বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২২

পায়েল চট্টোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


মেঘমুলুক

 

()

ছোট্ট পুঁতির মতো একটা বীজ। হবু-প্রাণ। গাছের। মায়াভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে নবীনদা। যেন কোন এক অমূল্য রত্ন আমার হাতে তুলে দিচ্ছে।

-"মানুষের জীবন নয় বলে কি তার দাম থাকে না? এই যে তুমি অক্সিজেন পাচ্ছো, হাওয়া পাচ্ছো, আলো পাচ্ছো, কাদের জন্য বলো তো?''

কথাগুলো বলার সময় নবীনদার মুখে আলো। চোখে খুশির ঝিলিক। গাছের বীজগুলো আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল ''যত্ন করো''। আমার চোখের সামনে যেন একটা আলোর মালা দুলছে।

কয়েক মাস হল এ পাড়ায় এসেছি। বেশ বর্ধিষ্ণু পাড়া। আকাশছোঁয়া ইমারতের দল চারিদিকে। সকলেরই যেন বড় তাড়াহুড়ো আকাশ ছোঁয়ার। সবাই ব্যস্ত। স্টেশন এবং বাসডিপো থেকে বেশ কাছাকাছি জায়গাটা। তাই পকেট সামলে সাধ্যমত দু'কামরার একটা খোপ জোগাড় করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।

রোজ সকালে ঘুম ভাঙাতো একটা কাঠ-ঠোকরা। জানালার শার্সিতে এসে তার উপস্থিতি জানান দিত। স্থির চোখ, হলুদ ঠোঁট। আমি জানলা না খুলে ওকে দেখতাম। জানলা খুলে দিলেই উড়ে পালায়। সময় বুঝে মানুষের প্রাত্যহিক কাজকর্মে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার চেষ্টা আমায় মুগ্ধ করতো। ওর চোখে নরম আলো। প্রথমদিন বেশ অবাক হয়েছিলাম। শহরের মাঝখানে প্রকৃতির এই অপার কৃপা! তবে এর নেপথ্যে যে একজন মানুষ রয়েছে বুঝলাম কয়েকদিন পরে।

ফ্ল্যাটের পূর্ব দিকের জানলাটা খুলতেই চোখে পড়লো একফালি সবুজ-ঘেরা, ছায়া মাখানো বাড়ি। উঁহু, কোন তাড়া নেই তার আকাশ ছোঁয়ার। টালির চালে ঘেরা ছোট্ট বাড়িটা যেন মাটির বুকেই খুশি। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে সেই বাড়ির পেছনদিকের বাগান। হরেক রকম রঙের মেলা। নানা রঙের ফুল। প্রকৃতির সৃষ্টির নান্দনিক সৌন্দর্য। একটা লম্বামতো লোক সেখানে মাটি খুঁড়ছে। মাটির বুকে জায়গা করে দিচ্ছে একটা প্রাণের। গলদঘর্ম হয়ে সে প্রকৃতির অস্ফূটে বলা কথা শুনছে। মাঝে মাঝে ঘাড় নাড়ছে। বিড়বিড় করছে। কৌতূহল মেটানোর জন্য একটু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম একটা ভাঙ্গা বোর্ড উঁকি দিচ্ছে বাগান থেকে। 'অব্যক্ত নার্সারি'। বুঝলাম এই সবুজ গালিচার মত বাগানই আশ্রয়দাতা ওই কাঠঠোকরার। ভাঙা বোর্ডটার পাশ থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো।

 

()

-'' কী কী গাছ নেবে বলো?''

-''পাম আর বনসাই দাও, ঘর সাজাবো।''

-''শুধু ঘর সাজাবে? আর প্রকৃতি? একে রক্ষা করবে না! নিয়ে যাও যা পছন্দ, আমার কাছে বীজও আছে। নেবে? টবে প্রাণ ফুটবে। নিজের চোখে দেখতে পাবে।''

সেই আলাপ নবীনদার সঙ্গে। কিছু মানুষ ছায়ার মত হয়। তাদের উপস্থিতি শীতল করে। তাই সৌজন্যতার বাঁধাধরা গন্ডিতে থাকে না তারা। নবীনদার সঙ্গে বেশিদিন 'আপনি' টেকেনি। গাছ যেমন মাটি ছুঁয়েও আকাশের দিকে চোখ মেলে থাকে, নবীনদাও তেমনি 'মাটি'র মানুষ। বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট নার্সারিটায় ঢুকে মনে হল কয়েক শতাব্দী পর যেন স্বপ্নের মত নরম নিঃশ্বাস নিলাম। গাছেরা যেন খিলখিলিয়ে হাসছে।

ছেলে দাবি জানিয়েছে আমাদের ফ্ল্যাটের বারান্দাটা 'ফটোজেনিক' করতে হবে। ওর অফিসের অনলাইন অনুষ্ঠানের উপযোগী স্থান করে তুলতে হবে। গাছ দিয়ে সাজাতে চায়।‌ নবীনদার প্রাণভোমরা 'গাছ' আমার ঘর সাজানোর 'উপকরণ'।

কয়েকটা টব হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল নবীনদা। আমি হাত পেতে প্রকৃতির সৃষ্টি গ্রহণ করলাম। নবীনদার হাতের চারিদিকে ক্ষত। আঙুলের ঘর্ষণে জন্ম নেয় ছোট ছোট প্রাণ। গাছ। প্রকৃতির সৃষ্টি। নবীনদার প্রাণভোমরা।

পাড়ার লোকে বলে নবীনদা নাকি আস্ত একটা পাগল। নবীনদা নিজেকে বলে 'গাছ-পাগল'। অফিস যাওয়ার পথে নবীনদার নার্সারিটা পেরিয়ে যেতে হয়। বৈশাখের শুরুতে রোদের তেজ পুড়িয়ে দেয়। ক্লান্তিহীন মানুষটা তখনও প্রকৃতির পরিচর্যা করে চলে। বাড়ির একটা অংশ ঝুরঝুর করছে। ভ্রুক্ষেপ নেই। সন্তান স্নেহে লালন করে চলেছে গাছেদের। চোখে মায়ার ঝিলিক।

একদিন আবদার করে বসল, ''তোমার ফ্ল্যাটের গাছগুলো দেখতে যাব, দেখি কেমন যত্ন করো''। হ্যাঁ, না কিছুই বলে উঠতে পারলাম না। অস্বস্তি! নবীনদা বোধহয় পড়ে ফেলল। হঠাৎ করে হা-হা হাসি। ''আরে মজা করছিলাম।'' সেদিনের পর কয়েক দিন নবীনদার নার্সারির পাশ দিয়ে আর যানি। মনের সংকীর্ণতা কি দখল করে নেয় উদারতাকে? একটা খচখচানি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি সেদিন। বারান্দার গাছগুলোর দিকে চোখ যায়। ওদের কি মুখ ভার?

 

()

একদিন হুড়মুড় করে হাঁটছিলাম। অফিস যাওয়ার পথে ঘড়ির কাঁটার চোখরাঙানিতে বেশিরভাগ দিনই বিধ্বস্ত থাকি। সেদিন আবার প্রমোশনের তালিকা বেরোবে। হঠাৎ পিছু-ডাক!

-''দিদি, এই কাগজটার মানে কী বল তো?'' উস্কোখুস্কো চুলের একটা লোক সামনে এসে দাঁড়ালো। হাতের শিরা ফুলে উঠেছে। পায়ে কাদা। গায়ে কিসের যেন গন্ধ! মাটির গন্ধ কি! নবীনদা।

-''আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে আজ। পরে দেখবো।''

উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার ঘাড় ধরে এগিয়ে দিচ্ছে রাস্তার দিকে। তবুও কাগজটা ব্যাগে পুরে নিলাম।

-''ফিরে এসে দেখে তোমায় বলবো নবীনদা।''

-''দেরি হয়ে যাবে না তো?''

নবীনদার চোখে আকুতি। বাঁচার নয়, বাঁচানোর। উত্তর না দিয়েই ক্যাবে উঠে পড়লাম। পরে কাগজটায় চোখ বুলিয়ে যা বুঝলাম, ''কাগুজে ফরমান।" নবীনদার বসতবাড়ি, জমি নাকি 'দখলি জমি'। সঠিক কাগজ না দেখাতে পারলে ছেড়ে দিতে হবে নিজের ঠাঁই। বাঁচানোর আকুতিসমেত একজোড়া চোখ আমায় তাড়া করে বেড়ালো অনেকক্ষণ। তবে অফিসের কাজ, প্রোমোশনের তালিকা ভুলিয়ে দিল সবটা। ঠিক জলের দাগের মত। ভেবেছিলুম নবীনদার গাছ-সাধনা দাগ কেটেছে মনে! তবে কি সবই জলের দাগের মত ক্ষণস্থায়ী?

সেদিন বাড়ি ফেরার পথে দেখি সেই একই চোখ আমার পথ চেয়ে বসে আছে। নবীনদাকে বুঝিয়ে বললাম সবটা। খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো। নবীনদার নার্সারিতে তখন অন্ধকার নেমেছে। ''আলো জ্বালবে না?'' বলতে পারলাম না। কাগজটা হাতে নিয়ে ঠায় বসে আছে নবীনদা। সাদা কালো অক্ষরে নবীনদার স্বপ্ন-মৃত্যুর হাতছানি। বাড়ি ফিরে ফ্ল্যাটের গাছেদের দিকে তাকালাম। কোথাও যেন জলের টুপটুপ শব্দ। একজোড়া চোখ। ছলছলে।


()

''আমার ছেলে বিষ্ণু। বাতাসে বড় বিষ জমেছে! আমার বারো বছরের ছেলের বুকেও সেই বিষ জমলো। নিঃশ্বাস নিতে পারত না। ডাক্তার বলল ফুসফুস কাজ করছে না! কী যেন নাম! মুখ্যু মানুষ, মনে থাকে না। হ্যাঁ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়ে  গিয়েছিল। চলে গেল ছেলে। ছেলের শোকে বউটাও বাঁচল না।''

চোখ দিয়ে মুক্ত ঝরছে নবীনদার। একটু থেমে আবার শুরু করল,

''ভাবলুম, জীবন কী করে শেষের পাতায় চলে যায় তা তো দেখা হলো, আমি শেষ  থেকে শুরু করলাম, এই গাছেদের দিয়ে। ওদের দেখে মনে হতো, ওরা মাথা দোলাচ্ছে। বলছে ফল হবে, ফুল হবে, বাতাসে বিষ কমবে। প্রাণ বাঁচবে। তাই ওদের মধ্যেই বিষ্ণুকে খুঁজে নিয়েছি। বাবার সঙ্গে এখানে থাকতে এসেছিলাম কোন ছোটবেলায়! এখন কাগজ কোথায় পাই বল তো?''

উত্তর নেই কারোর কাছে। একফালি কাগজের অভাব! এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে স্বপ্নের শেকড়। নবীনদার মাটি মাখা হাত। পায়ে কাদা। আমি কী উত্তর দেবো বুঝতে পারছি না!

আবার নবীনদাই শুরু করল,

-''এখানে ফ্ল্যাট হবে। আজ কয়েকজন এসেছিল। কাগজ দেখাতে না পারলে আমায় চলে যেতে হবে। আর দেখালেও আকাশ ছোঁয়া ইমারত আমার এই গাছ-ভূমিকে দখল করবেই! পরিবেশকে মানুষ এত তুচ্ছ ভাবে? তাচ্ছিল্য করে?''

আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। হঠাৎ মনে হল একটা কাঠঠোকরা দূরের গাছটাতে বসে মাথা দোলাচ্ছে! ওর স্থির চোখ। আমি তাকাতে পারছি না। আমি যখন আমার নিশ্চিন্ত আস্তানায় ঢুকছি, বিকেলের আকাশের ঝলমলে রোদকে গ্রাস করে নিচ্ছে কালো মেঘ।


২টি মন্তব্য: