বন্ধু
তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও
আমরা দুজনে একই সঙ্গে একই বছরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রি তে এম এস সি পাশ করেছি! ও তারপর পি এইচ ডি করতে এদেশে আসে আর আমি এপ্ল্যায়েড কেমিস্ট্রিতে ঢুকি! আমাদের ব্যাচের আরও কিছু ছেলেরা তখন এ দেশে এসেছে, কিন্তু আমি ঠিক সেরকম করে বন্ধুদের সঙ্গে মেশার বড় একটা সুযোগ পাইনি! আমার বাবা সায়েন্স কলেজেই কাজ করতেন, টিফিনে বাবার সঙ্গে কলেজে যাওয়াটা বরাদ্দ ছিলো! আর ক্লাস শেষ হলেই আমার পিসি, একদফা টিফিন খাইয়ে রবিতীর্থে সুচিত্রাদির কাছে গানের ক্লাসে নিয়ে যেত! এই নিয়ে অনেকেই আমাকে আড়ালে ‘খুকুমনি’ বলে ডাকত! আমার আর বাবার টিফিনটা বাবার বেয়ারা করে দিত, আর বাবার ঘরে বসেই খেতাম! অনেক সময় এমন হয়েছে, আমরা ক্লাসে কিন্তু তখন প্রফেসর আসেননি! আমি উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কমল বলে একটি ছেলে উঠে বলল, ‘দাঁড়াও এখনো খুকুমনির খাওয়া শেষ হয়নি, তাই স্যার অপেক্ষা করছেন!’
আর একবার ক্লাস হচ্ছে তার মধ্যে কেউ যেন চেয়ার ভেঙে সশব্দে পড়ে গেল! স্যার দেখতে পাননি যে কে পড়ে গেল! জিজ্ঞেস করলেন, '’কে পড়ে গেল?’ সঙ্গে সঙ্গে কমল বলে উঠল, ‘কে আবার? নিশ্চই খুকুমনি’! সুতরং এদের সঙ্গে আমার খুব হৃদ্যতা ছিল না!
যাইহোক যে গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম সেইখানে ফিরে যাই! আমার এখনকার রুমমেট এদেশে চলে আসার মাস তিনেক বাদে আমাদের এক বন্ধু, দেবাশীষ, যার সঙ্গে আমার ভালোই আলাপ ছিল, সে এদেশে এলো! আমার এই বন্ধুটির একটা গুণ যে ও রেখে ঢেকে কিছু বলতো না, সেটা আমার ভালো লাগতো! সে পোর্টল্যান্ডে পি এইচ ডি করতে এলো! আসার আগে আমাকে ভুরু নাচিয়ে, মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি, রাহুলকে কিছু পাঠাবে নাকি?’
আমি খুশি ও এককথায় রাজি! তখন আমার
সবচেয়ে প্রিয় বই সঞ্চয়িতা! আমার অনুরোধে ও একটা সঞ্চয়িতা নিতে রাজি হ'ল! আমি
ওর কাছে সত্যিই খুব কৃতজ্ঞ! এতো মোটা ও ভারী একটা বই কেউ নিতেই চাইতো না!
এরপর প্রতীক্ষার পালা! বেশ কিছুদিন ধরে
অপেক্ষা করে রইলাম! ও নিশ্চই হঠাৎ বইটা পেয়ে খুব অবাক হবে, আর আমাকে জানাবেও! অপেক্ষাই
সার, আমি কোনো প্রাপ্তিসংবাদ পাইনি! শেষে মুখফুটে জিজ্ঞেসও করেছি, বলেছে তখনও
পায়নি! তারপর সময় কেটেছে আমিও ভুলে গেছি বইয়ের কথা!
এই ঘটনার তিন বছর বাদে আমি এদেশে এলাম! তখন সব সময় বাড়ির জন্যে মন কেমন করতো! বিদেশে আসার আগে বন্ধুরা বলেছিল, ‘তুই কি লাকী, আমেরিকায় হানিমুন করতে যাচ্ছিস!’
এখানে এসে মনে হ'ল কি মরতে এ দেশে এলাম!
এ কোন গন্ডগ্রামে এসে পৌঁছলাম! পুলম্যান আর পাঁশকুড়ার (সেই সময়ের) মধ্যে তফাৎ
শুধু এখানে একটা বড় ইউনিভার্সিটি আছে! মনে হত একটা ডানা পেলে উড়ে দেশে ফিরে যেতে
পারতাম! বিশেষ করে একটু জ্বরজারি হলে, বা শরীরটা গড়বড় করলে!
দেশে আমার যদি একটু জ্বর হলে একটা দেখার জিনিস হত! বাবা কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর মুখে মিষ্টি মিষ্টি হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিয়ে যাচ্ছে! আমাদের হাউস ফিজিশিয়ান, আমার ডাক্তারকাকা এসে মিক্সচার আর পুরিয়া দিয়ে গেল! জ্যেঠু কোর্ট থেকে ফিরেই নাড়ি দেখতে বসে গেল, যেন ওকালতির সঙ্গে ডাক্তারিও পাশ করেছে! কাকার মেয়ে বলতে আমরাই, সারারাত নিজেও ঘুমোতো না আর আমাকেও ঘুমোতে দিত না! পাশে বসে কনস্ট্যান্ট বিড়বিড় করে বলে যেত, ‘ঠাকুর আমি তো জীবনে কোনো অন্যায় করিনি, আমার মেয়ের কেন কষ্ট হবে! ওকে ভালো করে দাও ঠাকুর!’ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই এটেনশন পেতে পেতে আমি এভাবেই যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম! তখন হিসেবে করতাম, কোন পিসা এখনো দেখতে আসেনি, কাকাভাই ফোন করেছিল কি না, জাম্মা কবার ঘরে এসে দেখে গেল ইত্যাদি ইত্যাদি! আর আমার মা, যাকে আমি বৌদি বলতাম, সে এতো আদর ঠেলে আমার কাছে আসার সুজোগই পেত না!
আর একটা বদ অভ্যেস ছিল, যা কিছু আমার
মনের মধ্যে থাকতো প্রকাশ করতাম না, ঘুমের ঘোরে সে সব কথাই বলতাম, কাঁদতাম! মা (আমার
ঠাকুমা) ঠেলে জাগিয়ে দিয়ে বলতো, ‘পাস্ ফিরে শো, তাহলে আর খারাপ স্বপ্ন দেখবি
না!’
এবার পট পরিবর্তন, এদেশের কথা! আমি এখানে আসার প্রায় মাসতিনেক বাদে একদিন আমার বর ল্যাব থেকে খুব উত্তেজিত হয়ে ফোন করলো যে সামনের শুক্রবার দেবাশীষ আসছে, ওদের লং উইকএন্ড, তাই তিনদিন থাকবে! দেবাশীষ আমারও ভালো বন্ধু তাই আমার আনন্দ দেখে কে! এই প্রথম একজন তৃতীয় ব্যক্তি থাকবে আমাদের সঙ্গে, তার ওপর সে আমাদের দুজনেরই বন্ধু, দুজনেরই ক্লাসমেট! আমরা দু-ঘরের ফ্ল্যাটে থাকতাম! দেবাশীষের জন্যে একটা ঘর ভালো করে সাজিয়ে দিলাম! বিছানায় দেশের চাদর, সাইড টেবিলে এমব্রয়ডারি করা টেবল ক্লথ, হ্যাঙ্গারে নতুন তোয়ালে! হৈ হৈ করতে করতে শুক্রবার এসে গেল!
দেবাশীষ এলো আমাদের কাছে! বাড়ি এসে আমাকে দেখেই প্রথম কথা, ‘একি! তুমি এদেশে এসেও তো সেই পাড়া গাঁইয়াই রয়ে গেছ?’
আমি কিছু মনে করিনি, কারণ দেবাশীষ
চিরকালই একটু ঠোঁটকাটা, আর বেশ জোরে জোরে কথা বলে! ও আগেও এমনই ছিল!
আবার এ কথাও বললো, ‘আই এম জাস্ট কিডিং!
এখানে এসে তো কেউ শাড়ি টাড়ি পরে না, তাই
অনেকদিন বাদে কারুকে শাড়ি পরা দেখে ভালো লাগলো! বাই দা ওয়ে, তোমাকে বলতে ভুলে
গেছি, তোমার দেওয়া সঞ্চয়িতাটা আমার আর পাঠানো হয়নি! সরি, ওটা আমিই বের করে মাঝে
মাঝে পড়ি!’
এবার একটু রাগই হল! তবে বন্ধু বলে সব দোষ মকুব! আমরা সেদিন সন্ধ্যে থেকে প্রায় রাত দেড়টা পর্যন্ত কত গল্প, কত গান করলাম! খুব ভালো লাগলো! আড্ডা ছেড়ে কেউ আর উঠতেই চায় না লিভিংরুম থেকে! শেষে 'ও' বলল, এখানেই দুটো ম্যাট্রেস তুলে এনে বিছানা করি, তিনজনে শুয়ে শুয়ে গল্প করব! হায় রে আমার ঘর সাজানো, দেবাশীষ আসার পর থেকেই সেই যে লিভিংরুমে গেঁড়ে বসেছে, একবারও ঘরে যায়নি! এখন তো সে ঘর লন্ডভন্ড! দু-ঘর থেকে দুটো ম্যাট্রেস তুলে আনা হয়েছে, তার ওপর চাদর পেতে বিছানা হলো!
সেদিন ভোরের দিকে আমার শীত করছিল, ছটফট করছিলাম! একটু গা’টা গরম! থার্মোমিটার নেই, ও তাই আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘জ্বর নয়, তবে গা গস গস করছে, ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে’!
শনিবারটা তবু উঠে রান্না করলাম, একটু আধটু গল্পও করলাম, কিন্তু শরীরটা যেন ঠিক বইছে না! ওরা অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা মেরে কখন ঘুমিয়েছে তা আমি জানতাম না! আমি অনেক আগেই লিভিংরুমের ঢালা বিছানার এক কোণে গুঁড়িসুড়ি মেরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! রবিবার আমাদের টাকো খেতে যাবার কথা, কবে থেকে অপেক্ষা করে আছি! তখন তো সচরাচর বাইরে খাওয়া হত না! তাই বাইরে খেতে যাওয়ার একটা আলাদাই আনন্দ!
আমার গায়ে বেশ জ্বর! এমনিতেই আমি একটুতেই কাবু, তার ওপর আবার বিদেশ বিভুঁয়ে! শুনতে পাচ্ছি কিচেনের কিচিরমিচির! আটটা ডিমের ওমলেট হচ্ছে লাঞ্চের জন্যে! খেতে বসে কিছুই খেতে পারলাম না, শুধু একটু স্প্রাইট! কেবলই চোখে জল আসছে, বাড়ির জন্যে মন কেমন করছে! রাগ হচ্ছে, মনে হচ্ছে কেন মরতে এ দেশে এলাম, এখানে জ্বরজারি হলে কেউ দেখার নেই! যদিও ও মাঝে মাঝে এসে আমাকে দেখে যাচ্ছে!
শুনতে পেলাম দেবাশীষ ওকে বলছে, ‘বারবার ওকে বিরক্ত করিস না, ভালো করে ঘুমিয়ে শরীরটা রেস্ট নিতে দে, তাহলেই দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে’!
এদিকে চোখ বুজলেই বাড়ির সবাইকে দেখতে
পাচ্ছি, আর নিঃশব্দে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে যাচ্ছি!
সন্ধ্যেবেলা ‘টাকো বেলে’ খেতে যাবার কথা, 'ও'যেতে রাজি হল না! দেবাশীষের বক্তব্য, ‘ও তো ঘুমোচ্ছে, আমরা ঘন্টা দুয়ের জন্যে ঘুরে আসলে ও জানতেও পারবে না’!
আমি কান খাড়া করে শুনছি! যাইহোক 'ও'র
আপত্তিতে ওরা খেতে গেল না, বাড়িতে পিৎজা অর্ডার দিল! একা আমি থাকতে পারি না, ভয়
করে! ওরা বাড়ি আছে জেনে আমি সন্ধ্যে থেকেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! আমি তখন
বাড়ির স্বপ্নে বিভোর, দেখছিলাম আমার শরীর ভালো নেই জেনে পিসা দেখতে এসেছে অমৃতি নিয়ে, তাতা -
ছোটদুও এসেছে, একঘর লোক! মা মাথায় ঠান্ডা হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ শুনতে পেলাম
কেউ আমাকে খুব জোরে জোরে নাড়া দিয়ে কি বলছে! আমার ঘুমটা ভেঙে গেল! আমি থতমত হয়ে
উঠে জিজ্ঞেস করলাম, 'কি হয়েছে'?
'ও' বলল, ' কিচ্ছু না, তুমি হয়তো কোনো
ভয়ের স্বপ্ন দেখেছিলে, তাই কাঁদছিলে! জল খাবে? আবার ঘুমোনোর চেষ্টা করো'!
কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন থেকে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম!
কিছুক্ষণ পর আবার ডাকাডাকি, 'কি হল
তোমার? কষ্ট হচ্ছে? ঘুমোতে পারছো না'?
দেখলাম দেবাশীষ বালিশ নিয়ে শোবার ঘরে
চলে গেল! সকালবেলা একটু জোর করেই উঠলাম, দেবাশীষ চলে যাবে, একটু লাঞ্চ করে দেব!
ততদিনে কয়েকটা খাবার করতে শিখেছি, ফ্রেঞ্চ টোস্ট আর সুজির হালুয়া করে দিলাম!
দেখলাম দেবাশীষ খুব একটা কথা বলছে না, বেশ চুপচাপ! আমিই বললাম, ‘সাবধানে যেও, আর পৌঁছে একটা
ফোন কোরো’! তারপর আমি আস্তে করে ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম! 'ও'
একবার এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কিছু খাবে না? আচ্ছা একটা ডিমসেদ্ধ করে দিই খাও,
নইলে গায়ে জোর পাবে কি করে?'
'আমি কিচ্ছু খেতে পারছি না, বমি হয়ে
যাবে', বলে মূড়িসুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম! মনে মনে ভাবছি, ম্যাগো ডিম্ সেদ্ধ? আমি
সুস্থ শরীরেই ডিম্ সেদ্ধ খাইনা, আর এখন জ্বরমুখে খাবো? আমার তখন বৌদির (মা'র) করা
আলু-মরিচ খেতে ইচ্ছে করছে! ঘুম আসছে না, পেটে ক্ষিদে নিয়ে ঘুম হয়?
ওরা লিভিংরুমে বসে কথা বলছে! দেবাশীষ
ভেবেছে আমি ঘুমোচ্ছি! একটু নিচু গলায় ওকে বলছে, 'শোন, তোর সঙ্গে একটা সিরিয়াস
কথা আছে! তোর জন্যে আমার বেশ চিন্তা হচ্ছে! তুই স্বপ্নাকে কাছের থেকে কতদিন
দেখেছিস? ক্লাসে বন্ধুদের সঙ্গে তো আমরা সবাই মিশেছি, কিন্তু তাতে তো আর কার ভেতরে
কি রোগ আছে তা জানা যায় না! আগে কোনো খোঁজখবর নিয়েছিলি? ওর যে মাথার গন্ডগোল
আছে, সেটা কি জানতিস? আগেই ছিল, না ইদানিং সূত্রপাত হয়েছে? সময় থাকতে একটা কিছু
কর, নইলে ভবিষ্যতে তোকেই পস্তাতে হবে! আমার আর কি দুদিনের জন্যে এসেছি, আজই
ফিরে যাবো, তোর জন্যেই আমার কষ্ট হচ্ছে!'
এই হল আমার বিদেশে কাছে পাওয়া দেশের
বন্ধু!
তবে দেবাশীষকে আমি দোষ দিই না! ওর ওপর আমার রাগ? নাহঃ, তাও আর নেই! একঅর্থে কথাটা তো ঠিকই বলেছিল! একপথে দুজনে অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করা মানেই যে তারা পরস্পরের বন্ধু হবে তার তো কোনো স্থিরতা নেই! হয়ত কিছু পরশ রেখে যায়! সে পরশ হয় কখনো তিক্ততার আবার কখনো স্নিগ্ধতার, কখনো ভালোবাসার! এমনকি চিরদিনের সাথীকেও কি আমরা সঠিক চিনতে পারি? তাকে প্রতিদিন এক নতুন চোখে দেখার চেষ্টা করি, অন্য ভাবে চিনি, অন্য সুরে ছন্দে বাঁধি, যাতে জীবন হয় ছন্দময়, গতিময়, হয় সুন্দর!
আজ মন বলে, পথে চলে যেতে যেতে কোথা কোন্খানে তোমার পরশ আসে কখন কে জানে-- বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও--
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন