যে-লেখাটা লিখতে চাইনি কখনও
দেখতে দেখতে দু-বছর। ঠিক দু-বছরও নয় যেন -- বইটি হাতে নিলে তার অক্ষরের গায়ে হাত
ছোঁয়ালে এখনও খুব জীবন্ত অশোক। অশোক তাঁতী। যে বইটি আমাকে দিয়েছিলেন বইমেলা ২০২০তে।
এখনও জ্বলজ্বল তাঁর হাতের লেখা, ‘ঝড় ও ষাঁড়’ গল্পগ্রন্থের সামনের সাদা পাতায়। বইটি
দিয়ে একবারও বলেননি, পড়ে দেখবেন। বা কেমন লাগল জানাবেন। জীবন খুব নিস্পৃহ এক চলমান
টারবাইনের মতো, এটা জানতেন অশোক। বইয়ের ব্লার্বে
‘যুগাবধি মেগা ইন্ডাস্ট্রির টারবাইনে তাঁর জীবন ও প্রতীতি ঘুরছে’ লেখা আছে যেমন। তাই
সরব লিখিয়েদের মতো অতটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁকে
শোভা দেয় না। কিন্তু তাঁকে যে পড়ে দেখতে হয়,
হবে -- এটার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। তার চেয়েও নিশ্চিত বলা ভালো, তাঁর চিন্তা ভুবনের
সঙ্গে আগেভাগেই এমন পরিচিতি গড়ে উঠেছিল যে, সমগ্র লেখক কেন -- মানুষটিকেও চিনে নিতে
অসুবিধা হয়নি। অশোক যখন থেকে ‘হাওয়া ৪৯’-পত্রিকার সঙ্গে জড়িত তখন থেকেই তাঁর সুচিন্তিত
মতামত আমাদের ঋদ্ধ করেছে। সমীরদা (প্রয়াত সম্পাদক) যখনই কোনো তরুণকে খুঁজে পেয়েছেন,
তাকে, তার নিহিত সাংস্কৃতিক সত্তাকে নিংড়ে নিতে জানতেন। অশোকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম
হয়নি। অশোকও বুঝি খুঁজে পেয়েছিলেন এক ঈপ্সিত
প্ল্যাটফর্ম। যেখানে দাঁড়িয়ে দু-দণ্ড কথা বলা যায়, থিতিয়ে বসা যায়। সমীরবাবুর সঙ্গে
দীর্ঘ আলোচনা ফোন, কথাও চালাচালি বোধহয়, কিন্তু আশ্চর্যের হলেও অশোক লিখে উঠতে পারেননি।
তিনি পড়তেন। পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা নিয়ে আলোচনা করতেন। নতুন নতুন বিষয়ের সঙ্গে কীভাবে
আত্মীকরণ ঘটানো যায়। ভাবতেন তা নিয়ে। বলতে গেলে সময়ের উদ্ভাবিত ‘ঝুরোগল্প’ নামকরণ ও
কাজল সেন-এর সেই ফর্ম নিয়ে চর্চা অশোককে প্রভাবিত
করে থাকবে। অধুনান্তিক পরিসরের ধারণা নিশ্চিতরূপেই আমদানীকৃত। তবে তার বঙ্গীয় পুনর্নির্মাণ
কেমন হবে -- তা নিয়ে চলত নিয়ত কাঁটাছেঁড়া। সাহিত্যের চলমান ধারায় তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে
কী কী জটিলতা, চলত তা নিয়েও দীর্ঘ মুসাবিদা। পরবর্তী সময়ে অশোককে জানার সুবাদে, তাঁর
লেখাপত্রের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কারণে বুঝেছি তিনি সতত অধুনান্তিক ভাবনার সেবক। তাঁদের
সংস্থা ‘আরাবিকা’ যাঁদের চর্চার বিষয়ই হল প্রান্তিক সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা, সেখানে অপর ভাবনার শরিক না-হলে দায়বদ্ধতা
শিথিল হয়ে আসে, তা জানতেন অশোক। সে কারণেই তাঁর আমন্ত্রণ -- যদিও সামান্যই জানি, বলার
জন্যে, সেই দুর্গাপুরে, প্রত্যাখ্যান করতে পারিনি। অশোক বেশি লিখতেন না। তবে যেটুকু
লিখতেন, তা দরকারি। ‘হাওয়া ৪৯’-এর সঙ্গে তাঁর নিবিড়তার কথা বলে শেষ করা যাবে না। তাঁর গদ্যের ভুবন নিয়ে যৎসামান্য আলোচনা
সেরে নিতে ইচ্ছে করছে।
‘ঝড় ও ষাঁড়’ বইটি গল্পের। গল্পের কাহিনি সে তো থাকবেই। কিন্তু অশোকের দেখার চোখটাই আলাদা। প্রান্তিক মানুষকে কীভাবে দেখতে হয়, তা বেবাক মালুম হয় গল্পের চলনে। যাকে আমরা ধরতাই বলি। যে কোনো বিষয় বা স্থান কিংবা চরিত্র থেকে আচমকা শুরু হয়ে যেতে পারে তাঁর শুরুটা। সেখান থেকেই আমাদের আগ্রহকে উসকে দিয়ে সেই কাহিনি চলমান হয়। তাঁর লেখায় পরিবার যেমন আসে, পারিবারিক সমস্যার টানাপোড়েন আসে সমভাবে। আবার ব্যক্তিগত যাপন ওই পরিবারিকের বাইরে নিত্য কাজের জগৎ, একঘয়েমি থেকে মুক্তির কামনাও আমরা অনুভব করতে পারি। নিত্য নৈমিত্তিক খুঁটিনাটি তাঁর দেখার বিষয়, গল্পের বিষয়। তথাকথিত চমক বা সাড়া জাগানোর কোনো ইচ্ছেই দেখতে পাই না লেখার মধ্যে। বরং নিভৃতে অবলোকন করতে এবং তাঁর চোখ দিয়ে দেখানোতেই তাঁর আগ্রহ বেশি যেন মনে হয়। সেই অর্থে যাকে ওপেন এন্ডেড গল্প বলি, তা হয়তো বিশ্বাস করতেন অশোক -- কাহিনির আপাত সমাপ্তি ঘটত, কিন্তু শেষ হত না।
ব্যক্তিগত যাপনেও অশোক উচ্চকিত হতেন না, আগেই বলেছি। আসতেন যেতেন, অথচ কোনো প্রভাব ফেলার চেষ্টা ছিল না। ‘হাওয়া ৪৯’ সম্পাদকের চির প্রস্থানের পর পত্রিকা আদৌ বেরবে কি না, বেরোলেও কে দায়িত্ব নেবে, খরচ জোগান দেবে কে বা কারা -- এসব নিয়ে যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অশোক। হ্যাঁ, লেখা দিয়েই সহায়তা করেছিলেন। যেটি একটি পত্রিকা চালিয়ে নিয়ে যাবার একান্ত উপাদান। একটি দীর্ঘ লেখা মেল করেছিলেন। ঝুরোগল্প নিয়ে আলোচনা -- ‘ঝুরোগল্পের জিওডেসিক’। ওই সংখ্যায় একটি ঝুরোগল্পও লিখেছিলেন ‘আঁধি নেই’ নামে। প্রবন্ধটির সম্ভবত প্রিন্ট আউট নেবার পর প্রুফ আকারে তা থেকে বাদ পড়ে গেছিল কিছুটা অংশ। আমাদের কারও মনে হয়নি লেখাটা আরও আছে। সেভাবেই ছেপে বেরিয়ে যায়। অশোকের হাতে পত্রিকা পৌছানোর পর অন্য কোনো লেখক হলে তেড়েফুঁড়ে উঠতেন -- উনি খুব নির্লিপ্ত ভাবে বললেন, দাদা, লেখাটা যে আর একটু ছিল। খেয়াল করেননি! আমার লজ্জা রাখার জায়গা ছিল না। যদি হার্ডকপি পেতাম তাহলে এই ভুল হত না। বস্তুত এরকম আগে কখনো হয়নি। অশোকের অভিমান টের পেতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু তাঁর উদাসীনতা সেটুকু দ্রুত মুছে দিতে পেরেছিল। জানতাম এসবের পরেও লেখা দিতে কার্পণ্য করবেন না। কথা দিয়েছিলাম এর পরের লেখা পেলে যত্ন নিয়ে ছাপানোর ব্যবস্থা করব। সায় জানিয়েছিলেন অশোক। সেই লেখা আর পাওয়া হল না।
এই মারণকালে অসময়ে অশোকের মতো আরও অনেকের মৃত্যু দেখতে দেখতে মৃত্যুশোক বুঝি বা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। ততোধিক ক্লান্তি ও বেদনা এই দীর্ঘ বয়স বেঁচে থেকে অনুজদের বিদায় দেখে যাওয়া।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন