সমকালীন ছোটগল্প |
প্রস্তরীভূত
গ্রীষ্ম আসে, বর্ষা যায়, শরৎ হতে বসন্ত -- সকলেই নিজ নিজ নিয়মে
আবর্তিত হয় ঋতুচক্রে। বসন্তের স্পর্শে আশোক-কিংশুক সেজে ওঠে রক্তাম্বরে। মধুপের
গুঞ্জরণে মুখরিত হয় কুঞ্জবনের লতামণ্ডপ। তপোবনের শান্ত পরিবেশেও জৈবিক নিয়মে
ঘনিষ্ঠ হয় পক্ষীমিথুন, হরিণ-দম্পতি। শুধু ঋষি গৌতমের মনে কোনও ভাবান্তর আসে না।
প্রত্যহ ব্রাহ্মমুহূর্তে
উপাসনা-পূজাদি সমাপন করে তিনি বহির্গত হয়ে যান, সমস্ত দিন ব্যস্ত থাকেন
তপশ্চর্যা, অন্যান্য মুনি-তপস্বীজনের সঙ্গে শাস্ত্র-আলোচনায়। সন্ধ্যায় গৃহে
প্রত্যাবর্তনের পরেও, মনোরম দীপালোকে যৌবনবতী অহল্যার উৎসুক মুখচ্ছবি দেখেও যেন
দেখেন না তিনি।
দেখেন না, না কি দেখতেন না?
সে দেখার চক্ষু কি আদৌ ছিল তাঁর? কতকাল তো
অতিবাহিত হয়ে গেছে, তবু পাষাণময়ী অহল্যার মনে হয় যেন এ সকলই ঘটে চলেছে -- এখনও তীব্র, বর্তমান কালের মতোই স্মৃতিতে জাগরুক সেই
প্রাত্যহিক অবজ্ঞার অভিঘাত।
একদিন প্রশ্ন করেছিলেন অহল্যা,
“এই কঠোর তপশ্চর্যার দ্বারা কী অর্জন করা যায় স্বামী?
অক্ষয় স্বর্গবাস?”
-“স্বর্গবাসও তো একপ্রকার সুখভোগেরই
কামনাজাত, অহল্যা। আমি লাভ করতে চাই পরমব্রহ্মের উপলব্ধি। ”
- “কোথায় সেই পরমব্রহ্ম, মহর্ষি?
মানব-মানবীর আবেগে, অনুভূতিতে কি তিনি নেই?
মনুষ্যের প্রেম, করুণা, দয়ার জন্য ঈশ্বরের কি ইচ্ছা হয় না মর্ত্যের ধূলিতে নেমে
আসার?”
- “আজ এমন অদ্ভুত প্রশ্ন কেন করছ,
অহল্যা?” বিস্মিত গৌতম প্রতিপ্রশ্ন
করেছিলেন।
- “জানি না স্বামী। অনেকসময় অন্তরাল
থেকে আপনাদের শাস্ত্র-আলোচনা শুনেছি। দেব-গন্ধর্ব-কিন্নর ও সিদ্ধগণের পবিত্র কথা
শুনেও মনে প্রশ্ন জাগে -- মনুষ্য
হতে এঁরা পৃথক কোথায়? শুধুমাত্র স্বর্গ ও অমৃতের অধিকারই
কি দেবকুলকে বিশিষ্ট করেছে? না কি
যথার্থই দেবত্বের স্পর্শে নিহিত আছে এমন কিছু -- যা অর্জন করতে পারলে মনুষ্য ধন্য হতে পারে?”
প্রশ্নে দৃশ্যতই বিচলিত বোধ করেন গৌতম। কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করে বলেন, “তুমি ঋষিপত্নী। তোমার
জানা উচিত যে এ সকল প্রশ্নের উত্তর তপস্যা ব্যতীত লাভ করা যায় না। তা না করে তুমি
পুষ্পচয়ন, বনমালা-দ্বারা প্রসাধন --
ইত্যাদিতেই কাল যাপন করতে আগ্রহী।... অনর্থক
বিলম্বে আমায় প্ররোচিত কোরো না। আমি স্নান-আহ্নিকের উদ্দেশে যাত্রা করি এইবার। আর
শোনো, ইতোমধ্যে ওই বৃক্ষবাটিকায় জলসেচনের কর্ম সম্পন্ন করে রেখো। তাপপ্রভাবে শুষ্ক
হয়ে যাচ্ছে।”
গৌতম দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হলেন পর্ণকুটির হতে। তাপের প্রভাবে কি
বৃক্ষ-লতা-গুল্মই শুষ্ক হয় শুধু? অহল্যার অভিমান-তপ্ত তনুবাটিকায় কে-ই বা জল সেচন
করে? পুত্র শতানন্দ যতদিন শিশু ছিল -- ক্রীড়া করে বেড়াতে এই কুটির প্রাঙ্গণে, তখনও
অহল্যার প্রতি এতদূর উদাসীনই ছিলেন গৌতম। তথাপি সন্তানের সান্নিধ্য ভরিয়ে রাখতে
অহল্যার প্রাত্যহিক জীবনের অনেকাংশ। সেই পুত্রও প্রবাসে চলে যাবার পর অহল্যার
জীবনরসের উৎস যেন স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। হায়, জায়া ও জননীর দায়িত্ব নির্বাহ করার পরও
কেন যে অহল্যার তৃপ্তি হয় না?
কেন গৌতমের দৃষ্টিকটু লাগে জেনেও প্রত্যহ নবীন পুষ্পসমাজে
সজ্জিতা হয়ে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ান তিনি?
এও কি তপস্যা নয় -- সম্পর্কের অভ্যস্ততায় বন্দি,
চিরাচরিত এক স্বামীর মুখ থেকে একবারের জন্যেও ‘প্রিয়া’
সম্বোধন
শ্রবণের তপস্যা?
সহসা অদূরবর্তী লতামণ্ডপ আন্দোলিত হয়ে ওঠে, গৌতম কি এত শীঘ্রই
ম্নান সমাধা করে এলেন? অহল্যা দ্রুত আহার্যের ব্যবস্থা
করতে উদ্যত হন।
-
“ব্যস্ত হয়ো
না প্রিয়তমা, দুদণ্ড নিকটে এসে দাঁড়াও।” গৌতমের আহ্বান শোনা যায় দ্বারদেশে। চমকিত হন অহল্যা। যথার্থ,
গৌতমের ন্যায় এক ব্যক্তিই এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর দ্বারে। কিন্তু তাঁর দৃষ্টিতে,
বচনে -- সহসা এ কী পরিবর্তন?
-
“কে আপনি?”
আগন্তুকের মুখের প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি রেখে প্রশ্ন করেন অহল্যা।
-
“আমায় কি অভিমানবশত
অস্বীকার করতে চাও প্রিয়ে? তোমায় কঠোর
বাক্য বলেছিলাম, অনুতপ্ত হয়ে তাই পুনরায় এসেছি। আমায় স্নিগ্ধ করবে না, সুমধ্যমে?”
অহল্যা অনুধাবন করেন -- এ নিশ্চয় কোনও ছদ্মবেশী দেবতা।
তবু ক্রোধের পরিবর্তে কেমন যেন কৌতুক জাগে তাঁর প্রাণে। এ কৌতুককে মুহূর্তের জন্য
সত্য মনে করলে ক্ষতি কী? অহল্যা
ধীরে ধীরে আগন্তুকের নিকটে আসেন। সংহত অথচ স্পষ্ট স্বরে বলেন -- ছদ্মবেশী
হলেও আপনি অতিথি। অতিথির তুষ্টিবিধান গৃহকর্ত্রীর কর্তব্য। বলুন, আপনার সন্তোষের
জন্য কী করতে পারি?”
গৌতমবেশী কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্ত।
নতমুখে বলে ওঠেন, “আমায় ছলনা ব্যর্থ হল দেখছি। সুরপতি ইন্দ্র আমি, ত্রিভুবনের কোনও বস্তুই আমার
অপ্রাপনীয় নয়। তবু আজ তোমায় রূপমুগ্ধ হয়ে প্রার্থীর ন্যায় ভিক্ষা করছি তোমার
প্রণয়। আমায় বিমুখ কোরো না অহল্যা।”
অহল্যা প্রতিবাদ করেন -- “কিন্তু আপনার এমন কামনা পূর্ণ করা
যে গর্হিত, দেবরাজ।”
-
“পাপের ভয়
করি না আমি। স্বর্গের অধীশ্বর আজ তোমার জন্য পৃথিবীতে নেমে এসেছেন, এ কি তোমার পরম
গৌরব নয় অহল্যা?” গৌতমবেশী ইন্দ্রের প্রবল আকুলতা
দেখে আর্দ্র হন অহল্যা। দৈবী প্রেম কি একেই বলে?
স্বর্গীয় আশ্লেষের স্বাদই বা কীরূপ? তবু
অহল্যার প্রেম জাগে না ইন্দ্রের প্রতি, শুধু জাগে গৌতমের ছদ্ম রূপ-অন্তরালে এক সত্য প্রেমিকের হৃদয়কে স্পর্শ করার
ইচ্ছা। স্বামী গৌতমের সঙ্গে এমন মুহূর্ত
সত্য হয়ে উঠুক কোন এক দিন-এ আশা অহল্যার আর করেন না।
কিন্তু এক মিথ্যা গৌতমের মধ্যে তার সত্য প্রতিচ্ছবির সন্ধান করতে করতে যদি এই
প্রার্থীর প্রার্থনা তৃপ্ত করেন অহল্যা --
সেও কি পাপ?
তৎপরের ঘটনা আর মনে করতে চান না
অহল্যা। তবু মনে পড়ে। অনতিবিলম্বেই প্রত্যাগত গৌতমের সেই ক্রুদ্ধ অভিশাপ, আর
ইন্দ্রের সেই কাপুরুষের ন্যায় পলায়ন। নিজে অভিশপ্তা হয়ে এত যন্ত্রণা হয়নি অহল্যার,
কিন্তু গ্লানিতে অনুতাপে তিনি দগ্ধ হয়েছেন ইন্দ্রের ওই পলায়ন-ভঙ্গিমা স্মরণ করে।
ভুল করেছিলেন অহল্যা -- স্বর্গীয়
প্রেমের আস্বাদলাভের আশায় সুরপতি অশ্লেষে
ধরা দিয়ে। ইন্দ্রের ক্ষণিকের লালসাকে প্রেমের গভীরতা ভেবে নিজেকেই তো নিজে অপমানিত করেছিলেন অহল্যা, দেবতার পদ ও মর্যাদাকেই
দেবত্ব বলে ভ্রম হয়েছিল তাঁর। গৌতমের অভিশাপ কি এই ভ্রমের আত্মগ্লানির চেয়েও
পীড়াদায়ক হতে পারে?
এরপর কতকাল অতিবাহিত হয়েছে তার গণনা
অহল্যা আর করেননি। আশ্রমের পথে দীর্ঘদিনের অযত্নলালিত তৃণলতা বেড়ে উঠেছে। কুঠিরটি
প্রায় ভগ্নদশায় পতিত। কোনও মানব আসে না এ আশ্রম
অভিমুখে। সকলেই জানে, এক অভিশপ্তা রমণীর বাস এখানে,
বায়ুভুক --
লোকচক্ষুর অন্তরালে অবস্থানই তার ভবিতব্য। তাকে ঘৃণা করা চলে, তার নিকটে আসা চলে
না। পুত্র শতানন্দও তো কোনওদিন আসে না জননীর সন্দেশ নিতে। নাকি পুত্রের দৃষ্টিতে
নয় -- সে-ও মাতাকে দেখে
পরিত্যক্তা, অপরাধিনী রূপে -- পুরুষশাসিত সমাজের দৃষ্টির
ব্যতিক্রমী সে-ই বা হবে কী করে?
অভিশাপমুক্তির এক শর্ত অবশ্য গৌতম
বলে গিয়েছিলেন। সে কথাও স্মরণে আছে
অহল্যার। একটি নাম উচ্চারণ করেছিলেন গৌতম। রাম-দশরথের পু্ত্র, রঘুবংশীয় রাজকুমার
রাম এ আশ্রমে পদার্পণ করলে ঘটবে অহল্যার শাপমুক্তি। সেই মুহূর্তের যন্ত্রণাময়
অনুভূতির পীড়নে, ক্ষোভে, অপমানে, গ্লানিতে নিজের মধ্যেই নিজেকে সংকুচিত করে
নেওয়ার মধ্যেও ওই নামটি স্মরণে রেখেছেন অহল্যা। দীর্ঘকাল ধরে ওই নামটি নিজ অবচতনে
জপমন্ত্রের ন্যায় বারবার উচ্চারণ করেছেন তিনি, আর ভেবেছেন -- কেমন
হবে এই নামধারী, যে একদিন তাঁর মুক্তির
দূত হয়ে আসবে? কেমন রূপে আসবে সে-- নির্বিন্ন
সন্ন্যাসীর মতো, অবহেলায় তাঁর দীনতাকে করুণা করে, উদ্ধারকার্য সম্পন্ন করে দিয়ে
চলে যাবে? না কি সে আসবে রাজার মতো, এক কালিমালিপ্ত
অপরাধীকে ক্ষমা করার ভঙ্গিতে তাঁকে মুক্তিদান করে চলে যাবে আপন গর্বে। মুক্তিদানের
পর তাঁর প্রতি কী দৃষ্টিতে অবলোকন করবে এই মুক্তিদাতা?
গৌতম সবশেষে আরও একটি কথা বলেছিলেন
অহল্যাকে, “শ্রীরামের আতিথ্য-সৎকার দ্বারা
লোভ-মোহশূন্য হলে তবেই তুমি আমার নিকটে পুনরায় আসার উপযুক্ত শরীর ধারণ করতে পারবে।”
লোভ আর মোহ তো সেই মুহূর্তে প্রায় নির্মূল হয়েছিল অবল্যার ক্ষুব্ধ মন হতে যে
মুহূর্তে দেবতাকে তিনি দেখেছিলেন সন্ত্রপ্ত তস্করের ন্যায় প্রস্থান করতে। তারপর
এতকাল ধরে এই নিঃসঙ্গ, জড়প্রায়, জীবজগতের অগোচর অভিশপ্ত জীবন অতিবাহিত করতে করতে
এই সৃষ্টির প্রতি, জীবনরসের প্রতি --
এই পৃথিবীর প্রতি তাঁর মোহ অপসারিত হয়ে গেছে। হৃদয়হীন এই জগতের প্রতি বিরাগে,
বিতৃষ্ণায় পাষাণ হয়েছে তাঁর হৃদয়ও। যদি তাঁর মুক্তি সত্যই আসে কোনও দিন, তবুও কি
তাঁর হৃদয়ের ভার লাঘব হবে?
অহল্যার চিন্তার দোলাচলে সহসা ছেদ
পড়ে। বহুকাল পরে মনুষ্য-কণ্ঠের কথালাপ যেন শ্রুতিগোচর হল মনে হয়। কে এল এই
অভিশপ্ত বিজন প্রদেশের নিকটে? কোনও
কৌতূহলী পথিক? অহল্যা উৎকর্ণ হয়ে শোনেন, এক
প্রবীণ কণ্ঠস্বর অগ্রসর হয়ে আসছে এ আশ্রমের ইতিহাস বর্ণনা করতে করতে। এ কাহিনি তো
অহল্যারই। অহল্যা শুনতে থাকেন, গৌতমের অভিশাপবাণী উচ্চারিত হয় আবার তাঁর সম্মুখে,
কিন্তু নিতান্ত বর্ণনার ভঙ্গিতে। নতুন করে
সেই অভিসম্পাত-বাক্যের পুনরুক্তি আর কোনও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না তাঁর মনে।
বর্ণনা শেষে বর্ণনাকারী বলে ওঠেন, “এই
মহাভাগা অহল্যা সেইদিন হতে একাকিনী কঠোর তপস্যায় কালযাপন করছেন। তুমি অগ্রসর হয়ে
তাঁকে দৃষ্টিগোচর কর রাম।”
মহাভাগা না কি মহা অভাগা? এ
কি শ্রদ্ধার প্রকাশ না কি বিদ্রূপ? অহল্যার
সমস্ত অন্তঃকরণ বিশুষ্ক হয়ে ওঠে, কিন্তু মুহূর্তমধ্যেই শান্ত হয়ে যায় -- ‘রাম’
শব্দটির উচ্চারণে। সত্যই তবে এসেছে সেই ‘মুক্তিদাতা’?
এক এক পল যেন বহুক্ষণের ন্যায় দীর্ঘতর হতে থাকে। অহল্যা উপলব্ধি করেন -- জীর্ণ, শুষ্কপত্র, এতকালের
অবহেলিত বন্ধ্যা আশ্রম ভূমির উপর দিয়ে
তারই অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে পদক্ষেপ। অহল্যার মুখ আনতই থাকে, চক্ষু থাকে নিমীলিত -- সম্ভাষণ বিনা তিনি দৃষ্টিগোচর করবেন না নিজেকে।
জগতের প্রতি, সকলের প্রতি তাঁর
বিরাগ আজ প্রস্তরকঠিন হয়ে উঠেছে। মুক্তিদাতার ক্ষমতা আছে কি সেই প্রস্তর চূর্ণ
করার?”
“দর্শন দিন, তপস্বিনী মাতা অহল্যা। আমি এসেছি।”
এক শব্দহীন ধ্বনিতরঙ্গের আহ্বান ভেসে আসে অহল্যার প্রস্তরীভূত প্রাণে। সৃষ্টিধারার
মতো সেই শ্রবণাতীত আহ্বান বর্ষিত হয় তাঁর সমস্ত সত্তার উপর। বিনা প্রয়াসেই উন্মীলন
ঘটে আনত দুটি নয়নের। অহল্যা দেখতে পান তাঁর অতি নিকটে শ্যামল তৃণের মতো দুটি চরণ।
ধীরে ধীরে দৃষ্টি উত্তোলন করেন অহল্যা। অধোবাস, কটিবন্ধ, বক্ষপট, স্কন্ধ, গ্রীবা,
মুখমণ্ডল -- পরিপূর্ণ
এক মানবের রূপ, কিন্তু বয়সে কিশোর। পদ্মপলাশের ন্যায় দুনয়ন তাঁরই মুখের উপর
নিবদ্ধ। ওই চক্ষুর ভাষা পাঠ করে চলেন অহল্যা, আর সর্বাঙ্গের জড়তা অতিক্রম করে
উত্থিত করেন নিজ দেহভার। এই দৃষ্টির সম্মুখে দিবালোকের মতো প্রস্ফুটিত হতেই হবে
তাঁকে।
রাম ও অহল্যা -- দুজনেই পরস্পরের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে তাকেন।
রামের দৃষ্টি আর স্মিতহাস্য যেন উচ্চারণ করে নীরবে--
-
“আপনার
তপস্যা পূরণ হয়েছে মাতা। পূজনীয়া আপনি। লোকাচার প্রয়োজন নেই আপনার। তবু সমাজের জন্য
এই সম্মান স্বীকার করুন।”
রাম ধীরে ধীরে নত হন অহল্যার চরণ
স্পর্শের জন্য। সঙ্গী লক্ষ্মণও অগ্রজকে অনুসরণ করেন। সম্ভাষণ করেন বিশ্বামিত্র। এক
অপার্থিব সংলাপের জগৎ থেকে যেন বাস্তবের পৃথিবীতে এসে দাঁড়ান অহল্যা। রাম-লক্ষ্মণ
ও বিশ্বামিত্রকে আতিথ্য-সৎকারে পরিতৃপ্ত করেন। বিদায়কালে রাম আরও একবার দৃষ্টিপাত
করেন অহল্যার প্রতি। যেন বলতে ইচ্ছা করেন, “আর
কোনও বক্তব্য আছে দেবী?”
-
“ শুধু একটি
নিবেদন। আমারই ন্যায় অন্য কেউ যদি--”
-
“কেউ অপর
কারওর ন্যায় হতে পারে না। বিচারের ভারও কোন এক ব্যক্তির নয়, সমষ্টির,
যুগ-মানসিকতার। অথচ পরিস্থিতি ও চরিত্র ভিন্ন হলে ঘটনাপ্রবাহ ও তার অভিঘাত ভিন্নতর,
কঠিনতর যদি হয়, সে দায়, সে যন্ত্রণাও সমাজযূপে বদ্ধ ব্যক্তিকেই স্বীকার করতে হবে
একদিন।”
-
“কিন্তু এ
যে বড় নিষ্ঠুর, এ যে আত্মপীড়ন, আত্মজনপীড়ন!”
-
“জানি। আপনার
পাষাণ-সত্তা যে আমি গ্রহণ করলাম, দেবী।”
রাম-লক্ষ্মণ ও বিশ্বামিত্র বিদায় গ্রহণ করেন। মিথিলার উদ্দেশে
যাত্রা করেন তাঁরা। মহর্ষি গৌতম প্রত্যাবর্তন করেন আশ্রমে। জিজ্ঞাসা করেন -- “মুক্তি
লাভ করেছ অহল্যা?”
-
“করেছি”,
উত্তর দেন অহল্যা। অনুচ্চারিত রেখে দেন আরও কয়টি শব্দ, “কিন্তু অন্য এক ঋণবন্ধনে আবদ্ধ
হয়ে পড়েছি।”
***
বাল্মীকি-রামায়ণ অনুসারে, রাম অহল্যাকে পাদদ্বারা স্পর্শ করেন নি,
কেবল তাঁকে দৃষ্টিগোচর করেছিলেন, এবং পরে স্বয়ং বয়োজ্যেষ্ঠা সেই তাপসীর চরণবন্দনা
করেছিলেন। আর লোকগাথা বলে, বহুবর্ষ পরে সীতার পাতালপ্রবেশের সংবাদ শুনে নাকি
পুনরায় পাষাণী-সত্তা ধারণ করেছিলেন অহল্যা —
স্বেচ্ছায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন