ধারাবাহিক উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(২৫)
বাবুল একদিন ফোন করল রাতের দিকে। লিপিকা অনুমান করে ছেলে কোনো কারণে কষ্টে রয়েছে কিন্তু বলতে চাইছে না। সে খোঁচায়নি, ওসব তার স্বভাবে নেই। হাত খালি হলে ঘরে গিয়ে খাটের একপাশে বসে। শোভন চেনা ভঙ্গিতে ঝুঁকে আছে খাতায়। দেখে কেমন রাগ হয়ে যায়, মনে হল টান মেরে ফেলে দেয় আঁকার সরঞ্জাম। রাগ নেমে গেলে মনের মধ্যে হূ হূ করে, আহা, আছে থাক না ওটুকু নিয়ে! ধীরে ধীরে শোভনের গা ঘেঁষে বসে, মাথায় হাত বোলায়, যেন শোভন ছোটো এক ছেলে। জিজ্ঞেস করে,
--হ্যাঁগো,
চলো দিল্লী থেকে একবার ঘুরে আসি। যাবে?
শোভন
নতুন আঁকাতে নিবিষ্ট, চমকে তাকায়,
--দিল্লীতে?
বাবুলের কাছে?
--আর
কোথায়?
--চলো
কবে যাবে? ওর ফ্ল্যাটে?
--হোটেলে
বা গেস্ট হাউসে যদি ব্যবস্থা করে দেয় তো ভালো।
--কেন?
ওর ফ্ল্যাটে থাকবো না?
--ওর
ফ্ল্যাট ওয়ান বেডরুম, ওর একার মতো, খুব ছোটো।
শোভন
মাথা নাড়ে, তা বটে! লিপিকা আনমনা হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। বড্ড ব্যালান্সড সে,
বড্ড গোছালো। তিলতিল করে তৈরি করেছে পরিপাটি ঘর-সংসার। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে নিজের
ঘরটাকে। পর্দা কেনার সময়ে কত বাছাবাছি করেছে—
হাফ
না ফুল? রিং না লুপ না আইলেট? দেওয়ালের পেইণ্টের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকবে কোন রঙে? বেডকভার
ভারী হবে না পাতলা কাপড়ের? ড্রইংরুমের বাছাই করা প্রত্যেকটি ছবি, সাজসজ্জা? অনুপুঙ্খভাবে
রাখা রান্নাঘরের প্রত্যেকটি সরঞ্জাম? সে না থাকলে কে নিপুণ করে খেয়াল রাখবে? তার আলভোলা মানুষটার? তাদের সহজ সরল ছেলেটার? হঠাৎ
গায়ে ভীষণ কাঁটা দিয়ে ওঠে। চারপাশে বাতাস কম মনে হয়, যেন অ্যাকোয়ারিয়ামের মতো বন্ধ
বাক্সে আবদ্ধ তারা সাঁতার কাটছে বছরের পর বছর। কাছাকাছি আসছে, ওইটুকুর মধ্যেই দূরত্ব
বজায় রাখছে। জলে সবুজ অ্যালগি ধরে, গায়ে ফাঙ্গাস গজায়, কাছের মানুষ আপনাআপনি দূরে সরে
যায়, ওভাবে চলতে থাকে। তাদের তিনজনের ইউনিট, তার ভাই-বোনেরা, শ্বশুরবাড়ির পরিজন —
যার
নাম এখন এক্সটেণ্ডেড পরিবার ক্রমশঃ অন্য জলে, অন্যান্য অ্যাকোয়ারিয়ামে একই সময়ে একই
সঙ্গে ভাসছে। সেই জল সময়ে-সময়ে দূষিত হয়, জন্ম নেয় ফাঙ্গাস। খালি চোখে ধরা পড়ে না,
সরাসরি অন্যকে আক্রান্ত করে না, আবার করেও। শোভনের অন্যমনস্কতা, বাবুলের মনখারাপ—এই সব লেপ্টে-থাকা
হালকা ফাঙ্গাস লিপিকাকে ছুঁয়ে ফেলেছে। ঘোরের মধ্যে হাঁসফাঁস লাগে। সে-ও কি ক্রমে শোভনের
মতো হারিয়ে যাচ্ছে? বড় খারাপ হারিয়ে যাওয়া। কষ্টে সামলে নেয় লিপিকা, সময় অপ্রতুল। এভাবে
তলিয়ে গেলে সমস্ত জলটাই অ্যালগীতে ভরে যাবে। জানালার বাইরের মিইয়ে আসা দুপুর, কী এক
বড়ো গাছের পাতার দুলুনি, ইতস্তত গাড়ির আওয়াজ —
সেদিকে
তাকিয়ে ঈষৎ অবিন্যস্ত গলায় বলে,
--শুনছো,
একটা প্ল্যান ভাবছি।
শোভন
প্রশ্ন করে না, জানতে চায় না। লিপিকা আপনমনে বলে,
--বাবুলের
বিয়ে দেওয়া দরকার — দায়িত্ব রয়ে
গেছে আমাদের। কী জানি নিজের চয়েস আছে কি না, তাহলে অন্তত একটা কাজ কমে। তবে আজকাল মেয়েরা
অনেক বেশী স্মার্ট আর ম্যাচিওর, ওর মতো হাঁদা ছেলেকে পছন্দ করবে? তাই ওর কাছ থেকে ঘুরে
আসতে চাইছি। জানো, আমার মনে হচ্ছে—
বলতে
বলতে চুপ হয়ে যায় লিপিকা। প্রায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে মামপির মুখখানা চোখে ভেসে ওঠে, খানিক
বিচলিত লাগে। ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে, কোনো জবাব না আসায় ঘাড় ঘুরিয়ে সে শোভনের দিকে
তাকায়। নিশ্চিন্তে কাত হয়ে আচ্ছন্নের মতো আধোঘুমে শোভন, যেন সংসারের অণুকোটি দায়িত্বে
তার কোনো দায়ভাগ নেই। ফ্যানের হাওয়ায় ফরফর করে উড়ছে আঁকার খাতার পৃষ্ঠা। মিশ্র অনুভূতি
সাপটে ধরে লিপিকাকে — মস্ত হয়ে মিলে
যায় ক্লান্তি, দুঃখ, ব্যস্ততা, স্নেহ, মায়া। লিপিকা আলতো করে শোভনের শরীরের ওপরে নিজেকে
রাখে, গাল রাখে শোভনের মাথায়। মানুষটা শ্যাম্পু করেনি কতদিন, ঘাপসা চুল, মাথায় গন্ধ
হয়েছে। শোভন চোখ মেলে, উঠতে গিয়ে বাধা পায়, হাসে। লিপিকার হঠাৎ লজ্জা করে, সোজা উঠে
বসে। শোভন সরে যায়,
--শোবে?
শোও না।
--নাঃ
বিকেল হয়ে এলো, কাপড়গুলো গুছিয়ে এসে চা করছি। শোনো..., আচ্ছা থাক।
--বলো
না, কী?
--বাবুলের
বিয়ের কথা ভাবছিলাম।
শোভন
হেসে ফেলে,
--ওর
বিয়ে? ছোট্ট একটা ছেলে!
--ছোট্ট?
না কি? একতিরিশ পেরোল।
--হুঁ,
তাহলে বিয়ে করা উচিত, খোঁজখবর করতে হয়।
--আগে
ওকে জানাই, মত জিজ্ঞেস করি — কাউকে পছন্দ
করে কিনা! এ কি আর আমাদের সময়ের মতো যে...
বলতে
গিয়ে শেষ না করে গিলে ফেলে লিপিকা। সপ্রতিভভাবে বলে,
--তাই
তো দিল্লী ঘুরে আসতে চাইছি দিনসাতেকের জন্য।
--আচ্ছা
যাবো। তুমি আমার আঁকাগুলো দেখো।
--দেখবো
আজ। আমি তেমন বুঝি না গো।
শোভনের খাতায় অর্ধসমাপ্ত ছবিটা দেবী কালীর, নীচে ক্যাপশন — ‘সেই মা’। স্কেচ শেষ হয়েছে, রঙ দেওয়া বাকি। এই প্রথম কোনো ছবিতে সে ক্যাপশন দিয়েছে। ছবিটা হাতে নিয়ে ঈষৎ কেঁপে ওঠে লিপিকা, নিখুঁত নয় অথচ অসম্ভব জীবন্ত চিত্র! আলুলায়িত কেশ, গলায় মুণ্ডমালার সঙ্গে রক্তজবার দীর্ঘ মালা, চারহাতের একহাতে উদ্যত খড়্গ, একটিতে নরমুণ্ড, উলঙ্গ দেবীর প্রসারিত দু-পায়ের তলায় অসহায়মুখে মহাদেব। সম্মোহিতভাবে সে ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে — ছবিটির ভাষা বর্ণনীয় নয়। দেবীর গায়ের রঙ এবং পশ্চাৎপট দুইই গ্রীষ্মকালের আকাশের মতো প্রখর নীল, মেঘের মতো থাক-থাক চুল দুই নীলের মাঝখানে ব্যবধান তৈরি করেছে। উগ্র, ক্রুদ্ধ ত্রিনয়ন, অথচ হাসিতে লজ্জার আভাস। সবল, সক্ষম, প্রবল আত্মবিশ্বাসী পূর্ণাঙ্গ নারীমূর্তি!
লিপিকা
স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়েই থাকে ছবির দিকে, আঁকল কী করে? কোনো ছবি দেখে আঁকা বলে মনে হচ্ছে
না। অবচেতনের কোন স্তরে ছিল? এমন ঐশ্বর্যময় দেবীর কোনো ছবি তাদের সংসারে নেই। তার পুজো
অতি সংক্ষিপ্ত, ছোটো ঠাকুরের তাকে জল-বাতাসা, সন্ধের ধূপটুপ। শোভন সেটুকুও করে না।
আস্তে
আস্তে খাতা বন্ধ করে লিপিকা, নিশ্চুপ বসে থাকে কতক্ষণ। আবার খাতাটা খোলে, ছবিটা দেখে,
কোনো মন্তব্য করতে পারে না। পাতাগুলো ওল্টাতে থাকে, খুব বেশী ছবি নেই। অপরাধবোধ কাজ
করে, শোভনকে সে নিজের মতো সরল করে নিয়েছে, বুঝতে পারেনি এত বছরেও। মায়া অতিক্রম করে
সমীহ জাগে, সাম্ন্য আওয়াজে তাকিয়ে দেখে শোভন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। জিজ্ঞেস করে,
--ভালো
হয়েছে?
--দারুণ!
অসম্ভব ভালো।
লিপিকা
হেসে মাথা নাড়ে। শোভন কৈফিয়ৎ দেওয়ার মতো করে বলে,
--রঙ
করা কমপ্লিট হয়নি, করে ফেলব।
--কী
দেখে আঁকলে তুমি?
--দেখে?
কই? আমি দেখে তো আঁকি না!
--ও।
তাহলে?
শোভন
ভাবে। ভাবতে ভাবতে অদেখা সেই গলিতে হারিয়ে যাওয়ার আগে লিপিকার মোবাইল বাজে, দেবী কলিং।
লিপিকা কেটে দেবে ভেবেও দেয় না। একহাতে শোভনকে আলতো ঠেলা মারে, অন্যহাতে ফোন তুলে বলে,
--বল
দেবী ভালো আছিস?
--হ্যাঁ
তুই তো আর খবর নিস না। শোন একটা সমস্যা হয়েছে। একদিন আসতে পারিস?
দেবিকার
স্বর মোলায়েম, ঝাঁঝ বা বিরক্তি নেই। আবদারের মতো করে বলে,
--আয়
না রে মেজদি, সারাদিন থাকবি। শোভনদাকে নিয়ে আয়। আসলে তোরে খুব মান্য করে মামপি, একটা
ব্যাপারে ওরে একটু বুঝাতে হবে।
--আমি!
কেন রে?
--আয়
না, তখন বলব।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন