প্রসঙ্গঃ তরুণ
মজুমদার (২)
শ্রীমান পৃথ্বীরাজ (১৯৭৩)
দশ বছর বয়েসে ‘বালিকা বধূ’ দেখা আর ষোল পেরিয়ে ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ দেখার অভিজ্ঞতা যে সম্পূর্ণ পৃথক হ’বে, তা বলা বাহুল্য। ‘বালিকা বধূ’র একটি তাৎপর্যপূর্ণ দৃশ্য এখনো চোখে ভাসেঃ সপরিবারে কোণারক বেড়াতে গিয়ে একটি আদিরসাত্মক মূর্তি দেখে রজনীর চমকে ওঠা! তখন, ১৯৬৭ সালে খুব একটা কিছু বুঝিনি, যদিও দৃশ্যটি অস্বস্তিকর লেগেছিল। ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ অন্য স্তরের ছবি। দামাল ছেলে রসিক বিয়ের পরেও তার দস্যিপনা বজায় রাখে, এমনকি স্ত্রী অমলার সঙ্গে স্ত্রীর সখীর কথামতো ‘গায়ে গা ঠেকিয়ে’ ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ পড়ার সময়েও! আর বহুবিবাহের বিরুদ্ধে কী দারুণ মজার প্রতিবাদ, যেখানে রসিক নিজেই দুই মায়ের সন্তান! রসিক অমলাকে হরণ ক’রে নিয়ে আসবেই শ্বশুরবাড়ি থেকে, তার বাবা তাকে দ্বিতীয়বার ছাঁদনাতলায় দাঁড় করাবার যতই চেষ্টা করুন না কেন! হাজার হোক রসিক তো নিজেই অমলাকে শ্বশুরবাড়িতে ছেড়ে পালিয়ে এসেছে, ‘ম্যাজিস্টর সায়েবের শালার’ নাকে এক ঘুঁষো ঝেড়ে দেবার পর! পৃথ্বীরাজ সংযুক্তাকে ঘোড়ায় চাপিয়ে হরণ করেছিলেন, রসিক অমলাকে তার শ্বশুরের সাধের মোটরগাড়ি চুরি করে তাতেই চাপিয়ে তার বাবার কাছে এনে ফেলে! নইলে যে বাবা এই বিংশ শতাব্দীর পৃথ্বীরাজের দ্বিতীয় বিয়ে দিয়ে দেবেন রসিকের চিরশত্রু ‘আলেকজান্ডারে’র বোন ‘ভূতি’র সঙ্গে – সেই ভূতি যে রসিকের স্বপ্নদৃশ্যে হয়ে ওঠে অমলাকে প্রাণদণ্ডদাত্রী সংযুক্তা!
আমার চিরকালের সবচেয়ে প্রিয় তিনটি বাংলা ছবির মধ্যে প্রথম স্থানে একে অপরকে গোঁতাগুঁতি করছে তরুণবাবুর এই অনবদ্য প্রেমগাথাটি, তাঁরই ‘দাদার কীর্তি’র সঙ্গে! মুখ্য চরিত্রে অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় অবিস্মরণীয়। ‘বালিকা বধূ’তে রজনী/চিনি-রূপিনী মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় বেশী নজর কেড়েছিলেন, অমলরূপী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের তুলনায়। এখানে, সজ্ঞানে কিনা জানি না, তরুণবাবু পাশা উল্টে দিয়েছেন। অমলাবেশিনী মহুয়া রায়চৌধুরী মিষ্টি, কিন্তু ছবির ফাটাফাটি শেষ দৃশ্যের আগে অয়নের পাশে কিছুটা নিস্প্রভ। ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অমলাকে রসিক তার চিঠিতে যা নিবেদন করেছিল, তা ‘বালিকা বধূর’ অমলের রজনীকে ‘প্রিয়তমা’ সম্বোধনের চেয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে! সলজ্জ অমলা শেষ দৃশ্যে স্বামীকে তার সেই দাবী নিজের কথামত মিটিয়ে দেয়! ছবিটি যে আমাকে পাগল করে ছেড়েছিল, তার কারণ অবশ্যই এই দৃশ্যটি! চারবার ভবানীপুরের অধুনালুপ্ত ‘ভারতী’তে দেখেছি, তার মধ্যে একবার আমার ইংরেজী-মাধ্যম স্কুলের দুই সহপাঠীকে বগলদাবা ক’রে (“ওরে দেখবি চল, একটা দারুণ বাংলা ছবি! ইংরেজী তো অনেক হ’লো!”)
অভিনয় নিয়ে কার প্রশংসা করবো? রসিকের বাবার ভূমিকায় সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিকের শ্বশুর পান্নালালের ভূমিকায় উৎপল দত্ত, রসিকের ঠাকুমা নিভাননী দেবী, আর ইতিহাসের মাস্টারমশাইয়ের ছোট্ট ভূমিকায় একমেবমদ্বিতীয়ম সন্তোষ দত্ত, যিনি ক্ষেপে গিয়ে রসিককে বেত মারতে থাকেন এই রাগে যে সে কোন আস্পর্ধায় পৃথ্বীরাজ সেজে আলেকজান্ডারের সঙ্গে টিফিনের সময় যুদ্ধ করছিল! এবং যাঁকে স্বপ্নে পৃথ্বীরাজরূপী রসিক নিজের রাজসভায় ড্রিল-স্যারের সঙ্গে শৃঙ্খলিত বন্দীরূপে দেখে!
শুধু একটি জিনিসই এই ছবিতে নিতে পারি নি – আমার পরিবারের অনেকেই একই কথা বলেছিলেন। তৎকালীন এক সমালোচকের মতে ছবির ‘সবচেয়ে সু-গীত গান’, লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘সখী, ভাবনা কাহারে বলে’! সত্তরের দশকে ঐ গানটির স্বত্ব নিয়ে রেখেছিল যাঁর কণ্ঠ তাঁর কাছে কয়েক মাস পরেই আমি গান শেখবার সুযোগ পাবঃ শ্রীমতী সুমিত্রা সেন!
আমার নিজের এই ছবিতে সবচেয়ে প্রিয় গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায়, ‘ওরে মন, তল্পিতল্পা নিয়ে এবার ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ো’! অবসর গ্রহণের মুহূর্তে এই গানটিই গাইতে চাই!
কুহেলি (১৯৭৩/৭৪)
সবাই ভাবছেন, “এ আবার কী? ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজে’র পর
‘কুহেলি’ কী করে?
সে তো সেই ১৯৭১-এ ‘কুহেলি’ মুক্তি
পেয়েছিল, এবং দেখতে হলে আমার সে ছবি দেখার কথা ছিল ভবানীপুরের ‘পূর্ণ’
প্রেক্ষাগৃহে (এখন বন্ধ পড়ে আছে, ‘ভারতী’র মতো অদৃশ্য হয়ে যাবার অপেক্ষায়!)।” না,
তা হয়নি! এটি একমাত্র তরুণ মজুমদারের ছবি যেটি কলকাতায় দেখিনি! ৭৩-এর ডিসেম্বর বা
৭৪-এর জানুয়ারীতে, দাদা তখন চন্দননগরে এস ডি ও পদে আসীন। প্রথম কাউন্সিলের পরীক্ষা
অক্টোবরেই শেষ হয়ে গেছে, আর আমিও গেছি দাদার কাছে ছুটি কাটাতে। তখন ওখানে ফরাসী
নাট্যকার মলিয়েরের বিভিন্ন নাটকের বাংলা রূপান্তর করা অভিনয় চলছে। একদিন দেখলাম
পাহাড়ী সান্যাল এসেছেন দেখতে!
এরই মধ্যে দেখি শহরের দেওয়ালে পোস্টার পড়েছে ‘কুহেলিঃ এক রুদ্ধশ্বাস রহস্য চিত্র!’ মনে পড়ল যে ছবিতে হেমন্তবাবুর গলায় আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘তুমি রবে নীরবে’, বাড়িতে যার রেকর্ড ছিল দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে। ততদিনে আমি গোঁড়া হেমন্তভক্ত। অতএব দাদার কাছে আর্জি জানালাম। মঞ্জুর হলো, দাদা জীপে চেপে রাতের শোতে নিয়ে গেলেন ‘স্বপ্না’ নামের হলে (এখন আর আছে কি?)। দারুণ জমাটি ছবি, শিরদাঁড়ায় বেশ শিহরণ জাগানো! কিন্তু বহু রহস্যকাহিনী পড়া আমার কাছে খুব তাড়াতাড়ি পরিষ্কার হয়ে গেল অপরাধী কে! তাও বেশ ভয় করছিল, কারণ ধরতে পারছিলাম না সে কী করে আপাত-ভৌতিক ঘটনাগুলি ঘটাচ্ছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে হেমন্ত আশাতীত ভাবে ভালো, দাদাও সে কথা স্বীকার করলেন!
ক’টি প্রশ্নঃ ‘তরুণ মজুমদারের নিবেদন’ কিন্তু পরিচালক হিসেবে ‘অভিমন্যু’র নাম কেন? এতো সেই ‘চিড়িয়াখানা’ ছবির টাইটেল কার্ডে পরিচালকের নাম ‘নায়ক’ রাখার
মতো! ডিটেকটিভ/রহস্য কাহিনীর চিত্রায়নে সরাসরি নিজের নাম দিতে কিছু পরিচালকের কি
সেই সময়ে কোন ছুৎমার্গ কাজ করতো? দুইঃ বিশ্বজিৎ হিন্দী এবং বাংলায় একাধিক এই জাতীয়
রহস্য ছবিতে অভিনয় করেছেন, তবে সন্ধ্যা রায় আর কোন ছবিতে (আপাত বা আসল) ভূত
সেজেছেন কি?
ফুলেশ্বরী (১৯৭৪)
সেই ১৯৬২/৩ সাল থেকে, যখন তরুণবাবু ‘যাত্রিক’ গোষ্ঠীতে ছিলেন, তখন থেকেই তিনি
তাঁর ছবিতে তাঁর নিজের সঙ্গে আরেকজনকে নিয়ে এক মণিকাঞ্চন যোগ ঘটান, যা বিরাজ করেছে
সেই ১৯৮৮ অবধি, ব্যতিক্রম একমাত্র হিন্দী ‘বালিকা বধূ’ (১৯৭৬)। তরুণবাবু যদি হন
সেই মণি, তাহলে কাঞ্চন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ১৯৭২ সালে ভারতের স্বাধীনতার রজত
জয়ন্তী মিশে যায় ঋষি অরবিন্দের জন্মশতবার্ষিকীর সঙ্গে। তখনই শেক্সপিয়র সরণীর
শ্রীঅরবিন্দ ভবনে একদিন চাক্ষুষ করি হেমন্তকে, গেয়েছিলেন ৮টি রবীন্দ্রসঙ্গীত ও
দুটি সময়োপযোগী অন্য গান। দেখে ভক্ত হয়েছিলাম, ১৯৮৯তে তিনি চলে যাবার পর এখন আমি
পূজারী।
এত কথা বললাম এই জন্যে যে তরুণ মজুমদারের ছবির অন্যতম আকর্ষণ আমার কাছে, সেই
‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ থেকেই হেমন্তবাবুর গান। অতএব ‘বিজলী’তে ‘ফুলেশ্বরী’। ছবিটি এবং তার গান অসাধারণ জনপ্রিয় হয়, বিশেষ করে, ‘যেও না
দাঁড়াও বন্ধু’। হেমন্ত নিজে ‘ফুলেশ্বরী, ফুলেশ্বরী’ গাইতে ভালবাসতেন বলেছেন, আর
আমার সবচেয়ে ভাল লাগে ‘আমি দেখতে ভালোবাসি’। কিন্তু ছবির শেষটা, ঐ হঠাৎ করে ‘সব
সমস্যা একে একে হলো সমাধান’ দেখে খুব বিরূপতা জেগেছিলঃ মনে হয়েছিল, এত করে crisisএর বেলুন ফোলালেন, তারপর ফুস করে এইরকম গোঁজামিল? দূর,
মানতে পারলাম না! কিন্তু ৬ বছর পরে তো প্রায় একই উপায়ে ‘দাদার কীর্তি’তে মধুরেণ
সমাপয়েৎ ঘটাবেন তরুণবাবু, তখন? সে কথা না হয় যখন ‘দাদার কীর্তি’ নিয়ে বলব, তখনকার জন্যেই তোলা থাক!
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন