কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০২ |
বাবা
বাবার আদেশ, পাত্রপক্ষের সামনে আসতেই হল রুমেলাকে।
অথচ সে সবে একুশ। দরজায় কলেজীয় রোমাঞ্চ। মনের গভীরে গোপন স্বপ্নের ফিসফাস। বড়দাভাইয়ের
মতো দশ লেনের হাইওয়ে ধরে গাড়ি হাঁকিয়ে অফিস, বিদেশী জার্নালে ছাপা রিসার্চ-পেপার, আরো
কত কী! মাঝে এই বেমক্কা ঝড়।
ছোটকার সেন্স অফ হিউমার আর শার্প উইটের ওপর
অগাধ ভরসা রুমেলার। কোনরকম ঝুটঝামেলা ছাড়াই এযাত্রায় নিশ্চয়ই রক্ষে পাবে। তার পাশেই
বসেছে ছোটকা। চোখ পিটপিট করে পাত্রের টপ-টু-বটম স্ক্যান করছে, ঠোঁটে টেপা হাসি। বাকিরা
ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ইতিমধ্যেই মিছরি ভেজানো নরম মালাইওয়ালা ডাবের জল পরিবেশিত হয়েছে। আধুনিক
পরিবার, প্রশ্ন-উত্তর ছাড়াই পাত্রী পছন্দ হয়ে গেল। দেনা পাওনাতেও তীব্র আপত্তি এঁদের।
ছোটকা ব্যাট ধরেনি এখনো, রুমেলা ঘামতে শুরু করল।
পরিবারতন্ত্র থেকে রাজনীতি হয়ে আলোচনা লেখাপড়ায়
এসেছে। কিছুক্ষণ আগেই প্লেটভর্তি মাছের ছোট ছোট গুলিকাবাব, সঙ্গে ধোঁয়াওঠা মাখোমাখো আলুর তরকারি আর স্যালাড সার্ভড হয়ে গেছে। পাত্রের
বাবা বললেন, ছেলের বড়ো ইচ্ছে হাভার্ডে ইকনমিক্স নিয়ে গবেষণা করবে। অমর্ত্য সেন তার
আইডল। প্রাথমিক খরচপাতি তিনি সামলে নেবেন।
পরেরগুলো যদি এবাড়ি থেকে পেয়ে যায়, ছেলেটার স্বপ্নপূরণ হয়।
-গোত্র কী? ঝুপ করে ছোটকা মাঠে নেমে পড়ল।
-সরি! পাত্রের মুখে বিস্ময়। তার মা বললেন,
ও ঠিক জানে না! আমরা কাশ্যপ!
-সেকি! সব পরিবারেরই গোত্র থাকে, সেটা জানো
তো? কেন থাকে বলো তো?
চাহিদা-যোগানের গ্রাফের মতো পাত্রের চোখ ওঠানামা
করছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরের তীর ধেয়ে গেল, প্রবর কতগুলো জানা আছে বাবা!
-না! মানে আজকাল তো এসব আর…
-শুধু ইকনমিক্স শিখলেই হবে! নিজের ওরিজিনটাও
জানা দরকার। আমাদের পরিবার এক্কেবারে সেকেলে টাইপের। দুবেলা আহ্নিক মাস্ট! ছেলেমেয়েদেরও
একই রুটিন।
ভাইবোন এমনকি মা কাকিমাদের মুখেও প্রশ্নের
ফুলঝুড়ি। ছোটকা বলে চলেছে,
যুক্তি-বুদ্ধি বলে যুগ বদলেছে! কিন্তু কিছুতেই
ওই ভড়ংটুকু ছাড়তে পারছি না আমরা। আমাদের পরিবারে যে যুক্ত হবে, তারও সেম সেন্টিমেণ্ট
থাকবে, সেটাই চাই।
পাত্রের করুণ দৃষ্টি রুমেলাকেও ছুঁয়ে গেল।
আচমকা বাবা বলে উঠলেন, আমার মেয়ে অক্সফোর্ড থেকে কন্টেম্পরারি লিটারেচর নিয়ে রিসার্চ
করতে চায়। ভালোই হয়েছে, হাভার্ড আর অক্সফোর্ডের মাঝে তো শুধু অ্যাটলান্টিক। দুজনেই
যাক। সংসারও হবে, সঙ্গে লেখাপড়াও। আপনার ছেলের খরচ আমরা দিয়ে দিচ্ছি। আমাদের মেয়েরটা
না হয় ওর হাসব্যান্ড দিয়ে দেবে!
পরিবারের সকলের মুখে মারকাটারি আলো, ছোটকারও।
রুমালি ভাবছে, বাবা তার স্বপ্নের কথা জানলো কী করে! সে তো কাউকে বলেনি!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন