এক ব্যতিক্রমী গল্পকারের অকালপ্রস্থান
সেটা নব্বই দশকের কোনো এক বছরের কথা হবে। নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের অনুষ্ঠান চলছে। কারোর কথাপ্রসঙ্গে উচ্চারিত হল একজনের নাম --অশোক তাঁতী। আমি সেই প্রথম এ-নামটা শুনি। পরে কবি-গল্পকার মৃণাল বণিকের কাছ থেকে জানতে পারি অশোক কর্মসূত্রে দুর্গাপুরে এসেছে এবং ভালো গল্প লেখে। এর পর থেকে যখনই কোনো পত্রিকায় অশোকের লেখা দেখতে পাই পড়ে ফেলি। কোনো একসময় কোনো সাহিত্যসভাতে দেখা হয়ে যায়। আলাপও হয়। কোন্ সভা ছিল তা এখন আর স্পষ্ট মনে পড়ে না।
প্রথম আলাপে অশোকের যে ছবিটি ধরা পড়েছিল তা অবশ্য মনে আছে। ছিপছিপে চেহারা, সুদর্শন, সুভদ্র, কিছুটা লাজুক, বাগাড়ম্বর দেখিনি কোনোদি্ন, মিতভাষী এবং সুরসিক। শেষের দিকে শারীরিক অসুস্থতার ছাপ অনেকটা প্রভাব ফেলেছিল শারীরিক সৌন্দর্যের ওপর।
অশোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ও ঘনিষ্ঠতা কিছুটা বৃদ্ধি পায় আমরা যখন ক’জনে মিলে ২০০৪ সালের মে মাসে আরবিকা বা রাঢ় বাংলা কথাসাহিত্য অ্যাকাডেমি (পরে সংস্থা নামে) শুরু করি। অশোক প্রথম থেকেই সংস্থার অনেক দায়িত্ব বিশেষ করে অর্থ–পরিচালনার দায়িত্ব খুব ভালোভাবেই পালন করত।
অশোকের গল্প মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন পত্রিকাতে প্রকাশিত হত। কিছুদিন আরবিকার উদ্যোগে মাসিক গল্পপাঠের আয়োজন করা হত মাইকেল মধুসূদন কলেজের একটি ঘরে। সেখানেও মাঝে মাঝে অশোকের গল্প শুনতে পাওয়া যেত। অশোক আমার দেখা বিরল লেখকদের একজন যার কোনো গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার আগে একটি প্রবন্ধের বই বেরিয়েছিল। সে বইটির নাম ‘রাঢ় বাংলার কারখানার গল্প’। এ ব্যাপারে অশোক নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী ও প্রশংসণীয় কাজ করেছিল। অন্যের গল্প নিয়ে আলোচনার পরিবর্তে সে নিজের গল্পগুলি প্রকাশ করতে পারত। বিশেষ করে যে কোনো তরুণ লেখকের কাছে তার প্রথম মৌলিক গ্রন্থটির একটি আলাদা স্থান ও আকর্ষণ থাকে। অশোক সে প্রলোভন জয় করে আলোচনাভিত্তিক গদ্যগ্রন্থটির প্রকাশ সর্বাগ্রে করাটিকেই তার যথোচিত সাহিত্যসেবা বলে মনে করেছিল।
‘রাঢ়বাংলার কারখানার গল্প’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৬ সালে মেদিনীপুরের অমৃতলোক সাহিত্য পরিষদ থেকে। বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন সাহিত্যিক এবং হাওয়া-৪৯ পত্রিকার সম্পাদক (বর্তমানে প্রয়াত) সমীর রায়চৌধুরী। তিনি লিখেছিলেন যে গল্পকারদের মধ্যে অনেকেই কারখানার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে তাঁরা আধুনিকতার একমাত্রিক নির্মাণ, বিদ্যায়তনিক শিক্ষা ও কৌমনিরপেক্ষ ভাবনার ধরতাই থেকে সরে গেছেন বৈশ্বিক মহাচেতনা বা পরমাপ্রকৃতি বোধে সচেতন ও অবিচ্ছিন্ন উভয় প্রকরণে।
দুর্গাপুর–আসানসোল শিল্পাঞ্চলে যে সব গল্পকার কলকারখানার পটভূমিকে কেন্দ্রীয় বিষয় করে গল্প লিখেছেন সেরকম ২১জন গল্পকারের নির্বাচিত কিছু গল্পের ভিত্তিতে অশোক এই বইটির আলোচনাগুলি সাজিয়েছিল। কতিপয় গল্পকারের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে - বিমান চট্টোপাধ্যায়, মণি মুখোপাধ্যায়, মানব চক্রবর্তী, প্রফুল্লকুমার সিংহ, উদয়ন ঘোষ, রবীন্দ্র গুহ, নন্দ চৌধুরী, সুজিত চট্টোপাধ্যায়, পার্থজিৎ ভক্ত, অশোক তাঁতী, সুবীর ঘোষ প্রমুখ। এঁরা সকলেই কর্মজীবনে কারখানার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে তাঁদের দেখাটা পথিকের দৃষ্টিতে দেখা নয়, একেবারে একজন অধিবাসী যে ভাবে দেখে সেরকম। ফলে অশোকের সুবিধা হয়েছিল এই সব গল্পের মাল্টিডাইমেনশন নিয়ে আলোচনা করার। অশোক এই বইটিতে কলকারখানার সঙ্গে জড়িত নানা বিষয় ও প্রেক্ষিতকে সামনে রেখে তার আলোচনাগুলি সাজিয়েছিল। বিষয়ের এত চমৎকার উপস্থাপনা ও বিশ্লেষণ আমি এর আগে কোনো বইয়ে পাইনি, বিশেষ করে যখন শিল্পাঞ্চলের গল্প নিয়ে আলোচনাই খুব বেশি একটা হয়নি। অশোক বইটিতে যে সব বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছিল তার মধ্যে কয়েকটা উল্লেখ করছি মাত্র -
১) বাস্তুচ্যূতদের কথা ২) ডায়াস্পোরিকতা ৩) ট্রেড ইউনিয়ন ৪) শ্রমিকের বাসস্থান ৫) দুর্ঘটনা ৬) খাদ্যবাহক ৭) দুর্নীতি ৮) কারখানার শব্দ ৯) যৌনতা ১০ ) নারীর কথা ইত্যাদি। সবগুলি বিষয় নিয়ে এখানে কিছু কিছু আলোকপাত করতে পারলে ভালো হত। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় জেনেই আশা করব আগ্রহী পাঠক অশোকের বইটি নিজে নিজে পড়বেন। ডায়াস্পোরিকতা সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে অশোক লিখেছে, “মণি মুখোপাধ্যায়ের চরিত্র ছগনলাল বা অশোক তাঁতীর চরিত্র রতন বা সুবীর ঘোষের চরিত্র লম্বোদর এই ডায়াস্পোরিকতা থেকেই জন্ম মধ্যবিত্ত মানসিক চেতনার। যা তৈরি হয় ভাগ্য অনুসন্ধানে গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষ নিয়ে। এই আর্থ–সামাজিক ব্যবস্থায় শ্রমিকশ্রেণির উদ্ভবের আংশিক কারণ এই সব গল্প থেকে পরিষ্কার”।
অন্যদিকে অর্থের বিনিময়ে যে যৌনতা তার রমরমা শিল্পাঞ্চলে। এরকম বিষয়ের ওপর আধারিত কয়েকটি গল্প নিয়ে আলোচনা করেছে অশোক। এই পর্যায়ের গল্পগুলি হল – ১) সুবীর ঘোষের ইস্পাত শ্রমিকের উৎসব ২) মানব চক্রবর্তীর ডিমের অন্ধকারে ৩) পার্থজিৎ ভক্তর অস্তিত্ব ৪) বিমান চট্টোপাধ্যায়ের শত্রু ৫) সুজিত চট্টোপাধ্যায়ের ফুলির দিনযাপন ইত্যাদি।
কারখানার জীবনে খাদ্যবাহক বা ডাব্বাওয়ালাদের একটা বিশেষ ভুমিকা থাকে। হাড়ভাঙা খাটুনির পর মধ্যাহ্নভোজনের বাটিগুলি তারাই শ্রমিকদের বাসস্থান থেকে বয়ে এনে দেয়। সুবীর ঘোষের গল্প অন্নবাহক এদের যাপন, লোভ ও মানবিকতা নিয়েই। একই খাদ্যবাহককে উপজীব্য করে গল্প লিখেছেন বিমান চট্টোপাধ্যায় নিশিকান্তর সৈন্যসামন্ত এবং অশোক তাঁতী রিফিউজি নামে। কারখানা বন্ধের যন্ত্রণার কথা এসেছে উদয়ন ঘোষ ও প্রফুল্লকুমার সিংহর গল্পে।
অশোকের বিশ্লেষণের একটি অংশ উদ্ধৃত করে এই পর্যায় শেষ করব। “লেখকের বয়স অনুসারেও গল্পের বয়ান বদলে যায়। বয়স্ক লেখক, যাঁরা সত্তরের দশক থেকে লিখছেন তাঁদের রচনায় যেমন ট্রেড–ইউনিয়নের আধিক্যের কথা উঠে এসেছে বিশ্বাস ও সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে, অল্পবয়স্ক লেখকদের রচনাতে সেভাবে ট্রেড–ইউনিয়ন আসেনি। তা বিশেষ কালখণ্ডের জন্য যেমন সত্য তেমনি সত্য লেখকের মানসিকতার”।
অশোকের প্রবন্ধের বইটি বেরোনোর চার বছর পরে ২০১০ সালে তার একটি গল্পসংকলন প্রকাশিত হয়, যার নাম ‘ঝড় ও ষাঁড়’। এই নামে কোনো গল্প নেই বইটিতে। ঝড় ও ষাঁড়ের পাগলের মতো ছুটে আসাটাকে সম্ভবত একবিন্দুতে ধরতে চেয়েছিল অশোক। তার গল্পের ক্রাফট এবং উপস্থাপনা ছিল অন্য ধরনের। লেখার ভাষাও ছিল ব্যতিক্রমী। তার চিন্তাচেতনায় অভিনবত্বের ছাপ ছিল যথেষ্ট।
তার ‘বেতাল ও সন্ততি’ গল্পে প্রতিযোগিতার প্রসঙ্গ আছে। কারখানায় প্রতিযোগিতা নিরন্তর। প্রতিযোগিতার মধ্যে না থাকতে পারলেই শ্রমিক অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। ছিটকে পড়ার ভয়। কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার জন্য বিজনের “বাড়ি ফিরতে রোজ একটু একটু দেরি হয়ে যায়”। এবং “অফিসে ছাঁটাই হবার ভয়ে সে বাড়ি থেকেই ক্রমশ ছাঁটাই হয়ে যাচ্ছে”। ‘ফুলেরা যেভাবে ফোটে’ গল্পে কারখানার আর এক জীবন্ত সমস্যা নিয়ে চর্চা রয়েছে। পরিবেশ দূষণ। “ধীরে ধীরে যখন সারা শরীরের ঘাম শুকিয়ে আসে তখন আমার শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। আমি বুঝতে পারি যে আর কোনোদিন আমার শ্বাস নেওয়ার প্রয়োজন হবে না”।
এই গল্পসংকলনটিতে মোট ১৮টি গল্প আছে। বইটির প্রকাশক আরবিকা প্রকাশনী, কলকাতা। অশোকের জীবনযাপনের ভিত্তিভূমিতে ভারী শিল্প। তার চিন্তা চেতনায় জড়বস্তুর প্রাণীসত্ত্বা ভারী আবেদনে ফুটে উঠেছিল। নগরজীবন, প্রকৃতিমগ্নতা এবং যন্ত্রসান্নিধ্য সবের মধ্যেই অশোক এক দ্বান্দ্বিকতাকে চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারত। এই সংকলনটিতে স্থান পাওয়া একটি গল্পের নাম ‘দধীচির হাড়’। গল্পটি বইয়ে ছাপা হওয়ার পাঁচবছর আগে ২০০৫ সালের জুন সংখ্যা ‘উজ্জ্বল একঝাঁক’ (সম্পাদনা – সুবীর ঘোষ) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই গল্পে অশোক জড়বস্তুতে প্রাণসত্ত্বা আরোপ করে সুন্দর সিমুলেশন দেখিয়েছে। কারখানার সমস্ত বৈদ্যুতিক যন্ত্র যেমন টারবাইন, ট্রান্সফরমার, বয়লার, জেনারেটর সব মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে একে একে বহু চালক মানুষকে মেরে ফেলে। যন্ত্রদের অনুভূতি এই যে “মানুষগুলো সব চামার হয়ে যাচ্ছে। দধীচির পবিত্র হাড় থেকে যাদের জন্ম তাদের উপযুক্ত সম্মানটুকুও দিচ্ছে না”। এই গল্পটি লিখে অশোক আমাকে দেয় আমার পত্রিকা ‘উজ্জ্বল একঝাঁক’এর জন্য। তখন গল্পটার অন্য নাম ছিল – বিদ্যুৎ সরবরাহ বা ওরকম কিছু একটা। নামটি আমার পচ্ছন্দ না হওয়ায় অশোককে বলি ‘দধীচির হাড়’ নামটা তার পচ্ছন্দ কী না। সে রাজি হয়ে যেতে ঐ নামেই গল্পটা আমার কাগজে ছাপা হয়। খুব সুন্দর একটা গল্প।
অশোক খুব বেশি লেখেনি। ২-৩টি উপন্যাস বোধহয় লিখেছিল। তার মধ্যে একটা উত্তরবঙ্গের এক পত্রিকায় (মধ্যবর্তী)। এছাড়া রতন শিকদার সম্পাদিত ‘অল্প কথায় গল্প পত্রিকা’তে সে নিয়মিত অণুগল্প লিখত। একবার অণুগল্প বিষয়ে একটা সুন্দর গদ্য লিখেছিল ঐ পত্রিকাতেই। তার একটি অণুগল্প সংক্ষিপ্ত আকারে এখানে তুলে ধরছি।
যন্তর
অন্ধকার ঝোপ পেরিয়ে পাঁচিলের ভেতর। সামনে অচেনা টগবগে যন্ত্র। বললাম – গুড ইভনিং ।
যন্ত্রটা আধুনিক প্রযুক্তির। ফিরল না। ইসমাইল দেখে ফেলল। শ্রমিকের দাবিতে লড়া আমার ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী। লুকিয়ে বলল, দাদা বেরিয়ে যান। ভি আর এস নেওয়া কর্মীকে দেখে ফেললে কারখানার মধ্যেই গুলি করছে চোর বলে। ইসমাইল হাত ধরে শেডের বাইরে ছেড়ে দিয়ে ছুট লাগাল।
পকেটে রাখা সরু বোতল থেকে গলায় ঢাললাম। পাশ থেকে মিনমিনে গলা, দাদা, ভালো তো?
চমকে
দেখলাম আমার পুরনো যন্ত্র।
--তুই
এখানে? জল কাদায়! কাজ করছিস না?
--না
দাদা। শরীর পেরে ওঠে না। যন্তর বলে ফেলে দিয়ে গেছে।
বাড়ির দিকে হাঁটি। মানুষ, যন্ত্র সবই উদ্বৃত্ত।
ছিটকিনি খোলা ছিল। তিন বছরের মেয়ে পাল্লাটা খুলে খুশি হল কী না বোঝা গেল না। পেছন ফিরে রান্নাঘরে ছুট লাগিয়ে চেঁচায়, মা, যন্তরটা এসে গেছে।
অশোক অল্পবিস্তর কবিতাও লিখত। সামাজিক মাধ্যমে পড়তে পেতাম। লকডাউনের বছর ক’আগের কথা হবে। বিধাননগরের ডিডিএ মার্কেটে অশোকের সঙ্গে দেখা। সংগীতশিল্পী শিপ্রা বসু কাছাকাছি কোথাও এসে গান শেখাতেন। অশোক মেয়েকে সেখানে পাঠিয়ে ডিডিএ মার্কেটে অপেক্ষা করছিল। আমিও তাকে সঙ্গ দিয়ে বেশ গল্পগুজব করে অনেকক্ষণ সময় কাটালাম। তার কিছুদিন পর থেকে তার সম্পর্কে শুধু খারাপ খবরই শুনতাম। কখনও অসুস্থতা কখনও দুর্ঘটনা কখনও অপারেশন। করোনা এসে বিশ্বকে গ্রাস করে আমাদের স্বাভাবিক জীবন ভরে তুলল আতঙ্কে। চারদিকে কেবলই আক্রান্ত হবার খবর আর প্রিয় পরিচিত জনেদের পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া। তার মধ্যে যে আমাদের প্রিয় অশোকও চলে যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি। আমরা যারা অশোকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ছিলাম এবং তার লেখালেখির সমাদর করতাম, তাদের কাছে অশোকের চলে যাওয়া এক বিশাল শূন্যতা। এক অপূরণীয় হাহাকার। বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৩। ১৯৬৮ থেকে ২০২১। ২০২০-র সেপ্টেম্বরে আমার জন্মদিনে আমাকে শুভেচ্ছা জানানো-ই তার সঙ্গে আমার শেষ বার্তা–বিনিময়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন