ধারাবাহিক উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(২১)
কী
ভাবো তুমি, কতবারই বলেছে লিপিকা, শোভন চট্ করে জবাব দেয়নি। অন্যমনস্ক চোখে তাকিয়ে
থেকেছে। ক-দিন ধরে শোভন খাতা আঁকড়ে হারিয়ে যাচ্ছে, খাওয়া-দাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিতে
হয়। অথচ খাওয়া, ঘুম সবই স্বাভাবিক। লিপিকা আর কত শক্ত থাকতে পারে? ইচ্ছে করে শোভনের
বাড়ির মানুষদের সঙ্গে আলোচনা করতে। শ্বশুর-শাশুড়ি চলে গেছেন এক দশকের বেশি। দূরে থাকার
কারণে বাকিদের সাথে তেমন হৃদ্যতা হল না কখনো। বছর চারেক হল চলে গেছেন ভাসুর, বড়ো-জা
একা থাকেন — ছেলেমেয়ে কাছে
থাকেন না। লিপিকারাই বা ঘনঘন খোঁজ নিতে পারে কই? ছোটো দেওর পরিবারসহ গুজরাটে তার কর্মস্থলে।
বড়ো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মানুষ, বসে ভাবছিল লিপিকা। চাপা বিষণ্ণতা ঘিরে থাকে, ঝেড়ে ফেলতে
চেয়েও পারে না। শোভন নিবিষ্ট হয়ে খাতার ওপরে ঝুঁকে আছে। সে রান্নাঘরের কাজ সেরে খাওয়ার
টেবিলে এসে বসল। এখান থেকে শোওয়ার ঘরের একটু অংশ দেখা যায়। তেমন আর কাজ নেই, টুকটাক
ডাস্টিং সেরে এবারে স্নানে ঢুকে যাবে। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ওঠে, অভ্যেসমতো শোভনের কাছে
এসে দাঁড়ায়। শোভন মুখ তুলে তাকায়, মজার গলায় বলে,
--কখনো
কুস্তি দেখেছো লিপি?
--নাঃ।
তুমি করতে নাকি? এই চেহারায়?
লিপিকাও
হেসে বলে। শোভন খাতাটা তুলে দেয় হাতে, স্কেচগুলো মানুষের অবয়ব নিয়েছে।
--দাদা,
আমি আর রঞ্জু — দ্যাখো সামনে
বিশাল জায়গাটা বালিভর্তি, কুস্তির জোয়ানেরা মাটি মেখে রেডি হচ্ছে।
--হুঁ,
দেখছি। ভালো হচ্ছে তোমার আঁকা। কিন্তু তুমি দেখলে কোথায়?
--যেখানে
ঠাকুর উঠত, ওরই কাছাকাছি ছিল আখাড়া। দাদু যখন বেঁচে ছিল নিয়ে যেত, পরে তিনজনে মিলে দেখতে যেতাম।
খাতা
নামিয়ে রেখে লিপি স্নান করতে চলে যায়। শোভন ঘুরে বেড়ায় অশ্বত্থ গাছের নীচে, অদূরে কুস্তির
আখাড়া। লোকে ভীড় করত কুস্তি দেখতে, প্রতিযোগিতা
হত। লাল-লাল ল্যাংগট-পরা চকচকে চেহারার মোটাসোটা লোক একজন আরেকজনকে তুলে আছাড় মারত
বালিতে। পরক্ষণে বালি ঝেড়ে উঠে পড়ত পড়ে-যাওয়া লোকটা, আর লাফ দিয়ে অন্য লোকটার পিঠে
চড়ে গলা চেপে পেছনে টেনে ফেলত। দর্শক এমনি-এমনি দু-ভাগে ভাগ হয়ে যেত, হাততালি দিত।
দু-জন কুস্তীগীর সবচেয়ে বলবান ছিল — মধু আর হরি।
মধুর মাথা ন্যাড়া, হরি সব চুল টেনে বড়োসড়ো খোঁপা বেঁধে রাখত।
ঠাকুর
যেখানে ওঠে ওখানে আগে ছিল খালি মাঠ, পরে সকলে মিলে চাঁদা তুলে না কি কম্পানি থেকে বেদী
করে দেয়। কে যেন স্বপ্ন পেয়েছিল, দুর্গাঠাকুর সপরিবারে বেদীতে উঠে দাঁড়িয়েছেন।
লাল
ল্যাংগটগুলোতে খুব চেপে চেপে রঙ দিয়েছে শোভন, অশ্বত্থগাছ ঝাঁকড়া সবুজ, একটা পাখির কোটর
তার গায়ে। একদিন দেখেছিল লম্বা বাদামী একটা সাপ আস্তে আস্তে ঢুকছে কোটরের মধ্যে। দাদা
বলেছিল পাখির ডিম খেতে ঢুকেছে। শোভনের বিশ্বাস হয়নি, দাদার সব কথায় সবজান্তা ভাব থাকত।
জানালার
বাইরে তাকিয়ে সে আনমনা বসেছিল, শহরটা শুধু বিল্ডিং-এ ভরে যাচ্ছে। কত বিল্ডিং-এর কাঠামো
সিমেন্টের প্রলেপ মেখে দাঁড়িয়ে আছে, কপাটহীন জানালা দরজার গর্ত ওই অশ্বত্থগাছের কোটরের
মতো হাঁ-করা। নিউ-টাউনে সাত-আট বছর আগে যখন তারা ফ্ল্যাট বুক করেছিল তখন এর চেয়ে ফাঁকা
ছিল। শোভনের গা শিরশির করে ওঠে হঠাৎ, সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তাড়াতাড়ি খাতার দিকে তাকায়।
খাতা, রঙের বাক্স বন্ধ করে সরিয়ে রাখে। খেয়াল হয়, ঘরে পবিত্র গন্ধ ঘুরছে। লিপিকা রোজকার
মতো স্নান করে বেরিয়ে নীচু গলায় গুনগুন করে
ঠাকুরের আসনে ফুল দিচ্ছে। মন প্রফুল্ল লাগে, নিশ্চিন্ত নির্ভাবনার, নরম হালকা আলোর
মতো সংসার তাদের।
লিপিকা চোখে চশমা দিয়ে সেন্টার টেবিলের ওপরে রাখা ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা ওলটাচ্ছিল, ‘পোস্ট মেনোপজ’ সংখ্যা — ওই বয়সে শারীরিক পরিবর্তন, মেজাজের পরির্বতন, বিভিন্ন অসুখ ও তার প্রতিকার, মধ্যবয়সীদের মহিলাদের সাজগোজের টিপস্, পড়তে মন্দ লাগছিল না। শোভন ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছে। তারও ইদানিং কিছুটা ঘুমের সমস্যা হচ্ছে, শোভনের কারণে কিছুটা বিক্ষিপ্ত থাকে। ঘড়িতে এগারোটা বারো, এবারে শুয়ে পড়া উচিত। পাশে রাখা মোবাইলটা দেখে, এক-একদিন হর্ষ হয়ত রাতে দশটা নাগাদ ফোন করে। তবে আজ আর করবে না, ভাবতে ভাবতে মোবাইল দেখায়, বাবুল কলিং। লিপিকা অবাক হয়ে ফোন ধরে,
--কীরে
এত রাতে?
--মা—
বাবুল
চুপ হয়ে গেছে, একটু জড়ানো গলা? লিপিকার অস্বস্তি হয়। সন্দেহ উঁকি দেয়, বাবুল কি ড্রিঙ্ক
করেছে! শান্ত গলায় বলে,
--কী
হয়েছে রে বাবুল, শরীর ভালো আছে তো?
--মা,
তোমাকে কয়েকটা কথা বলতাম—
--বল্
কিন্তু এত রাতে? তোর গলাটা যেন কেমন, কথাগুলো অস্পষ্টমতো—
--মা,
প্লিজ কিছু মনে কোরো না, আজ বেশী হয়ে গেছে —
ড্রিঙ্কিং!
স্তব্ধ
হয়ে যায় লিপিকা, উত্তর দিতে পারে না। কই বাবুল তো কোনোদিন বলেনি আগে, কোনোদিন টের পেতে
দেয়নি যে সে মদ্যপান করে! এত রাতে অসংযত জড়ানো স্বরে মা-কে ফোন করে বলছে কথা আছে —
বিষয়টা
গ্রহণ করতে পারে না। বাবুল আকুল হয়,
--শোনো
না মা, শুনবে না?
--তুমি
সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে কাল কথা বোলো বাবুল, এখন ফোন রেখে ঘুমিয়ে পড়ো। তোমার বাবা শুয়ে
পড়েছে।
ফোন
কেটে দেয় লিপিকা। কোনোদিন সেভাবে শাসন করতে হয়নি ছেলেকে, বুঝদার ছেলে তার মৌন থাকাতেই
বুঝে নিত। ছোট্ট ব্যাপারটায় অসম্ভব ধাক্কা লেগেছে, কানদুটো গরম হয়ে দপদপ করছে, বুকের
মধ্যে জোরালো লাব-ডুব। গায়ের শালটা আলগা করে নামিয়ে সোফার পেছনে মাথা হেলিয়ে নীরব হয়ে
বসে থাকে। পুরনো কথা মনে পড়ে। নিয়মিত না হলেও শোভনও আগে মদ্যপান করত, লিপিকা অশান্তি
করত না, চেঁচামিচিতে সে বিশ্বাস করে না। দিনের পর দিন বাক্যালাপ বন্ধ রাখত। তার অপছন্দের
কারণে কমিয়ে আনে এবং পরে একেবারে ছেড়ে দেয়। ছেলে এতবছর বাইরে, স্বাবলম্বী, বন্ধুবান্ধব
প্রচুর, এসব স্বাভাবিক, বরং তার নিজের ভাবনাটাই বাড়াবাড়ি। লিপিকা যুক্তির পথে নিজেকে
স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে থাকে। রাত বাড়ছে ক্রমশঃ, নিঝুম চারপাশ। আবার ফোন,
--মাসিমণি!
মা-ম্-পি?
এত রাত্তিরে জেগে? কোনো বিপদ-আপদ হয়নি তো বাড়িতে? বুকের মধ্যে ধ্বক করে ওঠে লিপিকার।
যতই জঘন্য অসভ্যতা করুক দেবিকা, মায়ের পেটের ছোটোবোন —
স্নেহ,
মায়া, মমতা আপনা থেকে ক্ষরণ হতে থাকে। অস্থির হয়ে ওঠে লিপিকা। শ্রুতি চাপা গলায় বলে,
--আপাতত
বাড়িতে নতুন কিছু ঘটেনি মাসিমণি, যেমন চলছিল তেমনই সব।
--তবে?
--হর্ষ
খুব আপ্সেট্ মাসিমণি!
--কী?
--তুমি
ওরকম ওর ফোন কেটে দিলে—
লিপিকার
মাথার মধ্যে গুলিয়ে যায়, মা-কে কী পেয়েছে বাবুল! ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলে,
--এগুলো
বলতে বাবুল তোকে ফোন করেছে? ওর কাছে তোর নম্বর--
--আছে
মাসিমণি। আমরা কাজন হই, তুমি ভুলে গ্যাছো।
ধড়ফড়
করে উঠে বসে লিপিকা, সোফাতে বসে গাঢ় ঘুমে চোখ জুড়ে গিয়েছিল। ফোন খুলে দেখে বাবুলের
ফোনের পরে কোনো ফোন নেই। এত রাতে হঠাৎ মাম্পির ফোন আসার কথাই নয়, লিপিকা স্বপ্ন দেখছিল।
মাম্পি পরিণত মেয়ে — খুব জরুরি অবস্থা
ছাড়া ফোন করার কারণ নেই। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফ্যালে লিপিকা, মাম্পির প্রতি কেমন বিরাগ
ও আশঙ্কার গর্ত হয়ে আছে মনের মধ্যে। অথচ তার যথেষ্ট কারণ নেই। বাবুল যেমন সরল, মাম্পি
ততটাই বুদ্ধি রাখে — সমবয়সী দুটি
ছেলেমেয়ের মানসিকতার বিরাট পার্থক্য তাদের বড়ো হয়ে ওঠার পরিবেশ। মাম্পির জন্য ঈষৎ
মায়া হয়, মনখারাপ লাগে ছেলের জন্য, অনুতাপ হয়, ওভাবে ফোন কেটে দেওয়া ঠিক হয়নি।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন