বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

 একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


 

(১৪)

 

কিন্তু কেন ও এমন করল? হৃদয় জানতে চাইল, আমার ভালোবাসার জন্য ও হঠাৎ এত মরিয়া হয়ে উঠেছিল কেন? 

বিশ্রুত বলেছিল, সবার কাছে যাকে ছোটো হয়ে থাকতে হয় অথচ যার মধ্যে বড়ো হওয়ার প্রচণ্ড জেদ রয়েছে, তারও আত্মসমর্থনের জন্য, প্রেরণার জন্য কাউকে লাগে। সম্মান ও ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে সেও মরীয়া হয়ে থাকে। ও তোকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল, তোর কাছ থেকে ভালোবাসা পাবে না জেনেও।

এইভাবেই হৃদয় ও অনির্বেদের মধ্যে সম্পর্ক জোড়া লেগেছিল। কিন্তু ভালোভাবে লাগেনি। ফাঁকফোঁকর অনেক থেকে গেছিল। সেগুলি যখনই সুযোগ পেত নিজেদের প্রকাশ করত। কিছুদিনের মধ্যেই ফুলের বাগান নিয়ে মেতে উঠল অনির্বেদ। বিশ্রুতের সঙ্গে ওর কিছুটা ঘনিষ্ঠতাও হলো। আর এই ঘনিষ্ঠতার সূত্রেই একদিন ফাঁকটা টের পেল হৃদয়। একটা পিকনিক হওয়ার কথা ছিল। রোববারের বিকেলে সমুদ্রের ধারে সবার উপস্থিতিতেই প্রস্তাবটা দিয়েছিল হৃদয়। সকলেই যে যার মতো করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল। অনির্বেদ কিন্তু চুপ করেই রইল।

হৃদয় জানতে চাইল, কী হয়েছে তোর? চুপ করে আছিস কেন?

অনির্বেদ কাঠ-কাঠ গলায় বলল, আমার হবে না, বাদ দে আমাকে।

এই ব্যাপারগুলোই ঠিক পছন্দ করত না হৃদয়। প্রথমে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। তারপর গলার ওই কাঠ-কাঠ ভাব। যদিও সবচেয়ে বেশী দুঃখিত হলো সে-ই। কথাটা বুঝিয়ে অন্যভাবেও বলা যেত। কোনও সমস্যা থাকলে সমাধানও খোঁজা যেত। কোনও সুযোগই দিল না অনির্বেদ।

পরদিন বিশ্রুত আসল কারণটা জানাল হৃদয়কে। বলল, পিকনিকের জন্য সবাইকে চাঁদা দিতে হবে।

অনির্বেদের পক্ষে সেটা এখন দেওয়া সম্ভব নয়।

হৃদয় একটু অসন্তুষ্টই হলো। বিরক্তি নিয়েই বলল, কথাটা ও সরাসরি আমাকে বললেই পারত। চাঁদাটা আমিই দিতাম।

বিশ্রুত চুপ করে রইল। পরে বলেছিল, ওর সঙ্কোচের যথেষ্ট কারণ ছিল। তুই ওর সমস্যার কথাটা কখনই ঠিকঠাক বুঝতি না। কেউ অভাবে বা দারিদ্র্যে আছে জানলে তার জন্য তোর মনে করুণা জেগে উঠত। আর ঠিক এটাই ও চাইত না। কারও কাছে করুণা চাওয়া ছিল ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। ওর মধ্যে অসম্ভব আত্মমর্যাদাবোধ ছিল। আসলে, নিজেকে ও কখনই তোর সমকক্ষ ভাবতে পারত না। তুই যে একদিন ওকে উপেক্ষা করেছিলি, জীবন থেকে বাদ দিতে চেয়েছিলি, সেটাও ও ভুলতে পারত না। ওর মধ্যে সব সময় একটা হীনমন্যতাবোধ কাজ করত। কিন্তু তাই বলে তুই ওকে করুণা করবি, সেটাও ছিল ওর কাছে অসহ্য। এরকম কোনও সম্ভাবনা দেখা দিলেই ও তাই নিজেকে সরিয়ে নিত বা রুখে উঠত। ওর মধ্যে একটা প্রচণ্ড কষ্ট হতো। এটা তো ঠিকই, তুই ছিলি সচ্ছলতায় অভ্যস্ত। ওর প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও তুই ওর বাস্তবতাকে ঠিক বুঝতি না।

তাহলে ও তোকে বলল কেন? হৃদয় জানতে চেয়েছিল।

কারণ আমি তোর চেয়ে বেশী বাস্তববাদী। আমাকে নিয়ে ওর মনে কোনও অভিমানও ছিল না। আমার ওপর একটু একটু করে ভরসাও করতে শুরু করেছিল ও। তাছাড়া ও জানত, আমি তোর খুব কাছের মানুষ। হয়তো ভেবেছিল, আমাকে বললে আমি তোকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে পারব। নতুন করে তোর সঙ্গে ওর কোনো ভুল বোঝাবুঝি হোক, সেটা ও একেবারেই চাইছিল না...

বিশ্রুতের কথা শুনতে শুনতে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেছিল হৃদয়ের। পুতুলের মেলায় মাটির পুতুল বিক্রি করছিল অনির্বেদ। পাশেই বসেছিল হৃদয়। কী একটা কাজে ওই মেলায় গেছিল সে। আগে থেকে জানত না সেখানে অনির্বেদের দেখা পাবে। এমন সময়ে একটি লোক সেখানে আসে। তারপর বেশ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেই অনির্বেদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগে না হৃদয়ের। হঠাৎ সে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, আপনি বোধহয় জানেন না, উনি শুধু একজন পুতুল বিক্রেতা নন, একজন শিল্পীও বটে!

লোকটি হঠাৎ কথা থামিয়ে দেয়। অনেকক্ষণ ধরেই একটি পুতুল নিয়ে সে দর কষাকষি করছিল। এবার অদ্ভুত চোখে তাকায় দু-জনের দিকে। তার মতো একজন মালদার ক্রেতার চোখে চোখ রেখে একজন তুচ্ছ পুতুল-বিক্রেতার হয়ে কেউ এমন জোরালো সওয়াল করতে পারে, এযেন তার ধারণার বাইরে! সে যেভাবে কথা বলছে, সেটাই তো কথা বলার রীতি! পালটা কেউ মেজাজ দেখাবে কেন? লোকটি আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে যায়। যাওয়ার আগে তীব্র, ঝাঁঝালো দৃষ্টি দিয়ে আঘাত করে যায় হৃদয়কে।

হৃদয় ভেবেছিল অনির্বেদ এই ঘটনায় খুশী হবে। কিন্তু অনির্বেদের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায়, হঠাৎ যেন সে খুব রেগে গেছে। হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে সত্যিই রাগে ফেটে পড়ে অনির্বেদ। বলে, কেন তুই এভাবে বললি? আমার একটা পুতুল বিক্রি হয়ে যেত!

হৃদয়ের মন খারাপ হয়ে যায়। এই দিক দিয়ে ব্যাপারটা সে মোটেই ভাবেনি। অনির্বেদ এই পুতুলের মেলায় এমনি এমনি বসে নেই। ওর মতো খেয়ালখুশী মেটাতে সে এখানে হাজির হয়নি। ও এসেছে অর্থের প্রয়োজনে। ওর পুতুলগুলো বিক্রি না হলে ওদের হাঁড়িতে ভাত চড়বে না। এখানে কে ওকে শিল্পীর সম্মান দেবে? সেই সম্মান নিয়েই বা ওর কী হবে? পুতুলগুলো বিক্রি হওয়া নিতান্তই প্রয়োজন। একজন তুচ্ছ পুতুল-বিক্রেতা হয়ে থাকলেই এখানে ওর লাভ। ওকে শিল্পী-টিল্পী বলে উঁচু করতে গেলে ওর শুধু লোকসানই হবে। তাছাড়া এই হট্টগোলের মধ্যে একজন অভাবী দরিদ্র শিল্পীকে দেখে লোকের করুণা ছাড়া কিছুই হবে না। হৃদয় আবার ওকে করুণার পাত্র করে ছাড়ল! হাসির খোরাক!

পিকনিকের সময় আবার একটা ঘটনা ঘটে। বিশ্রুতের জীবনে তখন দিশারী এসে গেছে। ডান্স কলেজে দু-জনে একসঙ্গে নাচ করত। এই দিশারীর বন্ধু সাঁঝা। দু-জনেরই খুব ফুলের বাগানের শখ। উৎসাহও খুব। সাঁঝকে নিয়ে অনির্বেদের মনে একটু একটু করে ভালো লাগা তৈরী হচ্ছিল। কিন্তু সঙ্কোচও খুব। সাঁঝ অত্যন্ত ধনী পরিবারের মেয়ে। তার ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। কিন্তু ওসব তো ভাবেনি অনির্বেদ। সাঁঝকে কেউ সুন্দরী বলবে না। কিন্তু তার অন্তরের সৌন্দর্যকে দেখতে পায় অনির্বেদ। তার মতো করে তার বন্ধুদের অন্য কেউই সেটা দেখতে পায় না। আর এটাই ভেতরে ভেতরে তাকে সাঁঝের ব্যাপারে ব্যাকুল করে তোলে।

 

(ক্রমশঃ)     


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন