ভালোবাসার কথা বলতে এলাম:
প্রাণের মানুষ ৩
অতলান্ত-প্রশান্ত সফরের সব ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়ে গেল জুন মাসের গোড়ার দিকে। জুলাই পড়লেই আমরা বেরিয়ে পড়ব। কলকাতায় সব খবর ঠিকঠাক। পামেলা জোরকদমে আপিস করছে। এদিকে আমার তো ততক্ষণে কলেজের গরমের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। আকবর বাদশার পায়ের তলার সর্ষেগুলো কুড়কুড় শব্দ করে ঘুরে ফিরে বেড়ায়, কুটুস কুটুস করে চিমটি কাটে, পা বেয়ে বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে ওঠে! একটু যে চুপ করে স্থিতু হব তার কি আর উপায় আছে?
ঠিক করলাম আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো ছিটোনো যে ভাইবোনগুলো আছে তাদের একটু দেখে আসি। তা আমার বাপু ভাবনা আর কর্মে তেমন বিলম্ব সয় না। ঠিক করলাম প্রথমে ট্রেনে করে যাব নিউ জার্সি। সেখানে জয়, সংহিতা আর তাদের ছানারা থাকে। ওদের সঙ্গে থাকবো দিন কয়েক। সেখানে দেখা হবে শুভদেব, অপরাজিতার সঙ্গে। তখন পরনে থাকবে কলাপাতা রঙের শাড়ি। দেখা হবে প্রিয়া, মার্কাস আর নিখিলের সঙ্গে। তারপর সেখান থেকে ট্যাক্সি চেপে যাবো পেনসিলভ্যানিয়া। রানা আর সীমন্তির বাড়ি যাওয়া হয়নি বহু বছর। আর আশ্চর্য্যের ব্যাপার, সেখানে আচমকা দেখা হয়ে যাবে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আসা সুজাতা আর বিজয়ের সঙ্গে। সেদিন রাতে পরব ফুলছাপ সিল্ক। কখন যে কার জন্য কোন চমক অপেক্ষা করে আছে তা কেবল জানেন সেই অদৃশ্য নাট্যকার। তারপর রানার গাড়ি চেপে ওদের সঙ্গে যাব সেনান্দোয়া ন্যাশনাল পার্ক। সেখানে আমরা সকলে মিলে থাকবো একটা ছবির মতো সুন্দর বাড়িতে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষা কাঠের বাড়ির বারান্দায় ছায়া দেবে পাইনের জঙ্গল। খুব কাছ দিয়ে বয়ে যাবে ঝর্ণা। হঠাৎ দেখে ফেলবো এক কালো ভালুক আর তার ছানাকে... দেখে ফেলবো সোনার হরিণ। সেখানে দেখা হবে শম্পা তুষার আর তুলির সঙ্গে। বিকেলে চায়ের সঙ্গে মাখা হবে ঝালমুড়ি। তারপরে শম্পাদের গাড়িতে চেপে চলে যাব নর্থ ক্যারোলিনা। সেখানে ওদের বাগানের ফুল দিয়ে সাজাবো ওদের বসবার ঘর। বাগানের সবজি দিয়ে তৈরী হবে দুপুরের খাবার। আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে বিশাখা। বিশাখার সঙ্গে পূর্ণিমার রাতে এক বিশাল হ্রদের জলে দেখতে পাব চন্দ্রালোক। সেদিন পরব চাঁদের আলোর মতো নরম সাদা রেশমের কাপড়, তাতে বসানো থাকবে হালকা সোনালি পাড়। এইসব স্বপ্নের মতো দিন, ভালোবাসার মতো মুহূর্ত আর মায়ার মতো একটা ফেলে আসার বিষণ্ণতা সুটকেস বোঝাই করে পড়ন্ত বিকেলে বোস্টনের প্লেন ধরব। সুসময় বালির মতো আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যায় যে...
‘অথচ সেই আগের মতোই ফুটছে শিউলি,
আগের
মতোই বাতাস ছুটছে।
তবে
কেন এই মাটি-জল আমার কি না
স্পষ্ট
করে বুঝে নিতে আর পারি না,
তবে
কেন হাজার প্রশ্ন জেগে উঠছে?
আগের
মতোই ফুটছে যখন শান্ত শিউলি,
আগের
মতোই বাতাস ছুটছে?
মাঝে মাঝেই বুকের মধ্যে ঝনকে ওঠে
এখন
এই পড়ন্ত বেলায়।
দিনের
দীপ্তি মিলিয়ে যাবার খানিক আগে
বন্ধুদেরও
মুখ দেখে আজ ধাঁধা লাগে,
মন
বসে না কোনো কাজে, কোনো খেলায়।
বুকের
মধ্যে বিষণ্ণতা ঝনকে ওঠে
এখন
এই পড়ন্ত বেলায়’।
পামেলার মায়ের অসুস্থতার খবর ইতিমধ্যে পেয়েছি। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার পথে ওর মুখ চোখ দেখে আর কথাবার্তা শুনে আন্দাজ করলাম যে ওকে কলকাতা চলে যেতে হবে দিন দশেকের ভেতরে। পরের কয়েকটা দিন কাটল ‘একা যাব’ হৃদয়ঙ্গম করতে। ঋজুকে জানালাম আমার সিদ্ধান্তের কথা। টেলিফোনে কথা হলো :
‘মা, তোমাকে একা যেতেই হবে? তুমি তো কখনো এতটা গাড়ি চালাওনি। আমার তো এখন আর কোনো ছুটি নেই। তুমি কি ওই বুকিং-এর টাকা দেওয়া হয়ে গ্যাছে বলে যাচ্ছ? তুমি ওই টাকার জন্য চিন্তা কোরো না। তোমার সেফটি হল সবচেয়ে আগে’।
ছেলেটা
কত বড় হয়ে গেল! কেমন প্রাজ্ঞ অভিভাবকের মতো কথা কইছে! আমার চোখ ফেটে জল আসে।
‘না রে ঋজু। টাকার জন্য নয়। এই পথটা আমাকে যেতেই হবে। The road is calling me. I have to go.’
ঋজু চুপ করে যায়। আমরা এখন পরস্পরকে অনেকখানি জায়গা দিতে অভ্যস্ত। একটা সময় ছিল যখন আমি বোস্টন থেকে নিউ জার্সি, নিউ ইয়র্ক গিয়ে ওর ঘর দুয়ার গুছিয়ে দিতাম। স্তূপীকৃত জামাকাপড়ের পাহাড়ের তলা থেকে হাম্বা ডেকে বাছুর বেরিয়ে আসত । মাস খানেকের মতো রান্না করে ওর ফ্রিজার বোঝাই করে রেখে আসতাম। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। চিরুনির পাশে হলদে Post-it-এ লিখে রাখতাম ‘Use Me!’
ঋজুর বছর তিনেক আগে বিয়ে হয়েছে। সমীক্ষা একজন অসাধারণ বিদুষী মেয়ে। ওরা পরস্পরকে খুব ভালোবাসে, যত্ন করে। ঋজু এখন ওর জামাকাপড় সুন্দর করে ভাঁজ করে দেরাজে রাখে, চমৎকার মুরগির ঝোল রাঁধে, পরিপাটি করে চুল আঁচড়ায়। ঋজুর জীবনে আমার ভূমিকা পাল্টেছে আর আমিও সেটি ক্রমে ক্রমে হৃদয়ঙ্গম করে ফেলেছি। এখন আমার সুতো ছাড়ার সময়। ওদেরকে একান্ত সময় দেবার সময়। এইটেই আসল খেলা। পরিবর্তিত অবস্থানের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া, গুছিয়ে নেওয়া। পরবর্তী পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হওয়া।
‘সকালবেলা তাই আমাদের কোনও কাজ হয়নি করা
আমরা
অনন্তকাল এমনি চুপচাপ হারানো দিনের গল্প শুনছিলাম
পুলিশের
মতো
আমরা
আমাদের কর্তব্য স্থির করছিলাম পুলিশের মতো
আমরা
ভাবছিলাম সেইসব হারানো দিনগুলি ফিরে পাবার জন্য
লাকি
মিতাকে পাঠিয়ে দেখবো একবার
আমরা
বসে বসে এলোমেলো উত্তাল সম্ভাবনার স্বপ্নে এমনি করে
ব্যস্ত
রাখছিলাম আমাদের
আমরা
এমনি করে সময়ের একের পর এক চড়াই-উৎরাই হচ্ছিলাম পার
এমন
সময় তারা বললো, ‘গাড়ি এসে গেছে, উঠে পড়ো উঠে পড়ো –
এখানে
থাকলে বাঘে খাবে তোমাদের’
আমরা
তখনই লাফিয়ে লাফিয়ে অনেকে হামাগুড়ি দিয়ে, হেঁটে
ভবিষ্যৎ-গাড়ির
দিকে চলে গেলাম
আমরা
সকলেই এখানে বাঘের জিহ্বা এড়িয়ে গিয়ে ওখানের বাঘের
জিহ্বার
দিকে চলে গেলাম’।
আগে কথা ছিল যে আমরা ৩ জুলাই লেক-শোর ট্রেন ধরে শিকাগো পৌঁছবো। এদিকে এখন পামেলা যাবে না, আর খবর পেলাম যে ঋজু আর সমীক্ষা ওই সময়টা আমার বেয়াইবাড়ি আসছে সিরাকিউস শহরে। সেই প্রাগৈতিহাসিক ম্যাপ মুখস্থ করা এতক্ষণে কাজে দিলো। মনে পড়ল লেক-শোর ট্রেন সিরাকিউসে মিনিট পাঁচেকের জন্য থামে। ছেলেটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো। Nissan Rogue SUVর চক্করে পরবর্তী দেখা হওয়াটা একটু অনিশ্চিত বটে! আমি রেল কোম্পানিকে ফোন করলাম। ‘আচ্ছা আমার অমুক তারিখে লেক-শোর ট্রেনা শিকাগো যাবার কথা। আমি কি দুদিন আগে রওনা হয়ে সিরাকিউসে নেমে যেতে পারি? দুদিন পরে আবার একই ট্রেনে বাকি রাস্তাটুকু যাব। এটা কি সম্ভব? লেক-শোর তো রোজই ছাড়ে!’
‘আপনার
কপাল ভালো। টিকিট আছে বটে’।
‘ধন্যবাদ’।
ব্যাস! বেয়াইবাড়িতে জানিয়ে দিলাম যে আমি পরশুদিন দুদিনের জন্য ওদের সকলের সঙ্গে দেখা করতে আসবো। তারপর ৩ তারিখ লেক-শোর ধরে চলে যাবো শিকাগো। আমেরিকায় দেখেছি লোকেরা অনেক আগে থেকে সব প্ল্যান করে তবে লোকের বাড়ি যায়। সকলের সপ্তাহান্তের প্ল্যান ক্যালেন্ডারে দাগানো থাকে বহু মাস আগে। এখানে বলে 'Save the date.' তা আমার কুটুমবাড়ি এমনিতেই খুবই ভদ্রজন। তার ওপর ঋজুর কাছে আমার ‘একা যাব’ প্ল্যান শুনে খানিকটা সন্ত্রস্ত ও বটে।
তারা আমাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানালো। আমিও ঝটপট বাক্স গুছিয়ে ট্রেন ধরলাম। এবার বাক্সে কলাপাতা রঙের শাড়ি, ফুলছাপ সিল্ক, চাঁদের আলোর মতো নরম সাদা রেশমের কাপড়... কিছুই নেই। এবার রয়েছে পাখি দেখার দূরবীন, ইলেকট্রিক কেটলি, চা-পাতা, ফ্লাস্ক-মগ, ফার্স্ট এড বাক্স, জিনস, শার্ট, জ্যাকেট ইত্যাদি প্রভৃতি। আর রয়েছে ফোনে ডাউনলোড করা আমার প্রিয় সব গানগুলি।
মাথার ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা। আজকে ঋজুর সঙ্গে, সমীক্ষার সঙ্গে দেখা হবে। দেখা হবে কুটুমবাড়ির সকলের সঙ্গে। তারপর দুদিন পরেই লেক-শোর চেপে শিকাগো। সেখানে অপেক্ষা করে রয়েছে Nissan Rogue SUV যাকে কিনা আমি এক্কেবারেই চিনি না। তার সঙ্গে যেতে হবে দু’হাজার মাইল। পথে পড়বে কত না রাজপথ, জনপথ... আমি সেই সব দেখতে দেখতে গাড়ি চালাবো অবলীলায়। মাথার চুল এলোমেলো করে যাবে দমকা বাতাস। কিশোরকুমার গাইবেন…
चला जाता हूँ, किसी की धुन में
धड़कते दिल के, तराने लिये
मिलन की मस्ती, भरी आँखों में
हज़ारों सपने, सुहाने लिये, चला जाता हूँ...
আর আমার পাশে... আমার পাশে… একদম আমার পাশে থাকবেন রাজেশ খান্না!
(ক্রমশ)
অসাধারণ লেখা!
উত্তরমুছুনধন্যবাদ…:)
উত্তরমুছুন