কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০১ |
আনন্দশিল্যুট
পাখি ফিরে আসে। ঘরে না ঢুকে আবার এসে দাঁড়ায়
গেটের কাছে। কাঠের গেট। বেশ প্রাচীন। তবে শক্তপোক্ত। গ্রামীণ অথচ আন্তরিক এক
সৃষ্টি। এই গেটের উপর হাত রাখলেই পাখি যেন টের পায় এক অন্য ধরনের পেশাদারিত্বের
উষ্ণতা। একা পাখি এ রকম অনেক কিছুই টের
পায়। যেমন, শ্যামল যখন তাসের আড্ডায়, পাপাইদেরও সাড়া পাওয়া যায় না, অন্ধকারের
অপ্রতিরোধ্য এক টান ও টের পায়। চারপাশের বুনো বাসকপাতার ঝোপের বেড়া, ঝুপসি হয়ে
দাঁড়িয়ে থাকা সাদাগোলাপি ফুলের শিরিষ গাছ আর ঠান্ডা অন্ধকার তখন পাখির সঙ্গী। সারা
দিনের সব প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি পাখি তখন নিরুদ্বেগে উচ্চারণ করে যায় ওদের সামনে। শিরিষফুলের রেণু মেখে বাসকপাতার ওমটুকু নিয়ে
অন্ধকার তখন চুপচাপ এসে বসে যেন সামনে।
পাখি তখন অন্য পাখি। নরম গলায় পাখির বলা সব কথার ওরা যেন তন্ময় শ্রোতা। কখনও এসে
বসে ও পাশের কুলিবস্তির সাদাকালো কুকুরের বাচ্চাটাও। আর পাখি কথা বলে। একটু একটু
ডুবে যায় এক অন্য বাতাসে। এরা কেউ কখনও বলে না, রাত হয়েছে, পাখি ঘরে যাও। আর তার
পরের দিন সারাটা সকাল এই বাতাবরণ তাকে যেন আগলে রাখে সমস্ত তুচ্ছতা থেকে, উদ্বেগ
থেকে, অকারণ ভয় থেকে।
এই যেমন এখন। চারপাশে অন্ধকার, বুনোগন্ধ আর
রাতপোকার শব্দ নেমে আসছে নিরবচ্ছিন্ন। কে যে
কাকে সঙ্গত করছে, জানাটাই যেন অপ্রাসঙ্গিক। এক মায়াজাল ছড়িয়ে পড়ছে পাখির
চারপাশে। মেয়ের জন্য উদ্বেগ, শ্যামলের জন্য চিন্তা ওকে ভিতরে ভিতরে কষ্টে রেখেছিল। সামনের বজরি ছড়ানো রাস্তাটা
একটু ঘুরে সোজা চলে গিয়েছে অনেক দূরে, বড়ো রাস্তার দিকে। নীলু ওই রাস্তা থেকে আরো
আর-ও বহু দূরে চলে গেছে। বিদেশে। পাখির হয়তো সেখানে কোন দিন যাওয়া হবে না। নীলুকে
আর কাছে না পাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে পাখি সে সব থেকে দূরে সরে
যাচ্ছে একটু একটু। শুধু সুগভীর টান যেন। সবার জন্য। বাবুইয়ের জন্য, নীলুর জন্য,
পাপাইয়ের জন্য, ঐ সাদাকালো কুকুরশাবকের জন্য, বুনো গন্ধের জন্য, শ্যামলের জন্য।
পাখির সারা শরীর যেন যেন আনন্দ হয়ে ওঠে এই প্রায় অপার্থিব সাহচর্যে। পাপাইয়ের
থুতনির টোল, বাবুইয়ের নরম চোখ, নীলুর থুতনির নিচের ছোট্ট বাদামী মশা, শিরিষের
পাউডারপাফের মত ফুলের রেণু - সব কিছুকে ছুঁয়ে দেখতে পাখির খুব ইচ্ছে করে, এক্ষুনি।
ওর ছিপছিপে শরীরের ডান হাঁটু সামান্য ভাঁজ হয়ে
আসে, ডান হাতের পাঁচটা আঙুল যেন আকুল, সমস্ত শরীরে যেন অলৌকিক এক নাচের মুদ্রা ঘন হয়ে আসে।
বাতাসে কোথাও ভারি এক গভীর আবাহনের শঙ্খ বাজছে।
পৃথিবী অপেক্ষা করছে। এখন পাখির শুধু আনন্দ। আঙুলসব কখন যে পাখির অজান্তেই নাচের
মুদ্রা হয়ে উঠেছে!
অন্ধকারে পাখি এখন শুধু এক চিরন্তন নির্জন আনন্দশিল্যুট!
দূরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে শ্যামলের মোটরসাইকেলের শব্দ দ্রুত গড়িয়ে আসছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন