কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৪ |
শূন্যপুর ১২
গুরুংদের তিন পুরুষ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল
সেই সকালে। খারকা বাহাদুর বিস্ফারিত চোখে চেয়েছিল তার উত্তরপুরুষদের দিকে। তার ফরসা
মুখ কালচে মেরে গেছিল। রতন গুরুং নিজের বাপ আর ছেলের, অতীত ও ভবিষ্যতের, ঠিক মাঝামাঝি
দাঁড়িয়েছিল। তার ইচ্ছে করছিল, টিভিটাকে আছাড় মারে। এগারো বছরের রঞ্জন গুরুং কিন্তু
চোখ সরাচ্ছিল না বুড়োর চোখের থেকে। ওর চোখের ভাষা পড়া যায় না।
নাতির সঙ্গেই বাওয়াল লেগেছিল আজ বুড়োর।
বুড়ো ক্ষেপে ছিল অবশ্য গত মাসখানেক।
বিলবস্তি গাঁয়ে হাজার দেড়েক লোকের বাস।
তার মধ্যে বাদ পড়ল শ পাঁচেক। খারকা তাদের একজন। পরিবারে সে একাই অবশ্য। লিস্টির বাইরে।
সাদিয়ায় ছুটোছুটি হল বিস্তর। বাবুরা বলল, বাপের লেগাসি কাগজে ভুল। তবে তেমন বড় ভুল
নয়। বড়জোর পাঁচ বছর জেল হতে পারে। জরিমানাও গুনতে হবে সেই সঙ্গে। বউ-ছেলে যতই বোঝাক, একই লেগাসি কাগজ দেখিয়ে তারা
পার পেয়েছে যখন, তখন নিশ্চয় ভুল হচ্ছে কোনো। ভুলটুকু বোঝার অপেক্ষা। সরকার বাহাদুরের
ভুল হয়? হলে তা বোঝায় কে? উকিলে বোঝাতে পারে? উকিলের টাকা কই?
সেদিন সকালে নাতি টিভি চালিয়েছিল। গলায়
টাই বাঁধা একটা লোক ব্যাজার মুখে খবর পড়ছিল। এটা সেটার পর সেই খবরে এল, যা নাতি শুনতে
চাইছিল। খারকা বাহাদুর। ন্যুব্জ চেহারা দেখে কে বলবে, সে ষোলোর তাগড়া রঞ্জনকে পিঠে
বেঁধে বাজারে নিয়ে যেত ছোটবেলায়? খারকা বাহাদুর, এখন বাহাত্তর, চৌকির কোণে চুপ মেরে
বসে থাকে। তবু তো থাকে। তাকে জেলে ভাবতে কষ্ট হয় রঞ্জনের।
অথচ ন্যুব্জ শরীরটা খাড়া হল। চোখে আগুন।
এলোমেলো তেড়ে এল। টলমলে পায়ে ঝাঁপালো রঞ্জনের উপর। যেন আঁচড়ে কামড়ে দেবে। যেন সে-ই
পাঠ করছে দুঃসংবাদ। যেন সে-ই ঘোষণা করছে মৃত্যুশমন। রতন বাহাদুর থামিয়েছিল বাপকে। বুড়ো
কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়েছিল বাপের। হুঁশ ফিরে পেয়ে, বুড়ো ঢুকে গেছিল নিজের কোটরে। রাতে রঞ্জন
ঘুমোতে পারেনি। একটা অশক্ত লোক তার দিকে, তা টিভির দিকে, বা অদেখা শত্রুর দিকে নড়বড়িয়ে
তেড়ে আসছিল স্বপ্নে বারবার।
সকালে বাপের ধাক্কার ঘুম ভাঙল। আছাড়ি
পিছাড়ি কান্না। দুই উত্তরপুরুষের ধাক্কায় আগল ভাঙল যখন, ততক্ষণে দাদুর চোখ ঠিকরে বেরুচ্ছে।
পুলিশ বেলা গড়ালে এসেছিল। বিছানা ওল্টাতে
চিঠি পাওয়া গেছিল। দুই উত্তরপুরুষকে লেখা চিঠি, নেপালি ভাষায়। ইন্সপেক্টার বিজাতীয়
চিঠি সন্দিগ্ধ চোখে তুলে দিয়েছিল রতনের হাতে। পড়ে মানে বোঝাতে বলেছিল।
হিয়ারিং-এর তারিখ মনে করিয়ে দিয়েছিল
খারকা বাহাদুর। ছেলে-নাতি যেন হাজিরা দেয়। ইন্সপেক্টর বলেছিল, 'স্ট্রেঞ্জ! মরার পর
নাগরিকত্ব পেলেই বা কী? না পেলেই বা কীসের মাথাব্যথা?'
ইন্সপেক্টর দেখেনি, সেই সময় রঞ্জনের
চোখদুটোও আগুনে হয়েছিল। ভাগ্যিস! বাপের বদলে এবার ছেলেকে চেপে ধরেছিল রতন। ভাগ্যিস!
মরণোত্তর নাগরিকত্বের লোভ তখনও চোখ ঠিকরে
বেরোচ্ছিল খারকার চোখ থেকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন