ছের এক রগরগে গল্প। সেই উপাদান এই সিনেমায় ভরপুর ছিল। কিন্তু কার-ওয়াই এই
ছবি বানালেন জীবনের কিছু মূল চাওয়া-পাওয়ার ওপর ফোকাস করে। যেখানে ভালবাসা, কামনা, বিশ্বাসঘাতকতা,
মানসিক ক্ষতি, স্মৃতি, হারানো সুযোগ, একাকীত্ব এবং সবার ওপরে সময়ের বয়ে যাওয়া – এই
পুরো উপাখ্যান ধরা হয়েছে। এবং এই চলচ্চিত্রের আরেক পাওয়া টনি লাং-এর অভিনয়। কান ফেস্টিভাল
থেকে লাং এই সিনেমার জন্য সেরা অভিনেতার সন্মান
পেয়েছিলেন। সবশেষে, সিনেমাটোগ্রাফি। এখানে ক্যামেরা ধীর, কোথাও কোথাও চরিত্র স্থান
থেকে সরে যাবার পরেও সেখানে স্ট্যাটিক, ফলে জলতরঙ্গের মত সিনগুলো একে একে একে খেলেছে,
তৈরি হয়েছে, দর্শকের অ্যাটেনশন দাবি করেছে। কোথাও অবজেক্টের ওপর ফোকাস, কোথাও ডিপ ফোকাস,
ক্লোজ শট কখনো দেহঘেঁষা। তার ওপর ডায়লগ। দর্শক ভাবার সময় পেয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয়
যেন হিচককের ক্যামেরা দেখছি। এবং নতুন কিছু টেকনিক সমেত ক্যামেরা সাবজেক্ট থেকে সাবজেক্টে,
আলোর উজ্জ্বলতার রকমফেরে, প্রতি সিনে দর্শকের উপস্থিতি দাবি করছে। এজন্যই এই সিনেমা
মাস্টারপিস।
শেষ ছবি জিয়া ঝাংকা-র ‘24 সিটি’। পঞ্চাশের
দশক থেকে শুরু করে বর্তমান সময় অব্ধি এক কারখানা
ঘিরে গল্প। সময় বদলে যায় কিন্তু সাধারণ মানুষের দুর্দশা নিজের জায়গাতেই রয়ে যায়। সেই নিয়ে ১০৭ মিনিটের
‘24 সিটি’।
চিনের চেংডু শহর, যেখানে দশকের পর দশক
এক কারখানা স্থানীয় মানুষের রুজি-রুটির ব্যবস্থা করে এসেছে। সেই কারখানা এবার ভেঙে
লাক্সারি অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হবে। সরকারি সিদ্ধান্ত। সেই কারখানা ঘিরে বহু মানুষের
স্মৃতি নন লিনিয়ার ন্যারেটিভ হয়ে এই সিনেমায় উঠে এসেছে। শেষ হচ্ছে কারখানার দুজন প্রাক্তন
শ্রমিকের ছেলেদের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে।
সাদামাটা সিনেমা, কিন্তু এর ভেতর শোষণের
যে ছবি, তা চিরন্তন। পরিচালকের মুন্সিয়ানা
যে উনি এই ছবি শুধুই ফিকশন হিসেবে তৈরি না করে, আধা ফিকশন আধা তথ্যচিত্র হিসেবে দেখিয়েছেন।
ফলে পুরো উপস্থাপনা আরো জোরালো ও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। এমনকি ইন্টারভিউগুলোর ক্ষেত্রেও
এক এরোপ্লেন ইঞ্জিন ফ্যাক্টরির সামনে পুরোটা করা হয়েছে যা সেই সময় ছিল ভগ্নপ্রায়। এর
সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে তিন প্রজন্মকে। ফলে সিনেমা এক অন্য মাত্রা পেয়েছে, প্রায়
আর্ট ফিল্মের পথে এগিয়ে গেছে।
সবশেষে দেখুন তং শু-শুয়েনের ‘দ্য আর্চ’
(১৯৬৯)। এর সিনেমাটোগ্রাফি করেছিলেন সত্যজিৎ
রায়ের বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র। শুধু সিনেমাটোগ্রাফির জন্যই এই সিনেমা দেখুন।
এক বিধবা মহিলার মনে প্রেম জেগে ওঠা, কিন্তু
নিজের মেয়ের জন্য সেই প্রেমের বহিঃপ্রকাশ না করা, এই নিয়ে সিনেমা। হ্যাঁ, আজকের এই
গোটা আলোচনার শেষে আপনি যদি বলেন, চিনের সিনেমা কোরিয়া বা ফ্রান্সের মত সাবালক ও দুঃসাহসী
তো নয়ই, বরং বাঁধা গতের সংযমে থাকতেই ভালবাসে – তাহলে আমি মাথা পেতে আপনার সেই রায়
মেনে নেব। কেন জানেন? সেটা বলেই শেষ করি। ১৯৯৩ পয়লা জানুয়ারি ‘ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন’
রিলিজ হল। দু’সপ্তার মধ্যেই চিনের পলিটব্যুরো
এই ছবি নিষিদ্ধ করে দিল। কারণ, এর ভেতর হোমোসেক্সুয়ালিটি দেখানো হয়েছে যা নাকি চিনা সংস্কৃতির বিরোধী। এরপরেও
কি আশা করেন কোন পরিচালক সাহস দেখাবে?
(ক্রমশ)