রবিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

রুবী মুখোপাধ্যায়

 

রম্যরচনা


মনীষা ম্যাডাম বনাম ছেলেদের কাজ


আমি মনীষা মুখার্জি। রাঁধুনি হিসেবে আত্মীয় বন্ধু মহলে বেশ নামডাক আছে। কিন্তু তাই বলে দৈনন্দিন রান্না! ও আমার ধাতে পোষায় না। তা বললে কী হবে! বেশ কিছুদিন বাড়িতে রান্নার লোক নেই। ক’দিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসি বলে সেই যে গেল আর ফেরার নামটি নেই। আমি যে কারণের দোহাই দিই না কেন, পাড়াপড়শি, পরিচিত, সকলেই আমার সামনে চুপ করে থাকবে, আর আড়ালে বলবে, ‘হুঁ! নিজে থেকে চলে গেছে না ছাই! যা একখানা মেজাজ, ওবাড়িতে  লোক টেকে না।’ তবু আশায় আশায় থাকি, কাল নিশ্চয়ই কাউকে পেয়ে যাবো। সেই বিশ্বাস নিয়ে রাতে ঘুমুতে যাই। কিন্তু কাজের লোকের কলিং বেল আর বাজে না। আজ সকাল আটটায়, বিরক্ত হয়ে চায়ের জল চড়াই। এমন সময় ছেলে ডেকে ওঠে, ‘মা, একজন মহিলা এসেছে, বলছে রান্নার লোক। ডাকবো?’ ‘শিগগির ওপরে ডাক’, বলে প্রায় জামাই আদরে, না না বৌ আদরে তাকে ডাকি, ‘এসো এসো’!

বাঃ, বেশ দেখতে, ছিমছাম সাজগোজ। মনে মনে ঠিক করে ফেলি, একেই কাজে বহাল করব। মাইনে একটু বেশি চাইবে? কী আছে? দিয়ে দেব! মেয়েটি ওপরে এসে, আমার সামনে  দাঁড়িয়েই বলে — ‘মাসিমা, কথা যা বলার একটু তাড়াতাড়ি বলুন, আমার তাড়া আছে।’ আমি বলি, ‘সে কী! তাড়া থাকলে কী করে চলবে? আমার বাড়িতে তো তোমায় এই সময়েই রান্না করতে হবে!  মেয়েটি মাটির দিকে তাকিয়ে কী যে দেখল, ভগবান জানে। আমার দিকে ভুরু  কুঁচকে এমন করে তাকাল, যেন আমাকে অগত্যা উদ্ধার করে দিচ্ছে। তারপর বলল, ‘সে আমি মেনেজ করে নেব। এই তো কটা বাড়ির পরেই ছেলেরা থাকে, আমি সেখানেই আছি।’ ‘আছিস মানে, থাকিস নাকি সারাদিন ওখানে?’ ‘তা বলতে পারেন!’ ‘তাহলে আমার বাড়ির রান্না?’ — ‘সে আপনি চিন্তা করবেন না। ফাঁকে ফোঁকরে এসে ঠিক আপনার রান্না সেরে দিয়ে যাব। কিন্তু ছেলেদের কাজ ছাড়তে পারব না।’ — ‘কেন রে! আমরা কী মাইনে কম দিই, যে সব হামলে   পড়ে ‘ছেলেদের’ কাজের দিকে ছুটে চলেছিস? কী আঠা আছে বল তো?’ — ‘হ্যাঁ  মাসিমা, সে আপনি যাই বলুন, ওদের কাজে পয়সাও আছে, স্বাধীনতাও আছে। খিট খিট করার জন্যে আপনার মত বয়স্ক কেউ নেই কিনা!’ একে মা মনসা, তায় ধুনোর গন্ধ! একে মাসিমা, তার ওপর আবার বয়স্ক। সকাল সকাল বয়সের ওপর এই জোড়া আক্রমণে মনীষা ভেবে উঠতে পারছে না কী করবে। চোখ রাঙাবে, না-কি ডানহাতের মুঠো দিয়ে দেবে নাকের ওপর একটা  পাঞ্চ? না না না! তিষ্ঠ! আত্মসংবরণ কর, মনীষা! মনের কথা মনে রেখে সে বলে, ‘বাব্বা! তা আর কী সুবিধে সেখানে পাস শুনি?’

‘সে যদি বলেন তো, রান্না আমার ইচ্ছে মতন করি। তেল বেসি কি ঝাল কম — ওসব কথা বলার মত কেউ নেই মাসিমা। আর তা ছাড়া ওরা তো সবসময় এফএম চালিয়ে রাখে। গান শুনতে শুনতে কাজে বেশ মন লেগে যায়, জানেন!’ — অঃ, তা আর কী মধু আছে শুনি?’ — ‘কী যে বলেন মাসিমা, আপনাদের বয়স হয়েছে, কথার গন্ধে শুধু দোষ ধরেন। জানেন, দাদারা কী মিষ্টি করে জল চায়, আমার নাম ধরে কেমন ডাক দেয়, বলে, ‘জয়া, পানি দিজিয়ে না, একেবারে রান্নাঘরে ঢুকে আমার হাত থেকে জল নিয়ে যায়। গায়ে কী যে সুন্দর  গন্ধ, বাব্বা! ওরা কাজে বেরিয়ে গেলে আমিও লুকিয়ে লুকিয়ে ফুস ফুস করে একটু সেন্ট মেখে নেই। আপনার এখেনে কি আর তা পারবো?’

মনে মনে নরম হয়ে নিজেকে বলি, লুকিয়ে চুরিয়ে একটু আধটু সেন্ট মাখার পারমিশন না হয় আমিও দেব। কিন্তু মুখে তো সে কথা স্বীকার করা যাবে না। তাই বলি, — ‘আচ্ছা আচ্ছা, ওদের না হয় সবই ভাল, কিন্তু ওদের তো সবই করতে হয়, কাপড়কাচা, বাসনমাজা, ঘরমোছা, রান্নাকরা। আর পাস তো মোটে দেড় হাজার টাকা, তবে অত কথা বলছিস কেন রে?’ লাজুক মুখে জয়া বলে, ‘সে একটু ইদিক উদিক করে মেনেজ করি আর কি। ঘরমোছা, ও তো দাদারা ছুটির দিন ঘরে থাকলে, দেখিয়ে দেখিয়ে করি। অন্য দিন একটু ঝাড়ু মেরে দিই শুধু। আর আপনাদের মতন তো অত বেসি বেসি পদের রান্না হয় না। দুটোর বেসি পদ ওরা খায় না। আর জানেন, বলে দিয়েছি ছুটির দিন কিন্তু ছবি চালাতে হবে টিভিতে। আমি একটু একটু করে সিনেমা দেখি, আর বিজ্ঞাপন দিলে সেই ফাঁকে ফাঁকে রান্না করে নিই, দাদারা কিছু বলে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিনেমা দেখলে মাঝে মাঝে বিছানায় বসতেও বলে। — ‘থাম  থাম, আর বলতে হবে না, এবার আমার বাড়ির কাজের কথা শোন। — ‘ঠিক আছে, আগে  বলুন, কজন লোক? কটা করে রুটি খান, কটা করে তরকারি রাঁধতে হবে, কখন আসতে হবে, মাসে কটা ছুটি পাবো?’

প্রশ্নের বন্যায়, আমি, মনীষা ম্যাডাম, ভেসে যাই। উত্তর দেওয়ার মুড হারিয়ে ফেলি। হাত নেড়ে ভ্রু কুঁচকে ইশারায় চলে যেতে বলি মেয়েটিকে। আইটি সেক্টরে কাজ করা ‘ছেলেদের কাজ’ নয়, ‘প্রৌঢ় স্বামী’-র অফিসের ভাত রান্না করতে গ্যাস ধরাই।

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন