শনিবার, ১৪ মে, ২০২২

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ১০২


একথা হয়তো কারও কারও মনে হতে পারে যে, সময় যত এগোচ্ছে, সময় তত  জটিল ও কুটিল হয়ে উঠছে। বাড়ছে সমাজের জটিলতা ও কুটিলতা এবং একইসঙ্গে মানুষের মনন ও মানসিকতাও প্রভাবিত হচ্ছে তারই পরিণামে। না,  একথা কখনই মেনে নেওয়া যায় না যে, অতীত মানেই তার সবকিছু ভালো, অতীতের দিনগুলিই ভালো ছিল, সমাজ ভালো ছিল এবং মানুষের মনও ভালো ছিল। আসলে সময়ের ভালো মন্দ বলে কিছু হয় না। সময় তার নিজের নিয়মে গড়িয়ে যায়, তার কোনো শুরু নেই, শেষও নেই। কিন্তু সেই সময়ের গর্ভে যা  কিছুর অবস্থান, প্রকৃতি-সভ্যতা-সমাজ-মানুষ, সেই সবকিছুরই যেমন একটা শুরু আছে, তেমনি একটা শেষও আছে। আর তাই স্বাভাবিক কারণেই পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রকৃতি-সভ্যতা-সমাজ-মানুষের ক্ষেত্রে একটা তুলনামূলক বিচার ও বিবেচনার প্রসঙ্গ থাকেই। বরং বলা যেতে পারে যে, তুলনামূলক বিচার ও বিবেচনায় সময়ের নিজস্ব কোনো ভূমিকা থাকে না, যদিও প্রকৃতি-সভ্যতা-সমাজ-মানুষের ভালো থাকা বা মন্দ থাকার পরিপ্রেক্ষিতে সময়কে ভালো বা মন্দের পর্যায়ভুক্ত করা হয়ে থাকে। আর তাই,  সময়কে জটিল ও কুটিল অভিধায় উল্লেখ না করে তার আওতায় নিয়ত বদলে যাওয়া প্রকৃতি-সভ্যতা-সমাজ-মানুষকে অভিযুক্ত করাই যুক্তিযুক্ত। অতীতেও যেমন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়, শিল্পে, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে বিভিন্ন জটিলতা ও কুটিলতা ছিল, আজকের চলমান জীবনযাত্রায় তারই প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে, এবং তা আরও নোংরা ও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। সামগ্রীক পরিবেশ আরও দূষিত হয়ে উঠেছে।   

 

সম্প্রতি একটি সাহিত্য পুরস্কারকে কেন্দ্র করে যে তুমুল কোলাহল চলছে, তার প্রাসঙ্গিকতায় কিছু সাধারণ প্রশ্ন মনে আপনা আপনিই উঠে আসছে, যাঁদের কোনো একটি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কৃত করার জন্য মনোনীত করা হয়, সেই মনোনয়নের কোনো নিরিখ আছে কি? সেই নিরিখের যৌক্তিকতা কতটা, বা আদৌ আছে কি? কেননা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সেই সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের ঘনিষ্ঠ বা অনুগত অথবা সেই সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যাঁদের ক্ষমতাবৃত্তের অন্তর্গত, তাঁদেরই পুরস্কার প্রাপক রূপে বেছে নেওয়া হয়। বিশেষত যে সংস্থাগুলি বা প্রতিষ্ঠানগুলি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারের অধীনস্থ, তাদের ক্ষেত্রে এই পাইয়ে দেওয়ার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। আবার একইসঙ্গে প্রশ্ন জাগে মনে, যাঁরা পুরস্কারের সিলেকশন কমিটিতে অবস্থান করেন, তাঁদের যোগ্যতা কতটা? তাঁদের মধ্যে কি আদৌ নিরপেক্ষতার মানসিকতা আছে? নাকি তাঁরাও সেই কাছের মানুষজনদের বা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মানুষজনদের প্রভাব এড়িয়ে যেতে পারেন না? কেননা, এই পাইয়ে দেবার নীতি থেকে বিচ্যুত হলে তাঁদেরও আর পাওয়ার কিছু থাকবে না। কিন্তু দুঃখ হয়, লজ্জাও হয়, এঁরা  এতটাই বধির হয়ে গেছেন যে, বাইরের কোলাহল তাঁদের কানে এলেও তা গ্রাহ্য করেন না। কেননা চাটুকারিতাবৃত্তি এমনভাবেই তাঁদের মনন ও মানসিকতা  অধিকার করে নিয়েছে যে, জ্ঞানপাপী হয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা ও ক্ষমতাকে ধরে রাখাই শ্রেয় বলে মনে করছেন। আর এভাবেই যেমন একদিকে মনুষ্যসমাজের অধঃপতন ঘটে চলেছে, অন্যদিকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্র আরও আরও দূষিত ও কলুষিত হয়ে উঠছে। বলা বাহুল্য, এটা একটা খুব সামান্য উদাহরণ মাত্র। নাহলে একটু সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়, সমাজ-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সভ্যতার প্রতিটি ক্ষেত্রই কীভাবে জটিল ও কুটিল হয়ে চলেছে এক শ্রেণীর কায়েমীস্বার্থের মানুষজনের দৌলতে।

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ১৯ 




চিনদেশের যে কোন কিছু নিয়েই লিখতে বেশ ভয় লাগে। তা সে অর্থনীতি হোক বা কোভিড ভাইরাস। এমনি বেশ চাপা দেশ, মিলিটারির আধিপত্য, বেশি কিছু বললেই কোর্ট মার্শাল। কিন্তু চিনের প্রাচীন শিল্প ও সংস্কৃতির এক দীর্ঘ ইতিহাস  আছে। তেমনি ইতিহাস রয়েছে চিনের সিনেমার। ১৮৯৫ সালে প্যারিস আর বার্লিনে প্রথম চলচিত্র বানানোর মোটামুটি দশ বছরের ভেতরেই চিনদেশে প্রথম সিনেমা বানানো হয়েছিল। ১৯১৪ সালে যখন ভারতে প্রথম চলচিত্র ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ বানানো হয়, তদ্দিনে চিনে প্রচুর ব্যবসায়িক সফল ছবি বানানো হয়ে  গেছে। সিনেমার ইতিহাসে এই দেশকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। ইরানের পরে আমাদের আজকের গন্তব্য তাই চিন। হ্যাঁ, একটা কথা শুরুতেই বলে রাখা ভাল। চিন থেকে প্রচুর ছবি অস্কারের জন্য পাঠানো হলেও নমিনেটেড হয়েছে খুবই কম সংখ্যক ছবি এবং আজ অব্ধি চিনের কোন ছবি অস্কার পায়নি। কিন্তু তাই বলে চিনের ছবি দুর্বল নয়, বরং মূলত ইতিহাস আশ্রয়ী। এবং সেই কারণেই  চিনের ছায়াছবির সিনেমাটোগ্রাফি কিন্তু বেশ শক্তিশালী। আমরা আজ প্রথমেই চিনের এমন কিছু ছবি বেছে নেব যেগুলো থেকে চিনের বেশ খানিকটা ইতিহাস পাওয়া যাবে। এবং তার পাশাপাশি অন্য বেশ কিছু আর্ট ফিল্মও বেছে নেব।

তো, আমাদের বাছাই ১৫টা চিনা সিনেমা হল - দ্য গডেস (১৯৩৪), স্প্রিং ইন এ স্মল টাউন (১৯৪৮), ইয়েলো আর্থ (১৯৮৪), রেড সোরঘাম (১৯৮৭), এ সিটি অব স্যাডনেস (১৯৮৯), জু দো (১৯৯০), রেইজ দ্য রেড ল্যান্টার্ন (১৯৯১), এ ব্রাইট সামার ডে (১৯৯১), ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন (১৯৯৩), দ্য ব্লু কাইট (১৯৯৩), টু লিভ (১৯৯৪), চাংকিং এক্সপ্রেস (১৯৯৪), ইন দ্য মুড ফর লাভ (২০০০), 24 সিটি (২০০৮) ও আফটারশক্‌ (২০১০)।

আমি জানি, আপনারা যারা চিনের ছবি দেখেন, এই লিস্ট দেখে একটু মুচকি হেসে বলবেন, গং লি-র এত ছবি? তাহলে বলি, চিনের এই নায়িকা আমার প্রিয় একটাই কারণে – ওনার সাবলাইম অভিনয় ক্ষমতা। ঠিক যে কারণে ওনার ছবি দেখলে মীনাকুমারী বা নার্গিসের কথা মনে পড়ে যায়। চড়া টোনে নয়, বরং  অন্তঃসলিলা এবং কম কথায় শুধু মুখের অভিব্যক্তি দিয়ে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেওয়া – এজন্যই গং লি আমার প্রিয় নায়িকাদের লিস্টে। তবে এখানে ওনার যে পাঁচটা ছবি রেখেছি - রেড সোরঘাম (১৯৮৭), জু দো (১৯৯০), রেইজ দ্য রেড ল্যান্টার্ন (১৯৯১), ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন (১৯৯৩) এবং টু লিভ (১৯৯৪) – এর ভেতর মাত্র একটাই আলোচনা করব। 

প্রথমে এই ছবিগুলোর ভেতর কী কী ইতিহাস দেখানো হয়েছে, সেগুলোর একঝলক দেখা যাক।

কুড়ি-তিরিশ-চল্লিশের দশকে চিনে ভারতের মতই ধনিক শ্রেণী, জমিদারি প্রথা  ও একাধিক মিস্ট্রেস রাখার প্রচলন ছিল। যখন কমবয়সী মেয়েদের এইরকম বয়স্ক ধনী ব্যক্তির কাছে বেচে দেওয়া হত। সেইরকম কিছু থিম নিয়ে ‘রেড সোরঘাম’, ‘জু দো’, ‘রেইজ দ্য রেড ল্যান্টার্ন'। ভিন্ন পটভূমিকায়। একটু অন্যরকম আর্ট ফিল্মের ছোঁয়া রয়েছে ‘ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন’ ছবিতে। আবার তিরিশের দশকের সাংহাইতে কীরকম সামাজিক অন্যায় চলত, যে কারণে এক অসহায় মা-কে যৌনকর্মীতে পরি্ণত হতে হয়, তার দলিল ‘দ্য গডে’। তিরিশের দশকের এক কমুনিস্ট সৈনিকের অভিজ্ঞতা নিয়ে বানানো  হয়েছে ‘ইয়েলো আর্থ’। চল্লিশের দশকের চিন-জাপান যুদ্ধের পর এক পরিবারের  ধ্বংস নিয়ে তৈরি ছবি ‘স্প্রিং ইন এ স্মল টাউন’। চল্লিশের দশকের তাইওয়ানে  চিনের অনুপ্রবেশকারীদের কীভাবে কুপিয়ে মারা হয়েছিল, সেই নিয়ে ‘এ সিটি অব স্যাডনেস’। পঞ্চাশের দশকের মাও-সে-তুং এর সময়ের চালচিত্র ফুটে  উঠেছে ‘দ্য ব্লু কাইট’-এ। ষাটের দশকের নেপথ্যে এক রোমান্টিক ড্রামা ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’। ১৯৭৬-এর তাংশান ভূমিকম্প নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘আফটারশক’। একমাত্র ‘24 সিটি’ এইসময়ের চিনের কথা তুলে ধরেছে।

সুতরাং দেখতেই পাচ্ছেন, চিনের বেশিরভাগ ছবি ইতিহাসে মোড়া। এবং খুব বেশি ইতিহাস আমরা ঘাঁটব না (এটা আমি এই সিরিজের প্রথম থেকেই বলে আসছি)। বরং বেছে নেব একটু অন্যরকম সিনেমা। ফলে আমরা আজ আলোচনার জন্য নিয়ে নেব - ইয়েলো আর্থ (১৯৮৪), ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন (১৯৯৩), চাংকিং এক্সপ্রেস (১৯৯৪), ইন দ্য মুড ফর লাভ (২০০০) এবং 24 সিটি (২০০৮)। তাহলে সাবেক চিন থেকে আধুনিক চিন, পুরোটাই আমরা খানিক দেখে নিতে পারব।

সময়টা ১৯৩৯এর বসন্তের শুরু। চিনা সেনাবাহিনীর এক সৈনিক গু উত্তর দিকের এক গ্রামে আসে যেখানকার মাটি হলুদ। উদ্দেশ্য, সেই গ্রামের লোকেদের থেকে লোকসঙ্গীত রেকর্ড করে নিয়ে গিয়ে কমুনিস্ট সেনাদের জন্য সেইসব গানে নিজেদের ইচ্ছেমত কমুনিস্ট কথা চাপিয়ে বাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করা। এই নিয়েই পরিচালক চেন কাইগে-র প্রথম ছবি ‘ইয়েলো আর্থ’। প্রায় দেড় ঘন্টার ছবি।

গু এসে সেই গ্রামে এক গরীব চাষির বাড়িতে ওঠে। চাষির বউ মারা গেছে, সঙ্গে রয়েছে শুধু ১৪ বছরের এক মেয়ে আর ১০ বছরের এক ছেলে। গু সকালে নিজের কাজ করে চলে আর রাত্রে সেই পরিবারের সঙ্গে গল্পচ্ছলে দক্ষিণের  কমুনিস্ট রাজ্যে মেয়েরা কত স্বাধীন সেই গল্প শোনায়। গল্প শুনে ১৪ বছরের মেয়ের মনেও স্বপ্ন জাগে, তার মনে হয় তার জীবনও এইরকম হওয়া উচিৎ। কিন্তু রক্ষণশীল বাবা এইসব গল্প অপছন্দ করে। কারণ কয়েক মাসের মধ্যেই সে  তার মেয়ের বিয়ে দিতে চায় এক বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে, নিজের ধারদেনা মেটানোর জন্য। গু কাজ শেষ করে চলে যাবার সময় সেই মেয়েটি এসে তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার অনুরোধ করে, কিন্তু কমুনিস্ট সেনাবাহিনীতে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। তাই গু তাকে বলে অপেক্ষা করতে, বাহিনীর কমান্ডারকে বলে সে পরেরবার ওকে নিয়ে যাবে। মেয়েটি সরল বিশ্বাসে বাড়ি ফিরে যায়। পরের বছর গরমে গু আবার সেই গ্রামে ফিরে আসে। কিন্তু তখন চাষির বাড়ি কেউ নেই। পরিত্যক্ত। গ্রামে ভয়ঙ্কর খরা চলছে, সমস্ত চাষিরা একজোট হয়ে নেচে চলেছে বৃষ্টির আশায়।

গ্রাম্য গল্প। কিন্তু ক্যামেরায় চোখ রেখে প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে গল্প বলা আর সংলাপের মধ্যে দিয়ে গল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে তফাৎ আছে। এই সিনেমা প্রথম শ্রেণীভুক্ত। ভিসুয়াল গল্প। বিশ্বাস, বিশ্বাসভঙ্গ এবং তার মাঝে বয়ে চলা  জীবন, হলুদ মাটি, হলুদ নদী। এই সিনেমা প্রথমবার দেখে আমার ইয়েট্‌সের when you are old কবিতার কয়েক লাইন মনে পড়ে গেছিল – ‘one man loved the pilgrim soul in you/ and loved the sorrows of your changing face’। ছবির বিশেষত্ব এর লং শট এবং সেটাও স্ট্যাটিক। প্যানোরামিক ক্যামেরা থাকার জন্য একেক লং শটে প্রকৃতির অনেকটা করে দৃশ্য ফুটে উঠেছে। এবং এর ফলে এটাও দেখানো সম্ভব হয়েছে যে এই বিশাল প্রকৃতির মাঝে মানুষ শুধু ছোট্ট এক অংশ। এছাড়াও এখানে মধ্যযুগীয় কিছু রীতিনীতি বা তিরিশের দশকের রাজনৈতিক প্রতিফলন রয়েছে। আর সেই সময়ের চিনের লোকসঙ্গীত তো মাঝে মাঝেই। এই সিনেমা আক্ষরিক অর্থেই চিনা সংস্কৃতির বাহক।

পরের ছবি আবার চেন কাইগে-র। ‘ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন’। তিরিশ- চল্লিশের টালমাটাল দশকে এক অভিনেতার ব্যক্তিগত জীবন ও অভিনয় জীবনের আইডেনটিটি ক্রাইসিস নিয়ে তৈরি এই ছবি। বিশাল বড় সিনেমা, প্রায় ১৭০ মিনিটের। কান ফিল্ম ফেস্টিভালে এই ছবি গোল্ডেন পাম পেয়েছিল। চিনের প্রথম ছবি হিসেবে।

ছোটবেলার দু’বন্ধু, দাইয়েই আর জিয়াওলু, মঞ্চাভিনেতা ও সমকামী। তাদের  নিয়েই ছবি। এই সিনেমা সেই সময়ের যখন চিনে বিংশ শতকের রিপাবলিকান ধারণা শুরু হচ্ছে। সেখান থেকে সিনেমা চলতে চলতে ৫০ বছর পেরিয়ে  সাংস্কৃতিক আন্দোলন অব্ধি টানা। যখন রক্ষণশীল ধারণা ছাড়িয়ে চিনে নিজের মত কিছু করার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। তার অংশ হিসেবেই সমকামিতা দেখানো হয়েছে। এবং এই দুই আবাল্য বন্ধুর সমকামিতার মাঝে জিয়াওলু-র সঙ্গিনী  হিসেবে গং লি-র অনবদ্য চুপচাপ অভিনয়। সবকিছু জেনেও, দেখেশুনেও যে নৈঃশব্দে এবং অবশেষে যে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। এই সিনেমায় চিনের ইতিহাস এবং বিশ্বখ্যাত পেকিং অপেরা-কে (পরবর্তীকালে নাম বদলে বেজিং অপেরা) মূলত সামনে রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে বয়ে চলেছে দুজন শিল্পীর কাজ, পেকিং অপেরার প্রতি তাদের আনুগত্য এবং পাশাপাশি তাদের ভেতর সমকামিতা। ছবিটা দেখুন। এর বেশি প্লট বলব না। এই ছবি রিলিজ হবার কয়েক সপ্তার ভেতরেই ব্যান করে দেওয়া হয়েছিল। প্রায় ন’মাস পর সেই নিষেধ তোলা হয়েছিল।

এই ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখার আরেক কারণ এর রংয়ের ব্যবহার। অনবদ্য  বলতেই হয়। সেটা কস্টিউম থেকে শুরু করে শুটিং-এর জায়গা, সব আনুসঙ্গিকে। সিনেমার গল্পে সাহসিকতার ছোঁয়া, সাথে সাথে ব্যক্তিগত ক্ষোভ, দুঃখ, বিশ্বাস, অবিশ্বাস – অনেকটা সেক্সপিয়ারের নাটকের মত। এবং ইতিহাসের পটভূমিকায় এই সিনেমাকে ফুল মার্কস দিতেই হবে কারণ একটা ছবিতে  ইতিহাসের ৫০ বছর একটানা দেখানো হচ্ছে, তাও নিখুঁত – এরকম সিনেমা সচরাচর পাওয়া যায় না। এককথায় শক্তিশালী ছবি।

পরের সিনেমা ওয়াং কার-ওয়াইয়ের ‘চাংকিং এক্সপ্রেস’ এক এক্সপেরিমেন্টাল  নন-লিনিয়ার ন্যারেশন। ৯৮ মিনিটের ছবি। দুটো ভালবাসার গল্প পরপর জুড়ে এই সিনেমা। আরো ভালভাবে বললে দুই পুলিশ প্রেমিকের ভাঙা হৃদয়ের দু’টুকরো কাহিনী। দুই কাহিনীই হংকং-এর পটভূমিকায়।

প্রথম গল্প পুলিশ নং ২২৩ এর, যার প্রেমিকা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। যার এখন নজর রয়েছে এক ঝাঁকড়া চুল মহিলার দিকে, কিন্তু এই মহিলা আদপে একজন ড্রাগ চোরাচালানকারী। দ্বিতীয় গল্প পুলিশ নং ৬৬৩-র, যার এয়ার হোস্টেস প্রেমিকার সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়েছে। একদিন সেই প্রেমিকা এক কফি শপে এসে তার জন্য একটা চিঠি ছেড়ে যায়, যেখানে সেই পুলিশ অফিসারের ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি রয়েছে। কফি শপের পাগলাটে ও কৌতুহলী ওয়েট্রেস ফে ওয়াং সেই চাবি নিয়ে চুপিসাড়ে অফিসারের ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। তারপর তাদের ভাললাগা শুরু হয়। গোটা সিনেমায় যা দেখে দর্শকের মন ভরে যাবে, তা হল ছিপছিপে যুবতী ফে ওয়াং-এর পাগলাটে অভিনয়।

এই ছবিতে লুকিয়ে আছে গতি, জীবন, জীবন উপভোগ করার ইচ্ছে, মানুষের সঙ্গে মানুষের সাধারণ সম্পর্ক এবং অদম্য প্রাণশক্তি। আর চিনের পঞ্চম  প্রজন্মের পরিচালক কার-ওয়াই এই শৈলির ছবি করতেই ভালবাসেন। ফ্রি স্টাইল। প্রশ্ন একটাই, এই ছবির নাম হঠাৎ ‘চাংকিং এক্সপ্রেস’ হল কী করে?  আপনারা খুঁজে বের করবেন, নাকি বলে দেব? বলেই দিই। হংকং-এর ‘চাংকিং ম্যানসন’ বলে এক বাড়িতে পরিচালক কার-ওয়াই বেড়ে উঠেছিলেন। এবং  ‘মিডনাইট এক্সপ্রেস’ মধ্য হংকং-এর পথচলতি এক রাত্রিকালীন স্ন্যাক্স শপ।  এই দুয়ে মিলেই চাংকিং এক্সপ্রেস।    

পরের ছবিও আবার সেই কার-ওয়াইয়ের। ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’। এটাও ৯৮  মিনিটের ছবি। সম্ভবত কার-ওয়াইয়ের শ্রেষ্ঠ কাজ। মনে করে দেখুন যে আমি ১১ নং পর্বে যখন আমার বাছাই গোটা পৃথিবীর প্রথম ২০ ‘টাইমলেস ক্লাসিক’ লিস্ট বানিয়েছিলাম, তখন এই ছবিকে সেই লিস্টে ২২ নম্বর হিসেবে রেখেছিলাম এবং বলেছিলাম যেদিন চিনের সিনেমা নিয়ে লিখব, একে নিয়ে আলোচনা করব।

এই ছবি এক সাংবাদিক চাউ ও এক কোম্পানি সেক্রেটারি সু-এর নীরব ভালবাসার ছবি। ষাটের দশকের সাংহাইতে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকার সময় তারা বুঝতে পারে চাউ-এর স্ত্রী ও সু-এর স্বামী একে অপরের সঙ্গে অ্যাফেয়ারে জড়িয়ে পড়েছে। এটা বুঝেও তারা বাড়িতে অশান্তি করে না। বরং চাউ ও সু মানসিকভাবে একে অপরের কাছে চলে আসে। সু চাউকে লেখালেখি নিয়ে সাহায্য করতে শুরু করে। দিনের অনেকটা অংশ একসঙ্গে কাটায়। দুজনেই দুজনকে মনে মনে ভালবাসে, কিন্তু কেউই সেই ভালবাসা সাহসী হয়ে মুখ ফুটে বলতে পারে না। সু কাজ শেষ করে মাথা নামিয়ে চলে যায়, চাউ কখনোই তার হাত ধরতে সাহস পায় না। চাউ সাংহাইতে কাজ শেষ করে একা সিঙ্গাপুর চলে যায়, যাবার সময় সু-কে তার সাথে যেতে বলে। কিন্তু সু গিয়ে পৌঁছয় অনেক পরে। এক বছর পর, সু চাউ-এর ফ্ল্যাটে গিয়ে তাকে ফোন করে, কিন্তু ফোন তুলে কথা বলতে সাহস পায় না। চাউ রাত্রে তার ফ্ল্যাটে এসে বুঝতে পারে সু এসেছিল, আবার চলে গেছে। কয়েক বছর পর, সু আবার সাংহাইতে ছেলেকে নিয়ে তাদের পুরনো ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতে শুরু করে। তদ্দিনে তাদের সেই বাড়ির মালিক চলে গেছে, নতুন এক মালিক এসেছে। চাউ একদিন সেই নতুন মালিক-কে সাংহাই এসে জিজ্ঞেস করে, সেই ফ্ল্যাটে কে ভাড়া থাকে। ফ্ল্যাটের নতুন মালিক জবাব দেয়, এক মহিলা ও তার ছেলে। বুঝতে না পেরে চাউ শহর ছেড়ে চলে যায়। প্রেম অসমাপ্ত রয়ে যায়।

এই সিনেমা নিয়ে গোটা পৃথিবীর অনেক সমালোচক বলেছেন যে ‘never before has a film spoken so fluently in the universal language of loss and desire’। কেন? এত দরাজ প্রশংসা কেন? কারণ এই সিনেমা যে কোন এক পরিচালকের হাতে হয়ে উঠতে পারত চাপা যৌন ইচ্ছের এক রগরগে গল্প। সেই  উপাদান এই সিনেমায় ভরপুর ছিল। কিন্তু কার-ওয়াই এই ছবি বানালেন জীবনের কিছু মূল চাওয়া-পাওয়ার ওপর ফোকাস করে। যেখানে ভালবাসা, কামনা, বিশ্বাসঘাতকতা, মানসিক ক্ষতি, স্মৃতি, হারানো সুযোগ, একাকীত্ব এবং সবার ওপরে সময়ের বয়ে যাওয়া – এই পুরো উপাখ্যান ধরা হয়েছে। এবং এই চলচ্চিত্রের আরেক পাওয়া টনি লাং-এর অভিনয়। কান ফেস্টিভাল থেকে লাং  এই সিনেমার জন্য সেরা অভিনেতার সন্মান পেয়েছিলেন। সবশেষে, সিনেমাটোগ্রাফি। এখানে ক্যামেরা ধীর, কোথাও কোথাও চরিত্র স্থান থেকে সরে যাবার পরেও সেখানে স্ট্যাটিক, ফলে জলতরঙ্গের মত সিনগুলো একে একে একে খেলেছে, তৈরি হয়েছে, দর্শকের অ্যাটেনশন দাবি করেছে। কোথাও অবজেক্টের ওপর ফোকাস, কোথাও ডিপ ফোকাস, ক্লোজ শট কখনো দেহঘেঁষা। তার ওপর ডায়লগ। দর্শক ভাবার সময় পেয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় যেন হিচককের ক্যামেরা দেখছি। এবং নতুন কিছু টেকনিক সমেত ক্যামেরা সাবজেক্ট থেকে সাবজেক্টে, আলোর উজ্জ্বলতার রকমফেরে, প্রতি সিনে দর্শকের উপস্থিতি দাবি করছে। এজন্যই এই সিনেমা মাস্টারপিস।  

শেষ ছবি জিয়া ঝাংকা-র ‘24 সিটি’। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে বর্তমান  সময় অব্ধি এক কারখানা ঘিরে গল্প। সময় বদলে যায় কিন্তু সাধারণ মানুষের  দুর্দশা নিজের জায়গাতেই রয়ে যায়। সেই নিয়ে ১০৭ মিনিটের ‘24 সিটি’।

চিনের চেংডু শহর, যেখানে দশকের পর দশক এক কারখানা স্থানীয় মানুষের রুজি-রুটির ব্যবস্থা করে এসেছে। সেই কারখানা এবার ভেঙে লাক্সারি অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হবে। সরকারি সিদ্ধান্ত। সেই কারখানা ঘিরে বহু মানুষের স্মৃতি নন লিনিয়ার ন্যারেটিভ হয়ে এই সিনেমায় উঠে এসেছে। শেষ হচ্ছে কারখানার দুজন প্রাক্তন শ্রমিকের ছেলেদের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে।

সাদামাটা সিনেমা, কিন্তু এর ভেতর শোষণের যে ছবি, তা চিরন্তন। পরিচালকের  মুন্সিয়ানা যে উনি এই ছবি শুধুই ফিকশন হিসেবে তৈরি না করে, আধা ফিকশন আধা তথ্যচিত্র হিসেবে দেখিয়েছেন। ফলে পুরো উপস্থাপনা আরো জোরালো ও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। এমনকি ইন্টারভিউগুলোর ক্ষেত্রেও এক এরোপ্লেন ইঞ্জিন ফ্যাক্টরির সামনে পুরোটা করা হয়েছে যা সেই সময় ছিল ভগ্নপ্রায়। এর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে তিন প্রজন্মকে। ফলে সিনেমা এক অন্য মাত্রা পেয়েছে, প্রায় আর্ট ফিল্মের পথে এগিয়ে গেছে।  

সবশেষে দেখুন তং শু-শুয়েনের ‘দ্য আর্চ’ (১৯৬৯)। এর সিনেমাটোগ্রাফি  করেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র। শুধু সিনেমাটোগ্রাফির জন্যই এই সিনেমা দেখুন। এক বিধবা মহিলার মনে প্রেম  জেগে ওঠা, কিন্তু নিজের মেয়ের জন্য সেই প্রেমের বহিঃপ্রকাশ না করা, এই নিয়ে সিনেমা। হ্যাঁ, আজকের এই গোটা আলোচনার শেষে আপনি যদি বলেন, চিনের সিনেমা কোরিয়া বা ফ্রান্সের মত সাবালক ও দুঃসাহসী তো নয়ই, বরং বাঁধা গতের সংযমে থাকতেই ভালবাসে – তাহলে আমি মাথা পেতে আপনার সেই রায় মেনে নেব। কেন জানেন? সেটা বলেই শেষ করি। ১৯৯৩ পয়লা জানুয়ারি ‘ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন’ রিলিজ হল। দু’সপ্তার মধ্যেই চিনের  পলিটব্যুরো এই ছবি নিষিদ্ধ করে দিল। কারণ, এর ভেতর হোমোসেক্সুয়ালিটি  দেখানো হয়েছে যা নাকি চিনা সংস্কৃতির বিরোধী। এরপরেও কি আশা করেন কোন পরিচালক সাহস দেখাবে? 

(ক্রমশ) 

 


শিবাংশু দে

 

তকাই, তাতাবাবু ও ‘অনর্থে’র ভুবন - ১  



  

কতটা লেখা লিখলে তবে, লেখক বলা যায়

কতটা কথা বললে তবে, কথক হবে মানা...?

(১)

অনেক লিখে 'কালজয়ী' লেখক হবার প্রয়াস অবিরাম দেখা যায়। কখনও পেশা, কখনও নেশা, কখনও শুদ্ধ ভালোবাসা। লেখালিখি করার নানা কারণ থাকে। একজন অকালপ্রয়াত কবি, যাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিলো তাঁর মৃত্যুর পরে। হয়তো আরো কিছু লেখা আছে তাঁর। সেগুলোও পরবর্তীকালে কিংবদন্তি। কিন্তু যদি প্রথম কাব্যসংকলনটি ব্যতিরেকে তিনি আর অন্য কিছুই না লিখতেন, তবু এই বিপুল বাংলা সাহিত্যের পরিসরে একটা গুরুত্বপূর্ণ বড়ো জমিদারি তাঁর অধিকারে থাকতে পারতো। তিনি সেকালে তাঁর শৈলীর সঙ্গে অপরিচিত, অনভ্যস্ত বাংলা পাঠকদের  উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,

 "...বলবো যা মোর চিত্তে লাগে,

নাই বুঝি তার অর্থ হোক

নাই বা বুঝুক বেবাক লোক..."

(২)

'অর্থ' শব্দটার নানা অর্থ হয়। এমন কি 'অনর্থ' শব্দটিরও নানা পরিভাষা, বহু ব্যঞ্জনা। কোথাও লেখে এই শব্দের মানে, অমঙ্গল, অশুভ, অনিষ্ট, ভুল অর্থ, কুকাজ, দুর্ঘটনা। অন্যত্র কোথাও যোগ হয়, নিষ্প্রয়োজন, অনাবশ্যক, ব্যর্থ, অর্থহীন, যার 'অভিধ্যেয়' নেই। এইখানটিতে একটু মন দেওয়া যাক। 'অভিধ্যেয়' মানে চিন্তার বিষয়, যা ধ্যানের বিন্দু হতে পারে। অতএব 'অনর্থ' শব্দের একটা ব্যঞ্জনা পাচ্ছি, যেখানে 'চিন্তা'র পরিসর নেই। 'চিন্তা' মানে  অনুভব ও মননের একটা ক্রমপর্যায় শৃঙ্খল। যেখানে এক জায়গা থেকে শুরু করে অন্য এক জায়গায় মানসিক অবস্থানটিকে তুলে নেওয়া যায়। অর্থাৎ শাস্ত্র মতে মানুষের সরলরৈখিক, স্বীকৃত, নিয়মবদ্ধ, ব্যাকরণভিত্তিক যে আর্ষ মননপদ্ধতি, তার বাইরে বেরোতে গেলেই 'অনর্থে'র ঝুঁকি এসে যায়।

বাংলাকবিতার জন্মলগ্ন থেকে, অর্থাৎ চর্যাপদে'র সময় থেকেই কবিদের 'অনর্থ' নামক ট্যাবু চিহ্নের দায় বহন করতে হয়। শুধু বাংলা কেন? সারা পৃথিবীতেই কবিদের সামনেই এই চ্যালেঞ্জটি প্রবল। কতটা 'বুঝিয়ে' বলবো? কতটা মৌন ইশারার রাজত্ব? 'সাহিত্য' কি বেবাক লোকের মৌরসিপট্টা? বেবাক লোক যা বুঝতে পারে তা কি সত্যি শিল্প হয়ে ওঠে? বেবাক লোককে 'বোঝানো'র দায় শিল্পীর কতটা থাকে? অর্থাৎ সৃষ্টি করার সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য 'মানে বই' লিখে রাখাটি কি শিল্পীর দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে?

এই চির-জাগরূক পুরাতন প্রশ্নগুলির প্রাসঙ্গিকতা কখনও ফুরায় না। তাই একজন শিল্পী যখন তাঁর কবিতায় এক শতক আগে এই প্রশ্নটি করেছিলেন, সাধারণ বাঙালি পাঠকের পক্ষে তা ছিলো একটু বেশি অগ্রসর, স্মার্ট একটি প্রশ্ন। এ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা তাঁদের ছিলো না। কিন্তু যখন এই কবি একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ লিখে বাংলা কবিতার সমাকীর্ণ জগতে চিরস্থায়ী স্থান করে নেন তখন ঘটনাটি খুব মামুলি থাকে না। পরবর্তীকালে সেই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার প্রতিটি পংক্তি বাংলাভাষায় ইডিয়ম হয়ে স্বীকৃত হয়ে  যায় তখন তারও কোনও দ্বিতীয় নজির  আমরা ইতিহাসে খুঁজে পাই না। অতএব এটা ভাবা যেতে পারে,  যে লেখা দিনের শেষে 'কবিতা' হয়ে ওঠে তার কোনও মানেবই প্রয়োজন হয় না। পাঠকই এগিয়ে এসে নিজেকে তৈরি করে নেয়।

হ্যাঁ, সেই কবিতা সংকলনটির নাম 'আবোলতাবোল' আর কবির নাম না হয় নাই বললাম।

(৩)

সাহিত্য পাঠকের কি কোনও 'বয়স' থাকে? যেমন শিশু পাঠক, কিশোর পাঠক বা প্রাপ্তবয়স্ক পাঠক। এই ধরনের মাত্রাভেদকে মাথায় রেখে কি কোনো শাশ্বত সাহিত্য সৃষ্টি করা যায়? বোধ হয় এর উত্তর হবে 'না' । যেকোনো 'প্রাপ্তবয়স্ক' পাঠক তথাকথিত কিশোর সাহিত্য থেকে যথেষ্ট মনের খোরাক পেয়ে যান। সাহিত্য পাঠকের শুধু 'মন' থাকে। অর্থাৎ সাহিত্য উপভোগ করতে হলে 'প্রাপ্তবয়স্ক' নয়, ‘প্রাপ্তমনস্ক' হওয়া দরকার।  বুদ্ধদেব বসু একবার বলেছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বড়োদের জন্য লিখলেও পড়ে আনন্দ পায় ছোটোরা। আবার সুকুমার ছোটোদের জন্য লিখলেও তা আনন্দ দেয় বড়োদের। এই 'বড়ো' বলতে যেসব লোকজন তাঁরা মনস্কতার সূত্রে বড়ো, বয়সের গুণিতকে হয়তো 'প্রাপ্তবয়স্ক' নাও হতে পারেন। অর্থাৎ মননশীলতার পরিণতির বিচারে  সুকুমার ছিলেন বেশি পরিণত। তাঁর গুরু রবীন্দ্রনাথের মতো তাঁরও বিশ্বাস ছিলো, তিনি শিশু-বুড়ো সবারই সমবয়সি। আবোল-তাবোলের অনুরাগী পাঠকের বয়স আট থেকে অষ্টআশি সবই হয়। তাই শরীরের মৃত্যুর প্রায় একশো বছর পরেও সুকুমার একজন প্রাসঙ্গিক 'আধুনিক' কবি, উষ্ণ, জীবন্ত ও অসম্ভব জনপ্রিয়।    

শুধু 'আবোলতাবোল' নয়। আর একটি লেখার কথা স্মরণ করি, সেটি কিন্তু গদ্য।  নাতিদীর্ঘ এই গদ্যটি ব্যতিরেকে যদি এই কবি আর কিছুই না লিখতেন, এমন কি 'আবোলতাবোল'ও যদি না থাকতো, তবু বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের শীর্ষে কোথাও তাঁর স্বীকৃতি অমলিন থাকতে পারতো। সেই লেখাটি 'হযবরল'। তাতাবাবু এই লেখাটির একটি চরিত্র, হিজিবিজবিজ ওরফে তকাইয়ের মাধ্যমে তাঁর 'অনর্থ'যানকে রূপ দিতে চেয়েছেন। যার কাজ শুধু জগতের যাবতীয় 'অসঙ্গতি' দেখে হেসে যাওয়া। অথচ জাগতিক অসঙ্গতির সব অর্থকেই সেখানে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হচ্ছে। আপাতভাবে এই লেখা বালক-কিশোরদের জন্য। কিন্তু 'প্রাপ্তমনস্ক'রা যখন থেকে এই সব লেখার রস পেতে শুরু করেছেন, বাংলাসাহিত্যের রসগ্রাহিতার মানদণ্ডগুলো নতুনভাবে ব্যাখ্যাত হতে শুরু হয়েছে ।

(৪)

জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের অনুগামী। উনিশ শতকের শেষদিকে বেড়ে ওঠা ব্রাহ্ম আদর্শে 'নৈতিকতা'র বাড়াবাড়ি নিয়ে ঐ সমাজের অনেক মননশীল ব্যক্তি আশংকিত ছিলেন। সংখ্যাগুরু সনাতনধর্মীয় জনগণের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে 'পবিত্রতর' বিকল্প মূল্যবোধ স্থাপন করতে চাওয়া ব্রাহ্মপণ্ডিতেরা প্রায়শঃ অতিবাদী অবস্থান নিতেন। ফলশ্রুতি, ক্রমাগত দ্বন্দ্ব, স্ববিরোধ ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনাক্রম এই সংখ্যালঘু, কিন্তু প্রভাবশালী জনগোষ্ঠীটিকে মূলস্রোত থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছিলো। নিজের মুদ্রাদোষে আলাদা হয়ে যাওয়ার  দুর্ভাগ্য গ্রাস করে নিচ্ছিলো ব্রাহ্মসমাজকে। ততোদিনে তিনটি ভাগ হয়ে গেছে।  আদি, সাধারণ ও নববিধান। বাংলার চিরাচরিত 'তৈলাধার পাত্র'পন্থী পাণ্ডিত্যগর্বী প্রবীণদের আধিপত্য থেকে ব্রাহ্মসমাজ'কে মুক্ত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ  বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন। লেখালিখি ও অন্যান্য কার্যকলাপের সূত্রে এই  অবস্থানটিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি অবিশ্রাম কাজ করে যেতেন। তাঁর এই প্রয়াসে তৎকালীন ব্রাহ্ম যুবসমাজের যে অংশ সক্রিয়ভাবে তাঁর সঙ্গে থাকতেন, সুকুমার ছিলেন তাঁদের অগ্রগণ্য। ব্রাহ্মসমাজের পণ্ডিতমন্যতার বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ ও প্রায় বিদ্রোহ কবি'কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে।

আদি ও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য সুকুমার ও অমল হোমের মতো তরুণ ব্রাহ্মরা ১৯১১ সালের ২৬শে জানুয়ারি (মাঘোৎসবের পরদিন) সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উপাসনায় কবি'কে বেদীগ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানান। তৎকালীন পরিস্থিতিতে এটা যথেষ্ট দুঃসাহসিক বলা যেতে পারে। কারণ  প্রবীণ, প্রাচীনপন্থী ব্রাহ্মরা কবি'র 'ধর্মপ্রচার' প্রবন্ধ বা 'নৌকাডুবি' এবং 'গোরা' উপন্যাসে ব্রাহ্মসমাজের সংকীর্ণতার যে ছবি আঁকা হয়েছিলো, তা নিয়ে বিশেষ ক্ষুব্ধ ও বিরূপ ছিলেন। এই সভায় কবি তাঁর 'ব্রাহ্মসমাজের সার্থকতা' শীর্ষক প্রবন্ধটি পাঠ করেন। সেই সভায় সমবেত ব্রাহ্মদের মধ্যে এই অনুষ্ঠানটির সার্থকতা বিশেষভাবে অনুভূত হয়। সুকুমার নিজেও তাঁর ‘গুরু’র পথে 'চলচ্চিত্তচঞ্চরী' নাটকে ব্রাহ্মসমাজের 'নৈতিক' অচলায়তনকে প্রত্যক্ষভাবে আঘাত করেন, যা বহু ব্রাহ্ম প্রাচীনপন্থীর উষ্মার কারণ হয়েছিলো।

উপেন্দ্রকিশোর কবি'র রাজর্ষি উপন্যাসের দুটি চরিত্র, তাতা ও হাসি'র নামে তাঁর পুত্র সুকুমার ও কন্যা সুখলতার নামকরণ করেন। সুকুমার পরিজন মহলে 'তাতা' নামেই পরিচিত ছিলেন। ১৯১৩ সালের জুনমাসে কবি যখন লন্ডনে রোটেনস্টাইন সাহেবের বাড়িতে কবিতা শোনাতে গিয়েছিলেন, তখন সুকুমার লন্ডনেই থাকতেন। পিয়ারসন সাহেবের হ্যাম্পস্টেড হিথের বাড়িতে যখন কবি'কে নিয়ে একটি সভা আয়োজন করা হয়, তখন সুকুমার একটি প্রবন্ধপাঠ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর বোন পুণ্যলতা চক্রবর্তীকে ২১শে জুন একটি চিঠি লেখেন, "...পরশুদিন Mr. Pearson -তাঁর বাড়িতে আমার Bengali literature সম্বন্ধে একটা paper পড়ার নেমতন্ন। ...সেখানে গিয়ে (দেখি) Mr. & Mrs. Rothenstein, Dr.P.C.Ray, Mr. Sarbadhicary প্রভৃতি অনেক (পরিচিত) তা ছাড়া অনেক অচেনা সাহেব মেম সব উপস্থিত। শুধু তাই নয়, ঘরে ঢুকে দেখি রবিবাবু বসে রয়েছেন। বুঝতেই পারছিস আমার কি অবস্থা। যা হোক চোখকান বুজে পড়ে দিলাম। লেখাটার জন্য খুব পরিশ্রম করতে হয়েছে। India Office Library থেকে বইটই এনে material জোগাড় করতে হয়েছিল। তাছাড়া রবিবাবুর কয়েকটি poetry translate করেছিলাম। সেগুলো সকলেরই খুব ভালো লেগেছিলো।... রবিবাবু আমাকে দেখেই বললেন, "এখানে এসে তোমার চেহারা improve করেছে।" এছাড়া ২১শে জুলাই ১৯১৩'তে সুকুমার লন্ডনের ইস্ট-ওয়েস্ট সোসাইটিতে Spirit of Rabindranath Tagore শীর্ষক প্রবন্ধটিও পাঠ করেন। এই আলোচনাটিই বিদেশে  রবীন্দ্রনাথের রচনা সম্বন্ধে প্রথম সামগ্রিক মূল্যায়ন। সুকুমার এ বিষয়ে পথিকৃৎ। এই সব ঘটনাক্রম প্রমাণ করে তিনি বস্তুত  একজন সিরিয়স, মননশীল যুবক। সেকালের নামী পরিবারের ব্রাহ্ম যুবকরা যেমন হতেন। তাঁরা জাগতিক, মহাজাগতিক সব কিছুর অর্থ সন্ধান করতে সতত নিয়োজিত থাকতেন। তৎকালীন বাংলা ইন্টেলেনজেন্সিয়ার ('বুদ্ধিজীবী' শব্দটি গালাগালির পর্যায়ে চলে যেতে আর ব্যবহার করি না) যাঁরা অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন, সুকুমার তাঁদের অগ্রগণ্য। কিন্তু শিল্পী হিসেবে তিনি ছিলেন 'সৃষ্টিছাড়া'। এই সব কাজের মধ্যে থেকেই তাঁর ভিতরে জন্ম নিচ্ছিলো আবোলতাবোল বা হযবরলের বীজ। 'অনর্থ'শিল্পের অঙ্কুর। ১৯১৮-১৯ সাল নাগাদ তাঁর স্মৃতি খুড়তুতো বোন লীলা মজুমদারের স্মৃতিকথায় পরবর্তীকালে এই ভাবে এসেছিলো-  

'...বড়দা যেখানেই যেত একটা আনন্দের তুফান সঙ্গে সঙ্গে যেত। বড়দা যেখানে থাকতো, অন্য কারো দিকে লোকের চোখ পড়তো না। তাই বলে বড়দার কিছু কার্তিকের মতো চেহারা ছিলো না। তবে চেহারার মধ্যে কী একটা যেন ছিলো যার সঙ্গে মুখায়ববের কোনো সম্পর্ক ছিলো না, কিন্তু যা তার সর্বাঙ্গ থেকে আলোর মতো ঝরে পড়তো। এখন বুঝি সেটি তার ব্যক্তিত্ব।

লম্বা দোহারা মানুষটি, একমাথা কালো কোঁকড়া চুল, চোখ দুটি প্রায় সব সময় হাসতো, কিন্তু গম্ভীর হলে এমনি গম্ভীর হতো যে কাছে ঘেঁষতে ভয় পেতাম। বড়দা ছিলো যেমন আমুদে, তেমনি রাশভারি, অন্যায় সে কখনো সইতো না। যতদূর মনে পড়ছে, বড়দার গালে একটা বড়ো তিল ছিলো, আমাদের সেটিকে ভারি পছন্দ ছিলো।'

তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে লঘুরস ও গুরুপ্রত্যয়ের মেরু কখনও অচল অবস্থানে থাকতো না। তিনি স্বতস্ফূর্তভাবে স্বভাবের এই দুই প্রান্তে আসা-যাওয়া করতেন।  ব্যক্তিজীবন বা সৃষ্টিজীবনে, সমান মসৃণতায়। লীলা মজুমদারের মতো অনেকেই যেমন বলেছেন, সুকুমার যেখানে যেতেন একটা প্রসন্নতার আবহ তৈরি হয়ে যেত। জীবনের সর্বক্ষেত্রে রসবোধ প্রয়োগের যে কৌশল তাঁর আয়ত্ব ছিলো, তা বিরল। একটা গল্প আমরা শুনেছি যখন কবির সাতান্নতম জন্মদিন  শান্তিনিকেতনে আয়োজন করা হয়েছিলো। কালিদাস নাগের বর্ণনায় পাই এই উপলক্ষ্যে সস্ত্রীক রথীন্দ্রনাথ, সস্ত্রীক সুকুমার, সপরিবার রামানন্দ, কালিদাস নাগ, সবাই হৈ হৈ করে রেলগাড়িতে শান্তিনিকেতন যাত্রা করলেন। "...বিকেলে পৌঁছে দেখি, কবি দিনুবাবুর ঘরে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন - সকলকে খুব খাওয়ালেন, তারপর সন্ধ্যায় আশ্রমের ছেলেরা এক বাঙ্গাল সভা করলে - নানা প্রদেশের চলতি ভাষায় ঠাট্টা, বিদ্রূপ, গান চললো - চমৎকার হলো - সুকুমার মৈমনসিংহের বাঙ্গাল-সভাপতি হলেন।" (কালিদাস নাগ)। এই 'বাঙাল-সভা' অনুষ্ঠানটির আরেকটি বিশদ বর্ণনা আমরা সীতাদেবীর রচনাতেও পাই।

"...খোলা মাঠেই সভা হইতেছিল। মেয়েরা ও মান্যগণ্য অতিথিবর্গ তক্তপোষে বসিলেন, ছেলেরা মাটিতে শতরঞ্চি বিছাইয়া। সর্বসম্মতিক্রমে সুকুমারবাবু সভাপতি নির্বাচিত হইলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাব করিলেন যে সুকুমারবাবুর পত্নী শ্রীমতী সুপ্রভাকেই সভানেত্রী করা হোক, কারণ আজন্ম কলিকাতায় বাস বলিয়া সুকুমারবাবুর বাঙালত্ব খানিকটা লোপ পাইয়াছে। কিন্তু সুপ্রভা রাজী না হওয়াতে সুকুমারবাবুই সভাপতির পদে বাহাল রহিলেন।... সভার কার্য যথাসম্ভব বাঙালভাষাতেই হইতেছিল। ...অতঃপর সভাপতি তাঁহার অভিভাষণ দিলেন অতি কষ্টে। বেশ পুরাপুরি বাঙাল ভাষা হইলো না।" এর পরের দিন চব্বিশে বৈশাখ, "সভাস্থ সকলের অনুরোধে সুকুমারবাবু তাঁহার 'শব্দকল্পদ্রুম' কৌতুকনাট্যটি পাঠ করিলেন। ইহার গানগুলিও হইলো বটে, তবে তাঁহার দলের লোকেরা এখানে কিঞ্চিৎ সলজ্জভাবে গান গাহিলেন।" এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় সুশোভন সরকারের স্মৃতিচারণ। 'লক্ষ্মণের শক্তিশেল' নাটকে তাতাবাবু'র হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে "রাবণ রাজায় মারো, রাবণরাজায় মারো" স্ফূর্তির রসে উজ্জ্বল গান তাঁর মনে থেকে গিয়েছিলো আজীবন।

(ক্রমশ)

 

 

 

 


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

আমার ইংরেজী বই পড়া




(২)

১৯৭০ সালে, স্কুলের পরীক্ষায় আমার মধ্যমেধাজনিত ফলাফল দেখে, বাবা-মা-দাদা মিলে আমায় অন্য এক স্কুলে ভর্তি করলেন। আগের বিদ্যালয়ের মতো এটিও ইংরেজী-মাধ্যম ছিল বটে, কিন্তু সেখানে প্রথম ভাষা ছিল বাংলা। এবার সে স্থান নিল ইংরেজী, আর এতদিনের দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজীর জায়গায় গেল বাংলা। আর এবার শ্রেণীশিক্ষক, সহপাঠী, বাড়ির লোকজন, সবাই একবাক্যে নিদান দিলেন যে ইংরেজী শিশু-সাহিত্যের অঙ্গন ছেড়ে বেরোতে হবেই, ইংরেজী শব্দভাণ্ডার ও লেখন-ক্ষমতা বাড়াবার জন্য। শ্রেণীশিক্ষকের প্রিয় ‘অ্যাডভেঞ্চার’ কাহিনীর লেখক ছিলেন Alistair MacLean, যাঁর উপন্যাসগুলির ওপর আধারিত একাধিক ছায়াছবি সাধারণ বাঙালী দর্শকের কাছেও সমাদর পেয়েছিলঃ যেমন The Guns of Navarone বা Where Eagles Dareহুকুম অনুযায়ী পারিবারিকসূত্রে বন্ধু, পরে আত্মীয়, অবশেষে সহকর্মী অগ্রজ আনন্দ লালের কাছ থেকে ধার করে পড়লাম লেখকের Night without Endএকেবারেই ভাল লাগল না! দাদা এবার বললেন, “বেশ, এবার আগাথা ক্রিস্টির একখানা রহস্যোপন্যাস দিচ্ছি। এটা শেষ করার আগে যদি অপরাধী কে ধরতে পারিস, তাহ’লে তোকে একটা এনিড ব্লাইটনের Famous Five কিনে দেব।” ক্রিস্টির উপন্যাসটি ছিল The Secret Adversary, এবং আমি শেষের আগেই ঠিক ধরেছিলাম মেঘের আড়ালে মেঘনাদ কে। দাদা কিন্তু পকেট বাঁচাতে কপট পাশা খেললেন, “না, না ভুল ধরেছিস। আর কাউকে ভাব!” ভেবড়ে গিয়ে আরেকটা নাম করলাম, এবং বাজী হারলাম! পরে ক্রিস্টির একনিষ্ঠ ভক্ত হয়েছি ঠিকই, কিন্তু ওই সময়ে তা হয়নি।

এবার একটু নেপথ্যকথন প্রয়োজন। আমাদের পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন আমার মা’র এক খুড়তুতো দিদি। সম্পর্কে মাসীমা হ’লেও তাঁকে ছোটবেলা থেকে মা জ্ঞানেই দেখে এসেছি। অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবারে মানুষ হওয়ার জন্য স্কুলশিক্ষা খুব অল্পদিনই তাঁর ভাগ্যে জুটেছিল। কিন্তু তাঁর মধ্যে ছিল শেখবার অদম্য ইচ্ছা। অভিধান ব্যবহার ক’রে নিজেকে ইংরেজী শিখিয়ে আমার পড়া সব ‘মেরি পপিন্স’ আর এনিড ব্লাইটনের যাবতীয় বই তিনি পড়ে ফেলেছিলেন। এর চেয়ে কঠিন ইংরেজী পড়া তাঁর পক্ষে দুঃসাধ্য ছিল। তাই মা, রাতে শোবার সময়, বিভিন্ন ইংরেজী উপন্যাস তাঁকে অনুবাদ ক’রে শোনাতেন, ঠিক যেমন আমাকে বাবা-মা পালা ক’রে শোবার সময় ইংরেজী গল্প এককালে শুনিয়েছিলেন!

এক রাতে শুয়ে-শুয়ে শুনছি মা মাসীমাকে এক অদ্ভূত ইংরেজী বই থেকে গল্প বলছেন, যে কাহিনী গতানুগতিক বাস্তব বা কল্পনাধর্মী গল্পের থেকে একেবারে আলাদা! তখন আমার বয়স ১৩/১৪, বইটির নাম The Life Everlasting, লেখিকার নাম Marie Corelli (যিনি বাংলায় আমাদের উচ্চারণ-প্রমাদের জন্য ‘মেরি করোলি’তে বিকৃত হয়েছেন!) ইনি ১৯শ শতাব্দীর শেষে লেখা শুরু ক’রে ১৮৯৫ সালে তাঁর উপন্যাস The Sorrows of Satan-এর মাধ্যমে তৎকালীন সমস্ত পুরুষ ও নারী ঔপন্যাসিকদের জনপ্রিয়তার নিরিখে কয়েক যোজন পেছনে ফেলে দেন! প্রথম মহাযুদ্ধের পর, বলা হয় যে পাশ্চাত্যে তাঁর জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাঁটা পড়ে (যদিও এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে)। কিন্তু ততদিনে ভারতবর্ষে তাঁর জনপ্রিয়তা মধ্যগগনে! বাঙালী সাহিত্যিকদের মধ্যে তাঁর পাঠকদের মধ্যে ছিলেন শরৎচন্দ্র ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুবাদ ছাড়াও কোরেলির অনেক বই তখনকার বোম্বাই শহরের Wilco Books কর্তৃক ১৯৫০ দশকের শেষ থেকে ষাটের দশকের প্রথমার্ধ পেরিয়েও পুনর্মুদ্রিত হ’তে থাকে। প্রসঙ্গত, কিছুদিন আগে পার্ক স্ট্রীটে Oxford Bookstore-এ দেখলাম যে Wilco Books-এর এই পুনর্মুদ্রণগুলি আবার সহজলভ্য হয়েছে!

বেশ কিছু অতি-নাটকীয় প্রেম-বিশ্বাসঘাতকতা-প্রতিহিংসা সংক্রান্ত উপন্যাস (Vendetta বা Wormwood) ছাড়া ভদ্রমহিলা যা লিখেছেন, তাতে আধ্যাত্মিকতা তো আছেই, তার সঙ্গে অনেক উপন্যাসে মিশেছে খৃস্টধর্মের আখ্যানসমূহের খুব উপভোগ্য পুনর্ব্যাখ্যা (যার জন্য ভারতে রোমান ক্যাথলিক চার্চের পক্ষ থেকে ১৯০৭ সালে কোরেলির তখন-অবধি প্রকাশিত বেশীর ভাগ বইকেই ঐ চার্চের অনুগামীদের পাঠের অযোগ্য বলে একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করা হয়!), এবং কল্পবিজ্ঞান। মা’কে হঠাৎ বললাম, “Life Everlasting-টা দাও তো।” হতভম্ব মা’ প্রশ্ন করলেন, “তুই পড়বি মারি কোরেলি!!!” সত্যিই তো, এনিড ব্লাইটন থেকে মারি কোরেলিতে যাওয়াকে ‘সুদীর্ঘ লম্ফ’ বলা যেতেই পারে! পড়লাম, দারুণ লাগল, আর পরপর মহিলার বই পড়তে শুরু করলামঃ A Romance of Two Worlds (তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস, যার প্রভাব নাকি বিভূতিভূষণের ‘দেবযান’ উপন্যাসে দেখা যায়), Ardath, The Secret Power, এবং, কিছু পরে, অবশ্যই জনপ্রিয়তার নিরিখে তাঁর সফলতম উপন্যাস, The Sorrows of Satan১৯৭১ সালে স্কুলের পত্রিকায় বেরোল আমার প্রথম সাহিত্য-সমালোচনামূলক লেখাঃ ‘Marie Corelli: the Neglected Author’১৯৭৩ সালে স্কুলের বাড়ির কাজে বন্ধুকে চিঠি লিখে নিজের পড়া কোন ভাল বইয়ের কথা বলতে বলা হয়েছিল। আমার ক্লাসের ঘনিষ্ট  বন্ধু সর্বজিৎকে উদ্দেশ্য করে লিখলাম The Sorrows of Satan-এর কথা, কারণ ইংরেজীতে সে বাঘা-বাঘা সব বই সর্বসমক্ষে পড়ত, আর পরীক্ষায় আমার চেয়ে অনেক বেশী নম্বর পেত! মারি কোরেলি আমার পেশাগত জীবনেও এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিতা। ওঁর লেখার প্রতি আমার আকর্ষণ দেখে দাদা বলেছিলেন, “ভবিষ্যতে ইংরেজী সাহিত্যে কোরেলির স্থান নিয়ে গবেষণা করিস।” ২০০৭ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া আমার Ph. D-র বিষয়বস্তু হ’লো ‘মারি কোরেলির উপন্যাস’, যা নিয়ে আলোচনা করার সময় তাঁর প্রবন্ধ ও কবিতাসমূহ নিয়েও লিখেছি। বিশেষ করে লিখেছি ভারতে, এবং স্পষ্টত বাংলায়, তাঁর প্রভাব নিয়ে।

এরপর আসি সেই লেখকের কথায়, যে লেখক তাঁর নির্মল, স্নিগ্ধ হাস্যরস দিয়ে আমার জীবন ভরিয়ে দিয়েছেনঃ তিনি P. G. Wodehouse। বাবা-দাদা ওঁর বই সাগ্রহে পড়তেন, আমাকেও পড়াবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। অবশেষে, ১৯৭২ সালে পন্ডিচেরীর শ্রী অরবিন্দ আশ্রমে কিছুদিন থাকার সময় আত্মীয়দের বাড়িতে দেখি A Pelican at Blandings বইটি। পড়ে হাসতে-হাসতে  পেটে খিল ধরে যায়। এরপর সবিস্ময়ে আশ্রমের গ্রন্থাগারে দেখি ঋষি অরবিন্দের ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে উডহাউসের একাধিক উপন্যাস! পরে বাবার কাছে শুনেছি যে তিনি নিজে শ্রী অরবিন্দের চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন যে সব গুরুগম্ভীর কারণে, তা ছাড়াও ছিল সাধকের এই উডহাউস পাঠের প্রবণতা! স্নাতকস্তরের পরীক্ষায় যখনই সুযোগ পেয়েছি, তখনই উডহাউসের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছি। পরে যাদবপুরে অনেকবার তাঁর লেখা পড়িয়েছি, এমনকি কয়েক বছর আগে ওঁকে একটি ঐচ্ছিক পত্রের বিষয়ও করেছিলাম – যেমন করেছিলাম মারি কোরেলিকে।

উডহাউসের প্রভাব আমার সাহিত্যপাঠের ওপর এতটাই বিস্তৃত যে ওঁকে জানার পর যে তিনজন ঔপন্যাসিক/ ছোট গল্পের লেখককে ভালবেসে পড়েছি, তাঁদের প্রত্যেকের লেখায় উডহাউসের প্রভাব অনস্বীকার্যঃ এঁরা হলেন ডাক্তার এবং ডাক্তারী পেশা নিয়ে যিনি নিজে ডাক্তার হওয়ার সুবাদে লিখেছেন, সেই Richard Gordon (‘Doctor’ series), নিজে উকিল হওয়ার সুবাদে ইংরেজী সাহিত্যে কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি, এবং উডহাউসের পর এক নতুন চরিত্র সংযোজনকারী John Mortimer এবং তাঁর সৃষ্ট উকিল Horace Rumpole, এবং সবশেষে Tom Sharpe, যাঁর লেখায় পরতে-পরতে আছে উডহাউসের কৌতুকের সঙ্গে গভীর ও তিক্ত ব্যঙ্গরস। প্রথমজনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমার বৌদির সূত্রে, তিনি যখন ডাক্তারী পড়ছেন, সেই সময়। মর্টিমারের সঙ্গে পরিচয় করান বিলেতে পড়াশোনা সূত্রে বসবাসকালীন আমার বাবার মাস্টারমশায় রেভারেন্ড Lovejoy। টম শার্পকে আবিষ্কার করি ব্রিটিশ টেলিভিশনে তাঁর, আমার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস, Porterhouse Blue-র ধারাবাহিক রূপ দেখে। এঁদের সঙ্গে যোগ করব রহস্যোপন্যাস ও গল্পের সুনিপুণ রচয়িতা আগাথা ক্রিস্টির নাম।




আরও সাম্প্রতিককালে
Stephen King-এর ‘হরর’ উপন্যাস ও গল্গুলি ভাল লেগেছে, যেমন লেগেছে Robert McCammon-এর উপন্যাস ও গল্প। শেষোক্ত লেখক ভয়ঙ্করতা দিয়েই শুরু করেছিলেন, কিন্তু এখন তার সঙ্গে অন্য অনেক উপাদান যোগ করে genre-blending-এর দিকে এগিয়েছেন। কিং এবং ম্যাকক্যামন দু’জনেই মার্কিন মুলুকের লেখক।

(ক্রমশ)


রামশরণ শর্মা

 

প্রাচীন ভারতে শূদ্রেরা


(অনুবাদ: চন্দন দত্ত)


(নিম্নতর বর্গের আনুমানিক ৬০০ খৃষ্টাব্দের পূর্বেকার এক সামাজিক ইতিহাস। ভারতের প্রথম সারির ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম, প্রয়াত শ্রদ্ধেয় রামশরণ শর্মা দ্বারা লিখিত ‘SUDRAS IN ANCIENT INDIA -- A Social history of the lower order down to circa AD 600’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ।)




অধ্যায় – ২ / ১ 

১৮৪৭ সালে, রথ (Roth) প্রস্তাবিত করেছিলেন যে, শূদ্রদের অবস্থান হয়ত আর্য সমাজের পরিসরের বাইরে ছিল। তখন থেকে সাধারণ ভাবে এটি ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, ব্রাহ্মণ্য সমাজের চতুর্থ বর্ণ গঠিত হয়েছিল প্রধানত অনার্য জনগোষ্ঠীকে নিয়ে, যাঁদের সেই দুরবস্থায় নামিয়ে এনেছিল (reduced) বিজেতা (conqueror) আর্যরা। এই অভিমত সমর্থন লাভ করতে থাকে বাবু-শ্রেণীর ইউরোপীয় এবং এশিয়া ও আফ্রিকার অশ্বেত অধিবাসীদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের সমরূপ অবস্থানকে কেন্দ্র করে।

এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বিজেতা আর্যরা বিবেচিত হয়েছিল উচ্চ জাতির (race) সমার্থক হিসেবে এবং অনার্যরা দাস বা দস্যু'র জাতির (race) সমগোত্রীয় হিসেবে। কিন্ত এইচ ডব্লিউ বেইলি (H. W. Bailey) দেখিয়েছেন যে, ঋগবেদে ব্যবহৃত ও উল্লেখিত 'আর্য (arya) শব্দটি থেকে জাতিগত প্রভাবের বিষয়টি নির্বিচারে টেনে আনা যায় না। শব্দটি টেনে আনা হয়ে থাকতে পারে এর গোড়ায় (base-এ) স্থিত 'আর' (ar) থেকে, যার অর্থ -- প্রাপ্ত করতে (to get)। ইরানীয় উল্লেখসমূহ (references) অনুযায়ী 'আর্য শব্দের অর্থ অধিষ্ঠাতা বা আর্যা  (possessor or noble), এবং এর সম্প্রসারণে (extension) 'আর্য শব্দটির  ভিন্ন কোনো অর্থের উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যে নেই, বৈদিক-সংস্কৃতি পরবর্তী সভ্য বৌদ্ধ এবং জৈন যুগের সাহিত্যে আর্যা বা মহদ্বংশীয় শব্দের ব্যবহারের কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া যাক। আর্য-রা হচ্ছেন কবিদের সমার্থক এবং এটি অবশ্যই একটি স্তুতিবাচক বিশেষণ। এইসব কিছু থেকে এটা অনুমিত হতে পারে যে,  ঋগবেদ অনুগামীরা বা ঈশ্বরেরা, যারা 'আর্য' হিসেবে স্তবগানের মাধ্যমে বন্দিত হতো, তারা হয় সম্পত্তির অধিকারী ছিল বা উচ্চবংশজাত (Noble) ছিল অথবা দুই-ই ছিল। যদিও তাদের ধনসম্পদ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলা হয়নি। মূলত একটি মেষপালক সমাজে, বিদ্যমান সম্পত্তির পরিমাণ কোনো মাপদন্ডেই বিশ্লেষণ করা যায় না। সেইজন্য সেই ঋগবেদীয় সমাজ সংঘবদ্ধ হয়েছিল, না শ্রমের সামাজিক বিভাজনের ভিত্তিতে, না সম্পত্তির বিভিন্নতার ভিত্তিতে। ঋগবেদীয় সমাজ প্রধানত সংঘবদ্ধ হয়েছিল জ্ঞাতিত্ব, কুল ও বংশের ভিত্তিতে। বিভিন্ন ধরনের জ্ঞাতি-ভিত্তিক পরিবারের পদবিগুলি (terms) ঋগবেদে বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে। এইভাবে 'জন' (jana) উল্লেখিত হয়েছে ২৭৫ বার এবং 'ভিস' (vis) ১৭০ বার। একইভাবে, গণ (gana) এবং ব্রত (vrata) উল্লেখিত হয়েছে অনেকবার। এই পরিবারগুলি সম্ভবত মোটামুটি বৃহৎ আকারের ছিল, কারণ 'কুল' (kula), যেটি প্রথমে পরিবার এবং পরে উচ্চ বংশজাত পরিবারের সমার্থক ছিল, সেটি ঋগবেদে উল্লেখিত হয়েছে কেবল একবার মাত্র এবং তাও কুলাপা'র (kulapa) অংশ হিসেবে। এতদসত্ত্বেও যদি ঘ্রাহা (grha) শব্দটিকে পরিবারের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণ করা হয়ে থাকে, ঋগবেদে সেটির উল্লেখ হয়েছে অনেকবার, যদিও সেটি ঘটেছে একশ'র চেয়ে কম সংখ্যক বার এবং সুতরাং সেটি 'জন' এবং 'ভিস'-এর তুলনায় কম পৌনঃপুনিক (frequent) ভাবে উল্লেখিত হয়েছে। ঋগবেদে উল্লেখিত 'আর্য' (Aryan) জাতিটি একই বংশগত উৎসের অধীন নাও হয়ে থাকতে পারে, কিন্ত তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল একটি সাধারণ ভাষা এবং একটি সাধারণ জীবনপ্রণালীর দ্বারা। সেইজন্য আর্য শব্দটির ব্যবহার বুঝতে হবে সেই অর্থেই।

যদিও এটি একটি বিতর্কিত বিষয় যে, দাস এবং দস্যুরা জাতিগত বিচারে অনার্য ছিল না, আমাদের মতে সেটি অনেক বেশি সত্য ছিল দাসেদের ক্ষেত্রে। যেমন পরবর্তীতে দেখানো হবে যে, দস্যুরা সম্ভবত একটি ভিন্ন ভাষা ব্যবহারকারীদের  প্রতিনিধিত্ব করতো এবং তাদের জীবনপ্রণালীও ছিল আলাদা, যেটা মনে হয়  দাসেদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। অধিকন্তু দাসেরা 'ভিস' (vis) নামক উপজাতির মধ্যে সংগঠিত ছিল, যে শব্দটি বৈদিক জনসাধারণ বা উপজাতিদের দ্বারা ব্যবহৃত হতো। সেই দৃষ্টিতে বিচার করলে, আর্য ও দাসেদের পারস্পরিক সঙ্ঘাত বা বিরোধকে মনে হবে মোটামুটি তেমনই, যেমন পারস্পরিক সঙ্ঘাত বা বিরোধ নিয়ে বৈদিক উপজাতিরা জীবন অতিবাহিত করছে। ঋগবেদের অসংখ্য স্তবগান, যেগুলির পুনরাবৃত্তি দেখা গিয়েছে অথর্ববেদে, সেগুলিতে আর্য-দেবতা ঈন্দ্র, দাসেদের বিজেতা হিসেবে প্রতীত হয়েছেন, যিনি প্রধানত মানুষ ছিলেন বলেই মনে হয়ে। কথিত আছে যে ঈন্দ্র, অধম দাসেদের গুহায় চালান করেছিলেন। বিশ্বের নিয়ন্ত্রক হিসেবে তিনি দাসেদের পরাভূত করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন এবং তাদের ধ্বংসসাধনের জন্য নিজে প্রবৃত্ত হওয়ার কথা বলেছিলেন। ঋগবেদের প্রার্থনায় পৌনঃপুনিক স্তবগুলির বিষয়বস্ত ছিল ঈন্দ্রের কাছে দাস উপজাতিকে উৎপাটিত করার অনুরোধ সংক্রান্ত। ঈন্দ্র নিজেও প্রতীয়মান হয়েছেন, দাসেদের সমস্ত রকমের উৎকৃষ্ট গুণাবলী থেকে বঞ্চিত করার এবং তাদের বশে আনার ভূমিকায়।

দাসেদের চেয়েও অনেক বেশি উল্লেখ রয়েছে ঈন্দ্র দ্বারা দস্যুদের উৎপাটিত করার এবং বশে আনার বিষয়টির। বলা হয়েছে যে, দস্যুদের হনন করে ঈন্দ্র, আর্য বর্ণকে রক্ষা করেছেন। দস্যুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার উদ্দেশ্যে আর্যদের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, দস্যুদের সংহারের উদ্দেশ্যে অন্তত বারোটি স্তোত্রের উল্লেখ রয়েছে, বেশিরভাগই ঈন্দ্রের দ্বারা। অপরপক্ষে, যদিও ব্যক্তি দাসেদের হত্যা করার কথা উল্লেখিত হয়েছে, তবুও 'দাসহত্যা' কথাটির উল্লেখ কোথাও নেই। এটি ঈঙ্গিত করে যে, দাস এবং দস্যু শব্দদুটি সমার্থক নয় এবং সূচিত করে যে, আর্যরা দস্যুদের নির্দয়ভাবে সংহার করার নীতি অনুসরণ করেছিল, কিন্ত দাসেদের ক্ষেত্রে তারা সংযমী মনোভাব নিয়েছিল।

আর্য ও তাদের প্রতিপক্ষের মধ্যেকার যুদ্ধ, প্রধানত  প্রতিপক্ষের দূর্গ ও প্রাচীর বেষ্টিত পরিসরসমূহের ধ্বংস সাধনের রূপ নিয়েছিল। দাস এবং দস্যু উভয়েরই দখলে ছিল অসংখ্য সুরক্ষিত দূর্গ সদৃশ পরিসরসমূহ, যেগুলির সাথে সাধারণভাবে সংযুক্ত ছিল আর্যদের অন্যান্য শত্রুরাও। এটি স্বাভাবিকভাবেই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বিলম্বে আবিষ্কৃত হরপ্পা সভ্যতার আত্মরক্ষার্থে নির্মিত দূর্গ সদৃশ পরিসরসমূহের কথা, যদিও আর্যদের ও হরপ্পাবাসীদের মধ্যে সঙ্ঘটিত বৃহদাকার সংঘর্ষের কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ আমরা এযাবত পাইনি। এটি থেকে প্রতিভাত হয় যে, যাযাবর বৃত্তি সম্পন্ন আর্যরা ঈপ্সিত হয়েছিল জনবসতিগুলিতে তাদের শত্রুদের দ্বারা সঞ্চিত ধনসম্পদে, যেগুলি দখল করার জন্য তাদের মধ্যে নিয়মিত চলমান যুদ্ধের অবতারণা হয়েছিল। উপাসকদের মনোভাব ছিল এইরূপ যে, যারা নৈবেদ্য উৎসর্গীকৃত করে না, তাদের হত্যা করা উচিত এবং তাদের ধনসম্পদ জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করা উচিত। দস্যুরা বর্ণিত হয়েছে ধনশালী কিন্ত আত্মত্যাগে অনীহা সম্পন্ন শত্রু হিসেবে। দুজন দাস সর্দারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের বলা হয়েছে ধনাকাঙ্ক্ষী। অভিলাষ ব্যক্ত  করা হয়েছিল যে, ঈন্দ্র দ্বারা সেই সমস্ত দাসেদের দমিত করা হোক এবং তাদের সংগৃহীত ধনসম্পদ জনসাধারণের মধ্যে বন্টন করা হোক। দস্যুরা মণিরত্ন ও সোনা ইত্যাদি অধিকৃত করে রেখেছিল, যা সম্ভবত আর্যদের লালসাকে উত্তেজিত করেছিল। কিন্ত পশুপালক সংস্কৃতির ধারক-বাহক আর্যদের কাছে প্রাথমিকভাবে শত্রুদের পশু-সম্পদের প্রতিই ছিল সর্বাধিক প্রলোভন। তাই যুক্তি দেওয়া হল যে, কাইকাটা-রা (Kikatas), যারা সম্ভবত হরিয়ানার বাসিন্দা ছিল, তারা যেহেতু নৈবেদ্য স্বরূপ দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি নিবেদন করে না, সুতরাং তারা গবাদি পশু পালনের যোগ্য নয়। অপরদিকে, তাদের শত্রুরা কিন্ত স্বভাবসিদ্ধ্ব ভাবেই আর্যদের ঘোড়া এবং রথ-কে যথাযোগ্য গুরুত্ব অর্পণ করতো। একজন ঋগবেদীয় কিংবদন্তীর বয়ান অনুযায়ী, দস্যুরা দধিচি নামক রাজকীয় ঋষিদের একটি নগর দখল করেছিল, কিন্ত পশ্চাদপসরণের সময় ঈন্দ্র তাদের অবরোধ ক'রে পরাজিত করেন এবং গবাদিপশু, ঘোড়া ও রথগুলিকে পুনরুদ্ধার ক'রে রাজাকে প্রত্যার্পণ করেন।

দস্যুদের জীবনপ্রণালী আর্যদের অত্যধিক বৈরি মনোভাবাপন্ন করে তুলেছিল। আপাতদৃষ্টিতে, পশুপালনের ওপর ভিত্তি করা আর্যদের উপজাতীয় অর্ধ-স্থায়ী (semi-settled) জীবনপ্রণালী, সুস্থির ও শহুরে সংস্কৃতির দেশীয় মানুষদের জীবনপ্রণালীর সাথে বেমানান ছিল। পূর্বেকার প্রধানত সেকেলে উপজাতি জীবনের অধিকারীরা নিজেদের অভিব্যক্ত করেছিল নানান সাম্প্রদায়িক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যেমন গণ-সভা, সমিতি এবং বিদাথা প্রভৃতিতে, যেগুলির মধ্যে ত্যাগের (sacrifice) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্ত দস্যুদের ত্যাগ-এর সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না। এটি সত্য ছিল দাসেদের ক্ষেত্রেও, কারণ ঈন্দ্রের আগমন হয়েছে ত্যাগের আদর্শ নিয়ে এবং সেটিই স্বতন্ত্র করেছিল দাস ও আর্যদের। ঋগবেদের সপ্তম খন্ডে একটি সম্পূর্ণ রচনাংশ (passage), 'আক্রাতুন'(akratun), 'অশ্রদ্ধা' (asraddhaa) এবং 'আয়োজন' (ayojan) প্রভৃতি একগুচ্ছ বিশেষণে পরিপূর্ণ হয়ে আছে, যেগুলি দস্যুদের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের ত্যাগ-হীন চরিত্রকে লক্ষ্যনীয় করে তুলতে। ঈন্দ্রের কাছে মিনতি করা হয়েছে, ত্যাগ পরায়ণ আর্য ও ত্যাগ-হীন দস্যুদের মধ্যে পার্থক্যকে তুলে ধরতে। তাদের 'আয়োজভানাহ'-ও (ayajvanah) বলা হয়েছে। অনীন্দ্র (anindra) (ঈন্দ্র-বিহীন) শব্দটিও অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে এবং সেটি সম্ভবত দস্যু, দাস ও আর্যদের অননুগামী কিছু ব্যক্তিদের নির্দেশিত করে। আর্যদের দৃষ্টিতে, দস্যুরা কালা-জাদুর (black magic) অভ্যাস করতো। এই ধরনের একটি বিশ্বাস, বিশেষ করে পরিলক্ষিত হয়েছিল অথর্ববেদ-এ, যার মধ্যে দস্যুরা  প্রতীয়মান হয়েছিল পিশাচ হিসেবে, যারা ত্যাগে ভীত হয়ে দূরে সরে থাকে। কথিত আছে যে, একটি সর্বশক্তিমান রক্ষাকবচ ঋষি অঙ্গিরা-কে দস্যুদের নগর দূর্গে বলপূর্বক প্রবেশ করতে সমর্থ করে তুলেছিল। অথর্ব বেদে প্রদত্ত দস্যুদের পৈশাচিক চরিত্র, মনে হয় ঋগবেদীয় পর্যায়ে তাদের যুদ্ধের নথির ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। অথর্ব বেদ অনুসারে, দেবতা-নিন্দুক দস্যুদের অর্পণ করতে হবে জীবন্ত-বলি হিসেবে। বিশ্বাস করা হয় যে, দস্যুরা বিশ্বাসঘাতক, তারা আর্যদের ধর্মানুষ্ঠানের অনুশীলন করতো না এবং কষ্টসহকারেও তারা মনুষ্যোচিত ছিল না।

আর্য ব্রত (vrata), যার সাধারণ অর্থ আইন বা আইনী বিধান (ordinance), তার থেকে দস্যুরা কীভাবে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছিল, সেটি আর্য এবং দস্যুদের জীবনপ্রণালীর মধ্যেকার পার্থক্যকে নির্দেশিত করার মধ্য দিয়ে পুনরায় প্রকাশ্যে এসেছে। এই বক্তব্যটি এবং 'ব্রত', যেটি উপজাতীয় সৈন্য বা গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত, এদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক স্থাপন করা যদি সম্ভবপর হয়, তবে প্রস্তাবিত করা যেতে পারে যে, ব্রত শব্দটির অর্থ খুব সম্ভবত উপজাতীয় আইন  অথবা তার ব্যবহার। দস্যুরা সাধারণভাবে বর্ণিত হয়েছে 'অভ্রত' ও 'অন্যব্রত' হিসেবে। 'অপব্রত' শব্দটি দু'জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে এবং সম্ভবত সেটি প্রযুক্ত হয়েছে দস্যু এবং আর্যদের মধ্যেকার ভিন্নমত পোষণকারীদের ক্ষেত্রে। এটি লক্ষ্যণীয় যে, এই ধরনের বিশেষণগুলি দাসেদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়নি, যা  পুনরায় নির্দেশিত করে যে, তারা দস্যুদের তুলনায় আর্যদের জীবনপ্রণালীর প্রতি বেশি নমনীয় ছিল।

এটি মনে করার কারণ আছে যে, আর্য ও তাদের শত্রুদের মধ্যে বর্ণগত পার্থক্য ছিল। এটি প্রতীয়মান হয় যে আর্যরা, যাদের মনুষ্যোচিত (manusi praja) বলা হয়েছে, এবং যারা 'অগ্নি বৈশ্বনর'-এর পূজা করতো, তারা আবশ্যকতা অনুসারে কৃষ্ণ বর্ণ-বিশিষ্ট মানুষদের (asiknivisah) বসতি সমূহে অগ্নি সংযোগ ঘটিয়েছিল, যারা কোনো প্রতিরোধ ব্যতিরেকেই নিজেদের অধিকৃত দ্রব্য-সামগ্রী পরিত্যাগ করে পলায়ন করেছিল। আর্যদের দেবতা 'সোমা' (Soma), কালো চামড়ার মানুষদের, যারা আপাতদৃষ্টিতে দস্যু ছিল, তাদের হত্যাকারী হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন। অধিকন্তু ঈন্দ্রকে, কালো চামড়ার রাক্ষসদের সাথে যুঝতে  হয়েছিল এবং একটি ক্ষেত্রে তিনি পঞ্চাশ হাজার কালো মানুষকে হত্যা করে প্রশংসিত হয়েছেন, যাদের সায়ানা (Sayana), কৃষ্ণ বর্ণের রাক্ষস মনে করা হতো। ঈশ্বর নিজেও কালো চামড়ার অসুরদের  বিচ্ছিন্নকরণ-কারী হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন। ঈন্দ্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যার কিছু ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে, সেটি নির্দেশিত করে কৃষ্ণ নামে খ্যাত এক আদর্শ বীরের সাথে যুদ্ধের প্রতি। কথিত আছে যে, কৃষ্ণ যখন অংশুমতি বা যমুনা নদীর তীরে দশ হাজার সৈন্য নিয়ে শিবির স্থাপন করেছিলেন, ঈন্দ্র তখন মারুতদের (Aryan vis) নিয়ে সৈন্য সমাবেশ করেছিলেন এবং যাজক-দেবতা বৃহস্পতি'র সাহায্যে অদেভিহ ভিসাহ'র (adevih visah) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। সায়ানা (Sayana) অদেভিহ ভিসাহ'র ব্যাখ্যা করেছেন কৃষ্ণবর্ণের অসুরসেনা রূপে (Krisnarupa asurasena)।  বলা হয়েছে যে কৃষ্ণ ছিলেন যাদব উপজাতির অনার্য কালো বর্ণের বীর (Dark hero)। এটি বিশ্বাস্য বলেই মনে হয়, কারণ পরবর্তী প্রজন্মগুলিও ঈন্দ্র ও কৃষ্ণের মধ্যেকার শত্রুতার কথা বিবৃত করেছে। কৃষ্ণগর্ভ'র (krsnagarbha) হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত বিষয়টিও উল্লেখিত হয়েছে, সন্দেহজনক ভাবে, সায়ানা (Sayana) যাদের উদ্ধৃত করেছেন, --- কৃষ্ণ নামক অসুরের গর্ভবতী স্ত্রীলোক বলে। একই  ভাবে ঈন্দ্র দ্বারা কৃষ্ণায়নী দাসীদের (krsnayanih dasih) পতন ঘটানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, কল্পনাপ্রসূত ভাবে সায়ানা যাদের বলেছেন -- নিকৃষ্ট রাক্ষসী সদৃশ বাহিনী (nikrstajatih ...asuri senah), কিন্ত উইলসন, কৃষ্ণকে গ্রহণ করেছেন কালো বর্ণের অনুভূতি হিসেবে। শেষোক্ত অর্থটি যদি সঠিক হয়, তবে এটি অধিষ্ঠিত হয় যে দাসেরা বর্ণগতভাবে কালো ছিল। কিন্ত তাদের ক্ষেত্রে 'কালো' শব্দটির বর্ণন হয়ত করা হয়েছে নির্বিচারে, যেভাবে সেটি করা হয়েছে দস্যু ও আর্যদের অন্যান্য শত্রুদের ক্ষেত্রে। যাইহোক, উপরোক্ত সম্পর্কস্থাপন সমূহ নিঃসন্দেহে ন্যূনতম সন্দেহের অবকাশ রাখে যে, ঈন্দ্রের আর্য অনুগামীদের,  অগ্নি এবং সোমা-কে, ভারতের কালো লোকেদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল। একটি বিবরণে, ঋগবেদীয় বীর ত্রসাদস্যু (Trasadasyu), পুরুকুৎসা'র (Purukutsa) পুত্র, বর্ণিত হয়েছেন 'কৃষ্ণ বর্ণীয় মানুষদের' নেতা হিসেবে। এটি হয়ত ইঙ্গিত করে যে, তিনি তাদের ওপর  নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

যদি দস্যুদের ক্ষেত্রে অনাসা (anasa) শব্দটি নাসিকাহীন অর্থে অথবা চ্যাপ্টা নাক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং দাসেদের ক্ষেত্রে 'উরসাশিপ্রা (ursasipra) শব্দটি ষাঁড়ের অধরোষ্ঠবিশিষ্ট অথবা সম্মুখে প্রসারিত বৃহৎ অধরোষ্ঠবিশিষ্ট অর্থে  প্রযুক্ত হয়ে থাকে, তাবে এটি প্রতীয়মান হবে যে, আর্যদের শত্রুদের শারীরিক গঠন ছিল ভিন্ন প্রকৃতির।

'ম্রাহরাবাক' (mrahravak) শব্দটি, যেটি ঋগবেদের নানান জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন রূপে উপস্থাপিত হয়েছে, সেটি আর্য ও তাদের শত্রুদের বাচনপদ্ধতির পার্থক্য সম্পর্কিত কিছু ধারণা প্রদান করে। এটি দুরকমভাবে দস্যুদের বৈশিষ্ট্যযুক্ত করেছে। সায়ানা, এটিকে বর্ণিত করেছেন 'প্রতিকূল বাচনপদ্ধতি' হিসেবে, এবং গেল্ডনার (Geldner) এটিকে উপস্থাপিত করেছেন 'ভুল বাচনপদ্ধতি' হিসেবে। ম্রাহরাবাক শব্দটিকে যদি ‘দুর্বোধ্য ভাষণপদ্ধতি অর্থে গ্রহণ করা না হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে এটি আর্য ও দস্যুদের মধ্যেকার ভাষাবিদ্যাগত কোনো পার্থক্যকে  নির্দেশিত করে না, বরং কেবলমাত্র দর্শায় যে, দস্যুরা তাদের অপ্রকৃত ভাষণপদ্ধতি দ্বারা আর্যদের অনুভূতিতে আঘাত করেছিল। এইভাবে, যদিও আর্য ও তাদের শত্রুদের মধ্যেকার যুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল গবাদিপশু, রথ সমূহ এবং অন্যান্য সম্পত্তির ওপর দখল কায়েম করা, তথাপি জাতি, ধর্ম ও বাচনপদ্ধতির পার্থক্য প্রভৃতিও সম্পর্ক তিক্ত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছিল।

(ক্রমশ)