বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

চিরশ্রী দেবনাথ

 

সমকালীন ছোটগল্প


ঊনকোটি সামার ক্যাম্প  

রাত্রি প্রায় শেষ, ঊনকোটি সামার ক্যাম্পে, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে অজস্র ঘর থেকে মনোরম আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে, এই আলো কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে দেখা যায়, কিন্তু তীব্র নয়, চোখে ব্যথা দেয় না। পাহাড়, উপত্যকার সারিবদ্ধ গাছগুলোর

মাথায় মাথায় কুয়াশার হালকা প্রলেপ, এখন বসন্তকাল শেষের পথে, পৃথিবীর বুকে নামবে চিরচেনা গ্রীষ্মকাল, বহুকাল আগে এইসময়টিকে বাংলায় বলা হতো চৈত্রমাস।

এখন এভাবে সময়কে চিহ্নিত করার প্রথা উঠে গেছে, তবে সংরক্ষণাগারে আদিম পৃথিবীর সমস্তকিছুই যত্ন সহকারে রাখা হয়েছে, যা পাওয়া গেছে তাই, কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক, পুরনো মুঠোফোন, এইসব ঘাঁটাঘাঁটি করে নানা উপায়ে সচল করার চেষ্টার জন্যও রয়েছে বিশেষ টিম, তবে এইসমস্ত কাজই খুব গোপনীয়, কারণ তখনকার হিংসাপ্রবণ মানুষের মনন ও বোধ অনেক কিছুই বন্দি ছিল মুঠোফোনের সূক্ষ্ম মস্তিস্কে।

পুরো সামার ক্যাম্পের দায়িত্বে রয়েছেন, মিঃ মৌনপতি, ৪০০১এর প্রতিভাশালী বৈজ্ঞানিক। সামার ক্যাম্পের চারধারে বন জঙ্গল, পশু পাখি, সবার যথেচ্ছ বিচরণ। ঊনকোটি পর্বতসারির নিচে দুরন্ত সমুদ্র, দ্য বে অব গ্রীন, সমুদ্রের জল এখানে সবুজাভ, প্রতিটি ঢেউ সবুজ জল নিয়ে ছুটে আসে। মাঝখানে ভেসে রয়েছে অসংখ্য দ্বীপ। দ্বীপগুলোতে বিভিন্ন রকম ফসলের চাষ হয়। যে মাটি যার উপযুক্ত। বহু আগে মানুষ ধান, গম, বাজরা, ভুট্টা, বিভিন্ন তৈলবীজ এসব ফসলের চাষ করতো। এখন বদলে গেছে খাদ্যশস্যের প্রকৃতি, স্বাদ, রঙ, গন্ধ, গুণাগুণ।
আসলে ‘সৃষ্টি 2’ নামক ভয়াবহ গ্রহাণুটি যখন পৃথিবীতে আঘাত হানলো, ধংস  হয়ে  গেলো পৃথিবীর এক বিরাট অংশ। বদলে গেল ভূপ্রকৃতি, আবহাওয়া। গ্রহাণুটি যেসময় পৃথিবীর বুকে আঘাত হেনেছিল, তখন পৃথিবীতে চলছিল পঞ্চম পরমাণু  যুদ্ধ। পৃথিবী এমনিতেই সেসময় ক্ষতবিক্ষত। মানুষ ধুঁকছিল তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকারক প্রভাবে। বিকলাঙ্গ শিশুতে ভর্তি পৃথিবী যেন অসংখ্য প্রেতাত্মার বিচরণভূমি। জল, হাওয়া শস্যক্ষেত্র সব বিষাক্ত। ঠিক সেই সময় এই গ্রহাণুটি আছড়ে পড়ে পৃথিবীর ওপর। মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ তলিয়ে যায় কালের গর্ভে, যেখানে ছিল জনপদ, সেখানে হয়ে যায় সমুদ্র, সমুদ্র জেগে ওঠে পাহাড় হয়ে, নদী, গিরিখাত, উপত্যকা সবকিছু বদলে যায়। মৃত আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠে, লাভায় ঢেকে যেতে থাকে শহরের পর শহর। কিছু কিছু জায়গা চরম ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায়। সমস্ত পৃথিবীতে সব মিলিয়ে বেঁচে থাকে এক মিলিয়নের মতো মানুষ আর পশুপাখি, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু বনজঙ্গল। কিন্তু পৃথিবী টিকে যায় ভালোভাবে। এই গ্রহাণুটির মধ্যে এমনসব মহাজাগতিক রাসায়নিক পদার্থ ছিল, যা পরিবেশের সঙ্গে মিশে পৃথিবীর আবহাওয়াকে পরিশুদ্ধ করতে থাকে। মানুষ নিজেদের ভুলগুলো বুঝতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষেরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বেঁচে যাওয়া প্রাকৃতিক সম্পদ, নদী, পশুপাখির প্রতি তারা অসীম যত্নশীল হয়ে ওঠে। শুরু হয় বিজ্ঞানের সেই সাধনা যা শুধুমাত্র মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা হবে। ঠিক করা হলো যেকোন প্রকার উদ্ভিদ ও পশুপাখিকে সংরক্ষণ করতে হবে।  প্রয়োজনে যদি কিছু ব্যবহার করতে হয় প্রকৃতি থেকে, তবে আগে আবার তা পুনর্গঠন করতে হবে।

সেই বিপুল প্রলয়ের বহুবছর পর আজকের এই স্বপ্নের পৃথিবী। পৃথিবীতে ধীরে ধীরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। জনসংখ্যা ভীষণ নিয়ন্ত্রিত। প্রতিটি মানুষ ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত যত্নের সাথে বড়ো হয়। বড়ো হতে হতে তাকে নিজস্ব চিন্তার বিকাশের জন্য স্বাধীনতা দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে তার  চিন্তার জগৎ গড়ে ওঠে, সে কাজ করার জন্য একটি বিশেষ ক্ষেত্র বেছে নেয়, এবং এইভাবে পৃথিবীকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য শারীরিক বা মানসিক শ্রম দান করে। কিন্তু মানুষের যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি লোভ, মোহ, হিংসা এগুলো মানুষের মধ্যে থেকে কোনভাবেই দূর করা যাচ্ছিল না, এই জিনিসগুলো মানুষের মন থেকে না সরালে ভবিষ্যৎ পৃথিবী আবার বহু যুগ আগেকার পৃথিবীর মতোই বিষাক্ত হয়ে উঠবে। তাই এখন সারা পৃথিবী জুড়ে বিজ্ঞানীরা এই বিষয় নিয়ে কাজ করছেন।
মিঃ মৌনপতি এরকম একটি মিশনেরই হেড। তার আন্ডারে সারা পৃথিবীতে চল্লিশজন তরুণ বিজ্ঞানী এ নিয়ে কাজ করছে। তিনি থাকেন ঊনকোটি সামার  ক্যাম্পে।

সৌম্যদর্শন রোদে পোড়া, টানটান চেহারা তার। পোশাকে বিশেষ কোন বৈচিত্র্য নেই। খুবই হালকা ধরনের পোশাক, এয়ার কন্ডিশন্ড, গরমকালে এই পোশাকে ঠান্ডা লাগে, শীতকালে গরম। পৃথিবীর সব মানুষই এ ধরনের পোশাক পরে এখন। উজ্জ্বল, কিন্তু কোমল রঙ। বহুযুগ আগে মানুষ নাকি বিদ্যুৎচালিত পাখা, ঘর ঠান্ডা গরম রাখার যন্ত্র ইত্যাদি ব্যবহার করতো। এখন এসব কিছুই নেই। যে বিশেষ মেটেরিয়েল দিয়ে পোশাক তৈরি করা হয়, তা সবরকম প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষকে আরাম দেয়। ঘরবাড়ি তৈরিতেও ব্যবহার করা হয় স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারি একধরনের বিশেষ হাইব্রিড উদ্ভিদ, যা সারা পৃথিবীর বিশাল সমুদ্র অঞ্চলে ছড়িয়ে  থাকা দ্বীপগুলোতে নিয়মিত যত্ন সহকারে চাষ করা হয়। পাঠানো হয় পৃথিবীর নানা প্রান্তে।

ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ছে, মিশে যাচ্ছে কৃত্রিম আলোর সঙ্গে, এখন আর আলাদা করে সনাক্ত করা যাচ্ছে না কিছুই। এই সামার ক্যাম্প একটি বিশেষ সংরক্ষিত এলাকা। এখানে সাধারন মানুষের আসা প্রায় নিষিদ্ধ। যদিও সেই অর্থে কমন পিপল বলে কিছু নেই আর। বিশাল পৃথিবীকে চালাচ্ছে গুটিকয় মানুষ। তাই প্রত্যেকের জন্যই রয়েছে বহু কাজের গুরুভার, সবকিছু একটি কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে চলছে।  
সামার ক্যাম্পের  সারিবদ্ধ  ঘরগুলোতে উজ্জ্বল যে আলোর বলগুলো জ্বলছে, তা আসলে মৃত মানুষের চিন্তাগুচ্ছ।

এই অলীক স্বপ্নময় বস্তুটি আহরণের কারিগর হলেন মিঃ মৌনপতি। এটাই তার গবেষণার মূল বিষয়, কেউ দিব্যি দেয়নি তাকে, নিজের তাগিদেই খুঁজে নিতে হয়েছে এই অদ্ভুত বিষয়।

মানুষ মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তাশক্তিরও মৃত্যু ঘটে। তিনি হয়তো সারাজীবন অনেককিছু পড়াশোনা করেছিলেন, কিংবা শিল্পের কোনও একটি মাধ্যম তার মধ্য দিয়ে উৎকর্ষতার চরম শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল, কিন্ত মৃত্যু মানেই সব শেষ, সৃষ্টিকর্মগুলোর সযত্ন সংরক্ষণ করা হয়, বা সেসব থেকে গবেষণাও করা যায়,  মানুষ তার সৃষ্টিকর্মে খুব সামান্য জিনিসেরই প্রতিফলন ঘটায়, ট্রিলিয়ন সূক্ষ্ম চিন্তার জাল মস্তিস্কে ছড়ানো থাকে, যার হদিশ পাওয়া যায় না।
কিন্তু এখন সম্ভব হয়েছে। বিজ্ঞানী মৌনপতি মনে করেন তিনি কিছুটা করতে পেরেছেন। এই ধাপে আসার আগে একটি কাজ তাকে করতে হয়েছে, তা হলো সম্ভাব্য মৃত্যুসময় বের করা। যেটা আংশিক সফল। কারণ কোন মানুষ ঠিক কখন মারা যাবে, এটা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে পৃথিবীতে। কিন্তু অমূল্য চিন্তাশক্তির ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানে একধাপ পেছন দিকে যাওয়া! তাই এক্ষেত্রে তিনি অসুস্থ বা বৃদ্ধ  প্রতিভাবান ব্যক্তিদের বেছে নিয়েছেন।  প্রতিভাবান মানুষের অনুমতিরও প্রয়োজন রয়েছে। মৃত্যুর আগে দেহদান বাধ্যতামূলক এখন।  কিন্তু মেধা বা চিন্তা দান নয়। তখনি ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে পৃথিবীর স্বার্থের কথা চিন্তা করতে হয়। সুখের কথা এই যে, বেশিরভাগ মানুষ এখন ভালো হয়ে গেছে, সাধারণ মানুষও তার চিন্তাশক্তি দান করে যায়, খুব সামান্য কিছু মানুষ ছাড়া।
এই চিন্তাশক্তি সংগ্রহের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে মৃত্যুর সময়টিতে সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে।

বিশেষ মেডিকেল টিম অসুস্থ বা বৃদ্ধ মানুষটিকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে একটি সম্ভাব্য মৃত্যুসময় মৌনপতিকে জানান। মৌনপতি, নির্দিষ্ট ব্যক্তিটির কাছে উপস্থিত হন। প্ল্যাটিনাম এবং নতুন আবিস্কৃত একটি মৌল গ্যারোবিয়াম এই দুইয়ের মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি সংকর ধাতু প্রস্তুত করা হয়েছে, সেটা দিয়ে ভীষণ সূক্ষ্ম এবং বিশেষ কিছু ধর্মবিশিষ্ট জালিকা বানানো হয়, সেইসঙ্গে এক্সরে তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে মৌনপতি একটি পদ্ধতি আবিস্কার করেছেন, যার মাধ্যমে মস্তিকের প্রতিটি কোষ থেকে শোষিত হয় চিন্তার স্হাবর রূপ, আলোকরশ্মির মতো বেরিয়ে আসে, সূক্ষ্ম জ্বালিকায় আটকে যায়। পরে তাকে গোলাকৃতি বলের মতো আকৃতি দেওয়া হয়, সংরক্ষণ করা হয় স্বচ্ছ ধাতুর পাত্রে গবেষণাগারে। 
এভাবে সাহিত্য, সঙ্গীত, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, ইত্যাদিতে মানুষ খুব দ্রুত এডভান্স হচ্ছে, পৃথিবীতে মানুষ এখন আর আবদ্ধ নয়, ঘুরে বেড়াচ্ছে মহাকাশের বিভিন্ন গ্রহে। কয়েকটি ছোট ছোট গ্রহ, যেগুলোর বায়ুমণ্ডল মোটামুটি ভাবে জীবন সৃষ্টির পক্ষে সহায়ক, সেগুলোতে পৃথিবীর মানুষেরা গিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, মানুষ থাকার মতো কোন পরিবেশ গড়ে তোলা যায় কিনা, কী ধরনের খাদ্য তৈরি করা যাবে সেসমস্ত জায়গায় ইত্যাদি।

ঠিক এই মুহূর্তে মৌনপতি ভীষণ চিন্তামগ্ন। কিছুদিন আগে তিনি পৃথিবীর অন্য একটি অংশে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানকার বহু প্রাচীন একটি গিরিখাতে ঘুরতে ঘুরতে তিনি তিনটি মানুষের মাথার খুলি পান, ব্যাগে করে নিয়ে আসেন। পরে সামারক্যাম্পে এসে নিজের ব্যক্তিগত পরীক্ষাগারে বসে খুলি তিনটির উপর অনেক এক্সপেরিমেন্ট করেন এবং আশ্চর্যরকম ভাবে এই খুলি তিনটি থেকে কিছু বিচ্ছিন্ন চিন্তা সংগ্রহ করতে পারেন। যা অনুবাদ করলে তিনি বুঝতে পারেন, এই তিন ব্যক্তি প্রতিভাবান পরমাণু বিজ্ঞানী ছিলেন এবং বিপুল ধ্বংসের সময় তাঁরা গবেষণাগারে  পরমাণু অস্ত্র নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি যা সংগ্রহ করতে পেরেছেন, তাতে  একটু  মাথা খাটালে তিনিও পরমাণু বোম তৈরি করতে পারবেন। কিন্তু বর্তমানের  পৃথিবীতে কোনোরকম অস্ত্র তৈরি করা নিষেধ। বনজ পশুর কাছ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য একধরনের স্প্রে ব্যবহার করা হয়, যা তাদের অজ্ঞান করে শুধু। তারপর বনকর্মীদের খবর দেওয়া হয়। কোন রাষ্ট্র নেই পৃথিবীতে। সব মানুষ সমান সুযোগ সুবিধা পায়। সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন দিক দেখার জন্য বিভিন্ন দপ্তর রয়েছে শুধু। কেউ কোন হিংসার আশ্রয় নেয় না। তাই বিজ্ঞানের সব গবেষণা শুধু কল্যাণকামী।   অস্ত্র তৈরির নিয়মকানুন মানুষ জানে না, জানার চেষ্টা করলেও ধরা পড়ে যাবে পিস ওয়ার্রকার বা শান্তি যোদ্ধাদের হাতে।
এখন মৌনপতি একটি মুশকিলে পড়েছেন, এই চিন্তাগোলকের রঙ হলুদ। এখন  এই পৃথিবীতে প্রায় সব চিন্তাগোলকের রঙ হালকা গোলাপি, ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে এখানে। মৌনপতির প্রিয় ছাত্র, অর্কপ্রভের চোখ কিন্তু এড়ায়নি। সে জিজ্ঞেসও করেছে দু একবার। তিনি এড়িয়ে গেছেন। চিন্তাগোলক কোনভাবেই ধ্বংস করা যায় না জেনেও তিনি সমুদ্রের কাছে গিয়ে গোপনে চেষ্টা করেছেন,
নিজস্ব সাবমেরিন নিয়ে চলে গিয়েছিলেন সমুদ্রগভীরে, কিন্তু এ যেন অবিনশ্বর, কিছুতেই এই চিন্তাগোলকের বিচ্ছুরণ বন্ধ হয় না। মৌনপতি আশ্চর্যভাবে লক্ষ করেছেন গোলকটির মধ্যে যেন নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ শক্তি রয়েছে, সে যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ, এমনকি তার বৃদ্ধিও আশ্চর্য নয় হয়তো, তবে কি চিন্তাগোলকের ভেতর কোষ তৈরির ক্ষমতা জন্ম নিচ্ছে? পারেননি চিন্তাগোলককে চুর্ণবিচুর্ণ করতে, হবে না, বুঝে গেছেন যা হবার।

আবার গবেষণাগারে নিয়ে এসে রেখেছেন। তাকিয়ে আছেন নির্নিমেষ। অত্যন্ত মেধাবী তার ছাত্র টিম। যে কারো হাতে পড়লে আবার পৃথিবী, পৃথিবী ছাড়িয়ে অন্য গ্রহে জ্বলে উঠবে রণদামামা। ক্ষমতা আর আগ্রাসনের লড়াই। কি করবেন তিনি তখন?  সামনের কম্পিউটার স্ক্রিনে লাল আলো জ্বলে উঠল, মানে দরজার বাইরে কেউ। তিনি টাচ করে দেখলেন অর্কপ্রভ, খুব অবাক হলেন, ওর তো আজ পৃথিবীর একমাত্র মরুভূমি হটগ্রীণে যাওয়ার কথা, যেখানে খুব সামান্য অংশ মরুভূমি আর অবশিষ্ট রয়েছে, যা সংরক্ষিত। বর্তমানে পর্যটনস্থল হিসেবে রাখা হয়েছে, মানুষ মরুভূমির সূর্যাস্ত দেখতে সেখানে যায় । তিনি অবাক হয়ে রিমোটে হাত রাখলেন। দরজা খুলে গেল, অর্কপ্রভ ঢুকলো এবং মৌনপতিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হলুদ চিন্তা গোলকের বাক্সটি নিয়ে দৌড়ে চলে এলো ঘরের বাইরে, মৌনপতি এ ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তিনিও ছুটে বাইরে এলেন, ততক্ষণে অর্কপ্রভ নিজস্ব প্লেনে করে অনেক উঁচুতে আকাশে । কিন্তু তিনি অর্কর গুরু, প্রখর মেধা,  গবেষণাগারে এসে ধ্যানস্থ হলেন। প্রবল আকর্ষণ ক্ষমতা সৃষ্টি করতে পারেন তিনি, এটা তাঁর বিশেষ ক্ষমতা, সাধনায় অর্জিত, প্রয়োগ করলেন হলুদ চিন্তা গোলকের উপর এবং সেই অবিনশ্বর বস্তুটি ভেসে চলে এলো তার দিকে, অর্ক শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো বহুদূরের আকাশ থেকে। অর্কপ্রভের চেহারা ভেসে উঠল মৌণপতির সবজান্তা কম্পিউটারের স্ক্রিনে। লোভ চকচক করছে, এই দৃষ্টিপাত মৌনপতি কোনদিন দেখেননি। একেই তাহলে লোভ বলে! কী কুৎসিত লোভের চেহারা, ছি ছি।  

এখন কি হবে? একঘন্টা গভীর আত্মমগ্ন রইলেন প্রাজ্ঞ বিজ্ঞানী।

স্যার, প্লিজ!

এই সুমিষ্ট কন্ঠস্বরটি মৌনপতির খুব চেনা, মেয়েটির নাম আর্যা। ও একটি কাপ রাখল মৌনপতির সামনে।

আর্যা মৌনপতির সামারক্যাম্পে প্রত্যেকবছর এসে কিছুদিন থাকে, আর বাকি সময় একটি অপূর্ব বাংলোতে, যার তিনদিকে পাহাড় আর একদিকে সমুদ্র, সেখানে থেকে রঙ নিয়ে কাজ করে, রঙের বিচ্ছুরণ তার প্রিয় বিষয়, এছাড়াও সে একজন ফ্যাশনবিশেষজ্ঞ। ভীষণ ব্যস্ত সবসময়, পৃথিবীতে নানা পেশায় কাজ করা মানুষের জন্য পোশাকের ডিজাইন, কালার সৃষ্টি করা আবার আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে নতুন সেট তৈরি করা, এই নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যারা কাজ করে সে তাদেরই একজন। মৌনপতির সামনে আর্যার রাখা হালকা সোনালি রঙের কাপে রঙহীন  স্বচ্ছ তরল, ফুলের নির্যাস আর জলের সমীকরণে তৈরি এই বর্ণহীন তরল মানুষকে খুব দ্রুত চাঙা করে তোলে, ব্রেনের কোষগুলোকে উজ্জীবিত করে ভেতর থেকে তাকে কাজ করার শক্তি দেয়। আর্যার হাতেও একই পানীয়। কোন কথা না বলে মৌনপতি কাপে চুমুক দিলেন।

আর্যা বলল, অর্কপ্রভ আমার বিশেষ বন্ধু, আপনি জানেন তো স্যার।

হুঁ।

আমার খুব লজ্জা করছে, ওর মধ্যে এধরনের লোভ দেখে।

হুঁ। আমিও খুব অবাক আর্যা।

ওকে কি সরিয়ে দেওয়া উচিত?

কোথা থেকে সরাবে?

আপনার সামারক্যাম্প থেকে। অথবা এই পৃথিবী থেকে! আর্যা কেটে কেটে বলল কথাগুলো।

কি বলছ তুমি আর্যা!

আমার সঙ্গে ওর দুদিন ধরে এবিষয়ে কথা চলছে, সে কিন্তু আরো ভয়ঙ্কর জিনিস ভাবছে। বলব কি আমি আপনাকে? ভুল হয়ে গেছে, আমার আরো আগেই বলা উচিত ছিল।

মৌনপতি ভেতরে ভেতরে খুব বিস্মিত এবং আহত হচ্ছেন, কিন্তু তিনি মুখের ভাব নির্বিকার রাখলেন। এই তাহলে ষড়যন্ত্র! মানুষ যেখানে সেখানেই ষড়যন্ত্র।

তিনি বললেন, তুমি কি করে ভাবলে ওকে সরিয়ে দেওয়ার কথা? তাহলে তুমিও তো সমান দোষে দোষী। তোমরা তো একই। আমি খুব ব্যথিত হলাম।

কিন্তু লোভ নামের সংক্রামক ব্যাধিকে ছড়াতে দেওয়া উচিত নয়। তাহলে পৃথিবী আবার বহুদিন আগের সেই পৃথিবী হয়ে যাবে।

সে কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। একজন রঙ ও সৌন্দর্যের কারিগর যে একথা চিন্তা করতে পারে আমি ভাবতেই পারিনি। তুমি এখন যাও আর্যা। আর তোমরা বোধহয় পরস্পরকে ভালোবাসতে, তার মানে, সেটা ভালোবাসা নয়, তোমাদের  মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসই জন্মায়নি, তোমরা শুধু অভিনয় করে গেছো। এখন আমি যদি বলি, তোমাদের দুজনকেই সরিয়ে দিতে হয় তাহলে?

আর্যা কাঁদছে। অনেকদিন পর মৌনপতি একটি মেয়েকে কাঁদতে দেখছে, কিন্তু কষ্ট হচ্ছে না, রাগ হচ্ছে খুব। দীর্ঘাঙ্গী, অপূর্ব সুন্দরী এই মেয়ে, কত সহজে নিজের বন্ধুকে খুন করার কথা ভাবছে, কিন্তু তাকে বদলে ফেলার কোন চেষ্টা করছে না। বৃথা সব আয়োজন, ব্যর্থ, ব্যর্থ।

তুমি এবার যাও আর্যা। কঠিন স্বরে বললেন মৌনপতি।

মৌনপতির ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে আর্যা। ঝর্ণার কলকল কানে আসছে। ঝর্ণার জলে সৃষ্টি হয়েছে অপরূপ এক প্রাকৃতিক জলাধার। সামান্য উষ্ণ জল। এই জলাধারের জলই উপত্যকার বুক চিরে নদী হয়ে প্রবাহিত হয়েছে, এই জলাধারের নাম মৌনপতি স্যার রেখেছেন দ্য সঙ্ ওব সীতা। সীতা নাকি কোনো এক যুগের ফেমাস একজন নারী ছিলেন, যাকে মানুষ পুজো করত। ঝর্ণার পাশে আবছামতো অন্ধকারে একজন মানুষ বসে আছে মাথা সামনের দিকে ঝোঁকা। একঝলক দেখেই আর্যা বুঝল, মানুষটি অর্কপ্রভ, হয়তো ক্ষমা চাইতে এসেছে। আর্যা অর্কপ্রভের পেছনে দাঁড়ালো। পেছন দিকে না তাকিয়েই, অর্কপ্রভ হিসহিসে স্বরে বলল, গ্রীণ টুয়েন্টি এনেছো তো সঙ্গে? মাথার ভেতর চালিয়ে দাও আর্যা, মরে যাই।

আর্যা বলল, গ্রীণ টুয়েন্টি দিয়ে তোমাকে মেরে কী হবে, যন্ত্রণাহীন মৃত্যু, আমি চাই কষ্ট পেয়ে তোমার মৃত্যু হোক!

তুমি বাঁচবে তো তারপর?

বাঁচব।

চলো তাহলে দুজনেই বাঁচি।

অর্কপ্রভ সহসা ঘুরে দাঁড়ালো, আর্যা আগে থেকেই এরকম কিছু আন্দাজ করেছিল। দুজনে মুখোমুখি, না কোন অস্ত্র নেই, কিন্তু চোখে চোখে আগুন জ্বলছে। সহসা এক আলোকসম্পাত হলো ওদের ওপর। গাঢ় সবুজ রঙের আলো। কোনো এক অদৃশ্য শক্তিবলে তারা দুজন কোথায় যেন যাচ্ছে।

মৌনপতি বুঝতে পেরেছিলেন এরকম কিছু হতে পারে, তাই তিনিই এই সম্মোহন সৃষ্টি করেছেন।

অর্কপ্রভ এবং আর্যা এখন মৌনপতির সামনে দুটো চেয়ারে বসে আছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে তারা যেন বসে বসে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মৌনপতি মনে মনে ঠিক করেছেন তিনি অর্কপ্রভ এবং আর্যার ব্রেনকে সম্পূর্ণ শূন্য করে দেবেন। তারা পরিণত হবে দুজন নির্বোধ মানুষে, তিনি ওদের দুজনের সমস্ত মেধাকে

চিন্তাগোলকে সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করছেন দ্রুত। কারণ সম্মোহন বেশি সময় থাকে না, আর এসব কাজে তাঁকে সাহায্য করার জন্য রয়েছে বেশ কয়েকজনের একটি টিম, কিন্তু আপাতত এই কাজ তাঁকে একাই করতে হবে গোপনে।

ধীরে ধীরে তাদের ব্রেন থেকে এতদিনের অধিত এবং অর্জিত বিদ্যা দুটো নামহীন চিন্তাগোলকে সংগৃহীত হলো, মৌনপতি দেখলেন এই চিন্তাগোলকদুটোর রঙ

সম্পূর্ণ গোলাপি নয়, হালকা হলুদও।

নির্দিষ্ট বাক্সে চিন্তাগোলকগুলোকে আবদ্ধ করে বিশাল ল্যাবের এককোণে পাঠিয়ে দিলেন। কোনো নাম মেনশন করা হলো না এগুলোর। যদি কোনোদিন অর্কপ্রভ ও আর্যা খুঁজে পায় তো পাবে, তখন তিনি আর এই পৃথিবীতে নেই।

সম্মোহিত অবস্থা কাটিয়ে উঠছে দুজনের, তিনি খবর দিয়েছেন দুটো সংস্থাকে, তারা এখুনি প্লেন পাঠাচ্ছে, অর্কপ্রভকে নিযুক্তি দেওয়া হবে চাষবাসসম্পর্কিত কাজে, সেখানে সে খাটবে শ্রমিকের মতো, আর আর্যাকে ছোট্ট বাচ্চাদের স্কুলে একজন সহায়িকা বা আয়ার ভূমিকায় রাখা হবে ।

খুব খারাপ লাগলেও, মৌনপতি বুঝলেন, বড়ো কোনো কাজের দায়িত্ব নিলে কিছু নিষ্ঠুর হতে হয় ক্ষেত্রবিশেষে। নতুন পৃথিবীতে তার হাত দিয়েই হলো সর্বপ্রথম শাস্তিদান। এতোদিন তো কাউকে শাস্তি দিতে হয়নি। অন্যায়কারী এবং শাস্তিদাতা ফিরে এলো আবারো দুনিয়ায়।

কিন্তু আসল বিষয়টির কি হবে?

তিনি কারো সঙ্গে আলোচনা করতে পারবেন না এ নিয়ে, নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন শুধু। তার পক্ষে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন, দেখা যাক কী হয়।

পৃথিবীর সমস্ত জায়গা থেকে তার আন্ডারে কাজ করা সব তরুণ বিজ্ঞানীকে দ্রুত আসতে বললেন সামার ক্যাম্পে।

দুদিন কেটে গেছে। মধুরঙের সুন্দর একটি দিন শুরু হচ্ছে।

সকাল ছটা। বিশাল হলঘরে পিনড্রপ সাইলেন্স। মৌনপতি বললেন, তিনি আজ বিকেলে ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করবেন।

মৃদু গুঞ্জন শুরু হলো। তারপর সমস্ত প্রোটোকল ভেঙে শুধু প্রশ্ন, কেন?  কেন?

স্যার পৃথিবীতে গুণী মানুষের সংখ্যা খুব কম, এরমধ্যে আপনার মতো একজন মানুষকে হারালে ভীষণ ক্ষতি হবে। আমরা আমাদের গবেষণায় এগোব কী করে, কে সাহায্য করবে আমাদের?

আমার কথা শেষ হয়নি, প্লিজ একটু থামুন আমার তরুণ বন্ধুরা! মৌনপতি বললেন।

তিনি ঠান্ডা স্বরে জানালেন, তাঁর ডিসিশন কোন অবস্থাতেই বদলাবেন না। আর তরুণ ছাত্ররা যথেষ্ট মেধাবী ও পরিণত, এখন নিজেরাই খুঁজে নিতে পারবে নিজেদের সব প্রশ্নের উত্তর।

তারপর বললেন, তিনি দেহও দান করবেন না, আর মৃত্যুর সময় তাঁর চিন্তাও তিনি সংরক্ষণ করতে দেবেন না।

মৌনপতি মরে যাওয়ার পর, তার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবে না কোনও চিন্তাগোলক। তিনি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবেন।

পৃথিবী এবং পৃথিবীর বাইরের গ্রহ সবকিছুর চরম স্বার্থের কথা চিন্তা করে এই ডিসিশন। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে যেন ইলেকট্রিক পদ্ধতিতে ছাই করে দেওয়া হয়। আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না। দ্রুত চলে এলেন গবেষণাগারে। বন্ধ হয়ে গেলো বাইরের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ।

হলুদ চিন্তাগোলক জ্বলজ্বল করছে, তীব্র আলোতে চোখ যেন পুড়িয়ে দিচ্ছে। আবার ধ্যানস্থ হলেন মৌনপতি। হলুদ গোলক এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে তার দিকে আসতে লাগল। মৌনপতির মাথার ওপর চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে একসময় মৌনপতির দেহে লীন হয়ে গেল। বিকেলবেলা নিজের রুমে নিজের তৈরি প্রাণঘাতী ইনজেকশন শরীরে বিঁধলেন। তার নির্দেশ অনুযায়ী ঠিক কুড়িমিনিট পর দরজা খোলা হলো। বিশেষ কক্ষে, মৌনপতির দেহ ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সবার চোখের সামনে। না কোনো চিন্তাশক্তি সংগৃহীত হলো না এই প্রখর প্রতিভার। আপন প্রতিভার তীব্র আগুনে ধ্বংস করে ফেললেন নিজেকেই। বাইরে শান্তির পৃথিবীতে, দ্য বে অব গ্রীণের উত্তাল ঢেউ। এখন জোয়ার আসার সময় হয়েছে।

 

 

 

 

 

 


1 টি মন্তব্য:

  1. অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে এই ইতিবাচক কল্পবিজ্ঞানের গল্পটি লেখা হয়েছে। মুগ্ধ হলাম।

    উত্তরমুছুন