বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২

সুদীপ্ত বিশ্বাস

 

ঈশ্বর : এজেন্ট ও মার্কেটিং




যে কোনও প্রোডাক্ট মার্কেটে বিক্রির জন্য ভালো মার্কেটিং-এর জুড়ি নেই। মার্কেটিং ঠিকঠাক করতে পারলে অনেক সাধারণ প্রোডাক্ট বাজার কাঁপিয়ে দিতে পারে। মার্কেটিংয়ের এই গুরুত্বের জন্যই মার্কেটারদের এত মোটা মাইনে দিয়ে কোম্পানিতে পোষা হয়। কারণ এরাই কোম্পানির প্রধান মেরুদন্ড। মার্কেটিং খুব ভালো হলে প্রোডাক্ট যতই নিম্নমানের হোক না কেন, তা বাজারে চলতে থাকে।   মার্কেটিংয়ের এমনই গুণ যে প্রোডাক্ট হিসেবে কিছু না থাকলেও সেটা বাজারে  প্রোডাক্ট হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া সম্ভব। শুনতে অবাক লাগলেও বাস্তব সত্য এটাই। মিথ্যে লোভ দেখিয়ে মানুষকে বোকা বানিয়ে মানুষের সর্বস্ব নিয়ে নেওয়া সম্ভব ভালো মার্কেটিং করতে পারলে। বিভিন্ন চিটফান্ড কোম্পানিগুলো এভাবেই টাকা তোলে জনগণের কাছ থেকে। শুধুমাত্র মার্কেটিংয়ের গুণেই প্রোডাক্ট না থাকলেও প্রোডাক্ট বিক্রি করে ফেলা সম্ভব। জনগণের মনে প্রোডাক্ট সম্পর্কে অন্ধ আস্থা তৈরি করা সম্ভব।

খুব গরমে আমাদের যখন তেষ্টা পায় তখন আমরা ঠান্ডা কোন পানীয় খুঁজি। কিন্তু আমাদের তেষ্টা পেলেই আমরা যদি কোকাকোলা খেতে চাই তাহলে বুঝতে হবে এটা কোকাকোলা কোম্পানির মার্কেটিং-এর জন্যই সম্ভব হয়েছে। যদি  আমরা পেপসি, স্প্রাইট বা অন্য ব্র্যান্ড ছেড়ে শুধুমাত্র  কোকাকোলা ব্র্যান্ডের দিকেই আকৃষ্ট হই, তাহলে তা কোকাকোলা ব্রান্ডের মার্কেটিং-এর সার্থকতা।  একইভাবে জুতো কিনতে আমরা যদি শুধু উডল্যান্ড-এর জুতো প্রেফার করি তাহলে সেটা উডল্যান্ড কোম্পানির মার্কেটিং-এর গুণ। এজন্যে মার্কেটাররা  আমাদের চিন্তাভাবনাকে নির্দিষ্ট দিকে চালিত করে। আমাদের চিন্তাভাবনাকে তারা কিছুটা আচ্ছন্ন করে দেয়। আমাদেরকে তাদের মতো করে ভাবতে শেখায়।

আজ অব্দি পৃথিবীতে যে বস্তুটির সবচেয়ে বেশি মার্কেটিং করা হয়েছে তার নাম হলো ঈশ্বর। প্রোডাক্ট না বলে এটাকে কনসেপ্টও বলা যেতে পারে। কেউ এটাকে ট্যানজেবল প্রোডাক্ট আবার কেউ এটাকে ইনট্যাঞ্জেবল প্রোডাক্ট বা কনসেপ্ট  হিসাবে মার্কেটিং করেছেন। এখানে বাস্তবে কোনও প্রোডাক্টই নেই। প্রোডাক্ট না থাকলেও মার্কেটিং এত জোরালো হয়েছে যে জনগণের মধ্যে অন্ধবিশ্বাস তৈরি হয়ে গেছে প্রোডাক্ট বিষয়ে। বড় বড় মার্কেট- গুরুরা  তাদের বিদ্যাবুদ্ধি এখানে  লাগিয়েছেন। দারুণ মার্কেটিং-এর জন্য এই প্রোডাক্ট কেউ কখনো চোখে না  দেখলেও সকলেই বিশ্বাস করে, প্রোডাক্টটি আছে। অথচ প্রোডাক্টের কোনও  অস্তিত্বই নেই। এটাই মার্কেটারদের সার্থকতা। প্রোডাক্ট ছাড়াও মার্কেটিং সম্ভব। এজন্য দরকার খুব স্ট্রং নেটওয়ার্কের।

ইন্সেন্টিভ? হ্যাঁ প্রচুর ইনসেন্টিভ পেয়েছেন এই প্রোডাক্ট-এর মার্কেটারেরা। তাঁরা  নিজেদেরকে সমাজের উঁচু স্তরে উন্নীত করেছেন, তাঁরাই বিভিন্ন আইন কানুন তৈরি করেছেন, তাঁরাই কাজ করেছেন ঈশ্বরের এজেন্ট হিসাবে। তাঁরা নিজেদেরকে মহাপুরুষ হিসাবে তকমা লাগিয়ে দিয়েছেন। মানুষকে তাঁরা অন্ধকারে রেখে দিয়েছেন, মানুষের  চিন্তাধারাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন। সাধারণ মানুষকেও এজেন্ট হিসাবে বা প্রচারক হিসেবে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছেন। মানুষের মধ্যেই প্রোডাক্ট সম্পর্কে একটা অন্ধবিশ্বাস ধরিয়ে দিতে পেরেছেন। মানুষ কেউ কখনো এই প্রোডাক্ট দেখেনি, তবু মানুষ এই প্রোডাক্ট সম্পর্কে পুরোপুরি বিশ্বাস করে। কেউ যদি বলে প্রোডাক্টটি নেই, তবে হাঁ হাঁ করে অন্যেরা তেড়ে আসে তার দিকে। এসবই হল স্ট্রং মার্কেটিং-এর ফল।

প্রোডাক্টটি আবার কয়েকটি ব্র্যান্ডনেমে বিক্রি হয়। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদি বিভিন্ন ব্র্যান্ডনেমে প্রোডাক্ট পাওয়া যায়। যারা যে ব্র্যান্ডের প্রোডাক্ট একবার নিয়েছে, তারা সাধারণত সেই ব্র্যান্ডের প্রোডাক্টই পছন্দ করে। জন্মের খুব শুরু থেকে মৃত্যুর পর অব্দি এই প্রোডাক্টের বাইরে তারা যেতে পারে না। গোটা সমাজ এই মার্কেটিংয়ে কাজ করে। প্রতিটি ব্র্যান্ড প্রতিটি ব্র্যান্ডের রাইভ্যাল। এক ব্র্যান্ডের খদ্দের অন্য ব্র্যান্ডের খদ্দেরদের দু'চোখে দেখতে পারে না। সম্ভব হলে পরস্পরের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি অব্ধি শুরু করে দেয়। প্রত্যেকেই মনে করে তাদের ব্যবহৃত ব্র্যান্ডটিই সেরা। অন্য ব্র্যান্ডের খদ্দেরদেরকে তাদের ব্র্যান্ডের কাস্টমারে কনভার্ট করতে প্রত্যেকেই চেষ্টা করে। এজন্য প্রচুর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অবধি হয়েছে। ঘরছাড়া, দেশছাড়া হয়েছেন প্রচুর মানুষ।

অনেক লোকজন এই প্রোডাক্টের মার্কেটিং-এর সঙ্গে যুক্ত। গোটা পৃথিবীই  মার্কেট। মার্কেট সেগমেন্ট হিসেবে পৃথিবীকে ভাগ করা হয়েছে বিভিন্ন সেগমেন্টে। কোনো কোনো দেশ কোনো কোনো ব্র্যান্ডের প্রোডাক্টকে বেশি পছন্দ করে। প্রোডাক্ট-এর ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রেফারেন্সকে খুব একটা মূল্য দেওয়া হয় না। ব্যক্তির জন্ম থেকেই কোন্ ব্র্যান্ডের প্রোডাক্ট তাকে নিতে হবে সেটা নির্দিষ্ট করে  দেওয়া হয়। তার অপছন্দ হলেও সেই ব্র্যান্ডের প্রোডাক্টটিই তাকে নিতে হবে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। এর বাইরে  কী যাওয়া সম্ভব নয়? সম্ভব, কিন্তু তা খুব জটিল এবং কষ্টকর। আফিমের নেশার মতো এই প্রোডাক্টের নেশা মানুষের রক্তে-মজ্জায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এরপর প্রত্যেকটি মানুষ এমন ভাবে আচ্ছন্ন হয়ে যায় যে তার সমস্ত বিদ্যা-বুদ্ধি, চিন্তা-চেতনা লোপ পায়। আস্তে আস্তে মানুষ নিজেও এই প্রোডাক্টের মার্কেটিং-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় নিজের অজান্তেই।  প্রোডাক্ট সেলের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট আউটলেট খুলে দেওয়া হয়।  এগুলোর নাম হল মন্দির-মসজিদ-গির্জা। এই আউটলেট খোলার জন্য সাধারণ মানুষেরা নিজেরাই তাদের গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে! সাধারণ মানুষের চিন্তা-ভাবনা চেতনাকে এমন ভাবে আচ্ছন্ন করে দেওয়া হয় যে সাধারণ মানুষ এর বাইরে কিছু ভাবতেই পারে না। তারা নিজেরাই এই প্রোডাক্টের মার্কেটিং-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় নিজের অজান্তে। যারা প্রোডাক্ট মার্কেটিং-এ বড় বড় এজেন্ট  হিসেবে কাজ করে তারা দাবি করে, তারা প্রোডাক্টটি দেখেছে। তারা উচ্চমানের অসাধারণ প্রতিভা সম্পন্ন মানুষ তাই তারা এই অলীক প্রোডাক্ট দেখতে পেয়েছে! সাধারণ মানুষ প্রোডাক্টটি দেখতে পায় না। যারা প্রোডাক্টটি দেখতে পায় না বা দেখেনি তাদেরকে নিম্ন শ্রেণীর মানুষ বলে ধরা হয়। নিম্ন শ্রেণীর মানুষেরা, যারা প্রোডাক্টটি দেখেছে, তাদেরকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখে। ওই ধরনের বুজরুক মিথ্যাবাদী মানুষকে প্রোডাক্টের ডাইরেক্ট এজেন্ট  বলে ধরে নেওয়া হয়  এবং তাদেরকেই মহাপুরুষ বলা হয়। প্রোডাক্ট মার্কেটিং-এ এরা খুব বড় ভূমিকা রাখেন। যে মহাপুরুষের প্রোডাক্ট মার্কেটিং-এ ভূমিকা যত বড়, তিনি তত বড় মহাপুরুষ। কেউ কেউ আবার যুক্ত হয়ে যায় প্রোডাক্টের গুণাবলী সম্পর্কিত পুস্তক  রচনা করার কাজে। এই পুস্তকগুলিকে ধর্মগ্রন্থ বলা হয়। সাধারণ মানুষ এই পুস্তকগুলোকে অত্যন্ত সমীহ করে চলে। এইসব পুস্তকে যত আজগুবি জিনিসই লেখা থাকুক না কেন, সকলেই তা বিশ্বাস করে। এইসব পুস্তক যত পুরনো হয়  তার অভ্রান্ততা ততই বেড়ে যায়। এসব পুস্তক সম্পর্কে ভালো মন্দ কোনো  ধরনের কোন প্রশ্ন করা যায় না। পুস্তকে যা-ই লেখা থাকুক না কেন তা মেনে চলতে হবে। কেউ মানতে না চাইলে তাকে শায়েস্তা করতে ছুটে আসে প্রোডাক্টের অন্যান্য খদ্দেররা। এভাবে ব্র্যান্ড লয়াল কাস্টমারেরাও মার্কেটিং-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সারা পৃথিবীতে এই অস্তিত্বহীন অলীক প্রোডাক্টকে প্রমোট করে চলছে। রমরমিয়ে চলছে মার্কেটিং, সমৃদ্ধ হচ্ছে ব্যবসা।

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন