রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১

মৌ চক্রবর্তী

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০১



হাঁটছে ওরা

 

হেঁটে আসছিল কামিনী আর বিজু। ভাইবোন দুজনে ফিরছে, ক্লান্ত। আলপথে ফেরা। দূরের গ্রাম, বসত। বোঝার উপায় নেই। ঘুঁটঘুঁটি অন্ধকার। কামিনী চলতে পারছে কি? বিজু ভাবে। কামিনী ওর চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। প্রান্তিক ডুবে গেছে।   কামিনী ভাবে, ওর বুড়ো বাপটা কীভাবে কাজ করে এই রাস্তা দিয়ে ফিরত! ট্রেন  যায় যায় যায়। আলো আর শব্দ চিরে দেয় ওদের শরীর, শুধু ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে  থাকে। কামিনীর আঁচল উড়ে নেতিয়ে পড়ে ফের। বিজুর চোখ দেখতে চেষ্টা করে। দেখা যায় নাকি ওভাবে! আর একটু দূরে কে যেন! কামিনী বলে, বাবা! বিজু চার পা পিছিয়ে ধরে ফেলে। কামিনী ফের অজ্ঞান। এই ঘন অন্ধকারে মাঠের মধ্যে  কোলে করে বসাও তো নিরাপদ নয়! আল ধরে হয়ত বা সাপ। বিজু সাপ বলতে নেই, রাতে বলতে হয় লতা। বাপ বলত। কান ভোঁ ভোঁ করে। বিজু জানে, মা খবরটা বিশ্বাস করেনি। তাই তো ওদের যেতে হল। হেঁটে, না ছুটে গেছিল দুই  ভাইবোনে। ওহ, ট্রেন মেলে। কামরায় বমি করেছিল কামিনী।

একটা ট্রেন ওদের ভেতর দিয়ে ফালাফালা করে যাচ্ছিল যেন। কামিনীর হাতে বাপের ধুলো-রক্তমাখা জামা। যাওয়া ছিল দুশ্চিন্তার। আর ফিরে আসা? যেন ফেরা নয়। ফিট হয়ে যাচ্ছিল কামিনী। ও হাট থেকে কিনে দিয়েছিল। স্টেশন মানে কত লোক। সব্বাই দেখতে আসছে। রেলে কাটা শ্রমিকের ছেলেমেয়েদের দেখতে। কেউ বলে, এরা? কেউ বলে, এ তো নরম্যাল? কেউ একজন মজা ছুঁড়ে দেয়, বলে, এবারে লাখটাকা পাবে। ফিটফাট জামা পরে বাবু হবে। চ্যানেলে বসবে।

যারা মরেছে তাদের কারোর বাড়ির কেউই আসেনি। অন্যরকম হলেও তো মৃত্যু!  কতগুলো বাপ মরেছে গো! বিজু বলে, হ্যাঁ, সিটাই তু ভাব। কতগুলা বাপ। হয়ত  তান্দের ঘরে আরও কচি ছেলেমেয়ে। কামিনী বলে, লালি কত খুঁজবে। বিজু বলে, মায় তো মাথা ঠুকে ঠুকে…

-ঐ, তু জামা–টামাগুলো দে। পুড়িয়ে দেই। কামিনীর হাতে একটা বোতাম। ভাঙা রেললাইনের সঙ্গে দুটো শরীর যেন ধোঁয়াতেই কাঁদছে। বিজু বলে, মায় জানতে চাইলে বলবি যে, উ অন্যলোক। আমাদের বাপ নয়। সে আর কোথাও আছে হবে, হাঁটছে। কামিনী তাকায় শুধু। বোবাপ্রায় বোনটার সঙ্গে ফের ট্রেনে। উঠেছে ভিড়ে। রাত সরে যাচ্ছে। ভোর আসছে। বিজু শুয়ে। সাদা পাখিগুলো উড়ে যাচ্ছে। ওদের কাছে এসে আবারও দূরে চলে যায়। কিছু দেরি হলেও যাদের অসুবিধে নেই, ওরাও তো তাই। জল ঠেসে পেট। গন্ধ পাচ্ছে গোবরের। কামিনী হেলিয়ে পড়ে। ধোঁয়া উঠছে ওদিকে কার ঘরে। আকাশ ফরসা হল বলে। ফের ঘন হচ্ছে অন্ধকার। হাঁটছে ওরা। গাঁ, ঘর, রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে, কোথাও ঘটি গড়িয়ে মাঝ উঠানে। কোথাও লাল মুরগি ঝুঁটি নেড়ে উড়তে চেষ্টা করছে। হাঁটছে ওরা। ওদের গ্রাম এটা নয়। কিন্তু ঠিক ওদেরই মতন। 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন