সিনেমার পৃথিবী – ১৩
আজ আমরা ফিরে দেখব ইতালির সিনেমা। যে
দেশে সবথেকে বেশিবারের জন্য বিদেশী সিনেমা বিভাগে অস্কার পুরষ্কার গেছে। মোট ১৪ বার।
স্বাভাবিকভাবেই, ইতালির সিনেমা নিয়ে মানুষের আগ্রহ খুব বেশি। আমি এই দেশের যা যা ছবি
দেখেছি, আজ তার ভেতর আমার মত করে কিছু সিনেমা প্রথমে বেছে নেব।
রোসেলিনির ‘রোম, ওপেন সিটি’ (১৯৪৫) ও
‘জার্নি টু ইতালি’ (১৯৫৪), ডি-সিকার ‘শু-শাইন’ (১৯৪৬) এবং ‘বাইসাইকল থিভস্’ (১৯৪৯),
ফেলিনির ‘লা ডোলচে ভিটা’ (১৯৬০) ও ‘এইট অ্যান্ড হাফ’ (১৯৬৩), অ্যান্তনিয়নির ‘রেড ডেসার্ট’
(১৯৬৪) এবং ‘লা ভেঞ্চুরা’ (১৯৬৫), বার্তোলুচির ‘দ্য কনফর্মিস্ট’ (১৯৭০), র্যাডফোর্ডের ‘ইল পোস্টিনো’ (১৯৯৪), বেনিনির
‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’ (১৯৯৭) এবং সোরেন্টিনোর ‘দ্য গ্রেট বিউটি’ (২০১৩)। আমার মনে হয় এগুলো দেখলে ইতালির সিনেমা নিয়ে বেশ খানিকটা ধারণা
মাথায় ঢুকে যাবে।
এই ১২টা একদিনে আলোচনা করা যাবে না।
তাছাড়া আমি এর ভেতর একটা ইতিমধ্যেই আলোচনা করে ফেলেছি, ভবিষ্যতেও আরো কয়েকটা করব। অতএব
আজ মাত্র চারখানা ছবির কথা বিশদে বলব - রোম ওপেন সিটি, লা ডোলচে ভিটা, রেড ডেসার্ট
ও দ্য কনফর্মিস্ট। আশাকরি আমার পাঠকরা, যারা আমার এই লেখা থেকে উৎসাহ পেয়ে বিভিন্ন
দেশের সিনেমা দেখতে শুরু করেছেন, বুঝতে পারবেন আমার এই চারখানা সিনেমা বেছে নেবার কারণ
কী হতে পারে।
ইতালির সিনেমায় স্বর্ণযুগ বললেই নব্য-বাস্তবতার
কথা উঠতে বাধ্য। এবং লক্ষ্য করুন, আমার বাছাই করা শুরুর দিকের ছবিগুলোও সেই সময় ধরেই
উঠে এসেছে। এই নব্য-বাস্তবতা (যা এর আগে ফ্রেঞ্চ সিনেমা ‘হিরোশিমা মাই লাভ’ নিয়ে বলতে গিয়ে খানিক আলোচনা করেছি) ইউরোপে এসেছিল
ইতালির হাত ধরেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালিতে মুসোলিনির পরাজয় সমাজে অনেক পরিবর্তন
আনে, যার প্রধান ছিল শিল্প ও সংস্কৃতিতে কাব্যিক বাস্তবতা, মার্ক্সিস্ট প্রভাব এবং
খেটে খাওয়া মানুষের আদর্শ ও জীবনকথা প্রকট হয়ে ওঠা। ইতালির সিনেমা সেই দিক তুলে ধরতে
শুরু করার পর ইউরোপের অন্যান্য দেশেও তা ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে অন্যান্য মহাদেশেও।
আর এখানেই আমি ইতালির সিনেমাকে ফুল মার্কস দেব। কারণ একটা আন্দোলন যে সিনেমার মাধ্যমে
এভাবে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তা ইতালি
দেখিয়েছিল। সেজন্য আজ আমার প্রথম বাছাই ‘রোম, ওপেন সিটি’।
মুসোলিনির ফাঁসি হয়েছিল ১৯৪৫-এ। আর রবার্তো
রোসেলিনির ‘রোম, ওপেন সিটি’ সেই বছরেই রিলিজ হয়ে প্রচলিত ধারণায় এমনভাবে নব্য-বাস্তবতার
ধাক্কা মেরেছিল যে ১৯৪৬-এ এই সিনেমাকে কান ফিল্ম ফেস্টিভালের মাধ্যমে পৃথিবী জোড়া স্বীকৃতি
দেওয়া হয়। অস্কার-এর জন্যও এই ছবিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। মূলত এই সিনেমাই গোটা পৃথিবীতে
নব্য-বাস্তবতার ঢেউ ছড়িয়ে দিয়েছিল।
১৯৪৩ সালের ১৪ অগস্ট রোম ‘মুক্ত শহর’
হিসেবে ঘোষিত হয়। যে কারণে বিদ্রুপবশত এই সিনেমার
নাম ‘রোম ওপেন সিটি’। গল্প দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায়। ১৯৪৪ সাল। মুক্ত শহর হলেও রোম যখন ফ্যাসিজম
আর জার্মানির নাজি দিয়ে অবরুদ্ধ। সেই সময় মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া বিভিন্ন চরিত্র
নিয়ে এই সিনেমা। যার পুরোভাগে এক ইঞ্জিনীয়ার এবং এক ক্যাথলিক ধর্মযাজক। মাঝে কিছু টুকরো
রোমান্টিক চরিত্রায়ন। এক সাধারণ গল্প। মুক্তিযুদ্ধের
চোয়াল চাপা সাহস। এবং সেই থেকে এই ছবির লিজেন্ড হয়ে ওঠা।
পৌনে দু’ঘন্টার এই সিনেমা থেকে প্রাপ্তি
বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় ছবির পরিচালনা ও
দৃশ্যায়নের কথা। তারপর সিটে বসিয়ে রাখার মত কিছু অভিনয়, যার প্রথম নাম অবশ্যই সেই ক্যাথলিক
ধর্মযাজক হিসেবে আল্ডো ফ্যাব্রিজি এবং নিজের মৃত্যুর দিকে অকুতোভয় দৌড়ে যাওয়া আনা ম্যাগনানি।
ওপেন সিটি খুব কম বাজেটের ছবি যেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক আলো ব্যবহার করা
হয়েছিল। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক প্রায় নেই। ছবির ন্যারেটিভ অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তব ঘটনা
থেকে নেওয়া, এবং পেশাদার অভিনেতা ওপরের দুজন ছাড়া প্রায় নেই। অথচ এতকিছু খামতি থাকার
পরেও এই সিনেমা শুধুমাত্র নব্য-বাস্তব নাটকীয়তার জন্য ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চূড়ান্ত সফল।
কীভাবে ওপেন সিটি লিজেন্ড হয়ে উঠল? প্রধান
কারণ অপেশাদার চরিত্রায়ন, যারা মাটি থেকে উঠে
এসে ছবি জুড়ে মাটির গন্ধ আর সাহস বয়ে বেড়িয়েছে। এবং এই সিনেমা মেলোড্রামা নয়, যুদ্ধের
নৃশংসতার এক উপাখ্যান হয়ে উঠেছে। যে দৃশ্যের জন্য এই সিনেমা বিখ্যাত, তা হল গর্ভবতী
পিনার ভূমিকায় আনা ম্যাগনানির দৌড়। ক্যামেরা রাখা হয়েছে চলন্ত ট্রাকে, এবং ফোকাস করা
হয়েছে পেছনে দৌড়ে আসা কালো পোষাকের পিনার দিকে। তাকে গুলি করে মারার পর সে রাস্তায়
পড়ে যাচ্ছে, সাদা পোশাক পরে তার বাচ্চা এসে তার লাশ জড়িয়ে ধরছে, আর ধর্মযাজক পিনার
লাশ নিজের দিকে তুলে ধরে দেখার চেষ্টা করছেন সে বেঁচে আছে কিনা। যুদ্ধের পাশবিকতা হয়ত
এর থেকে ভাল আর বোঝানো যেত না। সাদা ও কালো পোষাকের কম্বিনেশন অনবদ্য। তবে হ্যাঁ, ফটোগ্রাফার
হিসেবে আমার একটু আপত্তি আছে ঐ চটজলদি কাটসিনগুলোয়। পিনা গুলি খেয়ে রাস্তায় লুটিয়ে
পড়ার পর ক্যামেরার উচিৎ ছিল আরো অন্তত দু’সেকেন্ড সেই চলন্ত ট্রাক থেকে পিনার দিকে ফোকাস করে রাখা।
আরেকটা সিন, যেখানে বাচ্চারা রোম শহরকে আবহে রেখে হেঁটে চলে যাচ্ছে, সেটাও লক্ষ্য করার
মত। দেখবেন, থমাস হার্ডির কবিতা মনে পড়ে যাবে – ‘war’s annals will fade into
night/ ere their story die’। হ্যাঁ, যে কথাটা না বললে এই আলোচনা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে,
তা হল, এই সিনেমার স্ক্রিন-প্লে লিখেছিলেন ফেদেরিকো ফেলিনি।
ফেদেরিকো ফেলিনির ‘লা ডোলচে ভিটা’ বা
‘দ্য সুইট লাইফ’ ইতালির নব্য-বাস্তবতার পরবর্তী উদাহরণ। ওপেন সিটির পরেই একে বেছে নিলাম
এক বিশেষ কারণে। বিশ্বযুদ্ধ শেষে দারিদ্র আর
ধ্বংসস্তুপের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা ইতালির মধ্যে
এক বিশেষ শ্রেণী ধীরে ধীরে যে চকচকে সমাজ নিজেদের আশেপাশে গড়ে নিচ্ছিল, এই ছবি সেই সমাজের প্রতিচ্ছবি। এক গসিপ
ম্যাগাজিনের সাংবাদিক মার্সেলো সাতদিন ধরে রোমের আপাত উচ্চশ্রেণীর মধ্যে সুখ আর ভালবাসা
খুঁজে চলেছে। সেই বৃথা খুঁজে বেড়ানোর ছবি
‘দ্য সুইট লাইফ’। এই ছবির প্রধান সাত টুকরো
হল রোমের রাস্তায় মার্সেলোর সাতদিন ও রাত। এবং তার আগে রোম নতুন করে বানানোর এক ভূমিকা
ও সবশেষে এক উপসংহার। পুরোটাই মার্সেলোর বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে ফ্লার্ট ও যৌনতা, উচ্চশ্রেণীর
মানসিক অনিশ্চয়তা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন দ্রুত
জীবনযাত্রার প্রতি আসক্তি, এই নিয়ে। নিজের প্রেমিকার দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া, বাবা বুকে
ব্যথা অনুভব করা সত্বেও ছেলের কাছে যেতে গররাজী, মার্সেলোর এক বিখ্যাত ফিল্ম-স্টার
সিলভিয়াকে নিয়ে ট্রেভি ফাউন্টেনে রাত কাটানো – এই সমস্ত ঘটনা যুদ্ধ পরবর্তী ইতালির
ভঙ্গুর সমাজের নিদর্শন, যা চাকচিক্যের পেছনে দৌড়ে চলে। এই সিনেমা ট্রাডিশনাল প্লট ভেঙে
দিয়ে আলাদা টুকরোয় জোড়া মালা গেঁথে এক দৈনন্দিন বৈষম্য গড়ে তুলেছে, যে কারণে একে বিশ্বের
অন্যতম সেরা ড্রামা ছবি হিসেবে ধরা হয়।
সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন সিনেমার কাজ হল
সেলুলয়েডে জীবন ফুটিয়ে তোলা। সেই থিয়োরি মেনে নিলে ‘লা ডোলচে ভিটা’ দশে দশ পাবে, কারণ
এই সিনেমা এমন একজনের জীবনকে ছুঁয়ে ঘুরে চলেছে
যার না আছে দিশা, না আছে কেন্দ্র। সে বিক্ষিপ্ত গ্রহাণুর মত ঘুরে চলেছে, জানে না কোথায়
সুখ পাবে। অথচ তার জীবনের পালটে যাওয়া রোজনামচা
আছে। প্রায় তিন ঘন্টার এই সিনেমা দেখে আমি বুঝেছিলাম, এই ছবি আসলে দিন ও রাতের একাকীত্বের
ছবি, চড়াই ও উৎরাইয়ের ছবি, এক জায়গা থেকে শুরু করে সেখানে আর ফিরে না আসার ছবি। মোদ্দা
কথায় এই ছবি বর্ণনা করতে গেলে ক্যাওস থিয়োরি জানতে হবে। শুরুর সিনটার কথাই ধরা যাক।
যুদ্ধবিধ্বস্ত রোমে যিশুখ্রীষ্টের নতুন এক মূর্তি আনা হচ্ছে। হেলিকপ্টার উড়ছে, আর জেলেদের
জালে এক বিশাল ক্যাটফিশ লাফাচ্ছে। একজন প্রাণহীন, আরেকজন প্রাণের প্রতিভূ। এই অক্সিমোরন
চলেছে সিন থেকে সিনে। এবং বয়ে গেছে অফুরন্ত প্রা্ণশক্তি। সেই শক্তির অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে ফিল্ম-স্টার সিলভিয়ার ভূমিকায় অনিতা
একবার্গ ও ট্রেভি ফাউন্টেনে তার শিহরণ তোলা ভিজে চলার দৃশ্য।
এই সিনেমা মনোযোগ দিয়ে দেখার পর আমার মনে হয়েছে, আসলে সুইট লাইফ বলে কিছু হয় না। পুরোটাই এক মরীচিকা বা প্রহেলিকা। কিন্তু নিজেকে নিজের মত করে সেই সুইট লাইফ খুঁজে নিতে হয়। আর সেখানেই এই সিনেমা আর মার্সেলোর অমরত্ব। নব্য-বাস্তব ফেলিনির পরিচালনার অমরত্ব।
মাইকেলেঞ্জেলো অ্যান্তনিয়নির ‘রেড ডেসার্ট’
ইতালির নব্য-বাস্তব ধারণার পরের উদাহরণ। যুদ্ধবিধ্বস্ত
রোমে একে একে তৈরি হচ্ছে কারখানা। কারখানার শব্দ, ধূলো-ধোঁয়া, দূষণ আর নোংরা হয়ে যাওয়া নদীগর্ভ – সেখান
থেকে উঠে আসছে নব্য-আস্তবতার আরেক সংজ্ঞা।
অ্যান্তনিয়নির ‘লা ভেঞ্চুরা’ র থেকে আমি ‘রেড ডেসার্ট’-কে বেশ খানিকটা এগিয়ে রাখব শুধুমাত্র
থিম আর রংয়ের ব্যবহারের জন্য।
এ ছবির গল্প ফেলিনির ভিটা-য় উচ্চশ্রেণীর
মানসিক অনিশ্চয়তার পরের ধাপ। এক কারখানা মালিকের
স্ত্রী, যে মানসিকভাবে অস্থির এবং নিজের জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না, তাকে নিয়ে।
সেই কারখানার এক শ্রমিকের সঙ্গে তার রোমান্স নিয়ে। আর অবশ্যই এর পাশাপাশি নিম্নবিত্ত
শ্রমিকদের জীবনযাত্রার দুর্দশা নিয়ে। যেখান থেকে ‘বাইসাইকল থিভস্’ শ্রমিকদের চাকরির
হাহাকার দিয়ে শুরু করছে, ‘রেড ডেসার্ট’ সেখানে
থেকে কয়েক পা এগিয়ে কারখানার জন্য শ্রমিক আর
প্রকৃতির দূষিত হয়ে যাওয়া ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছে।
আমি কিন্তু এই সিনেমাকে শিল্পায়ন বা দূষণ দেখানোর জন্য বাছিনি। আমার চোখে এই সিনেমা সেলুলয়েডে এক জীবন্ত ক্যানভাস, যেখানে প্রতি পাতায় কাব্যিক বাস্তবতা। নব্য-বাস্তব সিনেমার অন্যতম প্রধান চিহ্ন। শিল্পায়ন কীভাবে প্রকৃতিকে নষ্ট করছে, তা দেখানোর জন্য অ্যান্তনিয়নি এই সিনেমা বানাননি। উনি কল কারখানার ভেতর দিয়ে গদ্যময় পৃথিবী কীভাবে দর্শকের চোখে পদ্যময় করে তোলা যায়, সেই চেষ্টা করেছেন। উনি বলেছেন ‘my intention was to translate the poetry of the world, in which even factories can be beautiful. The line and curves of factories and their chimneys can be more beautiful than the outline of trees, which we are already too accustomed to seeing’। অদ্ভুত, তাই না! আরো বলেছেন যে উনি এই সিনেমায় রং ও ক্যানভাসের সম্পর্ক আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন, সেইমত প্রতি সিন উঠে এসেছে। অর্থাৎ মোটিফ রইল কারখানার দূষণ ও শ্রমিকদের অপরিচ্ছন্ন জীবন, কিন্তু আসলে ফুটে উঠল পেইন্টিং-এর এক গোটা ক্যানভাস – এক কবিতা। সিনেমার শেষ সিন ভালভাবে লক্ষ্য করুন। মা আর ছেলের কথোপকথন। হু হু করে বিষাক্ত হলুদ ধোঁয়া বেরচ্ছে। ছেলে জিজ্ঞেস করছে, এই ধোঁয়ায় পাখিরা কি মারা যাবে? মা বলছে, না, পাখিরা জানে কোথা দিয়ে উড়তে নেই। কবিতা আর জীবন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। হয়ত আমার কথায় বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু আমার মতে এই সিনেমা অ্যান্তনিয়নির সেরা ছবি।
অ্যালবার্তো মোরাভিয়ার বিখ্যাত উপন্যাস
‘দ্য কনফর্মিস্ট’ (১৯৫১)। সেই নিয়ে বার্নার্ডো
বার্তোলুচি ১৯৭০ সালে বানালেন ‘দ্য কনফর্মিস্ট’। ছবির পটভূমি ৩০-এর দশকের ফ্যাসিস্ট
ইতালি। মার্সেলো নামক এক ফ্যাসিস্ট সমর্থক স্ত্রীকে নিয়ে প্যারিস যাচ্ছে তার বহু আগের
পরিচিত একজন প্রফেসরকে মারতে, যিনি আর ফ্যাসিজমের সমর্থক নন এবং ইতালি ছেড়ে প্যারিস
গিয়ে জীবনযাপন করছেন। সেখানে গিয়ে মার্সেলো প্রফেসরের তরুণী স্ত্রীর প্রেমে পড়ে। এবং
মার্সেলোর স্ত্রীর সঙ্গে প্রফেসরের তরুণী স্ত্রীর
লেসবিয়ান সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ছবি শেষ হচ্ছে ১৯৪৩-এর
পটভূমিকায়, যখন মুসোলিনি সরে যাচ্ছে আর মুক্তিযুদ্ধের হাওয়া এসে গোটা দেশ ঘিরে ধরছে।
মার্সেলো তখন এক সচ্ছল জীবন যাপন করছে, স্ত্রী পুত্র নিয়ে।
এই ছবি প্রাথমিকভাবে মনস্তত্ব নিয়ে আলোচনার
দাবি রাখে। কনফর্মিস্ট বলতে কী বোঝায়? এরা কারা? ইতালিতে ফ্যাসিজম চলাকালিন এক শ্রেণীর
লোক সেই শ্রেণীর ভেতর সমান বন্টন ব্যবস্থায় বিশ্বাস করত। সমাজে স্বাভাবিকতা চাইত। তারা মনে করত কোন এক বিশেষ শ্রেণীর প্রত্যেকের
হাতে সমান সম্পদ ও ক্ষমতা থাকা দরকার। এরাই
কনফর্মিস্ট। মার্সেলো সেই শ্রেণীর। সে আমলা, উচ্চবর্গের, বুদ্ধিজীবী কিন্তু শৈশবের যৌন অত্যাচার
ও বৈষম্যের কারণে যে ভাবেই হোক সমাজে এক বড় গোষ্ঠীর মধ্যে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে
চায়। সেই ধারণা তার মধ্যে এঁটে বসে গেছে (কনফর্ম)। আর এই স্বাভাবিক বাস্তবে ফেরার জন্য মার্সেলো সমস্ত অস্বাভাবিক কাজ করতেও
রাজি। যে কারণে সে তার প্রফেসর ও তার স্ত্রীকে হত্যা করতে পিছপা হয়নি। এই মনস্তত্ব
ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে, আমার মনে হয়েছে, বার্তোলুচি সাহায্য নিয়েছেন জার্মান এক্সপ্রেসনিজমের।
তাঁর সিনেমায় ৩০-এর দশকের এলিট ক্লাসের এমন কিছু ঘরবাড়ি আসবাব জীবনযাপনের ব্যবহার রয়েছে যা ৩০-৪০এর
জার্মান সিনেমার সঙ্গে মিলে যায়।
এই ১১০ মিনিটের সিনেমা তৈরি করার সময়
বার্তোলুচির বয়স ছিল মাত্র ৩০। বেশ কিছু ভুল ছিল এই ছবিতে। যেমন সিন থেকে সিনে কিছু
মিসিং লিঙ্ক রয়ে গেছিল। কিন্তু তার পরেও এই সিনেমা অনবদ্য, বিশেষ করে ৩০-এর দশকের ইতালি
ও ফ্রান্স ফুটিয়ে তোলা, যা নব্য-বাস্তবতার আগের দলিল হিসেবে কাজ করেছে। এবং যা না বললে
এই সিনেমার প্রতি অবিচার করা হবে, তা হল ক্যামেরার কাজ। খুব কম ছবিতেই আলো-ছায়ার এত
ভাল কাজ দেখা গেছে। বড় বড় হলঘর ব্যবহার করে তার আলো-ছায়ার স্পেস থেকে ফ্রেমে ভেঙে সিন
ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, বিভিন্ন আর্কিটেকচার ব্যবহার করে সিনের ভেতরেই একাধিক সিন বানানো
হয়েছে। এবং ক্যামেরা রাখা হয়েছে এমন কিছু অ্যাঙ্গলে যা কখনোই সাধারণভাবে ব্যবহার হয়
না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্যামেরা বাঁকা, ফলে
ভার্টিকাল ফ্রেম তৈরি হয় না। আমাদের চোখও সেট হয় না। যেমন রাস্তা দিয়ে গাড়ির চলে যাওয়া
বা কোন একজনকে গাড়ির পিছু ধাওয়া করা। দেখলে বুঝবেন। এর সাথে আছে ডিপ কালার কনট্রাস্ট।
সব মিলিয়ে বার্তোলুচির ক্যামেরা যেন হয়ে উঠেছে জেলখানা। এবং এই পুরো কাজটা করতে গিয়ে
দক্ষ হাতে ফ্রেম থেকে ফ্রেমে ফ্যাসিস্ট ইতালির ইতিহাস ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই ছবি দেখার
পর দর্শকের একটা ঘোর লেগে থাকতে বাধ্য।
শেষ করার আগে এই প্রসঙ্গে আরেকটা ছবির
কথা বলতে চাই। পাসোলিনির ‘সালো, অর 120 ডেজ অব সোডোম’ (১৯৭৫)। তবে সিনেমার ভেতরে ঢোকার
খুব তীব্র প্যাশন না থাকলে এটা দেখবেন না,
কারণ এটা দেখলে আপনার ঘেন্না পাবে, গা ঘিনঘিন করবে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে
ফ্যাসিস্ট ইতালিতে বাচ্চাদের ওপর কী রকম শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন হত, তার দলিল
এই সিনেমা।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন