রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১

অঞ্জন সেনগুপ্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প


পেনটা gone

 

আমি যে মফঃস্বল শহরে থাকি সেখানে অনেক কিছুই আছে। আবার অনেক কিছুই নেই! যেমন সেখানে মুক্ত বাতাস, ভাল বাংলা মাধ্যমের স্কুল, যান বাহনের পর্যাপ্ত চলাচল, কলকাতায় আসার জন্য অনেক ট্রেন ইত্যাদি সব রয়েছে। আবার নেই-এর তালিকায় মস্ত বড় তিনটি জিনিস নেই! আর তা হল, ভাল চিকিৎসা ব্যবস্থা, উন্নত মানের পড়াশোনার জন্য ভাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা! এসব  ব্যাপারে আমাদের সবাইকেই কলকাতার মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হয়সম্পাদকদের সামান্য করুণা পাওয়ার জন্য মফঃস্বলের কবি-সাহিত্যিকরা মনে মনে যে উৎকর্ণ হয়ে থাকেন তা কেউ মানতে না চাইলেও আমি মানি। আর এই নিয়েই আমার সাথে আমার পরম বন্ধু সুচারুর প্রায়শই কথা কাটাকাটি হয়। সুচারু আমার যুক্তি মানতে চায় না। অথচ আমি জানি ও একবজ্ঞার মতো কথা বলে যায়

বেশ কয়েকদিন পরে আজ বিজনের দোকানের কাছে হঠাৎ সুচারুর সাথে দেখা ও রাস্তার ওপার থেকে হাঁক ছেড়ে আমার কাছে এসে সাইকেলের হ্যান্ডেলটা ধরে প্রায় ফিসফিস করে বলল,জানিস অঞ্জন, পেন্টাগন-পেন্টাগন”।

ও যে মাঝে মাঝে দুর্বোধ্য সব কথা বলে তা আমি জানি। তবু আমিই ওকে যতটুকু বোঝার বুঝি। বাকিরা ওকে বলে পাগলা সুচারু। আসলে ওর কথার মধ্যে দুর্বোধ্যতা যতটুকু থাকে তার থেকে বেশি থাকে ওর কবিতার মধ্যে! কঠিন কঠিন সব কবিতা লেখে। কলকাতার কয়েকটি পত্র-পত্রিকায় যে ওর কবিতা ছাপা হয়নি তা নয়। তবে সব সম্পাদক সুচারুর গোল গোল কবিতা পছন্দ করেন না। অবশ্য এটা সুচারুও জানে ।

“চা খাবি?” আমি আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করি।

“খাব, তবে মাটির খুঁড়িতে”।

ভাল। তবে সে তো যেতে হবে ঐ বটগাছের নীচের দোকানটায়। নিবারণ অবশ্য চাটা আদা দিয়ে বেশ ভালই বানায়। তাই আমারও মন্দ লাগে না। ঠিক আছে তাই  সই। অগত্যা হন্টন। সুচারুর সাথে রাস্তায় হাঁটা মানেই হাজার লোকের বাঁকা চাউনি! আমি জানি শেষে অনেকেই আমাকে বলবে, শেষে তুমিও ঐ পাগলা কবির সাথে ঘুরছিলে!”

সুচারু সেন। দুর্দান্ত খ্যাপাটে কবি। যত সব কঠিন কঠিন শব্দ ওর কলমের ডগায় লেগে থাকে। কোথা থেকে যে অমন কঠিন শব্দ শিখেছে তা ওই জানে। অথচ স্কুলের গন্ডি ছাড়িয়ে আর পড়াশোনাটাও হয়নি! সাথে অভিধান নিয়ে না বসলে ওর  কবিতার বাক্যবন্ধে বারবার হোচট খেতে হয়। আমি মনে মনে ভাবি ধুর ছাই, ওভাবে কী আর কবিতার রস উপলদ্ধি করা যায় নাকি! পড়েও তো একেবারে মজা নেই। অবশ্য এমন কথা বললে সুচারু হেসে বলে,আসলে ব্যাপারটা কি জানিস অঞ্জন, আমরা অনেকেই সর্বসাকুল্যে মাত্র একশো-দু’শো শব্দের সঠিক অর্থ জানি। আর ঐ শব্দগুলো নিয়েই সারাটা জীবল চটকা-চটকি করে তৃপ্তি পাই। অনেকের লেখা কবিতা গোটা দশেক পাশাপাশি রাখলে দেখবি একই শব্দের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বহুবার! আর এই যে একই শব্দের জাবর কাটা সে জন্য কি নিজেকে অবলা জীব বলে মনে হয় না?”

আমি মাথা নেড়ে বলি,না, মনে হয় না। আর কেন হয় না জানিস চারু, আসলে আমাদের লেখার পাঠক অনেকেই। কারণ তারা সবাই সহজ লেখাই পছন্দ করে। জটিল কবিতা বা গদ্য পড়ে পাঠক কেন অহেতুক মনের উপর চাপ সৃষ্টি করবে বলতে পারিস! তাই তোর কবিতা পড়ে শহরের বা রাজ্যের মুষ্টিময় কয়েকজন। তারাই আহা-আহা করে! আর বাকিদের তা মাথার উপর দিয়ে চলে যায়।”

সুচারু আবার হেসে বলে,ব্যাখ্যাটা একেবারে মন্দ দিসনি। আসলে যারা আমার কবিতা ভাল বলে তাদের মাথায় রয়েছে অভিধানের সমস্ত শব্দাবলীর কুড়ি শতাংশ। তাই তারা কিছুটা বোঝে এবং প্রশংসা করে”।

আমি সামান্য ঝাঁঝের সাথেই বলি, “তার মানে তুই বলতে চাইছিস যে তোর  কবিতা পড়ে বুঝতে হলে আগে পাঠককে অভিধানটা ভাল করে পড়ে নিতে হবে! এমনটা হলে ভাই আমি অমন পাঠক হতে অপারগ। তাছাড়া পাঠক তো মনের আনন্দে সাহিত্য পড়ে কিন্তু পদে পদে হোচট খেলে সে পড়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে তাহলে কবি একদিন তার পাঠক হারাবে”।

“না, তা কেন! তবে তুমি মাত্র দু’শো শব্দ নিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পার না! তাছাড়া কবিতার শব্দ যদি তার আভিধানিক অর্থের বাইরে না যায়, তাহলে অমন ট্যাঁস কবিতা লিখে সময় নষ্ট না করাই উচিত। দেখবি একদিন আমার কবিতা সমাদৃত হবে। পাঠকেরা হাপিত্যেশ করবে আমার কবিতার জন্য, এটা তোকে আমি বলে রাখলাম”।

কথা বাড়ালে কথা ইলাস্টিকের মতো দীর্ঘতর হয়ে যায়। তবে আমি জানি সুচারুর নিজের কবিতার উপর ভীষণ আস্থা রয়েছে। পাহাড় সমান গর্ব! তবে এসব প্রায় বছর খানেক আগের কথা। ইদানীং শহরের কোন পত্র-পত্রিকায় ওর লেখা কবিতা চোখে পড়ে না! হঠাৎ করে দেখা হয়ে গেলে বা ওর বাড়ি গেলে সুচারু নিজের কবিতার ব্যাপারে আর কিছুই বলে না। ও লিখছে কিনা জানতে চাইলে বরং এড়িয়ে যায়। দিন-রাত নাকি শুধু বই পড়ে আর বিড়বিড় করে কী সব বলে!

একদিন ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছি। হাতে সময় থাকায় ইচ্ছে করেই সুচারুর খবর জানতে ওদের বাড়িতে ঢুকে পড়লাম। দেখি শীতের নরম রোদে হেলান দিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে থাকা বইয়ের মধ্যে ও মাথা গুঁজে এক মনে পড়ে চলেছে। আমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই ও মাথা তুলে প্রথমে কিছুক্ষণ ভ্যাবলার মতো হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। তারপর চকিতে বলল,ও,তুই এসেছিস। ভালই হল। গতকাল থেকে একটা সাল কিছুতেই মনে করতে পারছি না রে! অথচ ওটা জানা আমার খুবই জরুরি”।

আমি বিস্মিত হয়ে ওর পাশে বসে বলি,দেখ ভাই, চিরকালই এসব ব্যাপারে আমার স্মৃতিশক্তি ভীষণ দুর্বল। তুই তো জানিস যে আমি ইতিহাসে কত কম নম্বর পেতাম। তা বল দেখি কি জানতে চাইছিস! জানা থাকলে বলব”।

সুচারু ওর পুরনো অভ্যেস মতো বার কয়েক নিজের মাথায় আঙুলের টোকা মেরে  বলল,আচ্ছা তোর কি মনে আছে আমি কবে মুম্বাইতে গিয়ে বিদ্যাধর নাইপালের  সাথে ডিনার করেছিলাম? কয়েকদিন ধরে ভাবছি অথচ কিছুতেই স্মৃতির কপাট খুলতে পারছি না। আবার কী আশ্চর্য দেখ বাড়ির কেউ বলতেও পারছে না!”

আমি চমকে উঠলাম! সুচারু বলে কী! তাহলে কি সুচারুর সেই পুরনো অসুখটা আবার মাথা চাড়া দিয়েছে নাকি! তাহলে তো সাংঘাতিক। কম বয়সে ও একবার সাইকেল নিয়ে জমির আল দিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই সে ঐ আল থেকে পড়ে যায়। বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকার পরে ও যখন বাড়ি ফিরল তখন সে একেবারে অন্য মানুষ! কাউকেই চিনতে পারছে না। এমনকি বাবা-মা-ভাইকেও না! সকালে দাঁত মেজে থুতুটা গিলে নিচ্ছে! আর ব্রাশটা জানলা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে! কোন সবজির নাম মনে নেই কোন মাছের নাম বলতে পারছে না। ডাক্তারবাবু নাকি বলেছিলেন যে, কোন ভাবেই যেন ওর ব্রেনে কোন চাপ না পড়ে। ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে যাবে। বাড়ির লোকেরা যেন ওকে ভুল কিছু না শেখায়। তাহলে সেই অসুখটা কি আবার নতুন করে দেখা দিল নাকি! কিন্তু ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বললাম,সালটা ছিল ১৯৫৮। কিন্তু তুই ওটা কি বই পড়ছিস!”

সুচারু হাসতে হাসতে বলে,এটা কি বই জানিস, এটা হল বিশ্বকোষ। এখানে নাইপালের নামটা খুঁজছিলাম। অথচ কিছুতেই পাচ্ছি না। কেন নেই বল তো!”

“হয়তো ভুল হয়ে গেছে। তবে পরের সংস্করণে অবশ্যই থাকবে। সে না হয় হল। কিন্তু তোর কোন কবিতাই তো ইদানীং কোন পত্রিকায় দেখতে পাচ্ছি না! ব্যাপারটা কী বল তো!”

আমার কথা শেষ হতে না হতেই সুচারু তিড়িং করে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, উঃ! কী সাংঘাতিক! কী সাংঘাতিক! পেন্টাগন–পেন্টাগন”।

সেদিন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে চলে এলেও মাঝে মাঝেই সুচারুর জন্য মনটা বড় বিষণ্ন হয়ে যেত। দিন দিন ও কেমন যেন অসংলগ্ন হয়ে পড়ছে! একটা কথা বলতে বলতে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছে! অথচ ওর কবিতার হাতটা বড়ই সাবলীল ছিল। ওকে তাই আমার বড় হিংসে হত।

ইদানীং আমরা সবাই লক্ষ্য করছি যে সুচারু একটা অদ্ভুত খেলায় মেতেছে। রাস্তায় হঠাৎ কেউ পড়ে গেল বা রাস্তা পার হতে পারছে না, কোথা থেকে যেন ভোজবাজির মতো সুচারু এসে তাকে মাটি থেকে টেনে তুলছে! এমনকি ওষুধের দোকানেও নিয়ে যাচ্ছে! বড় যত্নে হাত ধরে কাউকে রাস্তাও পার করে দিচ্ছে! এমনকি ইদানীং সুচারুকে শ্রমজীবী ক্যান্টিনেও সেই কাকভোর থেকেই দেখা যাচ্ছে। কী অক্লান্ত  পরিশ্রমটাই না করছে। অথচ নিজে খাবারের একটা দানাও খাচ্ছে না। যারা ওখানে কাজ করে সেই নিঃস্বার্থ যুবকেরা সাধারণত যা জোটে তাই খেয়ে নেয়। কিন্তু কেউ আজো সুচারুকে এককাপ চা ছাড়া আর কিছুই খাওয়াতে পারেনি। ওর যুক্তি হল, “আমি খাওয়া মানেই একজন গরিবের ভাগের খাবার খেয়ে নেওয়া। আমি তো বাড়ি গিয়েও খেতে পারব। সেখানে আমার খাবার ঠিক ঢাকা থাকবে। অথচ ওদের বাড়ি আছে কিন্তু সেখানে কেউ ওদের জন্য খাবার নিয়ে বসে নেই! এটাই ট্রাজেডি!” তাই ওকে কেউ চা ছাড়া কিছুই খাওয়াতে পারেনি !

এমন খ্যাপাটে কবি ও সমাজসেবক একদিন হঠাৎ করেই শহর থেকে উবে গেল! ওর টিকি তো দূরের কথা ওর ছায়া পর্যন্ত কেউ দেখতে পাচ্ছে না। এমন কি ওর পাশের বাড়ির লোকও জানে না সুচারু কোথায়! তাই ইদানীং পথ দুর্ঘটনা হলেও কেউ এগিয়ে আসে না! বরং এড়িয়ে যায়! কেউ রাস্তা পার না হতে পেরে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকছে! কেউ ধুমকেতুর মতো এসে বলছে না, আপনাদের  সুচারু হাজির!

প্রায় মাস খানেক অফিসের কাজে বাইরে ছিলাম। তাই অনেকের হাল হকিকৎ আমার অজানা। কিন্তু দোর গোড়ায় পা দিতেই সেই মর্মান্তিক ঘটনাটা শুনলাম। নিজেকে সামলে নিতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। ছুটলাম হাসপাতালে। কিন্তু অত দূরে আর যেতে হল না। সুচারুকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। কে জানত এতদিন নিজের সাথে অমানুষিক লড়াই করতে করতে আজই সুচারু সেই লড়াইয়ের ইতি টেনে দেবে! আমার জন্য কি আর একটা দিন অপেক্ষা করতে পারল না! শুনলাম ও অসুখের মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলত,আমার পেন্টাগন-পেন্টাগন’। এর অর্থ কেউ বুঝতে পারত না! নার্সরা এসে ওকে চেপে ধরতেই ধীরে ধীরে ওর চরম আকুতিটা থিতিয়ে যেত। মুহূর্তের মধ্যে আমি চমকে উঠলাম! নিজের উপলদ্ধি বোধটা যে এত দুর্বল হয়ে গেছে সে জন্য নিজের উপর ভীষণ রাগ হল। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম ওকে লেখার কথা বললে কেন সুচারু এই কথাটাই বারবার বলত। অথচ আমি তা বুঝতে পারতাম না!

ফুল-চন্দনে সেজে বাড়ির অপ্রশস্ত আঙিনায় সুচারু এখন শুয়ে আছে। রোদ সরে গিয়ে এখন শুধু ছায়া পড়েছে ওর নরম শরীরে। সারা মুখে এক অনির্বচনীয় দুঃখ, যা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। আমি মন্থর পায়ে ভিড় সরিয়ে সুচারুর দিকে এগিয়ে যাই। ওর দু’চোখ বন্ধ হলেও আমি দেখলাম ও একবার তা সামান্য ফাঁক করে আমাকে দেখে মুচকি হাসল। ঠোঁট দুটোয় বেশ গর্বের হাসি লেগে রয়েছে! যেন ও আমাকে বড় ফিসফিস করে বলল, কিরে অঞ্জন, ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত তুই বুঝতে পারলি”। আমার মনে হল এতক্ষণ পরে ও যেন শান্তি পেল।

আমি তাড়াতাড়ি আমার বুক পকেট থেকে দামি পার্কার পেনটা ওর শীতল হাতে গুঁজে দিয়ে মনে মনে বললাম,ভাই চারু, এতদিন তোর কথার ভাবার্থটা বুঝতে পারিনি। কেন তুই কবিতা লিখতে পারতিস না তা আজ বুঝলাম। এখন তোর হাতে অনেক সময়। আমার পেনটা দিয়ে দিস্তা দিস্তা কবিতা লিখিস ভাই। তোকে যে কবিতা লিখতেই হবে! আর দেখিস এবার তোর কবিতার কদর হবেই”।

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন