বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

অচিন্ত্য দাস

 

(মসীচিত্র)

 

সবুজ উপবন ও রাজপথ




নিউ ইয়র্ক যে এক বিরাট মহানগর তাহা সকলেই জানে। তবে মহানগর বলিলে কম বলা হয়। একটির বদলে পাঁচটি মহা লাগাইলে উপযুক্ত হইতে পারে। কারণ এই নগরে পাঁচ-পাঁচটি বৃহৎ আকারের উপনগর রহিয়াছে – কুইনস্, ব্রঙ্কস্, ম্যানহাটন,স্টাটেন আইল্যান্ড এবং ব্রুকলিন। ব্রুকলিনের আটত্রিশ নম্বর রাস্তা হইতে ছাব্বিশ নম্বর রাস্তার দিকে চলিতে থাকিলে দক্ষিণ হস্তে পার্ক বা উদ্যান জাতীয় বিস্তৃত এক অঞ্চল নজরে পড়িবে এবং তাহার পর একটি অদ্ভুত দর্শন তোরণ দেখা যাইবে। অদ্ভুত বলিতেছি কারণ ইহার আকৃতি ও নকশা বা এককথায় যাহাকে স্থাপত্য বলা হইয়া থাকে তাহা সচরাচর চোখে পড়ে না, অন্তত আমি দেখি নাই। সাধারণ পিঙ্গল আভাযুক্ত প্রস্তরে নির্মিত প্রবেশদ্বারটিতে অতিশয় গম্ভীর ভাবের সহিত খানিক শান্ত ও সমাহিত ভাব মিশিয়া গিয়াছে। কিছুক্ষণ দেখিলে অবশ্য চোখ সহিয়া যায়। কিন্তু ভিতরে যে দিকে সূর্যালোক পড়ে নাই, সেদিক হইতে তোরণটি কৃষ্ণবর্ণের এবং অন্যরকম দেখাইতেছিল। মনে হইল ইহাতে কেমন যেন একটি অজানা ভয় মিশ্রিত ভাব রহিয়াছে। লেখা রহিয়াছে – ‘আফটার দ্য এন্ড’ যাহার বাংলা করিলে হইবে ‘শেষের পরে’। মনে মনে দু-একবার বলিবার পর মনে হইল ইহা অপেক্ষা ‘সমাপ্তির পরে’ ঠিক শোনাইতেছে। ওই তোরণ সোজা-বাংলায় ‘যমের দুয়ার’ ছাড়া আর কিছুই নহে। এই স্থানটির নাম গ্রীন-উড। মনে মনে বাংলা করিলাম – সবুজ উপবন। ইহা একটি সমাধি-ক্ষেত্র।   

তোরণ পার হইয়া সত্যি কথা বলিতে মুগ্ধ হইয়া যাইলাম। যেন ফ্রেমে বাঁধানো একটি সুন্দর ছবির ভিতরে প্রবেশ করিয়াছি। পিচের রাস্তা আঁকিয়া বাঁকিয়া সবুজ মাঠের মধ্য দিয়া এদিকে ওদিকে নান ভাগে বিভক্ত হইয়া চলিয়া গিয়াছে। বহু সংখ্যক বৃক্ষ রহিয়াছে – দু-একটি বৃক্ষ এখনও এই শীতের বাতাস উপেক্ষা করিয়া বহুবর্ণ পত্রের শেষ প্রদর্শনী ধরিয়া রাখিয়াছে। অধিকাংশ বৃক্ষ অবশ্য পত্রপুষ্পহীন, ডালপালা মেলিয়া বসন্তের অপেক্ষায় রহিয়াছে। স্থানটি ঠিক সমতল নহে। কোথাও ঢালু আবার কোথাও স্বল্প উচ্চতার টিলা। আঁকাবাঁকা রাস্তার পাশে শতশত সমাধি-প্রস্তর প্রথিত। সমাধি ফলকও রহিয়াছে বহু। এই সবুজ উপবন অনেকখানি এলাকা লইয়া – এদিক হইতে ওদিক যাইতে বহু সময় লাগিয়া যাইবে। আশেপাশে যাহা ছিল তাহাই দেখিতে লাগিলাম। সমাধি ফলক (এপিটাফ) গুলি যেন আমাকে আকর্ষণ করিতেছিল। অবাক হইয়া দেখিলাম এইদিকের সমাধিগুলি উনবিংশ শতকের। ১৮৩০ হইতে ১৮৯০এর মধ্যে মৃত্যু হইয়াছে এমন মানুষের ফলকই বেশি রহিয়াছে। মাইকেল মধুসূদনের বিখ্যাত পংক্তি মনে পড়িল – দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে তিষ্ঠ ক্ষণকাল…। মনে হইল ইহারাও যেন আমাকে শব্দহীন ভাষায় ডাকিয়া বলিতেছে – দাঁড়াও পথিকবর, দূরদেশে জন্ম তব জানি, তবু তিষ্ঠ ক্ষণকাল…

একদিন ইহারা সকলে বাঁচিয়া ছিল। পাথরে তাহাদের নাম এবং কাহারো ক্ষেত্রে তাহাদের জীবনী কয়েকটি লাইনে বাঁধা রহিয়াছে। কেহ সৈন্যদলে কাজ করিত, কেহ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করিয়াছে। কোনো সুখী-সংসার হইতে সন্তানসন্ততিরা তাহাদের পিতা ও মাতাকে একই স্থানে সমাধিস্থ করিয়া লিখিয়াছে ‘মৃত্যুর পরেও একসঙ্গে…’। উপবনে একটি জলাশয় দেখিলাম। স্বচ্ছ  নিবিড় জল। দু-একটি রাজহাঁস অলস ভাবে ভাসিতেছে। ইহারা কী জানে এই  জলাশয়ের চারিদিকের প্রস্তর ফলকগুলি কী কারণে নির্মিত? শুনিলাম এই উপবনের সরোবরে নাকি অনেক জলচর পাখি দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু এই  শীতের দিনে তাহারা উষ্ণতার খোঁজে দক্ষিণপানে চলিয়া যায়। জলাশয়ের তীরে অনেকগুলি সমাধি রহিয়াছে, এইগুলি নিশ্চয় ধনী ব্যক্তিদিগের কারণ সমাধিগুলি এক-একটি নিরেট কক্ষের ন্যায়। বেশি জমি লাগিয়াছে, পাথরের মূল্যও নিশ্চয় অধিক পড়িয়াছে। ইঁহারা জলাশয়ের কিনারা কেন বাছিয়া লহিয়াছেন তাহা জানা নাই। কী দেখিতেছেন? তাঁহারা কী জল ভালবাসিতেন, নাকি সরোবরে ছিপ ফেলিয়া মাছ ধরিবার নেশায় সারাবেলা জলের ধারে কাটাইতেন! এরূপ এটি সমাধি-কক্ষের সামনে দেখিলাম দুটি পাথরের কুকুর রহিয়াছে। আজ তাহারা কেহই নাই, শুধু সমাধিস্থ মানুষটির তাহাদের প্রতি ভালোবাসা এবং তাহাদের প্রভুভক্তি পাথরের অবয়বে আজও জীবন্ত রহিয়াছে। এতদিনের ব্যবধানে এই দূরদেশের পথিকের কাছে তাহা কেমন অনায়াসে পৌঁছিয়া যাইল।

পথপার্শ্বে একটি আবক্ষ মূর্তি দেখিয়া আগাইয়া যাইলাম। মহাশয়ের নাম ডি এম বেনেট। এপিটাফে লেখা রহিয়াছে যে ইনি উনিশ শতকে সামাজিক কুসংস্কার দূর করিবার কাজে লিপ্ত ছিলেন। উপরে লিখিত আছে যে এই প্রস্তর-সমাধির ব্যায়ভার বহন করিয়াছে ইঁহার সহস্রাধিক গুণমুগ্ধ শিষ্যগণ।

দেখিতে দেখিতে বেলা হইল, সাড়ে-দশটা বাজিয়া গিয়াছে। শীতের বাতাস তেমনই বহিতেছে, এই দেশের রৌদ্র তেজহীন এবং ইহাতে আমাদের দেশের শীতের রৌদ্রের মতো আরামদায়ক উষ্ণতা নাই।

একস্থানে দেখিলাম একটি পরীর মূর্তি, পাশে একটি বালিকা। কালের প্রকোপে মূর্তির মসৃণ ভাব চলিয়া গিয়াছে, তবু গড়ন ভারি চমৎকার। নিকটে যাইয়া দেখিলাম ইহা মাতা ও কন্যার সমাধি। মাতার মৃত্যু ১৮৬৭তে এবং তাহার মাত্র ছয় মাসের ভিতর তাহার বাইশ বছরের কন্যা এডিথ মারা গিয়াছিল। এই সমাধির সামনে দাঁড়াইয়া মুহূর্তে মনে হইল কোনো অদৃশ্য যন্ত্রী যেন এই হিমেল  নির্জন প্রভাতে তোড়ি রাগিনীতে আলাপ করিতেছেন। তীব্র মধ্যম – কোমল ধৈবত – শুদ্ধ নিষাদ লইয়া এমন আশ্চর্য মীড় দিতেছেন যে চরাচর জুড়িয়া অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা নামিয়া আসিতেছে। ছবি তুলিবার সময় মনে হইল সে বিষণ্ণতা ক্রমশ আমাকে ছাইয়া ফেলিতেছে।

বিষণ্ণতার ভার আর সহিল না। কালক্ষেপ না করিয়া সবুজ উপবনের  মানুষজনদের পিছনে ফেলিয়া নিকটতম দ্বার দিয়া বাহির হইয়া বড় রাস্তায় আসিয়া দাঁড়াইলাম। ব্যস্ত শহর। রাজপথে সোঁ সোঁ করিয়া গাড়ি, বাস, ট্রাক চলিতেছে। ফুটপাথের লোকজন কাজের তাড়ায় হনহন করিয়া হাঁটিতেছে। ফোন বাহির করিলাম এবং গুগুল ম্যাপ দেখিয়া আবাসনে ফিরিবার সংক্ষিপ্ততম পথটি ধরিলাম। পথটি বেশ অপরিষ্কার – ফুটপাথে প্লাসটিকের পাত্র, বোতল ইতস্তত পড়িয়া আছে। কাগজ, খাবারের অংশ, পিচবোর্ডের বাক্সের ভগ্নাবশেষ চোখে পড়িতেছে। কৃষ্ণাঙ্গ এক যুবক খানিক দৃষ্টিকটু ভাবে তাহার সঙ্গিনীকে ঘনিষ্ঠভাবে জড়াইয়া রাস্তা পার হইয়া গেল। দুইটি হাইস্কুলের কিশোর একটি প্লাসটিকের বোতলে ফুটবলের মত কিক মারিয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল ট্রাফিক বাতি অমান্য করিয়া। পাশে একটি ওয়ার্কশপ, ইহাদের পাতালরেলের কামরা সারাই করিবার স্থান। তিনটি কর্মচারী কী একটি রসিকতায় হো হো করিয়া উচ্চস্বরে হাসিয়া উঠিল। একটি ছোট কমদামী রেস্তোঁরা জাতীয় দোকান হইতে কফির গন্ধ আসিতেছে। এক নেশারু বৃদ্ধ টলমল করিয়া সে দোকানের দরজা ধড়াম করিয়া ঠেলিয়া ঢুকিয়া পড়িল।

সবুজ উপবনে যাহা দেখিলাম তাহার টাটকা স্মৃতি তখনও মনে আসা যাওয়া করিতেছে। আর ফোনের ভিতর তো ডজন খানেক আলোকচিত্র ইলেক্ট্রনিক সংকেতে সঞ্চিত থাকিবে। যখন খুশি দেখা যাইতে পারে। যাহা হউক, দেখিবার মতো একটি জায়গা দেখিলাম বটে। তবু সেই ছবির মতো সুন্দর সবুজ উপবন অপেক্ষা এই অপরিচ্ছন্ন পথ, আদব-কায়দার তোয়াক্কা না করা মানুষগুলি – আমাকে নিশ্চিতভাবে অধিক আকর্ষণ করিতেছিল। মনে মনে বুঝিতে পারিলাম জল ও অক্সিজেনের ন্যায় বাঁচিয়া থাকিবার জন্য এই আকর্ষণটুকু ভীষণ ভীষণ প্রয়োজনীয়।  


1 টি মন্তব্য: