রবিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২১

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


 

(১৩)

তোদের মধ্যে নির্মাল্য কার সঙ্গ বেশি পছন্দ করত? দুজনেরই। ও ছিল সুখী স্বভাবের অগভীর প্রকৃতির একটি ছেলে। সবসময়ে সঙ্কট আর জটিলতাকে এড়িয়ে যেতে চাইত। দুজনেরই। ও ছিল সুখী স্বভাবের অগভীর প্রকৃতির একটি ছেলে। সবসময়ে সঙ্কট আর জটিলতাকে এড়িয়ে যেতে চাইত। মানুষকে যেমন আনন্দ দিত, তেমনই নিজেও আনন্দে থাকতে চাইত। ওর মুখেও সেই সময়ে আমি কষ্টের ছাপ দেখেছিলাম। আসলে ও চাইত আমাদের তিনজনকে নিয়েই থাকতে। কোনও একজনকে বাদ দেওয়াই ওর পক্ষে কষ্টকর ছিল। অথচ আমাদের দুজনের দাবি ছিল সেরকমই। আমরা ওকে একা আলাদাভাবে পেতে চাইতাম। আর একে অপরকে বাদ দিতে। হ্যাঁ আমি আর অনির্বেদ সহ্য করতে পারছিলাম না একে অপরকে। ও একবার আমার কাছে ছুটে আসত, আর একবার অনির্বেদের কাছে ছুটে যেত। কিন্তু ক্রমে ওর মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন এলো। ও অপ্রিয় হতে চাইত না। কিন্তু সেই সম্ভাবনা দেখা দিল। আমার কাছে অনির্বেদের কথা বললে আর অনির্বেদের কাছে আমার কথা বললে আমরা যেভাবে বিরক্তি প্রকাশ করতাম, সেটা ওর কাছে খুবই অস্বস্তিকর হয়ে উঠল। ফলে ও গোপন করতে শুরু করল। আমার কাছে অনির্বেদের কথা আর অনির্বেদের কাছে আমার কথা পারতপক্ষে তুলত না। আমি আর অনির্বেদ যেন একে অপরকে ভুলেই গেলাম। আমি শুধু ভাবতে শুরু করলাম ও শুধু আমার কাছেই আসে আর সেকথা ভেবে মনে মনে গভীর আনন্দ পেতাম। অন্যদিকে অনির্বেদও ঠিক একইরকম ভাবত বোধহয়। পরে আমাকে সেরকমই বলেছিল। ও এটা নিরুপায় হয়েই করত কিন্তু একদিন ধরা পড়ে গেল। ওকে আমি অনির্বেদের বাড়ি থেকে বেরোতে দেখলাম। মনে আছে, কী ভীষণ আশ্চর্যই না আমি হয়েছিলাম সেদিন। ছুটে গেছিলাম ওর কাছে। তারপর প্রচণ্ড রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলেছিলাম, ও, তুই এখানে? এদিকে আমি ভেবেছিলাম...! আমার সেই প্রচণ্ড আবেগ ঝড়ের মতো আছড়ে পড়েছিল ওদের ওপরে। ওরা কিছু বলার আগেই আমি সেখান থেকে চলে এসেছিলাম। গোটা ব্যাপারটাই নির্মাল্যকে ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড আঘাত করেছিল। মেহুলীকে নিয়েও ঠিক সেই সময়েই ওর সমস্যা শুরু হয়। এর কয়েকদিন পরই নির্মাল্য ক্যারাটের ট্রেনিং নিতে বিদেশে চলে যায়। ও ফিরে এসেছিল বেশ কয়েকবছর বাদে।

বিশ্রুত একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, আসলে তোরা তিনজনই ছিলি খুব সংবেদনশীল প্রকৃতির। নিজেদের মধ্যে সম্পর্কটাকে ঠিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারিসনি, তাই ওটাও তোদের হাতের বাইরে চলে গেছিল। তোর দায়িত্বই ছিল সবচেয়ে বেশি, তাই তোর দোষটাও অন্যদের চেয়ে বেশি। অনির্বেদ এমনিতেই তোর সঙ্গে মানসিক দূরত্ব অনুভব করত। এই ঘটনা ওকে আরও দূরে সরিয়ে দিল। কতরকম সঙ্কট ছিল ওর জীবনে। সেগুলো না ভেবে তুই নির্মাল্যকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলি। ওর কথা একবারও বিবেচনা করলি না। ও কী তখন তোর সমান ছিল? ছিল না। জীবনে কোনোমতে ভেসে থাকার জন্য ও তখন মরিয়া চেষ্টা করছে! আসলে তোর জেদই ওকে জেদি করে তুলেছিল। তোর ঈর্ষাই ওর মনে ঈর্ষা জাগিয়ে তুলেছিল। তুই ওভাবে নিজের পছন্দ অপছন্দকে প্রকাশ না করতে শুরু করলে নিজেকে ও হয়তো গুটিয়েই রাখত। আর নির্মাল্যও সম্পূর্ণ নির্দোষ। ও তোদের দুজনকেই চেয়েছিল। ওকে আলাদাভাবে পেতে চেয়ে তোরা দুজনেই ওকে হারালি।

অনির্বেদ কিন্তু এই ঘটনা কোনদিনই ভুলতে পারেনি। হৃদয়ের ব্যাপারে স্থায়ীভাবে ওর মধ্যে নিরাপত্তার অভাব তৈরি হয়ে যায়। ওদের দুজনের মধ্যে আবার যে যোগাযোগ ঘটল, সেটা ছিল নিতান্তই একটা আকস্মিক ঘটনা। একদিন নৌকায় উঠতে গিয়ে ভাড়া নিয়ে হৃদয়ের সঙ্গে দুজন মাঝির তীব্র বাদপ্রতিবাদ হচ্ছিল। উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছিল। দুপুরবেলা, আশেপাশে কোনো লোকজন নেই। হঠাৎ কোত্থেকে সেখানে এসে হাজির হয় অনির্বেদ। মাঝি দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, উনি তো ঠিক কথাই বলেছেন।

তুই কে? একটা ষণ্ডা গোছের মাঝি অনির্বেদের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে। হৃদয়কে কিন্তু সে আপনি করেই সম্বোধন করছিল।

অনির্বেদ প্রচণ্ড রাগে বলে ওঠে, তা দিয়ে আপনাদের কী? ঠিক কথাটা উনিই বলছেন...

ভালো করে তার মুখের বাক্য শেষ হওয়ার আগেই মাঝি দুজন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর লাথি-ঘুষি-চড় বৃষ্টির মতো ওর ওপর পড়তে শুরু করল। পুরো ব্যাপারটা এত আকস্মিকভাবে ঘটল যে হৃদয় টানা কয়েক সেকেণ্ড থ মেরে দাঁড়িয়ে রইল। সম্পূর্ণ হতচকিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়। লোকগুলো কিন্তু ওকে স্পর্শও করল না। অনির্বেদকে মারতে মারতে শুধু বলছিল, এত সাহস তোর? বেশি মেজাজ দেখাতে এসেছিস? দেখাচ্ছি তোকে মজা। একসময়ে শান্ত হল ওরা এবং অনির্বেদকে ফেলে রেখে অদৃশ্য হয়ে গেল হঠাৎ। কোনোরকমে অনির্বেদকে ধরে নিজের বাড়িতে নিয়ে এল হৃদয়।

অনির্বেদ দু-হাতে মুখ ঢেকে চুপ করে একটা সোফায় গা এলিয়ে বসেছিল। সে জানে, ওরা কেন হৃদয়কে স্পর্শ করেনি আর ওকে অমন নির্মমভাবে মেরেছে। সমাজের চোখে ওরা দুজন সমান নয়। ওকে দেখলেই বোঝা যায়, ও একজন দরিদ্র অভাবী মানুষ। একজন দরিদ্র অভাবী মানুষের মেজাজ কেউ সহ্য করবে না। হৃদয়ের মা গ্লাসে করে শরবৎ এবং প্লেটে করে কয়েকটা মিষ্টি এনে রাখে ওর সামনে, অনির্বেদ ছুঁয়েও দেখে না।

হৃদয় এসে অনির্বেদের পিঠে হাত রাখে। তারপর বলে, আমাকে ‘তুমি’ করে বলিস কেন অনির্বেদ? আজ থেকে ‘তুই’ করে বলবি।

হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ে অনির্বেদ। তারপর তীব্র অভিমানে বলে, ‘তুই’ করে? সত্যি বলছিস তুই? তুই আমাকে ভালোবাসিস হৃদয়? সত্যি ভালোবাসিস আমাকে?

অনির্বেদের ভেতরে যে এত অভিমান জমে আছে, সেকথা জানত না হৃদয়। সেই মুহূর্তে অনির্বেদের প্রতি কোনো ভালোবাসাই বোধ করে না সে। কেমন একটা করুণার পাত্রই মনে হয় তাকে। তবু অনির্বেদের পিঠে হাত বোলাতে থাকে। মুখে অবশ্য কিছুই বলে না। কেমন বাধো-বাধো ঠেকে। মানুষ যাকে করুণা করে, তাকে ঠিক ভালোবাসা যায় না।

অনেকক্ষণ ধরে কাঁদে অনির্বেদ। হৃদয় অপেক্ষা করে। একসময়ে শান্ত হয় অনির্বেদ। চোখের জল মুছে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। ততক্ষণে হয়তো সে নিজেও বুঝে গেছে, হৃদয় ওকে মোটেই ভালোবাসে না। করুণা করে। তবে মনে মনে খুশিও হয়। হৃদয়কে আজ সে তুমির বদলে তুই করে ডাকতে পারবে। এটুকু সাহসও যে ওর আজ পর্যন্ত হয়নি। অন্তত কিছুটা অধিকার সে অর্জন করে নিতে পেরেছে। সমাজের যে স্তরে ওর বসবাস, হৃদয়ের বসবাস তার চেয়ে অনেক উঁচু ডালে। সেই ডালকে স্পর্শ করাও ও নিজের সৌভাগ্য মনে করে।

বিশ্রুত সব শুনে বলেছিল, নির্মাল্যর ব্যাপারে এই ছেলেটির তুই প্রতিপক্ষা হয়ে উঠেছিলি? ও তোর প্রতিপক্ষ হবে কেমন করে? তোর কাছ থেকে সামান্য সম্মান আর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে কেমন মরিয়া হয়েছিল দেখ। কত অভিমান আর কষ্ট জমেছিল ওর ভেতরে। অত মার খেল, কিছুই গায়ে মাখল না। শুধু ভিখিরির মতো তোর কাছ থেকে ভালোবাসা চেয়ে গেল। তুই যে ওকে একদিন ভালোবাসতে পারিসনি, সেকথা ও ভুলতে পারেনি। সেটাই ও তোকে মনে করিয়ে দিতে চাইল। তোর কাছে ভালোবাসার দাবি জানিয়ে গেল।

(ক্রমশঃ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন